আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দেশভাগের রাজনীতি এবং মুহাজির কথাশিল্পী সাদাত হাসান মান্টো

অশোক সিংহরায়


ভারতীয় রাজনীতির স্বাধীনতা-পূর্ব সাত দশককে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি প্রায় সমান্তরাল ভাবেই এগিয়ে গেছে; তাই দেশের স্বাধীনতার সাথে সাথেই দেশভাগও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল এবং চতুর ইংরেজ সেই সুযোগছাড়তেচায়নি।

১৮৮৫-র ডিসেম্বরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্নেই তৎকালীন বম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) প্রথম অধিবেশনে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলেছিলেন যে এই প্রতিষ্ঠান হল ভারতীয়দের ক্ষোভ এবং দাবি জানানোর মঞ্চ এবং কংগ্রেস মহারাণীর অনুগত বিরোধীর ভূমিকা পালনেই খুশি থাকবে, কারণ গ্রেট ব্রিটেন ভারতের কল্যাণের জন্য অনেক কিছু করেছে এবং এর জন্য সমস্ত দেশ তার উপর প্রকৃতই কৃতজ্ঞ; গ্রেট ব্রিটেন ভারতকে দিয়েছে আইনের শাসন, রেলওয়েজ এবং সর্বোপরি পশ্চিমী শিক্ষার অমূল্য আর্শীবাদ। যদিও অবশ্য কংগ্রেস পরবর্তী সময়ে জাতীয় আন্দোলনের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিল।

১৮৮৮-র মার্চে বৃটিশ সরকারের দিল্লি নিবাসী বিচারপতি স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মীরাটে তাঁর "এক দেশ, দুই জাতি" শীর্ষক বক্তৃতায় বিতর্ক সৃষ্টি করলেন এই বলে যে ভারতে মুসলমানদের নিজস্ব পরিচিতি (অনন্যতা)র কারণে জাতীয় কংগ্রেসের মিত্র হওয়ার থেকে ব্রিটিশের বন্ধুত্ব তাদের স্বার্থ অনেক বেশি রক্ষা করবে। কাজেই মুসলমানরা চায় না হিন্দুদের প্রজা হতে, তাদের ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বস্ত হওয়া উচিত যাতে মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে সামাজিকভাবে মিশতে পারে; তাদের সাথে খেতে পারে, তারাও মুসলমানদের সাথে খেতে পারে। ঢাকার নবাব সলিমুল্লা খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে আয়োজিত সম্মেলনে প্রথম সভাপতি হায়দরাবাদের মুস্তাক হোসেন বলেন মুসলিম লীগের কংগ্রেসের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন ঝগড়া নেই যতক্ষণ পর্যন্ত কংগ্রেস ব্রিটিশ শাসনের কোনো বিরোধিতা না করবে এবং মুসলমানদের স্বার্থে কোনো আঘাত না করবে।

হিন্দুমহাসভা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৫সালে মদনমোহন মালব্যের নেতৃত্বে। পরবর্তীকালে বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর প্রধান তাত্ত্বিক নেতা হয়ে ওঠেন। ভবিষ্যতে আর কখনও ব্রিটিশের বিরোধিতা করবেন না বলে মুচলেকা দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সাভারকর ইংরেজ নয় মুসলমানরাই হিন্দুদের শত্রু এই তত্ত্বের মূল প্রচারক হয়ে উঠেন। ১৯২২ সালে "Essentials of Hindutva" প্রবন্ধে তিনি "হিন্দুত্ব"বাদের জন্ম দেন, যা দ্বিজাতিতত্ত্বের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। লালা লাজপত রায় ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরের 'ট্রিবিউন' পত্রিকায় মুসলমানদের জন্য জন্য চারটি প্রদেশও বরাদ্দ করে দেন - উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলা। হিন্দু মহাসভার সমমনোভাবাপন্ন হিন্দুত্ববাদী আধাসামরিক ও অসরকারি সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্ম হয় ১৯২৫ সালে নাগপুরে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয় - ১৯২০ সালে তাসখন্দে (বিদেশে) / ১৯২৫ সালে কানপুরে (দেশে)। কমিউনিস্টদের একাংশ প্রথমটিকে জন্মসন হিসেবে মানে; অপরাংশ দ্বিতীয়টিকে জন্মসন হিসেবে মানে।

১৯১৪ সালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতের মাটিতে পা রাখেন, মহম্মদ আলি জিন্নাহ তখন প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী নেতা - সরোজিনী নাইডুর ভাষায় "হিন্দু মুসলিম সংহতির প্রচারক"। দেশে ফিরেই রাজনীতি শুরু করে গান্ধীজি ক্রমে কংগ্রেসকে নিয়মতান্ত্রিক দল থেকে গণআন্দোলনের পথে নিয়ে আসেন বলে কংগ্রেসকর্মী এবং সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। গান্ধীর সাথে জিন্নাহের প্রথমে মতান্তর, তারপরে মনান্তর হয়। তিনি গান্ধীজির সাথে তীব্র মতবিরোধের জন্য এবং ১৯২০ সালে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে গান্ধী অনুগামীদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার কারণে রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিয়ে লন্ডনে গিয়ে আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। পরবর্তী কালে ১৪ বছরের রাজনৈতিক সন্ন্যাস কাটিয়ে ১৯৩৪ সালে নতুন ভূমিকায় ভারতে ফিরে এলেন মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ লক্ষ্মৌ অধিবেশনে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলে এবং ১৯৪০ সালে লাহোর অধিবেশনে দ্বিজাতিতত্ত্বকে সামনে এনে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তানের প্রস্তাব পেশ করে।

কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের দাবি জানায় ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে (১৯৩৯ - ১৯৪৫) ইংরেজ ভারতকেও এইযুদ্ধে সামিল করতে চাইলে জাতীয় কংগ্রেস তার বিরোধিতা করে, পরে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যুক্তিতে শর্তসাপেক্ষে তাকে সমর্থন করতে রাজি হয়। ১৯৪২-এর আগস্টে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা "ভারত ছাড়ো" আন্দোলনের বিরোধিতা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজের সেনাবাহিনীতে হিন্দু যুবকদের যোগদানের আহ্বান জানিয়ে ইংরেজকে সহযোগিতা করা আবার একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিম লীগের সাথে সরকার গঠন করা হিন্দুমহাসভার রাজনৈতিক দ্বিচারিতাই প্রমাণ করে।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি সহিংস আন্দোলনের ধারাও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ক্ষুদিরাম, কানাইলাল থেকে ভগৎ সিং প্রভৃতি অগ্নিযুগের শত শত বিপ্লবীদের আত্মবলিদান, ১৯৩০-এ মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের গৌরবোজ্জল সংগ্রাম, ১৯৪৬ সালের বোম্বাইতে নৌবিদ্রোহ, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি কৃষক আন্দোলন, যেগুলিতে সব ধর্ম-মতের মানুষই অংশগ্রহণ করেছিল এবং এই আন্দোলন গুলিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের কোনও গন্ধও খুঁজে পাওয়া যায় না।

তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুদ্ধক্লান্ত এবং নানা পথের আন্দোলনে ব্যতিব্যস্ত ইংরেজ যখন ভারতকে স্বাধীনতা দিতে রাজি হল মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের মুসলিম লীগের দাবি এবং হিন্দুমহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাংলা ভাগে বায়না ধরার কারণে জাতীয় কংগ্রেসের দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য দোদুল্যমানতার জন্য স্বাধীনতা এল দেশভাগের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে - জন্ম হল পাকিস্তানের; বাংলা এবং পাঞ্জাব অখন্ড থাকল না। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহত অভিপ্রয়ান (মাইগ্রেশান) - কোটি কোটি মানুষ 'সাত পুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে' দেশান্তরি হল। অন্নদাশঙ্কর রায় কথিত "ধেড়ে খোকারা" আনাড়ি হাতে নাড়ি কাটার ফলে সদ্য প্রসব হওয়া দুই রাষ্ট্রের রক্তক্ষরণ বন্ধ হল না। স্বাধীনতার আগে ও পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারাল হাজার হাজার মানুষ; নিরাশ্রয় হল লক্ষ লক্ষ অসহায় পরিবার।

ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের এই উদ্বাস্তু বা মুহাজিরদের নিরাশ্রয় হওয়া, দাঙ্গায় আত্মীয়-পরিজন হারানোর যন্ত্রণা বাংলা, হিন্দী, পাঞ্জাবি, উর্দু ভাষায় সাহিত্যে, মঞ্চে, চলচ্চিত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিত হয়েছিল। উর্দু সাহিত্যে দেশভাগ-উদ্বাস্তু সমস্যা-দাঙ্গা-লুঠ-ধর্ষণ-মানবিক মূল্যবোধের অবনতি যার সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে তিনি সাদাত হাসান মান্টো যিনি নিজে ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতায় অত্যন্ত কাছ থেকে এগুলো দেখেছেন; দেশভাগকে যিনি কখনও মেনে নিতে পারেননি। এই যন্ত্রণা তাঁকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। জন্মসূত্রে কাশ্মিরী হলেও তাঁর পরিবার ছিল বংশানুক্রমিকভাবে পূর্ব-পাঞ্জাবের লুধিয়ানার বাসিন্দা; সেখানেই তাঁর জন্ম এবং বড়ো হওয়া। জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই)। চিত্রনাট্যকার হিসেবে হিন্দি চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। একসময় যুক্ত ছিলেন রেডিওর সাথে - বেশ কটি রেডিও-নাটক লিখেছেন; লিখেছেন একটি উপন্যাস; তিনটি প্রবন্ধের সঙ্কলনও রয়েছে। তবে তাঁর মূল পরিচয় ছোটগল্পকার - প্রকাশ করেছেন ২২টি ছোটগল্পের সঙ্কলন যে গল্পগুলিতে দেশভাগ, জীবনের কঠোর ও নির্মম সত্য, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, অন্যকে রক্ষা করতে গিয়ে আত্মত্যাগ, তথাকথিত পতিতা মেয়েদের যৌন-দাসত্বের জীবন হয়েছে উপজীব্য বিষয়। আই পি ডব্লিউ ইউ অর্থাৎ ভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। ছিলেন সাম্যবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ অর্থাৎ পাঞ্জাব ভাগ হয়ে গেলে তার স্ত্রী-কন্যারা লাহোরে চলে গেলেও তিনি বোম্বেতেই ছিলেন। বোম্বেতে অবস্থানকালে এক ভয়ঙ্কর দাঙ্গার মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি পাকাপাকিভাবে লাহোরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে যখন তাঁর বয়েস ৩৫ বৎসর। লাহোরেই ১৯৫৫ সালে মাত্র ৪২ বৎসর বয়েসে তাঁর মৃত্যু হয়। পাকিস্তান বাসকালে অনেক বুদ্ধিজীবীর সংস্পর্শে আসেন তিনি। সেখানে তাঁর সাহিত্যচর্চা পুরোদমে চললেও মানবিক মূল্যবোধের পূজারি, সমাজ-জীবনের চিত্রকে অবিকৃতভাবে প্রকাশ করার স্পর্ধা রাখা এই সাহিত্যিককে রাষ্ট্র, ধর্মবাদী সমাজ, এমনকি প্রগতিশীল সারস্বত সমাজও খারিজ করে দেয়। তিনি ক্রমে মদ্যপানে অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়েন যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই উর্দু লেখকের দেশভাগ বিষয়ক রচনাই এখানে আমরা আলোচনা করব।

সাদাত হোসেন মান্টো গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, "একজন লেখক তখনই কলম তুলে নেয় যখন তার চেতনা কোন কারণে আহত হয়"। দেশভাগের সিদ্ধান্তকে তিনি দেখেছিলেন "বিপর্যস্তকারী দুর্ভাগ্য" এবং "নির্বোধ পাগলামি" হিসেবে। এই বিষয়ে তাঁর লেখা "টোবা টেক সিং" একটি অসাধারণ গল্প। বিবিসি তাদের পৃথিবীর সেরা একশোটি গল্পের তালিকায় এটিকে রেখেছে।

লাহোরের এক পাগলাগারদের পাগলদের নিয়ে গল্পটা রচিত। দেশভাগের বেশ কয়েক বছর পরে দু' দেশের সরকার ঠিক করল ভারতের পাগলাগারদে যে মুসলমান পাগলরা আছে তাদের পরিবারের লোকেরা যদি পাকিস্তানে চলে যায়, তাদেরও পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর পাকিস্তানের পাগলাগারদে যে সব হিন্দু এবং শিখ পাগলরা আছে তাদেরও একই নিয়মে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। লাহোরের পাগলাগারদে ১৫ বছর ধরে বিষণ সিং বলে এক পাগল ছিল যে নাকি একসময় টোবা টেক সিং বলে এক জায়গার জমিদার ছিল বলে দাবি করত। আগে তার ছোটো মেয়ে এবং বাড়ির লোকেরা দেখা করতে এলেও পরে আর আসত না এবং বিষণ সিং নাকি গত ১৫ বছরে একদিনও শোয়নি। কয়েকদিন আগেই তার বন্ধু ফজলদীন এসে বলে গেল যে তার পরিবারের লোকেরা ভারতে চলে গেছে। সঠিক দিনে লাহোর থেকে হিন্দু ও শিখ পাগলদের ট্রাকে তুলে ওয়াঘা বর্ডারে নিয়ে আসা হল। ওদিক থেকে ভারতের অফিসাররা এসেছে। পাগলরা চেঁচামেচি, ছুটোছুটি শুরু করল। বিষণ সিংয়ের নম্বর আসতে সে ওপারে গিয়ে অফিসারকে জিজ্ঞেস করল, 'টোবা টেক সিং কোথায়?' ভারতের অফিসার হেসে বলল, 'পাকিস্তানে'। বিষণ সিং দৌড়ে এদিকে চলে এল। তাকে বোঝানো হল টোবা টেক সিংকেও ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সে দু'দিকের মাঝামাঝি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল; কেউ তাকে নড়াতে পারল না। সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে সকাল হতে আকাশভেদী আর্তনাদ করে সে পড়ে গেল, তার দেহ দুইদেশের মাঝখানের জায়গায় উপুড় হয়ে পড়ে রইল।

"খোলো" গল্পটি দেশভাগ জনিত দাঙ্গার সময় কিছু মানুষের মানবিক মূল্যবোধের কি নিদারুণ অবনমন হয়েছিল তারই যেন এক জ্বলন্ত প্রমাণ। দাঙ্গাবিধ্বস্ত মানুষদের নিয়ে ট্রেন অমৃতসর থেকে মুগলপুরা পৌঁছলে সেখানকার ক্যাম্পে সিরাজুদ্দিন তার মেয়ে সাকিনাকে খুঁজতে লাগল। তার স্ত্রী তার সামনেই মারা গেছে। মেয়ে সাকিনাকে নিয়ে সে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে দৌড়েছিল। কখন সাকিনা আলাদা হয়ে গেছে, সে ট্রেনে উঠতে পেরেছে কিনা সিরাজ তাও বুঝতে পারেনি। কয়েকদিন এভাবে খোঁজার পর তার সাথে আলাপ হল বন্দুক-লরি নিয়ে দাঙ্গায় আক্রান্ত মানুষদের উদ্ধার করে বেড়ানো আট তরুণের এক স্বেচ্ছাসেবী দলের সঙ্গে। সিরাজুদ্দীন তাদের তার মেয়েকে খুঁজে এনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। সে বলতে ভুলল না যে তার মেয়ে খুব সুন্দরী। একদিন ওই তরুণের দল মেয়েটিকে পেয়ে গেল। ভীত-সন্ত্রস্ত মেয়েটিকে লরিতে তুলে কেউ জল দিল, কেউ দুধ দিল, কেউ দিল খাবার। একজন নিজের গায়ের কোট খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিল। একদিন সন্ধেয় সিরাজুদ্দিন দেখল কয়েকজন লোক একটা মেয়ের দেহ এনে হাসপাতালে ঢুকিয়ে চলে গেল। সে পেছন পেছন গিয়ে সেই ঘরে ঢুকল। ঘরে আলো জ্বলে উঠতেই সে চিৎকার করে উঠল 'সাকিনা' বলে। সিরাজকে মেয়েটির বাবা বলে বুঝতে পেরে ডাক্তার তাকে জানলা খুলতে বলল। মেয়েটির হাতদুটো নড়ে উঠতেই সিরাজ আশান্বিত হল যে তার মেয়ে বেঁচে আছে। এদিকে সাকিনার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল - মেয়েটি নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষিতা।

আবার "মোজেল" গল্পে মোজেল নামে এক তরলমতি চপল স্বভাবের ইহুদি মেয়ে কিভাবে তার একসময়কার বন্ধু ত্রিলোচন সিংয়ের প্রেমিকা কৃপাল কৌরকে দাঙ্গার বিপদ থেকে উদ্ধার করে ত্রিলোচনের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করল তারই মানবিক আখ্যান। "শেষ স্যালুট" গল্পের রব নওয়াজ এবং রাম সিংয়ের একই গ্রামে বাড়ি, একই স্কুলে পড়াশুনা, সমবয়সী, একই সঙ্গে ফৌজে ভর্তি হয়, একই রেজিমেন্টে ছিল আগের যুদ্ধে ; কিন্তু দেশ ভাগের পর একজন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এবং দুজনেই কাশ্মীরে লড়াইয়ে। একদিন এক পাহাড়ের উপর তার সঙ্গীদের নিয়ে থাকার সময় রব নওয়াজ বুঝতে পারল দূরে পাথরের আড়ালে তার সঙ্গীদের নিয়ে তার একসময়ের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু বর্তমানে শত্রু শিবিরের রাম সিং। দুজন চিৎকার করে ইয়ার্কি, গালিগালাজ, ব্ল্যাঙ্ক ফায়ারিং করতে লাগল। রাম সিং তার বন্ধুকে মুখ দেখাতে পাথরের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলে হঠাৎ রব নওয়াজের গুলিতে সাংঘাতিক ভাবে আহত হল। রব নওয়াজ বুঝতেও পারে নি রাম সিং এভাবে বেড়িয়ে আসবে। এরপর রব নওয়াজ বন্ধুর কাছে গিয়ে ওয়ারলেসে তাদের ডাক্তারকে আসার অনুরোধ করল। প্রচন্ড রক্তক্ষরণে মারা যাবার আগে পুরোনো দিনের গল্প করতে করতে রাম সিং রব নওয়াজকে প্রশ্ন করে, "তোদের সত্যিই কাশ্মীর চাই?" এই ছোট্ট কথাটি গল্পটিকে অন্য মাত্রা দেয়। পাঞ্জাবের একই গ্রামের দুইজন দুইদেশের সেনাবাহিনীর হয়ে কাশ্মীর দখল করা এবং দখলে রাখার লড়াই করছে অথচ তারা নিজেরাই এটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। রব নওয়াজদের মেজর আসলাম যে একসময় রাম সিংদের রেজিমেন্টের মেজর ছিল, সে এলে মৃত্যুর আগে রাম সিং আগের অভ্যাসবশত বর্তমান শত্রু শিবিরের মেজরকেই ইইস্যালুট দিয়ে রব নওয়াজের দিকে তাকাতে তাকাতে মারা যায়। এইরকম আরেকটি অসাধারণ গল্প "টেটবালের কুকুর"। এমনই কিছু অসাধারণ গল্প "শরীফন", "ঠান্ডা গোস্ত", "গুর্মুখ সিংয়ের প্রতিজ্ঞা", "রামখেলাওন", "ইয়েজিদ", "শেষ ভালো যার" প্রভৃতি। বাবার খুনীকে কৌশলে খুন করে বদলা নেওয়ার গল্প (মেয়েটা) ; নিজের আত্মীয় অন্য ধর্মের লোকের হাতে খুন হওয়ায় নিজের সেই ধর্মের অভিন্ন হৃদয় বন্ধুকে খুন করার ভয় দেখিয়ে অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়ার গল্প (সহায়); দেশভাগের উত্তাল সময়ে মুসলিম মা তার হারিয়ে যাওয়া অপরূপা সুন্দরী মেয়েকে খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে যখন একদিন তাঁকে দেখতে পেল, সেই মেয়ে তার শিখ যুবক বরের সাথে যেতে যেতে ঘোমটা সরিয়ে পাগল মাকে দেখে না দাঁড়িয়ে বরকে নিয়ে চলে গেল, সেই গল্প (খোদার কসম)। এককথায় "মির্জা গালিব"-এর চিত্রনাট্যকার তাঁর অসাধারণ ছোটগল্পগুলিতে নানা দিক থেকে জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছেন। "সহায়" গল্পে মুমতাজের বলা কথাটাই যেন মান্টোর নিজের কথা, "...এটা বলিস না যে এক লাখ হিন্দু আর এক লাখ মুসলমান মরেছে... বরং বল দুলাখ মানুষ মরেছে। - ধর্ম, বিশ্বাস, নিষ্ঠা, বিবেক, বুদ্ধি এসব আমাদের শরীর নয়, আত্মার সঙ্গে জুড়ে আছে... ছুরি, চাকু, গোলাগুলি চালিয়ে কি আর এদের শেষ করা যায়? - ধর্ম বলতে যা প্রত্যেক মানুষকে স্বাতন্ত্র দেয়, মনুষ্যত্ব দেয়, আমি তার কথা বলছি।"

দেশভাগের আগে তিনবার এবং পাকিস্তানে থাকাকালীন সময়ে তিনবার তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার দায়ে অভিযোগ করা হয়। অবশ্য একবার সামান্য জরিমানা ছাড়া তাঁর কখনও শাস্তি হয়নি। মান্টো মনে করতেন, "সমাজ যদি উলঙ্গ হয়, তাকে জামাকাপড় পরানোর দায়িত্ব আমার নয়... যদি আমার লেখা অসহ্য মনে হয়, তার অর্থ হল, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিই অসহ্য হয়ে উঠেছে।"

দেশভাগকে আদৌ মেনে নিতে না পারার ব্যাপারে মান্টোর সাথে ভীষণ মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের। দেশভাগের পর ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মান্টো; ঋত্বিক ঘটক পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা থেকে এসেছিলেন ভারতের খন্ডিত পশ্চিম বঙ্গে। দুজনের যাত্রা বিপরীতমুখী হলেও অভিজ্ঞতা অভিন্ন; যদিও স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশভঙ্গির স্বতন্ত্রতা আছে।

ঋত্বিকও মান্টোর মত সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন; যুক্ত ছিলেন গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে শৃঙ্খলা ভাঙার কারণে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত। চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ব্যাকরণ না মেনে চলচ্চিত্রের নতুন ব্যাকরণ তৈরি করেন তিনি। অসংখ্য অসাধারণ চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু-জীবন নিয়ে ট্রিলজিঃ মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২) - যা উপস্থাপনার গুণে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের সম্পদ হয়ে আছে। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকার কারণে তারও ব্যক্তিগত জীবনের পরিণতি হতাশায় ভরা; মৃত্যু ৫০ বছর বয়সে। "মেঘে ঢাকা তারা" চলচ্চিত্রে উদ্বাস্তু পরিবারের বড় মেয়ে নীতা নিজের ব্যক্তিগত সুখকে বিসর্জন দিয়ে নীরবে পরিবারের সব দায়িত্ব পালন করে যায়; পরে যক্ষা রোগাক্রান্ত নীতা যখন শিলং পাহাড়ে দাদা শঙ্করকে কাতরকন্ঠে বলে, "দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম" তখন তা শুধু একটি বঞ্চিত মেয়ের কান্নাই থাকে না, পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনকেই যেন বে-আব্রু করে দেয়। "সুবর্ণরেখা" চলচ্চিত্রেও এক উদ্বাস্তু ক্যাম্পে মানুষরা জমিদারের লোকদের আটকাতে একতাবদ্ধ; কিন্তু এক জেলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বসতিতে অন্য জেলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের থাকা নিষেধ। অভিরাম বাগদির ছেলে জানার পর সীতা-অভিরামের সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে পড়ে। পরে এক ভঙ্ককর রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বিধবা সীতার আত্মহত্যা ; "রাত কত হল? উত্তর মেলে না" যেন সেই কঠোর সত্যেরই প্রতিধ্বনি। তবে হতাশায় সমাপ্তি নয়; অনাথ ভাগনের দায়িত্ব নিয়ে ঈশ্বরের ফিরে যাওয়া সুবর্ণরেখার ধারে কি এক নতুন আরম্ভের ইঙ্গিত দেয় না? এখানেই জিতে যায় ঋত্বিক ঘটকের আশাবাদ।

সাদাত হাসান মান্টোও তাঁর গল্পে কঠোর সত্য এবং সমস্যাজর্জরিত জীবনের চিত্রায়ণ করলেও, তিনি অবশ্যই আশাবাদী। তার অসাধারণ কিছু অণুগল্পের একটি চ্যালেঞ্জঃ "আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো - কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপরে সাইনবোর্ড তখনো পড়া যাচ্ছিল - ওখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।" এই দোকানটা না বেঁচে গেলে নতুন করে মহল্লা তৈরি হবে কী করে? এই জীবনবোধ নিয়েই সাদাত হাসান মান্টো জীবনবেদ রচনা করে গিয়েছিলেন।