আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২১ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

অন্দরের প্রতিরোধ


দেশজুড়ে চলছে ব্যাঙ্ক ধর্মঘট। ১৬ মার্চ একটানা আটচল্লিশ ঘন্টার ব্যাঙ্ক ধর্মঘট শেষ হলেই ১৭ মার্চ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা সংস্থাগুলির কর্মচারী আধিকারিকদের ধর্মঘট। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ মার্চ জীবন বিমা করপোরেশন অর্থাৎ এলআইসি কর্মচারী আধিকারিকদের ধর্মঘট। সবমিলিয়ে আর্থিক বছরের শেষ পক্ষে একটানা চারদিন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমা পরিষেবা ব্যবস্থার কাজকর্ম সম্পূর্ণ বিঘ্নিত হওয়া সত্ত্বেও সরকার নির্বিকার। আর প্রচারমাধ্যম নিরন্তর সম্প্রচার করে চলেছে যে এর ফলে সাধারণ মানুষের কত ক্ষয়ক্ষতি হবে।

কোথাও কিন্তু বলা হচ্ছে না যে নিজেদের বেতন বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থার কর্মচারী আধিকারিকরা ধর্মঘটের পথে পা বাড়াননি। তাঁদের এক এবং একমাত্র দাবি দেশের স্বার্থে রাষ্ট্রের ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থাগুলির বি-রাষ্ট্রীয়করণ ও বিক্রি বন্ধ করতে হবে।

১৫ এবং ১৬ মার্চ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে দেশ জুড়ে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে কর্মচারী ও আধিকারিকদের সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ ইউনাইটেড ফোরাম অব ব্যাঙ্ক ইউনিয়নস্। সরকারের উদ্দেশে তাঁদের বার্তা, কেন্দ্রের আনা তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যেমন সর্বশক্তি নিয়ে কৃষকেরা ঝাঁপিয়েছেন, বেসরকারি সংস্থাকে ব্যাঙ্ক বিক্রির উদ্যোগ বন্ধ না-হলে তেমনভাবেই তাঁরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন। প্রয়োজনে লাগাতার ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের ডাকও দেওয়া হবে, জানিয়েছে অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক অফিসার্স কনফেডারেশন (আইবক) এবং অল ইন্ডিয়া স্টেট ব্যাঙ্ক অফিসার্স ফেডারেশন (আইসবফ)। তাদের দাবি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে দক্ষ হাতে পরিচালনার ব্যবস্থা না-করে বিক্রির এই কৌশলে আখেরে ক্ষতিই হবে কর্মী ও গ্রাহকদের। ফলে সেটা আটকাতে রোদ, ঝড়, জল উপেক্ষা করে একটানা প্রতিবাদ ছাড়া পথ নেই।

সরকারকে তাঁদের কথা শুনতে বাধ্য করার জন্য কৃষকদের আন্দোলন যে উৎসাহ জোগাচ্ছে, সে কথা বলছে ব্যাঙ্ক ও বিমা পরিষেবার সঙ্গে জড়িত কর্মী-আধিকারিকদের বিভিন্ন সংগঠন। সরকারকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সম্মত না করানো গেলে চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনের ঝাঁঝ বাড়াতে লাগাতার ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। সেই পর্যায়ে গ্রাহক-সহ ব্যাঙ্ক শিল্পের বাইরের সকলের সহযোগিতা চাওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। দিল্লির সীমানায় অবস্থানরত কৃষকরাও ব্যাঙ্ক-বিমা ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছেন। ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চ ইতিমধ্যেই ব্যাঙ্ক ও বিমা শিল্পে ধর্মঘটের সমর্থনে পথে নামার কথা জানিয়েছে।

২০০৬ সালে স্টেট ব্যাঙ্কে টানা ৭ দিন ধর্মঘটের পরে পেনশন বৃদ্ধির দাবি আদায়ের নজিরের কথা অনেকেই ভুলে যাননি। এবারের আন্দোলনের গুরুত্ব অনেক বেশি। ব্যাঙ্ক-বিমা পরিষেবার রাষ্ট্রীয় মালিকানা রক্ষার স্বার্থে গড়ে উঠেছে এই আন্দোলন। কোনো আর্থিক দাবিদাওয়া নয় সরাসরি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করার জন্য এই যৌথ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

এতদিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অন্তত ৫১% অংশীদারি নিজেদের হাতে রেখে বাকিটা বিক্রির কথা বলত সরকার। এ বার গোটা ব্যাঙ্কই বেচে দিতে ময়দানে নেমেছে। শুধু ব্যাঙ্ক নয়, বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা থেকেও হাত তুলে নিয়ে বেসরকারি সংস্থার খুঁটি শক্ত করতে চায় সরকার।

আন্দোলনকারীদের মতে সরকারের এই পরিকল্পনা রুখতে জোট বাঁধবে ব্যাঙ্ক-সহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। যৌথ আন্দোলন সংগঠিত করতে আলোচনা শুরু করার সময় এসে গেছে। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যে ভাবে মাটি কামড়ে কৃষকেরা আন্দোলন করছেন সেই ধাঁচে প্রতিবাদ বহাল রাখার চেষ্টা চলছে।

রাজকোষে টাকা ভরতে ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থার বি-রাষ্ট্রীয়করণ তথা বিলগ্নিকরণকে বহুদিন ধরেই নিশানা করা হয়েছে। এইবারের বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সংখ্যা আরও কমানোর পাশাপাশি দু’টি ব্যাঙ্ক এবং একটি বিমা সংস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এলআইসি-তে সরকারের হাতে থাকা শেয়ারের একাংশও বাজারে বিক্রি করার প্রস্তাব আছে। তার পরেই দেশ জুড়ে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন এই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।

ধর্মঘটীরা শুধু নিজেদের চাকরির নিরাপত্তার স্বার্থে বি-রাষ্ট্রীয়করণের বিরোধিতা করছেন না। এতে স্বার্থহানি হবে গ্রাহকদেরও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্যাঙ্কে গ্রাহকদের ৫ লক্ষ টাকা আমানতে বিমার সুবিধা মিলবে বলে জানানো হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাঙ্কে তালা ঝুললে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পাবেন গ্রাহক। কিন্তু যাঁদের অনেক বেশি টাকা জমা আছে? বিশেষত প্রবীণ নাগরিকদের। তাঁদের কী হবে? মানুষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা রাখেন তাতে কার্যত সরকারের (সভরিন) গ্যারান্টি রয়েছে, এই ভরসায়। ব্যাঙ্ক বি-রাষ্ট্রীয়করণ হলে ওই গ্যারান্টি থাকবে না।

একই ভাবে সাধারণ বিমা পরিষেবা ব্যবস্থায় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার পরিচালিত সাধারণ বিমা প্রকল্পে ৮২ শতাংশ পলিসিই রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা সংস্থাগুলি করিয়েছে। গরিব মানুষদের জন্য প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনার মতো প্রকল্পে রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা সংস্থাগুলি লোকসান হজম করেও পরিষেবা দিচ্ছে। বেসরকারি বিমা সংস্থাগুলির কাছ থেকে এই সুবিধা আশা করা যায় না। শুধুমাত্র এলআইসি-রই ৪০ কোটি পলিসি রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিসেবেই দেশের সমস্ত প্রান্তের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে গ্রাহকেরা চোখ বুজে সংস্থার উপর আস্থা রেখেছেন। সংস্থার বি-রাষ্ট্রীয়করণ, হলে তাঁদের সঙ্গে বিশ্বসঘাতকতা করা হবে।

এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার সময়ই ঘোষণা করা হয়েছিল যে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক এবং একটি রাষ্ট্রায়ত্ব বিমা সংস্থা ২০২১–২২ অর্থবর্ষেই বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে৷ তার জন্য কোন কোন সংস্থাকে বেছে নেওয়া হবে, তা এখনও ঘোষণা হয়নি৷ কিন্তু শেষ খবর, শুধুই দুটি ব্যাঙ্ক এবং একটি বিমা সংস্থা নয়, সরকারের 'নীতি আয়োগ' কমপক্ষে এক ডজন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার তালিকা তৈরি করেছে, যেগুলির খুব শিগগিরই বি-রাষ্ট্রীয়করণ হবে।

সংযুক্তিকরণের পর এখন ১২টা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আছে। প্রথমে পাঁচটা সহযোগী ব্যাঙ্ককে স্টেট ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, তারপর ব্যাঙ্ক অফ বরোদার সঙ্গে বিজয়া ব্যাঙ্ক, দেনা ব্যাঙ্ককে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় পর্বে ‘‌মেগা মার্জার’-এর নামে ১০টা ব্যাঙ্ককে চারটে ব্যাঙ্কে পরিণত করা হয়েছে৷ ফলে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের সংখ্যা এখন মাত্র বারোটি। এর মধ্যে যে কোনও দুটো ব্যাঙ্ক বেসরকারি হাতে গেলে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের সংখ্যা দাঁড়াবে দশ। কিন্তু সেখানেই শেষ হবে না, কারণ সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে যে, সব ক্ষেত্রেই নূন্যতম এক এবং সর্বোচ্চ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার দায়িত্ব সরকার বহন করবে৷ অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও কমবে।

এর পাশাপাশি আরও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠে আসছে৷ ছোটো ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিকরণ হচ্ছে এই যুক্তিতে, যে তাদের কারও কারও অনুৎপাদিত সম্পত্তির পরিমাণ এতই বেড়ে গেছে, যে তুলনায় ভালো ব্যবসা করা ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাদের না জুড়ে দিলে তাদের পক্ষে পরিষেবা দেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু যে কারণে ব্যাঙ্কগুলির নাভিশ্বাস উঠছে, অর্থাৎ অনাদায়ী ঋণ, তা উদ্ধারে কি সরকার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? বরং দেখা যাচ্ছে, দেশের বড় শিল্পপতিরা, যাদের অনেকেই আবার বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ, ব্যাঙ্কের থেকে ধার নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না৷ এই ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা উদ্ধারের জন্য সরকারের কার্যত কোনো পরিকল্পনা দেখা গেছে কি? উলটে তাদের নামের তালিকা অবধি প্রকাশ্যে জানাতে নারাজ সরকার৷

সবমিলিয়ে সরকারের ঔদ্ধত্য এবং অহঙ্কারী মনোভাবের ফলে দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে মানুষের জীবন ও জীবিকা আজ বিপদাপন্ন। চলমান কৃষক আন্দোলন প্রতিবাদের একটা দিশা দেখিয়েছে। ব্যাঙ্ক ও বিমা পরিষেবার কর্মী-আধিকারিকরা প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর তাগিদে গড়ে তুলেছেন অন্দরের প্রতিরোধ। আগামী দিনে সমাজের অন্যান্য অংশের ক্ষোভ একত্রিত হয়ে সুসংহত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেই সমস্ত ক্ষেত্রের বি-রাষ্ট্রীয়করণের প্রস্তাব এবং সিদ্ধান্ত প্রতিহত করা যাবে।