আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

আয়ারাম গয়ারাম


স্বাধীনতার ৭৪ বছরে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি পশ্চিমবঙ্গ। দেশভাগের পর ১৯৫২, ১৯৬৪ র দাঙ্গা দেখেছে; দেখেছে ১৯৭৮ র প্রবল বন্যা, ১৯৮৪র শিখ বিপর্যয়, ১৯৯২-এর বাবরি ভাঙার পরিণতি। ১৯৬৭, ১৯৭৭ ও ২০১১-র তিনটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তথা ক্ষমতা বদলের ছবিও তার দেখা - কিন্তু এমন এক ভয়ানক সংকটের নির্বাচন পূর্ববঙ্গ ও বাংলাদেশ দেখলেও পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি।

এই নির্বাচন রাজনৈতিক ভাবে সারা দেশ তথা পৃথিবীতেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারত হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা হবে কি হবে না, নাকি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারত থাকবে তার পরীক্ষাও হবে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে। কেন্দ্রীয় শাসকদলের লোকজন রাতদিন ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করছে দিল্লি থেকে। প্রধানমন্ত্রী আসছেন ঘনঘন। তাঁর আপাতত নিজস্ব সাগরেদ ছোট বাজারে গঞ্জে রোড শো পর্যন্ত করছেন। তাদের কাছে এই নির্বাচন জেতা খুব জরুরি। সে-কারণেই তাদের মতাদর্শের বিরোধী দলগুলোর দরকার সম্মিলিতভাবে তাদের হারানো।

কিন্তু সে কাজ দূরে থাক, রাজনৈতিক দলগুলো আকচাআকচি খেয়োখেয়িতে ব্যস্ত। এবং একই সঙ্গে চলছে গালাগালি দলাদলি ও দল ভাঙানোর পালা। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের তিনটি ধারা। এক, বামফ্রন্টের পথ। একে অন্য দুটি বামধারার লোকজন সরকারি বাম বলছেন। অ-সরকারি বামদের দুটি ধারা। একটি এসইউসি প্রভাবিত। আরেকটি দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সিপিআই(এল এল) লিবারেশন ও অন্যান্যরা। এমনিতেই বামপন্থীদের নমেনক্লেচার করা বড়োই কঠিন। সামাজিক মাধ্যমের কারণে আরেকটি শব্দ জোরদার লিবেরাল বাম। সামাজিক মাধ্যমে চার দল মূলত দুটি পক্ষ হয়ে লড়ে যাচ্ছে। কে খাঁটি আর কে আগমার্কা - এ ফ্যাসিবাদের কারাগারে মুখোমুখি বা পাশাপাশি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা। তাও শুনেছি জেলে নানা সেল লড়ে যায় খাঁটিত্ব প্রমাণে। এরা লড়ছে - কারও কেশ পরিমাণ সরণ হয়েছে কিনা রাজনৈতিক কোনো স্কেল থাকলে মাপা যেতো। তেতো কথার ভিড়ে কেউ কাউকে ভাঙাতে অক্ষম - সম্পর্ক যদিও ভাঙছে রোজ। বন্ধুত্বও।

সিপিআই(এম) নীচের তলায় পতাকা হাতে কিছু লোককে দলে নিয়েছে। কিন্তু তাকে দলভাঙানো বলে না। সরকারি ক্ষমতায় নেই। লোকে রাগে ক্ষোভে আসতে পারে, বা কুলায় ফিরতে আগ্রহী অভিমান ভুলে।

তৃণমূল এবং বিজেপি দুই শাসক‌দলে দল ভাঙানো অব্যাহত। এছাড়া ফেরাফেরি ঠেলাঠেলি তো আছেই। ১৯৬৭তে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাঙতে কয়েকজন বিধায়ক আগ্রহী হন রাজ্যপাল ও দিল্লির যোগসাজশে। সে রাজনীতি খুব ঘৃণিত হয় পশ্চিমবঙ্গে। তারপর ১৯৭৭ তে কংগ্রেস ভেঙে কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি হয়। ১৯৯৮-এ কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস।

কিন্তু ২০১১-র পর যেভাবে দলবদল করিয়েছে তৃণমূল সুপ্রিমোর অনুমোদনে তাঁর দুই সাগরেদ - মুকুল শুভেন্দু - তা বিরল। মুকুল ঝরেছে। নতুন করে ধরেছে বিজেপিতে। কাঁথির অধিকারী পরিবারের যুবরাজ একদা মমতার নয়নের মণি এখন তাঁর বিরুদ্ধে ভোট লড়ছেন। বিজেপিতে গেছেন ছয় বিধায়ক ও দুই সাংসদ নিয়ে। এই ছয়জনের মধ্যে তিন জন আদি তৃণমূল বাকি তিনজন ২০১৬-র বাম কংগ্রেস জোটের ভোটে নির্বাচিত।

এ পর্যন্ত বিজেপিতে গেছেন ৩০ জন বিধায়ক সাংসদ। এর মধ্যে সাংসদ চারজন। একজন মুকুল রায় স্বয়ং। অন্য তিনজন শিশির অধিকারী, দীনেশ ত্রিবেদী ও সুনীল মণ্ডল। সুনীল মণ্ডল ২০১১তে বামফ্রন্টের ফরোয়ার্ড ব্লকের হয়ে বিধায়ক হোন, পরে দল ছেড়ে তৃণমূল সাংসদ।

সিপিআই(এম) তথা বাম কংগ্রেস জোট থেকে ২৬ জন বিধায়ক গেছেন তৃণমূল বা বিজেপিতে। ৭৬ জন বিধায়ক ছিলেন বাম কংগ্রেস জোটে। প্রায় ৩৩% দলত্যাগ করেছেন বিধায়ক পদ ত্যাগ না করে। এটা দুর্নীতি।

২০১১র পর আটজন বামফ্রন্টের মন্ত্রী গেছেন তৃণমূল ও বিজেপিতে। এখানে তৃণমূলের পাল্লাভারি।

প্রথম গিয়েছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র ঘোষ। বিজেপিতে। আরেকজন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা।

এখন কে হেলে আর কে কেউটে ধরেছেন জানা যায়নি, কিন্তু মানুষের মনে আতঙ্ক আমার ভোটে জেতা লোক দলত্যাগ করবে না তো পদ না ছেড়েই। এ-জন্য আইন বদলানো প্রয়োজন। দল বদলালে পদ ছাড়তে হবে। কিন্তু এই আইন যাঁরা আনবেন তাঁরাই এ-কাজে নোংরা অশালীন দক্ষতা দেখাচ্ছেন। ‌স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দল ভাঙানোর জন্য ফোন করছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও এক পথের প্রতীক। অমিত শাহ নাকি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন শৃঙ্খলা দেখা তাঁর কাজ। কিন্তু তিনি বেআইনি কাজে খুশি ডগমগ হয়ে থাকেন। দল ভাঙান। ত্রিপুরার রাজ্যসভা সদস্যকে দপ্তরে বসে প্রস্তাব দিয়েছেন।

এই রকম দলবদলু মাস্টারদের বিদায় চাই। কিন্তু জনগণেশের মনে কী মন্ত্রণা কাজ করছে - ইভিএম কিছুটা জানে। বাকি জানে ৭০ কোম্পানি তথা ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) জন বাহিনী হাজির। এর কতজন সেনা, কতজন - সত্যি সঙ্ঘী কাডার - এই অলিখিত জরুরি অবস্থা কালে নির্ণয় করবে কে?

গো-বলয়ে তৈরি হয়েছিল দলবদলু নাম আয়ারাম গয়ারাম। এতবার দল বদলাতেন। এখন পশ্চিমবঙ্গে এসে গেছে সেই আয়ারাম-গয়ারামের রাজনীতি। তাদের দিন কবে হবে অবসান! পরিস্থিতি এমন জায়াগায় পৌঁছিয়েছে যে বিজেপির ২৯৪ জন‌ প্রার্থীর মধ্যে ১৫৮ জন অন্য দল ভাঙিয়ে আনা। ইডি, সিবিআই, আয়কর লেলিয়ে টাকা ও পদের লোভ দেখিয়ে। এই নেতারা গতবার যে দলের হয়ে ভোট চেয়েছিলেন, বর্তমানে তার বিপক্ষে চাইছেন। এহেন আয়ারাম গয়ারামের রাজনীতিই কি রাজ্যের মানুষ মেনে নেবেন?