আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

চিঠির বাক্সো

প্রেরকঃ প্রবুদ্ধ বাগচী

তারিখঃ ১ জুন, ২০২১


শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার তার নিবন্ধে (‘বাংলার বামপন্থা - স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ’ ১৬-৩১ মে, ২০২১) সদ্য অনুষ্ঠিত রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থী শক্তির মূলত সিপিআই(এম)-এর শোচনীয় পরাজয় নিয়ে তাঁর মতো করে একটি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। কিন্তু আলোচনাটি বিস্তৃত হলেও আদপে খণ্ডিত। তাঁর ভাবনার সঙ্গে এইটুকু সহমত হতে আপত্তি নেই রাজ্যে সিপিআই(এম) যে মূল বামশক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল তার পেছনে ছিল রাজ্যের উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী ও গ্রামীণ কৃষকদের সঙ্গে তাদের নিবিড় সংযোগ। ওই অংশের মানুষরা ওই দলটিকে তাদের নিজেদের দল বলে আইডেন্টিফাই করতে পারতেন। এটা কঠিন সত্য যে একটা সময়ের পর, এই অংশের মানুষের থেকে দল ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি যে এই বাস্তবতা দল প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি কোনোদিন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৮ অবধি রাজ্যের কংগ্রেস দল সাংগঠনিক স্তরে বা ভোটের লড়াইয়ে কখনো সেইভাবে বিরোধী দলের জোরালো জায়গা নিতে পারেনি, কারণ তাদের অতীত ছিল কলঙ্কিত। এই বিরোধীহীনতা বা বলা যেতে পারে বিরোধীদের অন্যভাবে ম্যানেজ করে হাতে রাখার কৌশল সারা রাজ্যে দলের কর্মীদের মধ্যে একটা অসীম ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয়। রাখলে আমরা রাখব আর মারলে আমরাই মারব, এই মানসিকতা ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। একটা সময় যখন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের মনোনয়ন দিতে বাধা দেওয়া হল তখন তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক বলেছিলেন, আমরা কি বিরোধীদের প্রার্থীও দিয়ে দেব! কথাটার মধ্যে আপাতবিদ্রূপ থাকলেও মূল বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার ভঙ্গিটাও অস্বীকার করা যায় না।

১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে জোরালো একটা বিরোধিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। দল কিন্তু তাদের কর্মসূচি দিয়ে বা মানুষের সঙ্গে যোগ নিবিড়তর করে এই বিরোধিতাকে সামাল দিতে পারেনি। ১৯৯৮- উত্তর পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ তাতে তো বিরোধী দলের সঙ্গে গ্রামের অনেক গরিব মানুষও ছিলেন - সবটাই বিরোধী দলের সাজানো চক্রান্ত বলে লঘু করে দেওয়া যায় কি? এই গরিব গ্রামীণ মানুষরা কেন বাম দল ছেড়ে বিরোধীদের দলে নাম লেখাচ্ছেন তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আজ অবধি হয়েছে কি না জানা নেই। জানা নেই, কোন ভিত্তিভূমি থেকে বিরোধীরা তাঁদের দলে লোক টানতে সক্ষম হচ্ছেন, এই বিচারটাও হয়েছিল কি না। এই বিরোধীদের উত্থানকে মূলত মোকাবিলা করা হয়েছিল পেশীশক্তি দিয়ে, রাজনৈতিকভাবে নয়, বাম রাজনীতির মৌলিক মতাদর্শের বিস্তার ঘটিয়ে তো নয়ই । একইভাবে বিচার করে দেখা হয়নি, একচেটিয়া দলতন্ত্রের প্রকোপে (পার্টি সোসাইটি) কীভাবে এলাকায় এলাকায় জন্ম নিচ্ছে একেকজন ‘ভোট ম্যানেজার’, যাদের অশোক মিত্র বলতেন আঞ্চলিক জায়গিরদার। এইসব জায়গিরদারদের না ছিল কোনো রাজনৈতিক শিক্ষা, না ছিল কোনো নিয়ন্ত্রণ, তাদের কাজ ছিল বিভিন্ন নির্বাচনে দলকে ভোটের বৈতরণী পার করে দেওয়া, আর্থিক সাপোর্ট দেওয়া । দল তাদের সার্ভিস নিত বলে তাদের অনেক কুকর্ম দল বাধ্যত মুখ বুজে মেনে নিত। এর সবটাই বুর্জোয়া সংবাদপত্রের অপপ্রচার বললে আবারও মনকে চোখ ঠারা হয়। রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে গ্রামের মানুষও এগুলো নিজের মতো করে খেয়াল রাখছিলেন বইকি। তাই গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে কেন একটা তথাকথিত ‘আদর্শহীন’ দলের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন সেটার কোনো যোগ্য ময়নাতদন্ত আদৌ হয়েছে কি?

বামফ্রন্টের পেরেকে শেষ কফিন পোতা হয় ২০০৬-এর নির্বাচন জয়ের পর। যখন নির্বিচারে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের হুজুগে গ্রামীণ মানুষের বিরুদ্ধে একচেটিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি দলের কৃষকসভাকেও অন্ধকারে রেখে শিল্পের গোপন শর্ত সীমিত থাকে দুএকজন কর্তা ব্যক্তির হাতে, যারা ইতিমধ্যেই নিজেদের দলের থেকে বড় ভাবতে আরম্ভ করেছেন। এই পর্বের কথা বহু আলোচিত। কিন্তু নিবন্ধকার এই পর্যায়ে দলের ভুল কী ছিল বা ছিল না তা নিয়ে নীরব থেকেছেন। সম্প্রতি ডঃ প্রিয়াঙ্কা মাথুর (অধ্যাপক, জৈন বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গালুরু ও প্রাক্তনী জেএনইউ) একটা সেমিনারে বলছিলেন, তাঁর গবেষণার কাজে নন্দিগ্রামে যাওয়া ও সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা। গ্রামের মানুষরা বলছেন, আমরা তো চিরদিন এদেরই ভোট দিয়েছি, আজ তাঁরা আমাদের সঙ্গে একবার কথা না বলেই জমি নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দিলেন! আজকের বামশূন্য বিধানসভার পেছনে এই গভীর জিজ্ঞাসার মূল্য আমরা খুঁজব না?

কিন্তু বাস্তব হল এইসব ঘটনার আজও কোনো মূল্যায়ন হয়নি। যদি হত, তাহলে এইবারের বিধানসভার নির্বাচনেও বাম দলের নেতা সিঙ্গুরে গিয়ে বলে আসতেন না সিঙ্গুরের মাটিতেই তাঁরা প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠক করবেন, ওই একই জায়গায় শিল্পায়নের জন্য নতুন করে ভিত্তিফলকে সিমেন্ট লাগাতেন না। নন্দিগ্রামের প্রার্থীর প্রচারে গিয়ে প্রাক্তন বাম সাংসদ গলাবাজি করতেন না, এইখানে আবার তাঁরা শিল্প স্থাপন করবেন বলে। আর নন্দিগ্রামে ভোটের আগের দিন মুখ্যমন্ত্রীর একটা কৌশলী মন্তব্যকে পুঁজি করে গোটা দল হই হই করে যেভাবে নিজেদের নিষ্পাপ প্রমাণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে আবারও প্রকাশ্য হয়ে গেল ওই বিষয়ে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তাঁরা আদৌ অনুতপ্ত নন, বরং সবটাকেই ‘পরিকল্পিত চক্রান্ত’ বলে হাত ধুয়ে ফেলে আজও তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে চান। তাহলে তাঁরা কী শিক্ষা নিলেন? কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বা আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট সঠিক কি বেঠিক সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এবারের নির্বাচনে যেভাবে দল কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের প্রশ্নে কর্পোরেট-মডেল সামনে নিয়ে এসেছে তা আবার মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে পনেরো বছর আগের দুঃস্বপ্নে, এটা স্বীকার না করা মুর্খামি। কয়েকমাস আগে অর্থনীতিবিদ ডঃ অমিত ভাদুড়ি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারতে সম্ভবত দুটো দল আজও কর্পোরেট- নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের থিওরিতে বিশ্বাস করে - একটা বিজেপি, অন্যটা সিপিএম! তাঁর অনুমান যে অভ্রান্ত তা এবার আমরা স্বচক্ষে দেখলাম। এই মানসিকতা নিয়ে আর যাই হোক বাম চেতনার পুনরুজ্জীবন ঘটানো সম্ভব নয়।

সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত বাম দলের আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভুলের কথা নিবন্ধে আলোচনা হয়নি। একটা হল বহু আলোচিত প্রধান শত্রু ও বিজেমূল তত্ত্ব। বিজেপিকে প্রধান শত্রু বিবেচনা না করে তৃণমূল ও বিজেপিকে একই মুদ্রার দুইপিঠ বলে প্রচার করে নিজেদের ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া দলের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার প্রচার। সঙ্কীর্ণ এই জন্যে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করে এখানে প্রাধান্য পেয়েছে ২০১১ সালে তৃণমূল দলের কাছে তাদের বিপুল পরাজয়ের জন্য অসূয়া। অথচ ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বারবার বলেও ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়া। একটি কাল্পনিক বিজেমূল দলের প্রতি লড়াইয়ের বার্তা যে আত্মঘাতী ছিল এই কথা বর্তমান সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধেও বলা হয়েছে। একইভাবে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে বিগত রাজ্য সরকারের কিছু কিছু জনমুখী প্রকল্পের অভিঘাতকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে। সবটাকেই কাটমানি আর তোলাবাজির ডিসকোর্সে ফেলে এক্ষেত্রে রাজ্যের সর্ববৃহৎ বামদল প্রকাশ্যে বিজেপির হাতে হুঁকো খেয়েছে। কারণ মূলত জনবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিজেপি এইসব স্কিমগুলোকে অস্বীকার করতে চেয়েছে, এবং নিজেরা কাল্পনিক সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে ভুল পথে চালনার চেষ্টা করেছে। গরিব মানুষের স্বার্থরক্ষা যাঁদের কাজ তাঁরা গরিব মানুষের জন্য নেওয়া সরকারি কর্মসূচিগুলিকে নাকচ করেন কী করে? আমার ধারণা গ্রামের গরিবরা এটা ভালভাবে নেননি, ফলাফল তাই বলছে।

আরো বিস্ময়ের কথা হল, এত বড় পরাজয়ের পরেও দেখছি ফেসবুক এর বামপন্থীরা এই শূন্যতায় কী পুলকিত? এখনও তাঁরা হার স্বীকার করতে নারাজ। এখনও তাঁরা ঘুরিয়ে বলে চলেছেন, এটা আর এস এস এর দুর্গা বাহিনীর জয় ইত্যাদি ইত্যাদি সব বিচিত্র বুলি। বামপন্থী ফেসবুক বাহিনী তাদের দলের সম্পদ না দায়, এটা ভেবে দেখা উচিত। রেড ভলান্টিয়ার্সদেরসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নিবন্ধকার আশ্বস্ত, তাঁদের কাজ নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু দুটো জিজ্ঞাসা রাখতে চাই। বামফ্রন্টের আমলে যদি কোভিডের মতো অতিমারী ঘটত এবং বিরোধী দল এইরকম কোনও স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করতেন, তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হত কি? ১৯৮৭তে বন্যাত্রাণের সময় একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, সেইসময় দলের সমর্থক নয় এমন একটি সংগঠনকে বন্যাত্রাণে সরাসরি কাজ করতে দেওয়ায় বাধা এসেছিল। পরের কথাটা হল, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সমাজের সেবা করা নিশ্চয়ই ফেলে দেওয়ার নয়। কিন্তু তার রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড পাওয়া কি খুব সহজ? আমরা সবাই জানি, ১৯৪২ সালে ‘আগস্ট আন্দোলন’ থেকে কমিউনিস্ট দলের সরে আসার পর তাঁরা জনজীবনে খুব অচ্ছুত হয়ে গিয়েছিলেন, ১৯৪৩-এ মন্বন্তরের সময় সেই কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবকদের অতুলনীয় ভূমিকা তাঁদের আবার রাজনৈতিক মূল স্রোতে ফিরে আসতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে ইতিহাস একইভাবে পুনরাবৃত্ত হবে কি না সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। ভলান্টিয়ার্স থেকে ভ্যানগার্ড - ‘সে কি সহজ গান’?


প্রবুদ্ধ বাগচী
কলকাতা-৭০০০৩৬

তারিখঃ ১ জুন, ২০২১