'আরেক রকম' পত্রিকার অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যায় (১৬-৩১ অক্টোবর ২০২০) ঋক চট্টোপাধ্যায় লিখিত প্রবন্ধটিতে এই অংশটি ছাপা হয়েছেঃ

"পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। সেই কারণে এই ইভেন্ট-হরাইজন থেকেও এক ধরণের বিকিরণ পাওয়া সম্ভব। একে হকিং বিকিরণ বলে। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতির্বিদরা আমাদের ছায়াপথের বাইরে যে উজ্জ্বল বিকিরণগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেগুলির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওই বিকিরণগুলি তৈরি হয়েছে অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের থেকে। কিন্তু এই তত্ত্ব কি ঠিক? সত্যিই কি কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ করে? তাঁর উত্তরও মিলল ২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল। প্রকাশিত হল প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ছবি (চিত্র-৪)।"

অংশটি তাত্ত্বিকভাবে এবং তথ্যগতভাবেও ভুল । কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ করে, এটা  স্টিফেন হকিং-এর দ্বারা প্রস্তাবিত হলেও এর সত্যতা এখনো প্রমাণিত নয়। এই প্রস্তাবিত বিকিরণকেই হকিং বিকিরণ বলে। প্রত্যাশিত ভরের কৃষ্ণগহ্বরের বেলায় এই বিকিরণের পরিমাণ এত কম হবার কথা  যে এটিকে ডিটেক্ট করার কোন পন্থা এখনো বার করা যায়নি। তাই ছায়াপথের বাইরের যে বিকিরণের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন তা হকিং বিকিরণ নয় আর তার উৎস সরাসরি কৃষ্ণগহ্বরও নয়। কৃষ্ণগহ্বরের বিপুল মহাকর্ষের টানে তার দিকে পড়তে থাকা ভরপুঞ্জের মধ্যে থাকা তড়িৎ-আধানের ত্বরণ এই বিকিরণের উৎস। প্রবন্ধটিতে কৃষ্ণগহ্বরের যে ফটোগ্রাফটি মুদ্রিত আছে সেটি এই পড়তে থাকা তড়িৎআধানপুঞ্জ থেকে উৎসারিত বিকিরণকে ব্যবহার করেই পাওয়া। হকিং বিকিরণের  পেপারটিতে পেনরোজ কিন্তু সহলেখক ছিলেন না। পেনরোজ  ঘূর্ণনশীল কৃষ্ণগহ্বরের ক্লাসিক্যাল বিকিরণ নিয়ে কাজ করেছিলেন।  অন্যদিকে হকিং বিকিরণ বক্র দেশকালে  কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের  ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তাবিত।

আর একটা কথা। বিজ্ঞানের অনেক কিছুই বাকি অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। পেনরোজের যে কাজটিকে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছে নোবেল প্রাইজের জন্য, সেই পেপারটির রেফারেন্সে পেনরোজ কিন্তু অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীকে উল্লেখ করেননি।

তথ্যসূত্রঃ

1) Einstein Gravity in a nutshell by A. Zee, Princeton University Press, 2013, p. 409-424, 436-450.
2) https://www.nature.com/articles/d41586-019-01155-0
3) Press Release by Royal Swedish Academi of Sciences on 06.10.2020.
4) Roger Penrose, Physical Review Letters, no.3, vol.14, p.57

অধ্যাপক তাপস মিত্র,
গুরুদাস কলেজ,
কলকাতা।



লেখকের উত্তর

প্রফেসর মিত্রকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার এবং তার ত্রুটির প্রতি দিকনির্দেশ করার জন্য। লেখার যে তত্ত্ব ও তথ্যগত ত্রুটির কথা উনি বলেছেন সেটি আদতে আমার বাক্য-বিন্যাসের ত্রুটি থেকে উদ্ভূত।

প্রথমেই বলি, উনি লেখার বিজ্ঞান সম্পর্কিত যে অংশটির কথা বলেছেন, মূল রচনায় সেটি এইরূপ,

“নক্ষত্র পরিণত হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরে। আর ওই কৃষ্ণগহ্বরকে ঘিরে তৈরী হয় একটি ঘটনা-দিগন্ত বা ইভেন্ট-হরাইজন। পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। সেই কারণে এই ইভেন্ট-হরাইজন থেকেও এক ধরনের বিকিরণ পাওয়া সম্ভব। একে হকিং বিকিরণ বলে। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতির্বিদরা আমাদের ছায়াপথের বাইরে যে উজ্জ্বল বিকিরণগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেগুলির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওই বিকিরণগুলি তৈরি হয়েছে অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের থেকে।”

এখানে ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায় কারণ অনুচ্ছেদের ব্যবহার আমি করিনি। আদতে এটি হত দুটি আলাদা তথ্য -

১. নক্ষত্র পরিণত হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরে। আর ওই কৃষ্ণগহ্বরকে ঘিরে তৈরি হয় একটি ঘটনা-দিগন্ত বা ইভেন্ট-হরাইজন। পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতির্বিদরা আমাদের ছায়াপথের বাইরে যে উজ্জ্বল বিকিরণগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেগুলির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওই বিকিরণগুলি তৈরি হয়েছে অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের থেকে।

এবং
২. পরবর্তী সময়ে পেনরোজ, স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে যৌথভাবে দেখান এই ইভেন্ট-হরাইজনের কাছে স্থান-কালের আচরণ খুব অদ্ভুত। সেই কারণে এই ইভেন্ট-হরাইজন থেকেও এক ধরনের বিকিরণ পাওয়া সম্ভব। একে হকিং বিকিরণ বলে।

হকিং বিকিরণ একান্তই হকিং এর নিজস্ব আবিস্কার। কিন্তু তার ভিত্তি অবশ্যই হকিং-পেনরোজের ‘সিঙ্গুলারিটি থিওরেম’। ১৯৭৫ সালে হকিং-এর ‘Particle creation in black hole’ নামক গবেষণাপত্রটি দ্রষ্টব্য। আমি এই যোগসূত্রটির কথাই লিখেছি।

এছাড়াও প্রফেসর মিত্র চিত্র-৪-এর যে কারণ উল্লেখ করেছেন তা সঠিক। আমার লেখায় বাক্য বিন্যাসের ত্রুটির কারণে যেন মনে হচ্ছে যে চিত্র-৪ হকিং বিকিরণের ছবি। তা একেবারেই নয়। আমার এই ত্রুটির জন্য আমি দুঃখিত এবং ভবিষ্যতে আরও যত্নবান হব যাতে এমন কোনো ভুল ধারণা আমার লেখা থেকে উৎপত্তি না হয়।

তবে একটি ক্ষেত্রে প্রফেসর মিত্র সম্ভবত আমার লেখাটি ঠিক করে পড়েননি। আমি কোথাও লিখিনি যে পেনরোজের নোবেল প্রাপ্তির কাজে সরাসরি অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর কাজের রেফারেন্স আছে। আমি পরিষ্কার লিখেছি, পেনরোজের তত্ত্বের ভিত্তির অন্যতম স্তম্ভ অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর সমীকরণ। আর একথা খোদ পেনরোজ সাহেবই যখন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন একাধিকবার, তখন “বিজ্ঞানে অনেক কিছুরই অনেক কিছুর সাথে সম্পর্ক থাকে” বলে এড়িয়ে যাওয়া স্রেফ নিজেদের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার মতই লাগে। আমি অন্তত মনে করি না নিজেদের বিজ্ঞান গবেষণার ঐতিহ্যকে স্রেফ একটা সাধারণ ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়া বিবেচক কাজ। আমাদের আগের প্রজন্মের কাজের ইতিহাসই আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে উৎসাহিত করে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আর সেখানে যদি আমরা অন্য দেশের বিজ্ঞানীদের কথা বলি, তাহলে নিজের দেশের বৈজ্ঞানিকদের তাচ্ছিল্য করার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। আর আজকের সময়ে একথা আরও বেশী করে বলা উচিৎ, কারণ গনেশের মাথা অঙ্গপ্রতিস্থাপনের প্রথম ঘটনা, একথা আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস হতে পারে না।

পরিশেষে একথা আবার স্বীকার করতেই হয় যে আমার বাক্য-বিন্যাসের ত্রুটির কারণেই এই ভ্রান্তির উৎপত্তি। এর দায় একান্তই আমার। ভবিষ্যতে এই ধরনের ত্রুটি থেকে লেখাকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করব। আর আবারও প্রফেসর মিত্রকে ধন্যবাদ লেখাটি পড়ে ওঁনার মূল্যবান মতামত দেওয়ার জন্য।

ঋক চট্টোপাধ্যায়,
আইআইইএসটি,
শিবপুর, হাওড়া।




"আরেক রকম" পত্রিকার নবম বর্ষ, অষ্টম-নবম সংখ্যায় প্রকাশিত মালিনী ভট্টাচার্যের "ভাষার জন্য" সন্দর্ভের পরিপ্রেক্ষিতে আমার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আমি ১৯৪৯-১৯৫৫ পর্যন্ত তৎকালীন সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলাম এবং ঐ বিদ্যালয় হতেই ১৯৫৫ সালে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হই। সে সময় ঐ বিদ্যালয় এবং পশ্চিমবঙ্গের আরও কিছু বিদ্যালয় সরকারি বিদ্যালয় হিসাবেই পরিগণিত হত (তখন Govt. Sponsored School-এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না বলে মনে হয়)। আমার বয়স এখন আশির কাছাকাছি।

আমাদের বিদ্যালয়ের Progress Report অর্থাৎ Result Sheet ছিল লম্বায় এক ফুটের বেশি এবং চওড়ায় প্রায় দশ ইঞ্চি। এটা মনে হয় তৎকালীন সব সরকারি স্কুলের Progress Report-এর Format কারণ এটার সামনের পাতায় কোন বিদ্যালয়ের নাম ছাপা থাকতো না।

পরিবর্তে উপরের দিকে একটি সরলরেখার প্রান্তে School কথাটি ছাপা থাকতো এবং ফাঁকা সরলরেখার উপর নির্দিষ্ট বিদ্যালয়ের Rubber Stamp মারা হতো। Progress Report-এর সামনের পাতায় ছাপা থাকতো First Indian Language অর্থাৎ English Paper I and II।

এরপর ছাপা থাকতো Second Indian Language অর্থাৎ আমাদের ক্ষেত্রে Sanskrit Paper I and II। তারপর থাকতো ছাপা অক্ষরে Major Vernacular অর্থাৎ আমাদের জন্য Bengali Paper I and II।

এখানে বলে রাখা দরকার যে English, Sanskrit আর Bengali সব হাতে লেখা হতো।

ক্রমশ ছাপা অক্ষরে চলে আসত Mathematics, History, Geography, Science, Hygiene ইত্যাদি।

এই বিষয়গুলির পাশে চার পাঁচটি উল্লম্ব রেখা থাকতো যা ছিল Half-Yearly আর Annual পরীক্ষার ফুল মার্কস, পাস মার্কস এবং প্রাপ্ত নম্বরের দ্যোতক। পিছনের পাতায় লেখা থাকতো Conduct, No Attendance ইত্যাদি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ ভারতের রেওয়াজ উত্তর-স্বাধীনতা কালেও চালু ছিল কিন্তু আমরা ইংরাজী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই শিক্ষা পেতাম। এই চিঠিতে অন্য কিছুর সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে বলা শোভন নয় কারণ পরিপ্রেক্ষিত আলাদা।

অলোককুমার সেনগুপ্ত
সল্টলেক (বিধাননগর)
কলকাতা-৭০০০৬৪

তারিখঃ ১৬ মে, ২০২১



শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার তার নিবন্ধে (‘বাংলার বামপন্থা - স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ’ ১৬-৩১ মে, ২০২১) সদ্য অনুষ্ঠিত রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থী শক্তির মূলত সিপিআই(এম)-এর শোচনীয় পরাজয় নিয়ে তাঁর মতো করে একটি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। কিন্তু আলোচনাটি বিস্তৃত হলেও আদপে খণ্ডিত। তাঁর ভাবনার সঙ্গে এইটুকু সহমত হতে আপত্তি নেই রাজ্যে সিপিআই(এম) যে মূল বামশক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল তার পেছনে ছিল রাজ্যের উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী ও গ্রামীণ কৃষকদের সঙ্গে তাদের নিবিড় সংযোগ। ওই অংশের মানুষরা ওই দলটিকে তাদের নিজেদের দল বলে আইডেন্টিফাই করতে পারতেন। এটা কঠিন সত্য যে একটা সময়ের পর, এই অংশের মানুষের থেকে দল ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি যে এই বাস্তবতা দল প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি কোনোদিন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৮ অবধি রাজ্যের কংগ্রেস দল সাংগঠনিক স্তরে বা ভোটের লড়াইয়ে কখনো সেইভাবে বিরোধী দলের জোরালো জায়গা নিতে পারেনি, কারণ তাদের অতীত ছিল কলঙ্কিত। এই বিরোধীহীনতা বা বলা যেতে পারে বিরোধীদের অন্যভাবে ম্যানেজ করে হাতে রাখার কৌশল সারা রাজ্যে দলের কর্মীদের মধ্যে একটা অসীম ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয়। রাখলে আমরা রাখব আর মারলে আমরাই মারব, এই মানসিকতা ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। একটা সময় যখন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের মনোনয়ন দিতে বাধা দেওয়া হল তখন তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক বলেছিলেন, আমরা কি বিরোধীদের প্রার্থীও দিয়ে দেব! কথাটার মধ্যে আপাতবিদ্রূপ থাকলেও মূল বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার ভঙ্গিটাও অস্বীকার করা যায় না।

১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে জোরালো একটা বিরোধিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। দল কিন্তু তাদের কর্মসূচি দিয়ে বা মানুষের সঙ্গে যোগ নিবিড়তর করে এই বিরোধিতাকে সামাল দিতে পারেনি। ১৯৯৮- উত্তর পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ তাতে তো বিরোধী দলের সঙ্গে গ্রামের অনেক গরিব মানুষও ছিলেন - সবটাই বিরোধী দলের সাজানো চক্রান্ত বলে লঘু করে দেওয়া যায় কি? এই গরিব গ্রামীণ মানুষরা কেন বাম দল ছেড়ে বিরোধীদের দলে নাম লেখাচ্ছেন তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আজ অবধি হয়েছে কি না জানা নেই। জানা নেই, কোন ভিত্তিভূমি থেকে বিরোধীরা তাঁদের দলে লোক টানতে সক্ষম হচ্ছেন, এই বিচারটাও হয়েছিল কি না। এই বিরোধীদের উত্থানকে মূলত মোকাবিলা করা হয়েছিল পেশীশক্তি দিয়ে, রাজনৈতিকভাবে নয়, বাম রাজনীতির মৌলিক মতাদর্শের বিস্তার ঘটিয়ে তো নয়ই । একইভাবে বিচার করে দেখা হয়নি, একচেটিয়া দলতন্ত্রের প্রকোপে (পার্টি সোসাইটি) কীভাবে এলাকায় এলাকায় জন্ম নিচ্ছে একেকজন ‘ভোট ম্যানেজার’, যাদের অশোক মিত্র বলতেন আঞ্চলিক জায়গিরদার। এইসব জায়গিরদারদের না ছিল কোনো রাজনৈতিক শিক্ষা, না ছিল কোনো নিয়ন্ত্রণ, তাদের কাজ ছিল বিভিন্ন নির্বাচনে দলকে ভোটের বৈতরণী পার করে দেওয়া, আর্থিক সাপোর্ট দেওয়া । দল তাদের সার্ভিস নিত বলে তাদের অনেক কুকর্ম দল বাধ্যত মুখ বুজে মেনে নিত। এর সবটাই বুর্জোয়া সংবাদপত্রের অপপ্রচার বললে আবারও মনকে চোখ ঠারা হয়। রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে গ্রামের মানুষও এগুলো নিজের মতো করে খেয়াল রাখছিলেন বইকি। তাই গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে কেন একটা তথাকথিত ‘আদর্শহীন’ দলের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন সেটার কোনো যোগ্য ময়নাতদন্ত আদৌ হয়েছে কি?

বামফ্রন্টের পেরেকে শেষ কফিন পোতা হয় ২০০৬-এর নির্বাচন জয়ের পর। যখন নির্বিচারে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের হুজুগে গ্রামীণ মানুষের বিরুদ্ধে একচেটিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি দলের কৃষকসভাকেও অন্ধকারে রেখে শিল্পের গোপন শর্ত সীমিত থাকে দুএকজন কর্তা ব্যক্তির হাতে, যারা ইতিমধ্যেই নিজেদের দলের থেকে বড় ভাবতে আরম্ভ করেছেন। এই পর্বের কথা বহু আলোচিত। কিন্তু নিবন্ধকার এই পর্যায়ে দলের ভুল কী ছিল বা ছিল না তা নিয়ে নীরব থেকেছেন। সম্প্রতি ডঃ প্রিয়াঙ্কা মাথুর (অধ্যাপক, জৈন বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গালুরু ও প্রাক্তনী জেএনইউ) একটা সেমিনারে বলছিলেন, তাঁর গবেষণার কাজে নন্দিগ্রামে যাওয়া ও সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা। গ্রামের মানুষরা বলছেন, আমরা তো চিরদিন এদেরই ভোট দিয়েছি, আজ তাঁরা আমাদের সঙ্গে একবার কথা না বলেই জমি নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দিলেন! আজকের বামশূন্য বিধানসভার পেছনে এই গভীর জিজ্ঞাসার মূল্য আমরা খুঁজব না?

কিন্তু বাস্তব হল এইসব ঘটনার আজও কোনো মূল্যায়ন হয়নি। যদি হত, তাহলে এইবারের বিধানসভার নির্বাচনেও বাম দলের নেতা সিঙ্গুরে গিয়ে বলে আসতেন না সিঙ্গুরের মাটিতেই তাঁরা প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠক করবেন, ওই একই জায়গায় শিল্পায়নের জন্য নতুন করে ভিত্তিফলকে সিমেন্ট লাগাতেন না। নন্দিগ্রামের প্রার্থীর প্রচারে গিয়ে প্রাক্তন বাম সাংসদ গলাবাজি করতেন না, এইখানে আবার তাঁরা শিল্প স্থাপন করবেন বলে। আর নন্দিগ্রামে ভোটের আগের দিন মুখ্যমন্ত্রীর একটা কৌশলী মন্তব্যকে পুঁজি করে গোটা দল হই হই করে যেভাবে নিজেদের নিষ্পাপ প্রমাণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে আবারও প্রকাশ্য হয়ে গেল ওই বিষয়ে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তাঁরা আদৌ অনুতপ্ত নন, বরং সবটাকেই ‘পরিকল্পিত চক্রান্ত’ বলে হাত ধুয়ে ফেলে আজও তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে চান। তাহলে তাঁরা কী শিক্ষা নিলেন? কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বা আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট সঠিক কি বেঠিক সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এবারের নির্বাচনে যেভাবে দল কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের প্রশ্নে কর্পোরেট-মডেল সামনে নিয়ে এসেছে তা আবার মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে পনেরো বছর আগের দুঃস্বপ্নে, এটা স্বীকার না করা মুর্খামি। কয়েকমাস আগে অর্থনীতিবিদ ডঃ অমিত ভাদুড়ি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারতে সম্ভবত দুটো দল আজও কর্পোরেট- নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের থিওরিতে বিশ্বাস করে - একটা বিজেপি, অন্যটা সিপিএম! তাঁর অনুমান যে অভ্রান্ত তা এবার আমরা স্বচক্ষে দেখলাম। এই মানসিকতা নিয়ে আর যাই হোক বাম চেতনার পুনরুজ্জীবন ঘটানো সম্ভব নয়।

সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত বাম দলের আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভুলের কথা নিবন্ধে আলোচনা হয়নি। একটা হল বহু আলোচিত প্রধান শত্রু ও বিজেমূল তত্ত্ব। বিজেপিকে প্রধান শত্রু বিবেচনা না করে তৃণমূল ও বিজেপিকে একই মুদ্রার দুইপিঠ বলে প্রচার করে নিজেদের ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দলের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার প্রচার। সঙ্কীর্ণ এই জন্যে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করে এখানে প্রাধান্য পেয়েছে ২০১১ সালে তৃণমূল দলের কাছে তাদের বিপুল পরাজয়ের জন্য অসূয়া। অথচ ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বারবার বলেও ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়া। একটি কাল্পনিক বিজেমূল দলের প্রতি লড়াইয়ের বার্তা যে আত্মঘাতী ছিল এই কথা বর্তমান সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধেও বলা হয়েছে। একইভাবে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে বিগত রাজ্য সরকারের কিছু কিছু জনমুখী প্রকল্পের অভিঘাতকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে। সবটাকেই কাটমানি আর তোলাবাজির ডিসকোর্সে ফেলে এক্ষেত্রে রাজ্যের সর্ববৃহৎ বামদল প্রকাশ্যে বিজেপির হাতে হুঁকো খেয়েছে। কারণ মূলত জনবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিজেপি এইসব স্কিমগুলোকে অস্বীকার করতে চেয়েছে, এবং নিজেরা কাল্পনিক সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে ভুল পথে চালনার চেষ্টা করেছে। গরিব মানুষের স্বার্থরক্ষা যাঁদের কাজ তাঁরা গরিব মানুষের জন্য নেওয়া সরকারি কর্মসূচিগুলিকে নাকচ করেন কী করে? আমার ধারণা গ্রামের গরিবরা এটা ভালভাবে নেননি, ফলাফল তাই বলছে।

আরো বিস্ময়ের কথা হল, এত বড় পরাজয়ের পরেও দেখছি ফেসবুক এর বামপন্থীরা এই শূন্যতায় কী পুলকিত? এখনও তাঁরা হার স্বীকার করতে নারাজ। এখনও তাঁরা ঘুরিয়ে বলে চলেছেন, এটা আর এস এস এর দুর্গা বাহিনীর জয় ইত্যাদি ইত্যাদি সব বিচিত্র বুলি। বামপন্থী ফেসবুক বাহিনী তাদের দলের সম্পদ না দায়, এটা ভেবে দেখা উচিত। রেড ভলান্টিয়ার্সদেরসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নিবন্ধকার আশ্বস্ত, তাঁদের কাজ নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু দুটো জিজ্ঞাসা রাখতে চাই। বামফ্রন্টের আমলে যদি কোভিডের মতো অতিমারী ঘটত এবং বিরোধী দল এইরকম কোনও স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করতেন, তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হত কি? ১৯৮৭তে বন্যাত্রাণের সময় একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, সেইসময় দলের সমর্থক নয় এমন একটি সংগঠনকে বন্যাত্রাণে সরাসরি কাজ করতে দেওয়ায় বাধা এসেছিল। পরের কথাটা হল, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সমাজের সেবা করা নিশ্চয়ই ফেলে দেওয়ার নয়। কিন্তু তার রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড পাওয়া কি খুব সহজ? আমরা সবাই জানি, ১৯৪২ সালে ‘আগস্ট আন্দোলন’ থেকে কমিউনিস্ট দলের সরে আসার পর তাঁরা জনজীবনে খুব অচ্ছুত হয়ে গিয়েছিলেন, ১৯৪৩-এ মন্বন্তরের সময় সেই কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকদের অতুলনীয় ভূমিকা তাঁদের আবার রাজনৈতিক মূল স্রোতে ফিরে আসতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে ইতিহাস একইভাবে পুনরাবৃত্ত হবে কি না সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। ভলান্টিয়ার্স থেকে ভ্যানগার্ড - ‘সে কি সহজ গান’?


প্রবুদ্ধ বাগচী
কলকাতা-৭০০০৩৬

তারিখঃ ১ জুন, ২০২১



সম্পাদক সমীপেষু,
আরেক রকম
কলকাতা

আরেক রকম দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যায় (১-১৫ মার্চ) সৃজা মণ্ডলের প্রবন্ধ "ফিরে দেখাঃ শতবর্ষ পেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ" রীতিমত হতাশাব্যাঞ্জক। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখা সিরিয়াস প্রবন্ধে কোনো তথ্যসূত্র বা Reference নেই। প্রবন্ধের মধ্যে যা আছে সেগুলিও অসম্পূর্ণ এবং বিভ্রান্তিমূলক। প্রবন্ধের তৃতীয় প্যারাগ্রাফে লেখিকা লিখেছেনঃ ‘‘ ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালের অগাস্ট সংখ্যায় ‘অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া’র প্রথম অধিকর্তা প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী বিরজা শঙ্কর গুহ লিখেছেন, ‘স্যার আশুতোষের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ববিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’’ লেখিকা বিরজা শঙ্কর গুহের লেখাটির শিরোনাম উল্লেখ করেননি। আর তার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা হল বিরজা শঙ্কর গুহ উক্ত পত্রিকায় এরকম কোনো প্রবন্ধ লেখেননি। বিরজা শঙ্কর গুহর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও প্রকাশিত প্রবন্ধের যে তালিকা পাওয়া যায় তাতে এরকম কোনো লেখার উল্লেখ নেই। (Ray, 1974; 38-44) (Coon, 1963; 386-387)

এরপর লেখিকা প্রবন্ধের অষ্টম প্যারাগ্রাফে সুবিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ আন্দ্রে বেতাই-এর স্মৃতিকথা থেকে ইংরেজিতে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কিন্তু আন্দ্রে বেতাই-এর এই স্মৃতিকথার তথ্যসূত্রটি কি? এর কোনো উল্লেখ এই প্রবন্ধে নেই। আন্দ্রে বেতাই-এর যে স্মৃতিকথা অত্যন্ত সুপরিচিত তার শিরোনাম ‘Ourselves and Others’-এর কোথাও সৃজা মণ্ডল উদ্ধৃত দীর্ঘ অনুচ্ছেদের সন্ধান মেলে না। (Andre Beteille, 2013; 1-16) কোথা থেকে লেখিকা বেতাই-এর এসব কথা লেখেন?

ভুলে ভরা এরকম একটি প্রবন্ধ লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করবে বলে আমার ধারণা।

তথ্যসূত্রঃ
১) Bibliographies of eminent Indian anthropologist (with life sketches), 1974.
Birja Sankar Guha (1894-1961) pp. 38-44. By Shyamal Kumar Ray. Anthropological Survey of India, Calcutta.

২) Birja Sankar Guha, 1894-1961 by Carleton S. Coon, 1963. American Anthropologist, Vol. 65, No. 2, pp. 386-87.

৩) ‘Ourselves and Others’ by Andre Beteille, 2013.
Annual Review of Anthropology, Vol. 42, pp. 1-16.


অভিজিত গুহ
১৫/০৩/২০২২



সম্পাদক সমীপেষু,
আরেক রকম
কলকাতা

'আরেক রকম' দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যায় (১-১৫ এপ্রিল, ২০২২) শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অভিজিত গুহ মহাশয় আমার লেখা ‘ফিরে দেখাঃ শতবর্ষ পেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ’ প্রবন্ধটি পড়ে তাঁর পাঠ প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য জানিয়েছেন। এই সূত্রে জানাই, প্রবন্ধটির শেষে reference উল্লেখ করা উচিত ছিল, এই ভুল স্বীকার করে নিয়েও বিনীত ভাবে বলি, তথ্যসূত্র উল্লেখ না করলেও, তথ্যগুলো বোধহয় ভুল হয়ে যায় না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের একজন গবেষক (Senior Research Fellow - UGC-NET) হিসাবে আমার দায়বদ্ধতায়, শতবর্ষীয় এই নৃবিজ্ঞান বিভাগের ইতিহাস নথিবদ্ধ করার ছোট্ট প্রয়াসে আমি বিভিন্ন জার্নাল ও গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি।

প্রবন্ধের তৃতীয় প্যারাগ্রাফে আমি লিখেছিলাম, “ ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালের অগাস্ট সংখ্যায় ‘অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া’র প্রথম অধিকর্তা প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী বিরজা শঙ্কর গুহ লিখেছেন, ‘স্যার আশুতোষের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ববিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল”। চিঠিতে শ্রী অভিজিত গুহ লিখেছেন, ‘বিরজা শঙ্কর গুহ উক্ত পত্রিকায় এরকম কোনো প্রবন্ধ লেখেননি’। এই সূত্রে ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালের অগাস্ট সংখ্যায় বিরজা শঙ্কর গুহ লিখিত পঞ্চানন মিত্রের ‘Obituary’-র একটি অংশ আমি quote করলাম, ‘Dr. Mitra... was appointed on the staff of the Department of Anthropology which was started by the late Sir Asutosh Mukherji... Dr. Mitra... was mainly responsible for organising the Department in its new rooms in the Science College, Ballygunge’ (Guha, 1936:98), যেটির বাংলা তর্জমা করলে বোধ হয় লেখাই যায় - ‘স্যার আশুতোষের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ববিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।... বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজে বড় পরিসরে যখন বিভাগটি তৈরি হয়, পঞ্চানন মিত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন’। লেখাটির তথ্যসূত্র আমি দিলাম। পাঠক চাইলে যাচাই করে নিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, প্রবন্ধের অষ্টম প্যারাগ্রাফে সুবিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ আন্দ্রে বেতাই-এর স্মৃতিকথার অংশটি তাঁর সুবিখ্যাত memoir, 'Sunlight on the Garden: A Story of Childhood and Youth' (২০১২) থেকে গৃহীত।

আমি জানি অধ্যাপক অভিজিত গুহ নৃবিজ্ঞানের বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব। তবুও আমার সীমিত জ্ঞানের পরিধিতে এই চিঠি লিখলাম।


তথ্যসূত্রঃ
● দ সংখ্যা । ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ । ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮।
● Beteille, A. (2012). Sunlight on the Garden: A Story of Childhood and Youth. Penguin Viking.
● Guha, B. S. (1936). Obituary. Dr. Panchanan Mitra. Current Science, 5 (2), 98. (August 1936).
● https://www.jstor.org/stable/24206364

সৃজা মণ্ডল
০৫/০৪/২০২২



সম্পাদক সমীপেষু,
আরেক রকম,
কলকাতা

মহাশয়,

প্রথম সংখ্যা থেকে ‘আরেক রকম’-এর একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে, প্রায় গায়ে পড়ে এই বিতর্কের অবতারণা। প্রসঙ্গ - দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যায় প্রকাশিত গৌতম সরকার মহাশয়ের - “সাহিত্যে নোবেলঃ অ্যানি আর্নাক্স”। নিবন্ধটির বিষয়ে প্রাথমিক এবং সবিশেষ আপত্তি - শিরোনাম সহ নিবন্ধ জুড়ে অবিরত নোবেলজয়ী লেখিকার নামের ভুল বঙ্গীকরণ। ওঁর নামের সঠিক উচ্চারণ - আনি এয়ার্‌নো। প্রাবন্ধিকের বয়ানে - এয়ার্‌নো-র জন্মস্থান ইভ্‌তো হয়ে দাঁড়ায় ‘ইভেটট’! মার্সেল প্রুস্ত্‌ হয়ে যান ‘মার্সেস প্রাউস্ট’; সিমোন্‌ দ্য ব্যোভোয়া হয়ে যান - বুভোয়। এমন কি বিখ্যাত ভূতপূর্ব ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি লেখকের বয়ানে - ‘ফ্রঙ্কোয়েস্‌ মিটেরান্ড’। ফরাসি ভাষায় সামান্যতম ব্যুৎপত্তি না থাকা সত্ত্বেও ফরাসি সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা এক অনধিকার চর্চা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। নিবন্ধে লেখক গুগল থেকে যাবতীয় তথ্য আহরণ করেছেন; আমাদের সবারই উৎস তো তাই। কিন্তু ফরাসি সাংস্কৃতিক ধারা এবং বঙ্গদেশে ফরাসী-অনুরাগের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ ব্যতিরেকে পুরো নিবন্ধটি একাধারে হয়েছে দায়সারা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। অন্তর্জালবাহিত প্রচুর তথ্য সন্নিবিষ্ট করেছেন নিবন্ধকার। কিন্তু যাচাই করেননি, উদ্ধৃত বক্তব্যের আপেক্ষিক গুরুত্ব, তাই দীর্ঘ নিবন্ধ পাঠে মনে পড়ে হ্যামলেটের স্বগতোক্তি - My words fly up, my thoughts remain below।

উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল নোবেল-প্রাপ্তির পরে তাঁর প্রকাশক গালিমার-এ এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার্‌নো-র প্রণিধানযোগ্য উক্তি - ‘আমার জন্য এ এক বিশাল ব্যাপার; বিশেষত আমি যাদের প্রতিনিধিত্ব করি’। স্পষ্টতই তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর শ্রমজীবী প্রেক্ষাপটের কথা।

নিবন্ধে নোবেল কমিটির মন্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে আনি এয়ার্‌নো-কে আংশিক চেনা যায় মাত্র। স্মরণ করা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সুইডিশ একাডেমীর বিবৃতি। ফরাসী সাহিত্যে সামান্য অধিকার ভর করে আমাদের মত সাধারণ জনও বিস্মিত না হয়ে পারে না, এয়ার্‌নোর আবারো পুরস্কার প্রাপ্তিতে কারণ এতাবৎ কালে আনিকে বাদ দিলে, ফ্রান্সে সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখকের সংখ্যা পনেরো। এঁদের মধ্যে আছেন বাঙালির অতি পরিচিত রোঁমা রোঁলাঁ, ফ্রঁসোয়া মোরিয়াক্‌, অঁদ্রে জিদ, আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্র্‌ও; যিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

ফরাসী সংস্কৃতির জলবায়ুতে এত ঘনঘন প্রতিভার বিদ্যুৎ-চমক পরিলক্ষিত হয় যে এয়ার্‌নোর নিছক নারীবাদী বা শ্রমজীবী পরিবেশ থেকে উঠে আসার কথাই সব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ফ্রান্সে ১৬৭৮-এ প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের রচয়িতা একজন নারী - মাদাম দ্য লাফাইয়েত্‌।

কয়েক দশক আগে ফ্রঁসোয়াজ সাগঁ তাঁর একাধিক আত্মজীবনভিত্তিক উপন্যাসে বাঙালি পাঠকের মন জয় করে নিয়েছিলেন। তাঁরই উপন্যাসের শিরোনাম ‘বঁজুর্‌ ত্রিস্তেস্‌’ অনুপ্রাণিত জনপ্রিয় আধুনিক বাংলা গান তৈরি হয়েছে - 'সুপ্রভাত বিষণ্ণতা, তোমার আমি তোমার'। বর্তমান সময়কালে মাত্র তিরিশ বছর বয়েসে স্বনামধন্য লেখক এদুয়ার্‌ লুই-ও শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। এতদসত্ত্বেও এয়ার্‌নো-র বিশেষত্ব কোথায় যে এদুয়ার্‌ লুই স্বীকার করেন যে... যখন কিভাবে কথা সাজাবো খুঁজে পাই না, তখন এয়ার্‌নো খুলে পড়ি,... আমি যে কথা এক পাতা জুড়েও গুছিয়ে বলতে পারি না, উনি সেটা একটি বাক্যে সেরে ফেলেন।...

আনি এয়ার্‌নো-র বৈশিষ্ট্য তাঁর শ্রমিক-শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি; যা সংসার-সমাজ-জগৎকে, এক নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ায় হিসেবে দেখে। নির্যাতিত শ্রেণির পক্ষ নিয়ে তিনি তাঁর চারপাশকে নজর করে এক ভিন্নতর ভাষা নির্মাণ করে, যাকে কোন ট্যাগ-এর নিগড়ে বাঁধা মুস্কিল।

সাহিত্য-আলোচনায় একটি ব্যঞ্জনা এখন বহুল-প্রচলিত - অটোফিকশন; কাছাকাছি বাঙলা তর্জমা - আত্মজীবন-কাহিনী। আনি এয়ার্‌নো এসব চিহ্ন-প্রদানের বিপ্রতীপে দাঁড় করান তাঁর রচনাকে। আটপৌরে ভাষায় তিনি তাঁর গদ্য দিয়ে প্রমিত ভাষাশৈলীর ধারনাকেই চ্যালেঞ্জ জানান। তাঁর উপন্যাসের মূল ফরাসী শিরোনাম ইংরেজি অনুবাদে তার রূপকল্প হারিয়ে ফেলে। যেমন ’৭৪ সালে রচিত তাঁর উপন্যাসের ফরাসি শিরোনাম - লেজ্‌ আর্‌মোয়ার্‌ ভিদ্‌; যা সহজ বাংলায় - শূন্য আলমারিগুলি। এই দ্যোতনা ইংরেজি অনুবাদ ‘ক্লিয়ার্‌ড আউট’-এ হারিয়ে যায়। লক্ষণীয়, তিনি নীরবে ফরাসী দেশ থেকেই উদ্ভূত নানা দার্শনিক ভাবনার প্রতিস্পর্ধী বয়ান তৈরি করেন। শুধুমাত্র আন্তর্জালের তথ্য সম্বল করেই নজর করা যায় তাঁর ১৯৯২-এর উপন্যাস ‘পাসিয়ঁ স্যাঁপ্‌ল’ বা ‘সোজা কথা - আসক্তি’র আখ্যানে আছে বিদেশী কূটনীতিকের সঙ্গে তাঁর অবৈধ প্রণয় কাহিনী। এখানে তিনি বিধৃত করেন সেই যৌনবাসনা যা নীতির তোয়াক্কা করে না; দু' মাসে এই উপন্যাসের বিক্রি দু' লক্ষ। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘লে’ভেনমঁ’ বা ‘সঙ্ঘটনকাল’-এ ফিরে আসে তাঁর কলেজ জীবনে গর্ভপাতের বিষয়টি; যা ছিল ‘শূন্য আলমারিগুলি’তেও। এরপর প্রকাশিত হয় তাঁর রোজনামচা যাতে কূটনীতিকের সঙ্গে সম্পর্কের সোজা-সাপটা দিনলিপি; সাহিত্য নয়। এখানে বিবেচ্য জাক্‌ দেরিদা প্রবর্তিত যে ‘ডিকন্সট্রাক্‌শন’ বা ‘অবিনির্মাণ’-এর কথা আমরা জানি; তার সহজ ব্যাখ্যা যদি হয় - একটি ‘পাঠ’কে এমন অভিমুখে বিচার করা যাতে সেই টেক্সট-এর আপাত নিখুঁত সঙ্গতির অভ্যন্তরে পাওয়া যায় স্ববিরোধ। অর্থাৎ প্রতীয়মান হয় যে অতীব সচেতন প্রয়োগ সত্ত্বেও ভাষার এমন ক্ষমতা যে তাকে কব্জা করা মুস্কিল। আনি এয়ার্‌নো, একই ঘটনাকে তাঁর সৃষ্টিতে বারবার ফিরিয়ে এনে এই তত্ত্বের বিপ্রতীপে নিজেকে সুস্থিত করেন। সময় এবং অভিজ্ঞতার অনুবর্তনে তাঁর একই আখ্যানের অন্য পরত খুলে যায়; ডিকন্সট্রাকশন-অনুসন্ধিৎসু পাঠকের নতুনতর পাঠের প্রয়াস ব্যতিরেকে। ভাষার ক্ষমতার প্রশ্নে তাই হয়ত এয়ার্‌নোর ভাষাশৈলী সমস্ত সংস্কারমুক্ত। তিনি সদর্পে ঘোষণা করেন তাঁর রচনা রাজনৈতিক এবং এলিট-বর্জিত আবহাওয়ায় গড়ে ওঠার কারণেই তাঁর রচনাভঙ্গি সুশীল সমাজে ছুরির মত বেঁধে। তিনি নিজেই নিজের ভঙ্গিকে মনে করেন - বর্বরোচিত ভাবে দ্ব্যর্থহীন, নিচুতলার অভব্য ভাষা। সাহিত্যে তাঁর অবস্থান প্রকাশিত হয় অন্য এক দিক থেকেও। কোন রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েও সমাজের সকল প্রতিবাদ মিছিলে তিনি সামিল থাকেন। এই সব মিলিয়েই আনি এয়ার্‌নো সতত সৃষ্টিশীল ফরাসী সংস্কৃতিতে অনন্য; যেমন ছিলেন অধুনা প্রায় বিস্মৃত বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ানের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আলেকজন্দ্রা কোলন্‌তাই, শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গিতে যাঁর নারীবাদী চিন্তা লেনিন, ট্রট্‌স্কির সহধর্মিণীদেরও বিরূপ করে তুলেছিল।

উল্লিখিত সব কথাই অন্তর্জালে উপলব্ধ, প্রয়োজন ছিল সাহিত্যের প্রতি অনুরাগে এই বিষয়ে আরেকটু অভিনিবেশ।

বিনীত,

ভাস্কর দাশগুপ্ত
কলকাতা-৭০০০২৬