আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২১ ● ১৬-৩১ চৈত্র, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

ইস্তেহারের রাজনীতি


পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। এই সম্পাদকীয় প্রকাশ হওয়ার সময় দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট গ্রহণ চলছে। ইতিমধ্যেই তিন যুযুধান পক্ষের তরফে তাদের ইস্তেহার প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান নির্বাচনে নীতি, বিগত সরকারের ভূমিকা, আগামী সরকারের করণীয় ইত্যাদি বিষয় নেতাদের মুখে খুব বেশি শোনা যাচ্ছে না। বরং ব্যক্তিগত আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক বিষোদ্গার এবং নানান কদর্য কথায় ভরে উঠেছে রাজনৈতিক বক্তব্য। তবু, রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তেহার অনেক কথা বলে। ইস্তেহারগুলির মধ্যে পাওয়া যায় একটি দিকনির্দেশ যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি সরকার চালাবে বলে মানুষের কাছে ঘোষণা করছে।

এই বারের নির্বাচনে তৃণমূলের ইস্তেহারে যেরকম বেশ কিছু ঘোষণা রয়েছে যা গুরুত্বপূর্ণ। দুটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, প্রত্যেক পরিবার, যারা করের আওতায় আসেন না, তাদের মহিলাদের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা হাত খরচ, এবং তপশিলী জাতি ও উপজাতির ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা হাত খরচ, দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকে এই ঘোষণার সঙ্গে ন্যূনতম আয়ের যে ধারণা অর্থনীতিবিদ মহলে চালু হয়েছে তার সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। দ্বিতীয় যেই ঘোষণা খুব নির্দিষ্টভাবে করা হয়েছে তা হল প্রত্যেক জেলায় হাসপাতাল ও মেডিকাল কলেজ বানানো এবং ডাক্তারি ও নার্সের ভর্তির আসন দ্বিগুণ করা। এই ঘোষণা যদি সত্যিই কোনো সরকার বাস্তবায়িত করে তবে তা নিশ্চিত সাধুবাদ যোগ্য। কিন্তু তৃণমূলের জমানায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের নামে যেই ঠাট্টা মানুষের সঙ্গে করা হয়েছে তারপরে এহেন ঘোষণার গ্রহণযোগ্যতা আর কতটুকুই বা থাকে!

প্রশ্ন অন্য জায়গায়। জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির যে গপ্পো তৃণমূলী বুদ্ধিজীবিরা বহু বছর ধরে শুনিয়ে চলেছেন, তার মধ্যে একটি মস্ত ধোঁকা আছে। তা হল এই যে একদিকে এক ব্যক্তিকে মহৎ করে দেখিয়ে, তিনিই নেতা, তিনিই মাই-বাপ এই কথা প্রচারিত হতে থাকে। অন্যদিকে, উন্নয়ন বলতে বোঝানো হয় মানুষকে কিছু ভাতা পাইয়ে দেওয়া। নিশ্চিতভাবেই আমাদের মতন গরীব দেশ এবং রাজ্যে ভর্তুকি, মানুষের হাত টাকা তুলে দেওয়ার গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে যা উন্নয়নের আখ্যানে ক্রমশ জায়গা করে নিয়েছে তা হল অধিকারের পরিবর্তে সরকারী অনুদান। এই অনুদান নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের পাওয়ার কথা, এবং কিছু ব্যক্তিদের না পাওয়ার কথা। তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীগত পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। তদুপরি, তৃণমূলের মতন একটি ব্যক্তি নির্ভর দল যখন ক্ষমতায় থাকে, সেই ব্যক্তিত্বকে ঘিরে গড়ে ওঠে মোসাহেব শ্রেণি এবং পরজীবিদের দল। এই ছিদ্র ধরেই ঢুকতে থাকে দুর্নীতির বীজ যা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তদুপরি, দলটির নাম যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেস যার অধিকাংশ নেতাই দুর্নীতির অভিযোগে দুষ্ট, এবং যেহেতু দলটির কোনো নীতি আদর্শের বালাই নেই, তাই এই পরজীবি দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষরাই গ্রামের উদ্বৃত্ত এবং সরকারী অনুদান আত্মসাত করতে থাকে বিনা বাধায়। ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে এই শোষণ এবং তোলাবাজির পথ মসৃণ করার উদ্দেশ্যে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটানো হয়েছে, তাই এই নেতাদের শোষণের বিরুদ্ধে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ আরোপ করা সম্ভব হয় না। তাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে আজ একই ছবি - তৃণমূল নেতাদের তোলাবাজি এবং দুর্নীতির প্রতিকার চায় মানুষ। তৃণমূলের ইস্তেহারে যতই ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি থাকুক না কেন, উপরোক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমানে তাদের নেতারা যেই সম্পদ মানুষের থেকে শোষণ করে কেড়েছেন, তার বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষোভে ফুটছেন। তাই ইস্তেহারে বর্ণিত কথাও আর খুব বেশি শোনা যায় না তৃণমূলের প্রচারে।

বিজেপি তাদের ইস্তেহারে যেই বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে তা আরো বেশি সমস্যার। বিজেপি তাদের ইস্তেহারে মূলত দুটি কথা মানুষকে বলছে। এক, তারা বলতে চাইছে যে তৃণমূলের এই জনপ্রিয়তাবাদী অনুদান নির্ভর উন্নয়নের আখ্যান তারা আরো বর্ধিত আকারে মানুষের সামনে নিয়ে আসবে। তাই নারীদের নিয়ে, বিভিন্ন ভাতা নিয়ে ঢালাও প্রতিশ্রুতি রয়েছে বিজেপি-র ইস্তেহারে। উত্তরপ্রদেশের নারীদের কী অবস্থা, বা অন্যান্য রাজ্যে কর্মসংস্থানের কী পরিস্থিতি,পশ্চিমবঙ্গের প্রতিশ্রুতিগুলি কেন বিজেপি সরকার অন্য রাজ্যে চালু করতে পারেনি, এই প্রশ্ন বিরোধীরা করলেও, তা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব খুব বেশি ভাবিত নন, দুটি কারণে। প্রথম, তারা জানে যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি একটু বাড়িয়ে যদি মানুষের সামনে পেশ করা যায়, তাতে ক্ষতি নেই বরং লাভ রয়েছে। ১৫ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কে সাধারণ মানুষের খাতায় দেওয়া হবে, কালো ধন উদ্ধার হবে, অচ্ছে দিন আসবে, ইত্যাদি গালভরা প্রতিশ্রুতি বিজেপি দিয়েছিল, যা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু তাতে তাদের জয়যাত্রা ঠেকানো যায়নি ভারতের অন্যান্য রাজ্যে।

আসলে বিজেপি উন্নয়নের কথা বললেও তার মোক্ষম অস্ত্রটি হিন্দুত্ব এবং সাম্প্রদায়িকতা। ২০২১ সালের ইস্তেহারে যেরকম নাগরিকত্ব আইন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে প্রবর্তন করবে, এবং তা প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং-এই ঘোষণা করা হবে, এই কথা বিজেপি বলছে। এই আইনের বিধি বা রুল্স এখনো তৈরি হয়নি। এই আইনে নাগরিকত্ব পেতে হলে নিজেদেরকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আগে ঘোষণা করতে হবে। এই কথাগুলি বিজেপি চেপে যাচ্ছে। এবং পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে বিজেপিকে এই বিষয় কোনো কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে না। বেআইনি অনুপ্রবেশ বিজেপি বন্ধ করবে এই ঘোষণাও ইস্তেহারে করা হয়েছে। অমিত শাহ বলেছেন বিজেপি ক্ষমতায় এলে নাকি সীমানার ওপার থেকে মানুষ তো দূরস্থান, পাখিও ভারতে আসতে পারবে না। লাগাতার মুসলমানদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাগিয়ে বিজেপি প্রচার করে চলেছে। তাদের বড়-মেজ-ছোট নেতারা প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে যাচ্ছে। কিন্তু বিরোধী পরিসর থেকে এই রাজনীতিকে খুব চ্যালেঞ্জ করতে দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে কিছু গালভরা কথা বাদ দিয়ে, বিজেপি-র অনুপ্রবেশ, সিএএ ইত্যাদি রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কোনো দৃঢ় অবস্থান বিরোধীদের তরফে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি, এনআরসি-সিএএ-এনপিআর ইত্যাদি শব্দগুলিই তৃণমূলের ইস্তেহারে স্থান পায়নি। এই বিষয় মুখ্যমন্ত্রী অনেক বড়ো বড়ো কথা বললেও তারা সরকারে পুনরায় নির্বাচিত হলে এই আইনগুলি পশ্চিমবঙ্গে বলবত হবে না, এই ঘোষণা তৃণমূলের ইস্তেহারে নেই।

দ্বিতীয় যেই বিষয়টি বিজেপি ইস্তেহারে নিয়ে এসেছে তা হল পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির এক নতুন সোপান। বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন মাহিষ্য, তিলি ও অন্য জাতিদের ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে, পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় উন্নয়ন বোর্ড হবে, মতুয়া দলপতিদের মাসিক পেনশন দেওয়া হবে। পরিষ্কারভাবে বিজেপি নেতৃত্ব বলেছেন যে মুসলমানদের ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় এনে হিন্দু ওবিসি-দের অধিকার নাকি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাই বিভিন্ন তথাকথিত বঞ্চিত হিন্দু গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন করবে বিজেপি। এ ছাড়াও পুরোহিতদের ভাতা দেওয়া হবে, দুর্গাপূজাকে আন্তর্জাতিক পর্যায় উন্নীত করা হবে ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি বিজেপি-র ইস্তেহারে রয়েছে। রাজ্যের ২৭ শতাংশ মুসলমান সমাজের জন্য কোনো ঘোষণা বিজেপি-র ইস্তেহারে নেই। বরং ক্রমাগত তাদের বিরুদ্ধে তোষণের অভিযোগ তুলছেন বিজেপি-র নেতারা।

রাজ্যের বামপন্থীরা এবং শহুরে উচ্চবর্ণের চিন্তাবিদদের একাংশ বহু বছর ধরে একটি ধারণা পোষণ করে এসেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত নেই। এখানে যেন সাম্যবাদ এসে গিয়েছে। ধারণাটি যে ভুল তা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে কিছুদিন গেলেই বোঝা যায়। জাতপাতের নামে রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে হয়ত বিহার উত্তরপ্রদেশের মতন হয়নি। কিন্তু এই পরিচিতি সত্ত্বা এবং জাতি বৈষম্য পশ্চিমবঙ্গের সমাজে বহু বছর ধরে বিদ্যমান। কিন্তু বাম আন্দোলন এবং তার মধ্য দিয়ে পার্টি সমাজ গড়ে ওঠার ফলে সমস্ত দ্বন্দ্বই পার্টির মাধ্যমে প্রস্ফূটিত হত। জাতির প্রশ্নে বামপন্থীদের দ্বিধা, এবং মমতার পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির নানান পন্থা গ্রহণ বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গকে পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির একটি গবেষণাগারে পরিণত করেছে। শ্রেণির প্রশ্নের থেকেও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সত্য বোধহয় আর অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবু এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে প্রয়োজন জনমুখী একটি বিকল্প রাজনৈতিক এ্যাজেন্ডা যা মানুষের অধিকার এবং কর্মসংস্থানকে সুনিশ্চিত করতে পারে। বামপন্থীদের ইস্তেহারে সেই দিকনির্দেশ রয়েছে। প্রথমত, গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কথা সুদৃঢ়ভাবে লেখা হয়েছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উন্নতি, গরীবের ক্ষমতায়নের কথাও স্থান পেয়েছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ রোজগার যোজনায় ১৫০ দিনের কাজের গ্যারান্টি এবং শহরেও অনুরূপ রোজগার যোজনার ঘোষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে অতিমারী কবলিত অর্থব্যবস্থায় এহেন পদক্ষেপ মানুষকে গভীর অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণ দেবে। সরকারী শূন্যপদে নিয়োগ, এসএসসি-টেট পরীক্ষাকে নিয়মিত এবং স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের ঘোষণা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাজ্যের অধীন ব্যাঙ্ক তৈরি করার কথাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহু বছর ধরে বামপন্থীরা এই দাবি জানিয়েছেন। এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক একাধিকবার এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। বামেদের ইস্তেহারে এই দাবির অন্তর্ভুক্তি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।তবু, কিছু কথা বলা প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়।

দুটি বিষয়কে বামপন্থীদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে, আরো যেকটি দিন নির্বাচনের বাকি রয়েছে সেখানে প্রচারে সামনের সারিতে নিয়ে আসা উচিত। প্রথম হল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বিষয়টি। শুধুমাত্র রাজ্যের করের অংশ বাড়ানোর দাবি এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। জিএসটি আইন যেভাবে প্রবর্তন করা হয়েছে, যেভাবে এই আইন রাজ্যগুলির কর সংগ্রহের অধিকার হরণ করে বিকল্প অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই কথা জোর গলায় মানুষের সামনে নিয়ে আসতে হবে। মনে রাখা উচিত পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবিকে দেশের রাজনৈতিক এ্যাজেন্ডায় নিয়ে আসে ১৯৮০-র দশকে। তারপরে এই দাবি ফিকে হয়ে আসে। কিন্তু পুনরায় তা উত্থাপন করার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি গোটা দেশে যেই আর্থিক নীতি গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে বামেদের আরো সোচ্চার হতে হবে। কৃষি আইন, সংশোধিত শ্রম আইন, বেসরকারীকরণ, ব্যাঙ্ক-বিমা সংস্থাগুলিকে বেচে দেওয়ার সর্বনাশার নীতি মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। কথাগুলি যত জোরের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে বামপন্থীরা বলবেন তত বিজেপি ও তৃণমূলের পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি হোঁচট খাবে।