আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২১ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর আজব নিয়ম!


দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অদ্ভুত একটা পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা। সম্প্রতি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের অনুমোদিত হ্যান্ডবুকের একটি নির্দেশিকায় অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিকাল এডুকেশন জানিয়ে দিয়েছে যে এরপর থেকে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে অঙ্ক এবং পদার্থবিদ্যাকে আবশ্যিক বিষয় হিসাবে না নিলেও চলবে। দ্বাদশ শ্রেণির পরে বিই, বি-টেক কোর্সগুলিতে ভর্তির জন্য এত দিন গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন আবশ্যিক ছিল। এআইসিটিই-র নয়া নির্দেশ অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স, জৈব প্রযুক্তি, কৃষিবিজ্ঞান, বিজ়নেস স্টাডিজ়, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ১২টি বিষয়ের মধ্যে যে-কোনও তিনটি বেছে নিতে হবে পড়ুয়াদের।

এআইসিটিই চেয়ারপার্সন বলেছেন যে বায়োটেকনলজি, টেক্সটাইল ও এগ্রিকালচার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে বিকল্প থাকবে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও অঙ্ক দ্বাদশ শ্রেণিতে না পড়ার। তাদের ব্রিজ কোর্স করলেই চলবে। তবে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো কোর্সের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটবে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজ্য সরকাররা চাইলে পুরনো নিয়মেই চলতে পারে। তাতে সমস্যা নেই। তারা চাইলে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও অঙ্ক বাধ্যতামূলক রাখত পারে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য। কিন্তু তাহলে কি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রবেশিকা পরীক্ষাতে অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যার পরীক্ষা নেওয়া হবে না? কাউন্সিল থেকে জানানো হয়েছে যে প্রবেশিকা পরীক্ষা আগের মতই থাকবে। তার মানে, এই পরীক্ষায় পাশ করতে গেলে অংক ও পদার্থবিদ্যা পড়তেই হবে। তাহলে এরকম অদ্ভুত পরিকল্পনার অর্থ কী? প্রবেশিকার জন্য যে বিষয় পড়তেই হয়, সেটা ক্লাস টুয়েলভে ঐচ্ছিক হয়েই বা কী লাভ হল?

নিয়মের জটিল ফাঁক-ফোকরের বিষয় যদি বাদও দিই, তাহলেও যেটা প্রশ্ন থাকে, নীতিগত প্রশ্ন - প্রযুক্তিবিদ্যার খুঁটিনাটি বিষয়ে দক্ষ হতে গেলে অংক একটি আবশ্যিক শর্ত ছিল এতদিন, শুধুমাত্র জটিল গাণিতিক সমীকরণে দক্ষতালাভই যার উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল একটি বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী মনন তৈরি করা, যা প্রযুক্তিবিদ্যার প্রথম শর্ত। এবার থেকে কি তাহলে একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন মিস্ত্রির কোনও পার্থক্যই থাকল না? অথবা, এটাই কি বিজেপি-র পরিকল্পিত শিক্ষার গৈরিকীকরণের একটা ধাপ, যেখানে প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন কিছু টেকনোক্র্যাট তৈরি হবে, এবং পেছনে চলে যাবে বিজ্ঞানসম্মত মানসিকতা? আরও একধাপ পিছিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কারাচ্ছহন্ন মধ্যযুগের দিকে যাত্রা, যেটা সঙ্ঘপরিবার ও বিজেপির আদর্শ ছিল এতকাল?

তার মানে, এই শিক্ষানীতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যে একটা স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দিচ্ছে। বলে দিচ্ছে, বিজ্ঞানচেতনার আর দরকার নেই, শুধু প্রযুক্তি জানলেই হবে। আমাদের জীবনে গ্যালিলেও বা নিউটনকে দরকার নেই, কিন্তু আইফোন টেন ব্যবহার করবার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। কারণটা সহজবোধ্য। বিজ্ঞানসম্মত মানসিকতা মানেই প্রশ্ন করতে শেখা, বিজেপি-র গৈরিকিকরণের বিরোধিতা। তাই যেনতেন প্রকারেণ তাকে আটকাও। মোটা মাইনের চাকুরে তৈরি করো যারা নয়া উদারনীতির স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকবে, যারা হবে নরেন্দ্র মোদীর গুরূত্বপূর্ণ সমর্থনের স্তম্ভ, ঠিক যেরকম ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের একটা বড় অংশ মোদীকে ভোট দিয়ে এসেছে ২০১৪ সাল থেকেই, যারা মোদীর উত্থানের পেছনে একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে এসেছে। কিন্তু এই অংশটাকে কিছুতেই যুক্তিবাদী ও সচেতন হতে দিলে চলবে না। তাই অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যার গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে শুধুমাত্র কিছু প্রাথমিক জিনিসপত্র পড়িয়ে কিছু কর্মচারী তৈরিই লক্ষ্য। যেন আধুনিক মেকলের নয়া শিক্ষানীতি!

প্রতিবাদ হয়েছে শিক্ষক, ছাত্রসমাজ ও প্রযুক্তিবিদদের থেকে। প্রযুক্তি একটি জটিল ও উন্নত বিদ্যা, এসব ছেলেখেলা কে তার গুরুত্ব কমাবার অর্থই হল দেশের একটি মূল ভিত নষ্ট করে দেওয়া। পদার্থবিদ্যা ভাল করে না শিখে ইলেকট্রিকাল এঞ্জিনিয়ার হল যে ছেলেটি বা মেয়েটি, সিভিল এঞ্জিনিয়ার হল যে বা যারা, গণিত না জেনেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে বিশেষজ্ঞ হল যে তরুণ, তাদের হাতে না থাকবে একটি ব্রিজ বা একটি নির্মীয়মাণ বহুতলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত, না হবে একটি বহুজাতিক কোম্পানির ভবিষ্যৎ শক্তপোক্ত। দেশজুড়ে প্রতিবাদ এবং হাসি-মশকরার পাত্র হয়ে গেছে অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিকাল এডুকেশন। কিছু লজ্জাবোধ এখনও তাদের হয়তো অবশিষ্ট আছে। তাই প্রতিবাদের সামনে পড়ে তারা জানিয়েছে যে আপাতত এই নির্দেশিকা বাতিল করা হয়েছে। তবে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষক ও ছাত্রদের সচেতন থাকতে হবে যাতে অন্য কোনো পথে প্রযুক্তির শিক্ষার ক্ষতি না করতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার এবং অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিকাল এডুকেশন।