আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২১ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

চার দিনের ‘সুখ’

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


নেট দুনিয়ায় ওএমজি মানডে লিখে সার্চ মারলে বেশ কিছু ছবি ভেসে আসে। দেখা যায় রাস্তায় একটা কুকুর শুয়ে আছে দুঃখী মুখ নিয়ে। চোখের চাহনিতে প্রাণ নেই মোটে। দেখতে পারি, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে মিকি মাউস। ছবি আসে, একটি শিশু দু'হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে আছে একটা ছোট্ট চেয়ারে। বলছে, প্রতি সপ্তাহে এই সোমবার দিনটা আসার কি খুব দরকার? দুটো হনুমানের আঁতকে ওঠা মুখও দেখতে পাওয়া যায়। স্ক্রিন জুড়ে ধারালো ফন্টে খেলা করে, ওএমজি। প্রসঙ্গত, এই কথার পুরো মানে হল ওহ মাই গড।

শনি-রবির পরে এই সোমবার দিনটা নিয়ে আমাদের মনে নানা ভীতি উঁকি মেরে যায়। আবার সেই একটা পুরো সপ্তাহ। আবার ছ'দিনের ঘানি টানা। সৌভাগ্যবান যাঁরা, তাঁদের পাঁচ দিন। সন্দেহ নেই, সোমবার থেকে সপ্তাহান্তের দিকে চোখ রেখে আমরা একটা একটা করে দিন গুণতে থাকি। কবে আসবে শনিবার। কিংবা রবিবার। সম্প্রতি একটা খবর এসেছে। এর মধ্যে গোলাপ আছে, সঙ্গে কাঁটাও। তাই মুখের হাসি চওড়া হওয়ার পাশাপাশি একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নও ইদানীং পেন্ডুলামের মত দুলতে শুরু করেছে।

দিল্লি বলছে, শ্রমের আইন অর্থাৎ লেবার কোডে পরিবর্তন আসবে। ছ'দিন তো দূর কি বাত, পাঁচও ইতিহাস হল বলে। এ বার থেকে নাকি সপ্তাহে চার দিন কাজ করলেই যথেষ্ট। সপ্তাহ শব্দটার মধ্যে কাঁচি চালিয়ে কাজের দিনের সংখ্যা চার দিনে নিয়ে আসায় সংস্থাগুলোর কাছে পূর্ণ অধিকার থাকবে। কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু সংস্থার মালিকের কাছে এ হবে এক ইচ্ছেমাখা টুল। মানে চাইলেই করা যায় আর কি। এর ফলে বেশ কিছু সংস্থার কর্মীদের মনের মধ্যে ইতিমধ্যেই বইতে শুরু করেছে তাজা হাওয়া। তবে মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরা বলছেন, লাইনগুলোর মধ্যের অর্থ ধরতে না পারলে তা হবে ঘোর বিপদ।

শনি রবির জন্য যাঁদের মন আনচান করে, সঙ্গে আরও একটা দিন যোগ হলে দীঘার বদলে পুরী হয়। অথবা বকখালির বদলে চাঁদিপুর। সাপ্তাহিক অক্সিজেনের আটচল্লিশ ঘন্টার সঙ্গে আরও চব্বিশ ঘন্টা যোগ হলে মনের মধ্যে বয়ে চলা আনন্দধারার বেগ বাড়ে। বুকের মধ্যে ভ্রমরের গুণগুণ আরও তীব্র হয়। নতুন শ্রম আইন কিন্তু সপ্তাহে কাজ করার মোট সময়ের কোনও পরিবর্তন আনেনি। করতে হবে ৪৮ ঘন্টা কাজ। সাত দিনের মধ্যে তিন দিন চলে গেলে হাতে থাকে চার দিন। ফলে প্রতিটি কাজের দিনে কাজের ঘন্টার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ ঘন্টা। শুনলে হয়তো অনেকে হাসবেন, কিন্তু মানবসম্পদের ব্যাকরণ বলে, সপ্তাহে কোনও কর্মীকে সরকারিভাবে ৪৮ ঘন্টার বেশি কাজ করানো যায় না।

নয়া এইচআর রুলবুক অফিস ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে, অন্তত খাতায় কলমে। অন্যদিকে দুনিয়াজোড়া কর্মসংস্কৃতির হাল আরও বেশি কাজমুখী হওয়ার বার্তা দেয়। একটা কথা তো দিব্যি শোনা যায় আজকাল - ওভারটাইম এপিডেমিক। মানে কাজের সময়ের বাইরে গিয়েও কাজ করে যাওয়া, অন্তহীন স্রোতের মতো। ক্যালকুলেটর নিয়ে যদি হিসেব করতে বসা যায়, দেখা যাবে প্রতিদিন গড়ে যত ঘন্টা করে বেশি সময় দিতে হয় অফিসের কাজে, তাকে বছরের কাজের দিনগুলোর সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে এমন একটা উদ্ভট সংখ্যা আসে, যার মধ্যে আরামে ঢুকে যেতে পারে আরও বেশ কিছু দিন, যার জন্য পকেটে ঢোকেনি একটা টাকাও। অর্থাৎ, এই পুরো কাজের সময়টাই আসলে হয়ে গিয়েছে আনপেইড। এসব শুনে যাঁদের ভুরু কুঁচকোয়, তাঁরা আরও বেশি করে পরিবারের জন্য সময় বরাদ্দ করার দাবিতে গলা ফাটান। বলেন, এত বেশি কাজ করলে মানুষ যে যন্ত্রদাস হয়ে যাবে ক্রমশ। বলেন, নিজের জীবন কই? প্রশ্ন তোলেন, কাজের দিনের সংখ্যা চারে নামিয়ে আনা যায় না?

সাইট্রিক্স নামে একটি বিখ্যাত মার্কিন সংস্থা ‘দ্য ফিউচার অফ দ্য ওয়ার্কিং উইক’ অর্থাৎ সপ্তাহে কাজের দিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে জানা গিয়েছে, বিশ্বজুড়ে যত মানুষ চাকরি করে খান, তাঁদের ৪৭ শতাংশকেই কাজের সময়ের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। প্রতি সপ্তাহে গড়ে খাটতে হয় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪ ঘন্টা ৩৬ মিনিট বেশি। এ কথা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে, কোনও কর্মীর সাপ্তাহিক এই সাড়ে চার ঘন্টার পরিশ্রম অধিকাংশ সংস্থার কাছেই একেবারে মূল্যহীন। মানে, এর জন্য টাকা গুণতে হয় না। কর্মীরাও খেটে যান। মাথার উপরে খাঁড়ার মতো ঝুলতে থাকে চাকরি হারানোর ভয়। আর এই ভয়ের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন সংস্থার মালিকরা।

পরিবেশপ্রেমী মানুষেরা আবার কাজের দিনের সংখ্যা কমানোর নেপথ্যে অন্য নানা যুক্তি দেখান। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, পরিবেশে কালি মাখানোর জন্য বেশি কাজের সময় অন্যতম খলনায়ক। যুক্তিটা খুব সোজা। কাজের দিনের সংখ্যা বাড়বে যত, তত বেশি গণপরিবহন চলবে, তত বেশি মানুষ নিজেদের গাড়ি নিয়ে অফিসমুখী হবেন। যতক্ষণ অফিস চালু থাকবে, শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রগুলো ততক্ষণ গা ঘামাবে। উঠবে, নামবে লিফট। এর ফলে বিদ্যুৎ পুড়বে বেশি, নানা যন্ত্র বিষাক্ত গ্যাস উগরে দেবে দ্বিগুণ উৎসাহে। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত যা হবে তা হল পরিবেশ, আমাদের মাদার আর্থ। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম এর সঙ্গে যোগ করে দিয়েছে আরও দুটো লাইন। তারা বলছে, বেশি কাজ করলে মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরের সময়টাও আনুপাতিক হারে কমবে। বাড়ির বাইরে থাকতে হবে বেশি। নিজের রান্না নিজেই করার উপরে ঝোঁক আরও কমবে। জাঙ্ক ফুডের প্রতি আসক্তি বাড়বে। আর কে না জানে, জাঙ্ক ফুড-প্রেম জন্ম দেয় নানা শরীরী জটিলতার। ডায়াগস্টিক সেন্টারের কর্তাব্যাক্তিরা এসব জানতে পেরে মুচকি হাসবেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, বিলিং কাউন্টারের লাইনটা লম্বা হওয়া হয়তো শুধু সময়ের অপেক্ষা।

যাঁরা সপ্তাহের ছ'দিনই উদয়াস্ত কাজ করে ক্লান্ত, তাঁদের কাছে পাঁচ দিনের সপ্তাহটাই এক রূপকথার মতো লাগে। চার দিনের কথা ভাবলে হয়তো রাতে ঘুম আসবে না আনন্দে। অথচ পাঁচ দিনের কাজের সপ্তাহ চালু হওয়ার পিছনে কোনও মানবসম্পদ আধিকারিকের মহানুভবতা ছিল না। যা ছিল, তা হল ধর্মসংকট। ১৯০৮ সালে নিউ ইংল্যান্ড মিল নামে এক মার্কিন সংস্থা প্রথম পাঁচ দিনের সপ্তাহ চালু করার কথা ভাবে। কারখানাতে যাঁরা ইহুদী কর্মচারী ছিলেন, তাঁরা শনিবার ছুটি ভোগ করতেন, কাজ করতেন রবিবার। এমন নিয়মে চটে যান ওখানকার কিছু খ্রিস্টান শ্রমিকরা। প্রতিবাদ জানান। ক্রমাগত প্রশ্নের মুখে ও কর্মী অসন্তোষে ম্যানেজমেন্ট পিছু হটতে বাধ্য হয়। দু'পক্ষেরই মন রাখতে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ছুটি করে দেওয়া হবে শনি-রবি, এই দু'দিনই। পৃথিবীতে পাঁচ দিনের সপ্তাহের দরজা খুলে যায় সম্ভবত এর ফলেই। এর ১৮ বছর পরে, ১৯২৬ সালে বিখ্যাত মোটর প্রস্তুতকারক সংস্থা ফোর্ড মোটর কোম্পানির মালিক হেনরি ফোর্ড সমস্ত কারখানা ও অফিসে শনি ও রবি, দু'দিন ছুটি চালু করে দেন। ক্রমশ এই নিয়ম বলবৎ হয়ে যায় অধিকাংশ সংস্থাতেই।

দেশের শ্রম আইনে চার দিনের সপ্তাহ চালু হলে তা কতগুলো সংস্থা মেনে চলার ইচ্ছে দেখাবে, তার উত্তর হয়তো সময়ের কাছে রয়েছে। সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা যদি বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করতে হয়, তা হলে একজন কর্মীকে প্রতিটি কাজের দিনে অফিসে থাকতে হবে ১২ ঘন্টা। অনেকে এ খবর জানতে পেরে বলবেন, এ আর এমন কি! এখনই তো দিনে ১১ ঘন্টা করে কাজ করি, সোম থেকে শনি প্রতিদিন। সাইট্রিক্সের সমীক্ষা থেকে উঠে আসা একটা তথ্য কিন্তু বেশ ভয়ের। কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, চার দিনের সপ্তাহ চালু হয়ে গেলে অবধারিতভাবে কোপ পড়বে বেতনে। অর্থাৎ, কাজের দিন কমিয়ে এনে সংস্থা পয়সা বাঁচাবে। ‘একদিন অফিস করা কমিয়ে দিলাম’ বলে ১০ শতাংশ বেতন ছেঁটে দেওয়ায় শমন জারি করা যায় নিশ্চিন্তে। অফিসে কাজের দিন কমালে বিদ্যুতের খরচ বাঁচে, চা-কফির টাকাটা পকেট থেকে বেরোয় না, বেঁচে যায় স্টেশনারির খরচ। এর সঙ্গে অফিস চালানোর আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করলে সেই টাকার অঙ্কটা যে কোনও মাঝারি মাপের সংস্থার কাছেও মাসে কয়েক লক্ষ টাকা ছুঁয়ে ফেলে। ফলে ভাবতে বাধা নেই, এই সুযোগ লুফে নেবে বেশ কিছু সংস্থা। কর্মীরা ভাবছেন, ছুটি তো বাড়ল এক দিন, নয়া এইচআর পলিসির কোপে হয়তো বেতনও কমে গেল ১০ শতাংশ, কিন্তু কাজ কমবে তো? এই প্রশ্নের কোনও সন্তোষজনক উত্তর আপাতত তাঁরা পাচ্ছেন না।

কোভিডের আঁচড়ের দাগ এখনও স্পষ্ট। কাজের বাজারের পচে যাওয়া হাল নিয়ে গত কয়েক মাস যে খবর উঠে আসছিল, ভোটের দামামা বাজার ফলে তেমন খবর এখন মুখ লুকিয়েছে। আমাদের প্রত্যেকেরই চেনা পরিচিতের বৃত্তের মধ্যে কাজ হারানো লোকের সংখ্যাটা কম হয়। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার দিনের সপ্তাহ ঐচ্ছিকভাবে চালু হলে তা কর্মীদের আনন্দ দেবে যত, তার থেকে অনেক বেশি শোষণ করবে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের নতুন কর্মসংস্কৃতিতে অফিস ও বাড়ির মধ্যে গেঁথে দেওয়া কাচের দেওয়ালটা অনেক আগেই ভেঙেচুরে গিয়েছে। বাড়িতে বসে দিনে পনেরো ঘন্টা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অপ্রতুল নয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালে কানে আসছে, মাসের শেষে যে সত্তর শতাংশ মাইনেটা পাচ্ছ, এই অনেক। অতএব চুপচাপ মেনে নাও, মুখ বুজে কাজ করো, না পারলে সরে যাও, বাইরে লাইন লেগে আছে। চার দিনের সপ্তাহ হয়তো সংস্থাগুলোর কাছে রাঙা চোখ দেখিয়ে কর্মী-ম্যানেজমেন্টের আরও একটা ধারালো অস্ত্র তুলে দিল। বহু মানুষের কপালে বলিরেখার কারণ এখন এটাই।

আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশন অর্থাৎ আইএলও সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি কোনও কর্মচারীকে কাজ করালে তা ব্যাঁকা চোখে দেখে। ভারতের অধিকাংশ অসরকারি সংস্থাই এমন বিধিকে সম্মিলিত বুড়ো আঙুল দেখায়। সুইস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক ইউবিএস ২০১৮ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। জানা গিয়েছিল, কাজ করার নিরিখে বিশ্বের ৭৭টা শহরের মধ্যে সবার উপরে আছে মুম্বই। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীর একজন কর্মী বছরে কাজ করেন গড়ে ৩৩১৫ ঘন্টা। রোমে তা ১৫৮১ ঘন্টা। প্যারিসে ১৬৬৩, কোপেনহেগেনে ১৭১২। অর্থাৎ, প্রডাক্টিভিটি যাই থাকুক, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করতে ভারতীয়রা এমনিতেই দৌড়ে দুঃখজনকভাবে বেশ এগিয়ে। দেশের অন্যান্য মেট্রো শহরও মুম্বইয়ের থেকে বেশি পিছিয়ে নেই। চার দিনের সপ্তাহ সেই যন্ত্রণার কতটা উপশম করতে পারবে তা নিয়ে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়।

খাটুনির এক দিন কমবে ভেবে যাঁদের বুকে দোলা দিচ্ছিল কাশফুল, তাঁরা আরও একবার ভেবে দেখতে পারেন। হয়তো অফিসের ওয়ার্কস্টেশন থেকে সাময়িক মুক্তি মিলবে, কিন্তু ক্লান্তির যে ট্যাটুটা মনের মধ্যে লেপ্টে রয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও যা তুলতে প্রতিদিন ব্যর্থ হই আমরা, এই নয়া নিয়মে তা আরও গাঢ় হয়ে যাবে না তো?