আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

হিন্দুত্বঃ মুখ আর মুখোশের গল্প

অনুরাধা রায়


ওদের মুখের সামনে লেপ্টে থাকে মুখোশ। মুখোশটা ওদের খুব দরকার, আবার ওটা যে মুখোশ সেটা বুঝিয়ে দেওয়াও দরকার। মুখটা যাদের পরিচিত ও প্রেয় তারা এতে আশ্বস্ত হয়; যারা মুখটা চেনেই না তারা মুখোশের চাকচিক্যে ভোলে; আর বিরোধীরা চালাকিটা যদিবা বোঝে কিছু করে উঠতে পারে না। বিরোধীদের সঙ্গে, মানে গণতান্ত্রিক পরিসরে, যখন ওরা কথা বলে, তখন তো মুখোশটা পরেই থাকে। কাজেই বিরোধীরাও তর্কবিতর্ক যাকিছু তা ঐ মুখোশের সঙ্গেই চালায়, এইভাবে ওদের গণতান্ত্রিক শংসাপত্র দেয়, গণতান্ত্রিক পরিসরে ওদের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে দেয় (টিভির সান্ধ্য আসর এর একটা বড়ো দৃষ্টান্ত)। বিরোধীদের যেটা উচিত তা হল, ওদের মুখোশটাকে টান মেরে খুলে দেওয়া। খুলে দিয়ে ওদের হিংস্র চোখ, কষ বেয়ে গড়ানো রক্তসহ মুখটাকে অনাবৃত করা। অনাবৃত করলে অবশ্য দেখা যাবে সে শুধু হিংস্রই নয়, বিষম বিরূপ একটা মুখ, যা জন্মগত ভাঙাচোরা জোড়াতাপ্পির বিকৃতি বহন করছে। এই মুখ আর মুখোশকে একটু চেনানোর জন্যেই আজকের লেখা।

মুখে স্বদেশি, মূলে বিদেশি একটি মতাদর্শ

মুখের কাঠামো মানে মূল মতাদর্শটা অবশ্য খুবই সহজ আর স্পষ্ট। হিন্দুরা এই দেশের আদি অধিবাসী, দেশটা হিন্দুদের, হিন্দুজাতির। হিন্দুদের সংহত করে তার ভিত্তিতে স্থাপন করতে হবে হিন্দু জাতিরাষ্ট্র। সেখানে অহিন্দুরা বিদেশি বই নয়, তাদের যদি এদেশে থাকতেই হয় হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করে, হিন্দুদের অধীনে থাকতে হবে। এই মতাদর্শটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে দুটো আদর্শায়ন প্রক্রিয়া দরকার ছিল। ১)একটাই বিধিবদ্ধ, একশিলাবৎ হিন্দুত্বের ধারণা তৈরি করা। ২) বিশেষ একরকম আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের আবেগ জাগানো। হিন্দুরাষ্ট্রের আদর্শায়নের এই দুটি দিকই বিদেশি ভাবভাবনা দিয়ে অনুপ্রাণিত।

প্রথম কাজটা সহজ করে দিয়েছিলেন Monier Monier Williams-এর মত ইউরোপের প্রাচ্যবাদী পণ্ডিতরা (উল্লেখ্য তাঁর বই Hinduism and Its Sources)। এমনিতে তো প্রাক-আধুনিক ভারতে কোনো বিশেষ ধর্ম বা সংস্কৃতি অর্থে হিন্দু ধারণাটার চল একেবারেই ছিল না। উনিশ শতকের অনেকটা সময় জুড়ে অনেকেই ছিলেন যাঁরা নিজেদের বৈষ্ণব ভাবতেন, কি শাক্ত ভাবতেন, হিন্দু মোটেই নয়। অ-মুসলমান অর্থে হিন্দু শব্দের যে একটা অর্থ মধ্যযুগ থেকে তৈরি হয়ে উঠছিল, তার মধ্যে অনেকরকম ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণই ছিল, যাদের পারস্পরিক বিরোধিতা আর সংঘাতের ইতিহাস সুবিদিত। জাতিভেদপ্রথাও হিন্দুদের মধ্যে বিরাট বিভাজনের উৎস। আর এই হিন্দুধর্ম প্রায়শ আঞ্চলিক চেহারার, ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র-বহির্ভূত, এমনকি নাস্তিকতাকেও গণ্য করতে হয় তার মধ্যে। এখন আধুনিক যুগে প্রাচ্যবাদী সাহেবদের সাহায্যে এমন একটা সমরূপ হিন্দুধর্মের, ধর্মের চেয়েও বেশি করে হিন্দু সংস্কৃতির ধারণা তৈরি হল, যা নাকি একই সঙ্গে খুব উদার, সহিষ্ণু, আবার পৌরুষগর্বী বীরত্বে ভরপুর। এ হল হিন্দুত্বের জোড়াতাপ্পির একটা ছোটো উদাহরণ।

তেমনি ১৮শ-১৯শ শতকের ইউরোপের, বিশেষত জার্মানির, একটা বিশেষ রকম রোমান্টিক জাতীয়তাবাদের ধারাও হিন্দুত্ববাদীদের কাজে লাগল। Herder, Schiller, Fichte প্রমুখের দৌলতে সৃষ্ট এই জাতীয়তাবাদ একটা আদিম সমষ্টির মধ্যে গলে মিশে যাওয়াকেই ব্যক্তিমানুষের জীবনের পরম সার্থকতা বলে মনে করে, সেই সমষ্টির বাইরে সবাইকে শত্রুজ্ঞান করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায়। জাতীয়তাবাদের কিন্তু অন্যরকম চেহারাও হতে পারে। ইওরোপেই ১৯শ শতকে অন্যরকম জাতীয়তাবাদও ছিল, যা মানব-অস্তিত্বকে সংকীর্ণ নয় প্রসারিত করতে চাইত (মনে করুন জার্মানি ও ইটালির একীকরণের আন্দোলন)। কিন্তু ইতিহাসের একটা পর্যায়ে সংকীর্ণতাধর্মী জাতীয়তাবাদ খুব বেশি মাথা তুলল, তা থেকেই ফ্যাশিবাদের সূচনা (নাৎসিবাদসহ একটা বিশেষ রকমের মানসিকতা শব্দটা দিয়ে মোটের ওপর বোঝানো যেতে পারে, যদিও তার মধ্যে সূক্ষ্ম তারতম্য রয়েছে)। আমাদের দেশে ১৯২০-র দশক থেকে যে হিন্দুত্বের উদ্ভব তা ফ্যাশিবাদের অনুসারী। হিন্দুত্বের প্রবক্তারা প্রায়শই ফ্যাশিবাদের প্রতি অনুরাগ জ্ঞাপন করেছেন। বহু বিষয়ে দুই মতাদর্শের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় - সদাসর্বদা এই সন্দেহ যে জাতির বিরুদ্ধে শত্রুরা ষড়যন্ত্র করছে, ধর্মযুদ্ধের উন্মাদনা জাগিয়ে তা প্রতিরোধের চেষ্টা, তারজন্য আত্মত্যাগী সাহসী তরুণদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে সৈনিক হিসেবে তৈরি করার প্রয়াস। এমন বলা হয়েছে - ‘The project of Hindu Rashtra is ultimately someone else’s project.’

হিন্দুত্ব অবশ্য ভারতীয় চিন্তকদের উত্তরাধিকার নিয়েও গর্ব করে - দয়ানন্দ সরস্বতী, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, তিলক। মায় গান্ধী, রবীন্দ্রনাথকে দখল করতেও এরা পিছপা নয়। এঁদের নিয়ে গভীর পড়াশোনা না করেই, প্রসঙ্গ ছাড়াই কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার করে, মূর্তি বানিয়ে এঁদের পুজোর বেদীতে স্থাপন করা হয় সেজন্য। তবে বলতেই হবে, সে দোষ বিরোধী পক্ষেরও আছে। তারাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশেষ পড়াশোনা চিন্তাভাবনা না করে হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে মনীষীদের নিয়ে দড়ি-টানাটানি খেলায় নেমে গেছে। নিজের ভাবনা নিজে ভাবতে না পারার ফলশ্রুতি এই মনীষী-নির্ভরতা। মুশকিল হল, এইসব চিন্তকরা জাতির সংস্কৃতি বলতে অনেকটাই ‘হিন্দু’ একটা ব্যাপার কল্পনা করতেন যেযার মত করে। সে অবশ্যই আজকের হিন্দুত্ববাদীদের কল্পনা নয়, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্যে এঁদের উত্তরাধিকার কিঞ্চিৎ জটিল। তাই দু’তরফ থেকেই প্রসঙ্গ অনুল্লিখিত রেখে এঁদের উদ্ধৃত করা চলে।

প্রচুর অসংগতি দিয়ে তৈরি ইতিহাস

হিন্দুত্বের বিস্তারিত ইতিহাস পেশ করার সুযোগ নেই এখানে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল উনিশ শতক থেকেই। ১৯১৫ সালে হিন্দু মহাসভা তৈরি হয়েছিল কংগ্রেসি রাজনীতি থেকে আলাদা একটা হিন্দু-কেন্দ্রিক রাজনীতির প্রয়োজনবোধে। ১৯২৩ সালে হিন্দু মহাসভার বিনায়ক দামোদর সাভারকরের Hindutva: Who is a Hindu বইটি প্রথম হিন্দুত্বের চিন্তাগত ভিত্তিটা বেশ ভালভাবে প্রতিষ্ঠা করল, পিতৃভূমি-পুণ্যভূমির সমীকরণের সাহায্যে ‘হিন্দু’র সংজ্ঞা দিয়ে। বলা হল, হিন্দু হল সে-ই যার পিতৃভূমি, পুণ্যভূমি দুইই ভারতবর্ষ। অর্থাৎ খ্রিশ্চান আর মুসলমানদের দেশপ্রেম, এমনকি তাদের জাতীয়তা সন্দেহের মুখে পড়ল। এরপর, ১৯২৫ সালে হেডগেওয়ার নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করলে আজকে যাকে ‘হিন্দুত্ব’ বলা হয় তার সাংগঠনিক ইতিহাসের সূচনা। মতাদর্শের দিক দিয়ে সাভারকর-সূত্রই তার ভিত্তি। সংঘই হিন্দুত্বের মাতৃসংস্থা - আদর্শ থেকে নেতা ও কর্মী সবই যোগান দেয়, আজও। অনেক কিছুই এদের বদলে বদলে গেল প্রায় শতাব্দীকাল ধরে, কিন্তু মূল মতাদর্শ আর মনোভাব একই রইল, লৌকিক স্তরে যার অভিব্যক্তি - ‘হিন্দুস্থান হিন্দুকা, নহি কিসিকে বাপকা’। যুগপৎ সংস্কৃতি আর ভূমির ওপর সাভারকরীয় ঝোঁক থেকে সরে এসে ক্রমে ভূমি বাদ দিয়ে সংস্কৃতিই হিন্দুত্বের পক্ষে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে (যার ফলে এনআরআইদের দলে টানা সহজ হয়)। আর লক্ষ্য করে দেখুন, পিতৃভূমি কবে কীভাবে যেন মাতৃভূমি হয়ে গেছে (পিতৃভূমির ধারণাটা জার্মানি থেকে ধার করা - দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশই মা হিসেবে কল্পিত, অল্প কিছু ব্যতিক্রমের মধ্যে আছে জার্মানি) - এমনকি ‘ভারতমাতাকি জয়’ বলতে আপনি অস্বীকার করলে ওদের হাতে পিটুনি খাবেন, খুনও হয়ে যেতে পারেন। তা বাবা কি করে মা হয়ে গেলেন - এ প্রশ্ন কেউ ওদের করেছে বলে জানি না। করলে অবশ্য এরা বলতেই পারে, প্রাচীন ভারতে যেমন এরোপ্লেন ছিল, প্লাস্টিক সার্জারি ছিল, তেমনি জেন্ডার ট্রান্সপ্লান্টও নিশ্চয়ই ছিল!

হেডগেওয়ার সংগঠনটাকে প্রাথমিকভাবে গড়ে তুলেছিলেন - সারা ভারতের সব শাখার সদস্যদের একটাই নির্দিষ্ট সময়ে জমায়েত করে প্রার্থনা, শরীরচর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে, এবং এইভাবে তাদের মধ্যে একটা একাত্মতার অনুভব জাগিয়ে তুলে (এই আইডিয়াটা সিস্টার নিবেদিতার থেকে ধার করা)। তাছাড়াও তরুণদের দলে টানার ওপর জোর দিয়ে, ‘এক চালক, এক অনুবর্তিতা’র নীতি চালু করে (এ'দুটি আবার ফ্যাশিবাদের কথা মনে করায়)। এদের সবকিছুতেই বিদেশি মানে পাশ্চাত্য প্রভাব খুব বেশি করে চোখে পড়ে, যতই এরা মুখে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিরোধিতা করুক। যেমন, এদের খাকি শর্টস ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে ধার করা। সম্প্রতি করোনাকালে নরেন্দ্র মোদির ‘তালি বাজাকে থালি বাজাকে’ স্বাস্থ্যকর্মীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুজ্ঞা কদিন আগে ইটালিতে যা হয়েছিল একদম তার অনুবৃত্তি। আর সব সময়ে নিজেদের নীতির সমর্থনে বা কৃতিত্বের প্রতিপাদনে পাশ্চাত্যের সার্টিফিকেটও এদের খুব জরুরি। অতিসাম্প্রতিক একটি উদাহরণ - খড়গপুর আইআইটির এবছরের ক্যালেণ্ডারের একেকটি পাতায় প্রাচীন ভারতের জ্ঞানবিজ্ঞানের একেকটি দিকের জয়গাথার সমর্থনে একেকজন সাহেবের প্রসঙ্গহীন উদ্ধৃতি।

হিন্দুত্বের নিজের পড়াশোনা, ভাবনাচিন্তা খুবই কম; বস্তুত এ ব্যাপারটা হিন্দুত্ব নিরুৎসাহিতই করে, কারণ করলেই মতাদর্শটি ধসে যাবে (সম্প্রতিকালে হার্ভার্ড বা দেশের কিছু বাছা বাছা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর রাগ তার প্রমাণ)। নিঃশর্ত নির্দ্বিধ আনুগত্যই তার কাম্য। বেদ, গীতা ইত্যাদি হল পুজো করার জন্যে। রামায়ণ মহাভারতের জন্যে টিভি সিরিয়ালই যথেষ্ট। কোনো বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা নয়, কিছু প্রতীক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মতাদর্শটি - খাকি প্যান্ট, গৈরিক পতাকা, বিজয়া দশমীর মত কিছু উৎসব। সবশেষে রাম প্রতীকটি উদ্ভাবিত হয়ে তো কামাল করল। রামজনমভূমি আন্দোলনের সময়ে বালকৃষ্ণের আদলে হামাগুড়ি দেওয়া শিশু রামের মূর্তি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল চারদিকে - আহা, মিষ্টি বাচ্চাটার জন্মস্থানটাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে! এখন খুব দেখছি তীরধনুক হাতে আগ্রাসী রাম, যাঁর উদ্দেশ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ চিৎকার নিবেদিত। এসব পুরাণকথাকে আবার ইতিহাস বলেও চালানো হয়। তারজন্য দেশিবিদেশি পণ্ডিতদের রেফারেন্স বা উদ্ধৃতি উদ্ভাবন করতে ইদানীং খুবই দড় বিজেপির আইটি সেল।

এটা অনেকেই জানে, এদের জাতীয়তাবাদে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার স্থান ছিল না। তাই নেতাজী বা জঙ্গী জাতীয়তাবাদীদের দখল করা এদের আজ খুব প্রয়োজন। ব্রিটিশের জেলে সাভারকরের মুচলেকার কথা সুবিদিত। কংগ্রেসের কোনো আন্দোলনে (আইন অমান্য বা ভারত ছাড়ো) এঁরা যোগ দেননি। হেডগেওয়ার যদিও-বা খানিক ব্রিটিশ-বিরোধী ছিলেন, কংগ্রেসেও কিছুদিন ছিলেন (কংগ্রেসের মধ্যেও অনেকের যে হিন্দুত্বের ঝোঁক ছিল সেটা ঐতিহাসিক সত্য), পরবর্তী সরসংঘচালক গোলওয়ালকার ও পথ থেকে একেবারেই সরিয়ে আনলেন হিন্দুত্বকে। গোলওয়ালকরই এদের কাছে গুরুজি, মতাদর্শটি যাঁর দীর্ঘ নেতৃত্বে (১৯৪০-১৯৭৩) বেশ পরিণত চেহারা নেয়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দাঙ্গায় সক্রিয় অংশগ্রহণ, হিন্দু শরণার্থীদের দেখভাল ইত্যাদির সুবাদে সংঘ নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল, কিন্তু তারপরেই গান্ধীহত্যার দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে খানিকটা বিপাকে পড়ে। ১৯৬০-এর দশকে এসে আবার যে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সে অনেকটা গোলওয়ালকরেরই কৃতিত্ব।

মতাদর্শের ক্ষেত্রে গোলওয়ালকারের বড় অবদান ‘Positive Hinduism’। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যপূর্ণ ঐতিহ্যিক সমাজ কাঠামো বজায় রাখাই হিন্দুত্বের কাম্য, আবার সেই বৈষম্যকে সহনীয় করাটাও দরকার ব্যাপক জনসমর্থনের জন্য। তাই বলা হল, পাশ্চাত্য-আহৃত ব্যক্তিবাদ ও জড়বাদের বিপরীতে এই যে আধ্যাত্মিক চরিত্রের মহান হিন্দু সংস্কৃতি, এখানে নিজ সমাজের প্রতি কর্তব্যপালন সর্বাগ্রে বিধেয়। হিন্দুদের সব সমাজসম্পর্কই আসলে অঙ্গাঙ্গীভাব সম্পর্ক - ধনী-দরিদ্র, উঁচুজাত-নিচুজাত, নারী-পুরুষ, শিল্পপতি-শ্রমিক, শাসক-শাসিত। সবাই একই পরিবারের সদস্য (যেন একটা পরিবারের মধ্যে শোষণ বঞ্চনা থাকতে পারে না!) এভাবেই সামাজিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে, প্রকৃতির সঙ্গেও সশ্রদ্ধ সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থানে হিন্দুরা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছো্য। হিন্দুদের প্রকৃতি-অনুকূলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে গঙ্গা ও গো-ভক্তির কথা উল্লেখ করা হয় (অন্য নদী বা না-মানুষ প্রাণী কিন্তু নয়।)। আর এটাও উল্লেখযোগ্য যে, হিটলার যে পদ্ধতিতে জার্মানিতে ইহুদি সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন ভারতে মুসলমান সমস্যার জন্য গোলওয়ালকর সেই পদ্ধতির প্রয়োগ চান (যদিও একটা সময়ে এসে হিন্দুত্ববাদীরা দাবী করে যে, তীব্র বিদ্বেষী সুরের ‘We or Our Nationhood Defined’ বইটি আদৌ গোলওয়ালকরের লেখা নয়; ভি ডি সাভারকরের ভাই, যিনি আরএসএস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে, তাঁর লেখা। এ হয়ত ওদের চিরাচরিত মুখোশ-পরিধানের একটা উদাহরণ। আর একথা যদি-বা সত্যি হয়, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার প্রাসঙ্গিক লেখা তো আরএসএস-এর মতাদর্শের ওপরেও আলো ফেলে)।

এই তাহলে হল হিন্দুত্বের মুখের চেহারা - শুধু বিদেশিকে মুরুব্বি মেনে স্বদেশির প্রতিপাদন নয়, আরো নানা স্ববিরোধিতা ও অসঙ্গতিতে ভরা। অনেক সময়ে মনে হয় সেই মুখে শরীরের কোন গভীর অসুখের ছাপ। যারা বাস্তব আর কল্পনায় পার্থক্য করতে পারে না, দুটোকে গুলিয়ে ফেলে প্রাচীন ভারতে গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি বা বানরসেনার সমুদ্রের ওপর সেতু তৈরির গৌরবময় ইতিহাস রচনা করে, স্নায়ুবিজ্ঞানীরা তাদের স্কিটসোফ্রেনিক বলবেন। যারা ভাবে সবাই সব সময়ে ষড়যন্ত্র করছে তাদের বিরুদ্ধে, তাদেরও সমস্যা রীতিমত প্যাথলজির বিকার। সম্প্রতি গ্রেটা থুনবার্গের মত কয়েকজন বিদেশির টুইট নিয়ে যে হুলুস্থুলু কাণ্ড হল - শঙ্কা প্রকাশ করা হল যে তারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ধ্বংসে সচেষ্ট - সেটাকে কোনোভাবেই সুস্থ মানসিকতা বলা যায় না।

তবে একটু ধন্দ জাগে, এ কি মুখ না মুখোশ।? এসব কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা কি বিশ্বাস করে বলেন? যিনি দাবি করেন বানরসেনা সত্যি সমুদ্রের ওপর সেতু বেঁধেছিল রামচন্দ্রের জন্য, বা যিনি বলছেন গরুর দুধে সোনা মেলে, তাঁরা কি সেসব মনে মনে বিশ্বাস করেন? হয়ত তাঁদের দিক থেকে এগুলো কৌশলমাত্র, অর্থাৎ মুখোশ। কিন্তু অনেক মানুষকে তো সত্যি তাঁরা ভোলাচ্ছেন এসব বলে - তাঁদের কথা শুনে করোনা ঠেকাতে গোমূত্র খাচ্ছে আর অসুস্থ হয়ে পড়ছে কত মানুষ, খুব নরম মনের উপকারী বন্ধু হোয়াটস্যাপে হিংস্র মুসলিম-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে (মান্য ইতিহাসের বই থেকে মিথ্যে রেফারেন্স সহ), শিক্ষিত সুভদ্র প্রতিবেশী হঠাৎ বলতে শুরু করেন যে মুসলমানমাত্রই সন্ত্রাসবাদী, ওদের শায়েস্তা করা নিতান্ত প্রয়োজন। আসলে দেবতা আর দানব দুইই তো থাকে প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্ক ও শারীর রসায়নের মধ্যে। পারস্পরিকতা, ভালবাসা এসবের সঙ্গেই থাকে ভয়, ঘৃণা, বিদ্বেষ, আগ্রাসন। আরো থাকে - অযৌক্তিক কল্পনা, মিথের প্রতি আকষণ (মিথ জীবনের গভীরতম ও মহত্তম দিকটার চর্যায় যেমন সাহায্য করে তেমনই মানুষকে হিংস্রও করে তুলতে পারে)। এক্ষেত্রে নেতারা মানুষের স্নায়ুপথকে হাইজ্যাক করে বিশেষ বিশেষ স্নায়বিক রসায়নের ভিড় তৈরি করে ‘রোড শো’ করছেন। এইসব নেতারা একটা সুবিধাজনক জমিও পেয়ে গেছেন। আমাদের সমাজে অত্যধিক ধর্মচর্চা, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, বিশেষত যত আধুনিকতার অভিঘাতে অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাবোধের অভাব তৈরি হয়েছে ততই ধর্ম দিয়ে সেই ফাঁক ভরাট করা্র প্রবণতা - এসবের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েই ছিল অনেকদিন ধরে। নানা কারণে (অনেকটাই অর্থনৈতিক কারণ, তবে পুরোটা নয়) হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কেও গোলমাল বেঁধেছিল সেই উনিশ শতক থেকেই। সেই সময় থেকেই হিন্দুদের মধ্যেও যেমন হিন্দু আত্মপরিচিতি দানা বেঁধে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, মুসলমানদের মধ্যেও মাথা তুলছিল বিচ্ছিন্নতাবাদের আদর্শ। আমাদের জাতীয়তাবাদ প্রথম থেকেই ছিল অনেকটা হিন্দু জাতীয়তাবাদ। আমরা সচরাচর জাতীয়তাবাদ আর সাম্প্রদায়িকতাকে দাঁড়ি টেনে আলাদা করি। কিন্তু আসলে দুটির মধ্যে বিভাজনরেখা খুবই ঝাপসা। জাতিসত্তা কীভাবে কখন যে সাম্প্রদায়িকতা হয়ে যায়, চট করে ধরাও মুশকিল। আর দেশটা তো সত্যি সত্যি ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে’র ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেল ১৯৪৭ সালে, এইভাবে দু’তরফের বিচ্ছিন্নতাবাদের ওপরেই সিলমোহর পড়ল। তারপর মুসলমানসহ একেকটি জনগোষ্ঠীর লোকদের তোয়াজ করে (এবং তাদের পশ্চাৎপদ করে রেখে) ভোট ব্যাঙ্ক গঠনও আমাদের রাজনীতির বিরাট বৈশিষ্ট্য। হিন্দুত্ববাদী নেতারা এসবের সুবিধে নিয়েছেন। অবশ্য হিন্দুত্বের মুখটা ক্রমেই বেশি বেশি করে ভয়াল রক্তবর্ণ করে তুলতে তাঁদের নিজেদের কৃতিত্বও কম নয়।

হিন্দুত্ববাদ আর রাষ্ট্রবাদের দ্বন্দ্ব

হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদ আর রাষ্ট্রবাদের মধ্যেও একটা বিরোধ আছে। হিন্দুত্ববাদ হিন্দু সংস্কৃতির প্রচার করে হিন্দু সমাজকে একটা বিশেষ আত্মপরিচয়ে সংহত করতে চায়, তার ঝোঁক সংস্কৃতির ওপর, তার মনোযোগ স্ংগঠনে। রাষ্ট্রবাদের লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও ভোগ, সেই ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও আগ্রাসী করে তোলা। হিন্দুত্ববাদে আদর্শনিষ্ঠার ব্যঞ্জনা; রাষ্ট্রবাদকে বাস্তববাদও হতে হয়, আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়। আর গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে এই কাজটা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবাদকে সচেতনভাবেই একটা সুদর্শন মুখোশ পরে নিতে হয়। এই জায়গাটাতে হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যেই একটা মতান্তর ও মনান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

ওপর ওপর দেখতে গেলে, আরএসএস হিন্দুত্ববাদী, বিজেপি রাষ্ট্রবাদী। মুখোশটা তাই পরতে হয় প্রধানত বিজেপিকেই - উদারতার মুখোশ, উন্নয়নের মুখোশ। বিজেপির মতাদর্শ অনেকটা তৈরি করে দিয়েছিলেন তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দীনদয়াল উপাধ্যায় (যাঁকে ইদানীং বিরাট চিন্তক বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে)। গোলওয়ালকরের ‘positive Hinduism’-এর সঙ্গে তাঁর ‘Integral Humanism’(‘একাত্মতা মানববাদ’)-এর সাদৃশ্যও যেমন আছে, তেমনি তার তুলনামূলক নমনীয়তা আর উন্মুক্ততাও চোখে পড়ে। এই প্রথম বেকারত্ব দূরীকরণ, বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যপরিষেবার মত আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যের কথা এল হিন্দুত্বের মতাদর্শে। কোনোরকম আগ্রাসন নয়, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো বিষোদ্গার নয়। কিন্তু নিচু গলায় ‘হাজার বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামে’র কথা বলা হল। হিন্দু নয়, কিন্তু ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র প্রচ্ছন্ন ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হল - ধর্ম ও ঐতিহ্যকে আইনকানুন, সংসদ সবকিছুর ওপর স্থান দিয়ে। সুসংগঠিত নজরদারির প্রেরণা নেওয়া হল অর্থশাস্ত্র থেকে। শূদ্র ও মেয়েদের মত নিকৃষ্ট মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করার কায়দা শিখতে বলা হল মনুসংহিতা থেকে। সুতরাং ব্যাপারটা একটু আলাদা হয়েও মূলগতভাবে একই রইল। তবু সংস্কৃতি আর রাজনীতি, হিন্দুত্ববাদ আর রাষ্ট্রবাদের একটা দ্বন্দ্বও ভুল করার নয়।

আসলে কিন্তু এটা আরএসএস আর বিজেপির দ্বন্দ্বের চেয়েও বেশি কিছু। গোটা হিন্দুত্বের রাজনীতির মধ্যেই দ্বন্দ্বটা আছে অনেকদিন ধরে - যাকে বলা যায়, চরমপন্থী আর নরমপন্থীদের দ্বন্দ্ব। স্বাধীনতার ঠিক আগে, অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা যখন সমাগত, তখন আরএসএস-এর মধ্যে থেকেই অনেকে, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, চাপ দিচ্ছিল রাজনীতিতে প্রবেশ করার জন্যে; আবার অনেকের তাতে আপত্তিও ছিল। তারপর ১৯৫১ সালে একটা সমঝোতা হিসেবে জন সংঘ তৈরি হল। আগে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠন বলতে ছিল যে হিন্দু মহাসভা, তার সঙ্গে আর-এস-এস-এর মনের মিলও যেমন ছিল তেমনি সংস্কৃতি/রাজনীতির দ্বন্দ্বও ছিল। এখন ঐ মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই জন সংঘ গড়ে তোলার কাজে নামলেন, গোলওয়ালকরের আশীর্বাদ ও সক্রিয় সাহায্য নিয়ে, আর-এস-এস-এর বাজপেয়ী, আদবানি, দীনদয়াল উপাধ্যায়দের সঙ্গে করে। কিন্তু সংস্কৃতি/রাজনীতির দ্বন্দ্বটা রয়ে গেল হিন্দুত্বের অন্দরে। তারপর একটা সময়ে আর-এস-এস নিজেই রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে উঠল। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে তখন প্রবল আন্দোলন চলছে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে। গোলওয়ালকরের মৃত্যুর পর নতুন সরসংঘচালক বালাসাহেব দেওরাসের নেতৃত্বে আরএসএস তার শামিল হয়। ভারতীয় রাজনীতির সেই সন্ধিক্ষণের সুযোগসুবিধেগুলোর পূর্ণ সদব্যবহার করতে চেয়েছিলেন দেওরাস। কিন্তু গোল বাঁধল, যখন এমার্জেন্সির পর সদ্যজয়ী জনতা পার্টির মধ্যে মিশে গেল জন সংঘ, অতঃপর শরিক দলগুলির চাপে মাতৃ-সংগঠন আরএসএস-এর ওপরেই চাপ দিতে লাগল খুব বেশি চড়া হিন্দু ভাবমূর্তিটা মোছার জন্যে। বলরাজ মোধকদের মত রক্ষণশীল আরএসএস নেতারা মর্মাহত হলেন। ১৯৮১ সালে জন সংঘের জায়গায় বিজেপি তৈরি হল, ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে পেল মোটে দুটি আসন। বলা হয়, এই শোচনীয় ফলের একটা কারণ আরএসএস সেবার গোপনে ইন্দিরা গান্ধীকে অনেকটা সাহায্য করেছিল, বিজেপির ওপর বিরক্ত হয়ে (স্মরণীয় ইন্দিরাও সেই সময়ে হিন্দুত্বের দিকে বেশ ঝুঁকেছেন), বাইরে যদিও দুটি সংগঠন সহযোগী হিসেবেই বরাবর কাজ করছে। এটাও লক্ষণীয় বিজেপির সেই দুর্দিনে আর-এস-এস কিন্তু শাখার সংখ্যা ও প্রভাব প্রচুর বাড়িয়ে নিয়েছিল।

আরএসএস যে একেবারেই রাজনৈতিক নয়, পুরোপুরি সাংস্কৃতিক - এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এটা ঠিকই যে সংগঠন আর সংস্কৃতিই তার প্রধান কর্মক্ষেত্রে। অনেক স্বয়ংসেবক তারজন্য চিরকুমার থেকে যেতেন, বহু কৃচ্ছ্রসাধন করতেন। ভারতের আনাচেকানাচে, সমাজের তৃণমূল স্তরে তাদের শিক্ষা ও সেবামূলক সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারেরও কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা আরএসএস-এর আগেও ছিল এবং ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেই রাজনীতির পথটা তার কাছে সংসদীয় নয়, ধর্মযুদ্ধের পথ; যে যুদ্ধের প্রধান পদ্ধতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাঁধানো। কিন্তু আরএসএস সংসদীয় রাজনীতিও করে থাকে, সে অবশ্য করে প্রক্সির মাধ্যমে। এমন বলা হয়েছে, অন্য সংগঠনকে সামনে এগিয়ে দিয়ে রাজনীতি করা আরএসএস-এর এই সুবিধে করে দিয়েছে যে, তাকে সরাসরি মানুষের পর্যবেক্ষণ আর বিচারের আওতায় আসতে হয় না, নৈতিক ভাবমূর্তি তার ক্ষুণ্ণ হয় না। আসলে আরএসএস শুধু নির্বাচনী রাজনীতি করে শাসনক্ষমতা দখলের চেয়েও বড় রাজনীতি করে - সমগ্র সমাজের ওপর দখল কায়েম করতে চায়, মানুষকেই ভেতর থেকে বদলে দিতে চায়। উল্টোদিকে বিজেপি আরএসএস-এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের ফায়দা তোলে, কিন্তু আরএসএস-এর হিন্দুত্বের বাড়াবাড়ি দরকারমত অস্বীকারও করতে পারে। বিজেপি আর আরএসএস-এর মধ্যে শ্রমবিভাজন ব্যবস্থাটি চমৎকার, কিন্তু একটা চাপা দ্বন্দ্বও আছে।

১৯৮০-র দশকের শেষ থেকে হিন্দুত্বের যে রমরমা শুরু হয়, তার জন্য অবশ্য অনেকটা দায়ী অন্য একটি সংগঠন - বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে মূল্যবোধ মানসিকতার অনেক পরিবর্তনের সঙ্গে)। ভিএইচপিই হিন্দুত্বকে গণ-আন্দোলনে পরিণত করল, যার ক্লাইম্যাক্স বাবরি মসজিদ ধ্বংস। নিয়মানুবর্তিতায় বাঁধা আরএসএস এবং শুধুই উচ্চ রাজনীতি-করা বিজেপির পক্ষে এতটা সম্ভব হত না। আরএসএস আর বিজেপির কাছে সংহত হিন্দুসমাজ আর হিন্দুরাষ্ট্র ভবিষ্যতের সিদ্ধি - ক্রমশ সেদিকে এগোতে হবে। ভিএইচপি ঘোষণা করে দিল উদ্দেশ্য তো সিদ্ধ হয়েই গেছে, মানে সংহত হিন্দুসমাজ তৈরি হয়ে গেছে। অজস্র ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সংগঠনকে, অসংখ্য সাধুসন্তকে, ব্যাপকহারে তরুণ প্রজন্ম ও মেয়েদের, এমনকি প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে যোগ স্থাপন করে সবাইকে এক ছাতার তলায় এনে, নানারকম মিডিয়ার সাহায্যে কিছু হিন্দু প্রতীককে চূড়ান্তভাবে জনপ্রিয় করে তুলে, তারজন্য সর্বজয়ী বাজার আর মানুষের ভোগবাদী মানসিকতার পূর্ণ সদব্যবহার করে (প্রচুর লকেট, স্টিকার, ক্যাসেট ইত্যাদি বাজারে আনা এর একটা ছোটো উদাহরণ), পৌরাণিক হিন্দু পূর্বপুরুষদের উত্তরসূরী হিসেবে বিপুল সংখ্যক মানুষের আত্মপিরিচিতি তৈরি করে ভিএইচপি-র পক্ষে এই দাবী করা সম্ভব হয়। কিন্তু তার গতিবেগটা আরএসএস আর বিজেপির পক্ষে একটু বেশি ছিল। বেশ খানিকটা অশান্তিও তাই ছিল।

এই তিনটি সংগঠন মিলেই সংঘ পরিবার। বলা হয় আরএসএস ‘সাংগঠনিক’, বিজেপি ‘রাজনৈতিক’, ভিএইচপি ‘সামাজিক’। সংঘ পরিবারের এই তিনটি সংগঠনের আওতায় বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আরো অনেক সংগঠনও আছে। তারা পরস্পরের সহযোগী, কিন্তু তাদের সম্পর্কে্র মধ্যে অনেক টানাপোড়েন। তাছাড়া হিন্দুত্ব যতই রাজনীতির মধ্যে ঢুকেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে, শুধু ক্ষমতার ভাগাভাগিই টানাপোড়েনের একটা বড় কারণ দাঁড়িয়েছে। শিব সেনার সঙ্গে বিজেপির সংঘর্ষ তো সম্প্রতিকালে মহারাষ্ট্রের ও জাতীয় রাজনীতিতে হৈচৈ ফেলে দিল। জনসমক্ষে এসব টানাপোড়েন চাপা দেবার জন্যে হিন্দুত্বকে মুখোশ পরতেই হয়। আবার দরকার মত মুখোশ পাল্টে এটাও বলা যায়, ‘ওটা তো আলাদা সংগঠন, আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।’ বিজেপি প্রকাশ্যে আরএসএস-কে প্রায়ই অস্বীকার করে। কিন্তু মনে রাখবেন, বিজেপির রাজনীতিতে তার নিজের যুবমোর্চার চেয়েও বেশি প্রভাবশালী আরএসএস-এর এবিভিপি - জেএনইউ, যাদবপুরকে ঢিট করার জন্যে এবিভিপিই প্রাগ্রসর।

হিন্দুসংহতির বড় ফাটল - নারী, দলিত, জনজাতি

ইদানীং প্রায়ই শুনি, আমাদের কি সুন্দর বহুত্ববাদী দেশ ছিল, হিন্দুত্ববাদীরা তাকে অস্বীকার করে একটা অতিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি তৈরি করতে চাইছে। এ কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। হিন্দুত্ব মূলত উত্তর ভারতের একটা অংশের সংস্কৃতিকে সর্বভারতীয় বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায় বটে, কিন্তু এটাও জানে যে ভারতবর্ষ যে বহুত্বের দেশ সেটা স্বীকার করাই ভাল। আরএসএস-এর ‘একাত্মতা স্তোত্রে’ নানা অঞ্চল, নানা জনগোষ্ঠী, ধর্মগোষ্ঠীর নায়কনায়িকাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়, তাদের সমর্থন আদায়ের কৌশল হিসেবে (যে কৌশলটা বিজেপি ইদানীং বেপরোয়াভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করছে)। শুধু বাদ দেওয়া হয় মুসলমানদের। এই জায়গাটাতেই এদের বহুত্বের ধারণার সঙ্গে অন্যদের তফাত। আর যে বৈষম্য স্পষ্টতই উঁচুনিচু ভেদাভেদ, সেটা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলেরই খুব সমস্যা। তবে বিজেপিকে যখন হিন্দুসংহতির স্বার্থে সেসব চাপা দিতে হয়, তখন অন্যদের চেয়ে তার একটু বেশিই সমস্যা হয়, কারণ হিন্দুত্ব মতাদর্শগতভাবেই বৈষম্যবাদী। নারী, দলিত আর জনজাতিদের বিজেপি যত হীনজ্ঞান করে, আর কেউ ততটা নয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্যে বিজেপির মুখোশ তো লাগেই, কিন্তু তাতেও সমস্যা পুরোপুরি মেটে না। খুব সংক্ষেপে বিষয়টার একটা আন্দাজ দিচ্ছি।

নারী - মেয়েদের এরা পুরুষের জন্য বলিপ্রদত্ত মা আর স্ত্রী হিসেবেই শুধু দেখতে চায়। নারী-অধিকারসংক্রান্ত আইনকানুনগুলি পরিবারকে তছনছ করে দিচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। একদিকে যেমন ‘তিন তালাক’ রদ করে মুসলমান মেয়েদের পরিত্রাতা সাজে, অন্যদিকে ওদের কোনো নেত্রীর ক্যাসেটবদ্ধ বক্তৃতায় (সম্ভবত সাধ্বী ঋতাম্ভরা) শোনা যায় মুসলমান মেয়েদের ধর্ষণ করার জন্যে হিন্দু পুরুষদের প্রতি আহবান। বছর দুয়েক আগেও যোগী আদিত্যনাথ নারীদিবস উপলক্ষে এমন মত প্রকাশ করেছিলেন যে, নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয় - পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তারা নিতান্ত ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে কিন্তু রাজনীতির প্রয়োজনে মেয়েদের ব্যবহারও করতে হয়। ১৯৭০-এর দশক থেকে এই প্রয়োজন ক্রমেই বেশি করে অনুভূত হচ্ছে, ১৯৯০-এর দশক থেকে তো বটেই। সেক্ষেত্রে অবশ্য জঙ্গী যুদ্ধে লিপ্ত মা দুর্গা বা লক্ষ্মীবাঈদের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়। তবে এই নারীশক্তি মূলত মাতৃশক্তিই। লক্ষ্মীবাঈ-ও নিজে সাহসী নারী হিসেবে যত না মান্য, তার চেয়ে বেশি মান্য এক বীরের মা হিসেবে। সাধ্বী ঋতাম্ভরা, উমা ভারতীদের ভূমিকা তো সন্ন্যাসিনীদের ব্যতিক্রমী ভূমিকা, যা ভারতীয় ঐতিহ্যে অনেকদিনই মান্য।

কিন্তু মেয়েরা যতই হিন্দুত্বের রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকে, পুরুষ নিয়ন্ত্রকদের নারীচিন্তাকে ছাপিয়ে যেতে চায়, মেয়েদের নিজস্ব সমস্যাগুলি নিয়ে মাথা ঘামায়, রাজনীতিতে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাও চরিতার্থ করতে চায়। তখন পুরুষতান্ত্রিক হিন্দুত্বের সঙ্গে তাদের সংঘাতও হয়।

দলিত - তেমনি জাতিভেদপ্রথাও হিন্দুত্বের আরেকটি সমস্যাজনক জায়গা। এব্যাপারে আর্যসমাজের জাতিভেদ-বিরোধী সংস্কারবাদী মনোভাব আর সনাতনী ধর্মের উচ্চবর্ণের মানসিকতার মধ্যে রীতিমত দ্বন্দ্ব আছে (ভিএইচপি দুই ধারাকে যথাসাধ্য মেলাতে চেয়েছে বটে, কিন্তু দ্বন্দ্বটা থেকেই গেছে)। তাছাড়া হিন্দুত্বের মূল সমাজভিত্তি তো উঁচু জাতির। মোটের ওপর এমন একটা অবস্থান নেওয়া হয় যে, জাতিভেদপ্রথা ভাল, তবে অস্পৃশ্যতা খারাপ। এটা ঠিকই যে, আর-এস-এস নিজেকে জাতিপ্রথার ঊর্ধ্বে বলেই দাবী করে। শাখা সদস্যের ভর্তির ফর্মে জাতির উল্লেখ করতে হয় না। আম্বেদকর যবে থেকে স্বয়ংক্রিয় র‍্যাডিকাল দলিত আন্দোলনের নায়ক হয়ে উঠলেন, হিন্দুত্ব তাঁকে দখল করার মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে - তাঁর হিন্দুবিরোধিতার চেয়ে মুসলমান-বিরোধিতার ওপরেই বেশি জোর দিয়ে। আর তাঁর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণকে এই বলে ব্যাখ্যা করে যে, বৌদ্ধ ধর্ম তো হিন্দুধর্মেরই অঙ্গ (এই দুই ধর্মের বিরোধিতার ইতিহাস সম্পূর্ণ অস্বীকার করে),যাতে সুবিধে করে দেয় সাভারকরের পিতৃভূমি-পুণ্যভূমির সমীকরণ। দলিতদের অনেকের সমর্থনও পেয়েছে হিন্দুত্ব, যতই Kancha Ilaiah ‘I am not a Hindu’ বলুন, বা এমনকি বেশ কিছুদিন আরএসএস করে এসেও Bhanwar Meghwanshi-র মত কেউ বলুন ‘Why I could not be Hindu’.

জনজাতি - সাভারকরের ফর্মুলা জনজাতিদেরও দখল করতে হিন্দুত্বকে সাহায্য করে। তাদের আদিবাসী বলে অবশ্য স্বীকার করা হয় না (সে মর্যাদা তো আর্য হিন্দুদের), বলা হয় বনবাসী। তাদের সাহস, সততা, হৃদয়বত্তা ইত্যাদি গুণের প্রশংসা করা হয়। এমনকি তাদের গোভক্ষণকেও এই বলে মাপ করে দেওয়া হয় যে, সে তো ওরা পেটের জ্বালায় খায়, তাছাড়া কেউ তো ওদের শেখায়নি যে গোরু আসলে মা। মেবারের রানাদের রাজ্যাভিষেকে ভিলদের হাতে তিলক নেওয়ার প্রথার উল্লেখ করা হয়, উঁচু জাত আর জনজাতিদের সৌহার্দ্যের প্রমাণ হিসেবে। জনজাতিদের মধ্যে স্কুল, চিকিৎসালয় ইত্যাদি চালায় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম এবং খ্রিশ্চান মিশনারিদের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করে ‘ঘর ওয়াপসি’র ব্যবস্থা করে।

কিন্তু মেয়েদের, দলিতদের ও জনজাতিদের অন্তর্ভুক্তির এই যে রাজনীতি, সেখানে তাদের নিচু করে রাখার মনোভাবটা পুরোপুরি বজায় থাকে - তারা অন্তর্ভুক্ত হবে, কিন্তু পায়ের তলায় থাকবে। অর্থাৎ দৃশ্যমান মুখোশের তলায় মুখটা অক্ষুণ্ণ থাকে, কিন্তু মুখোশ ধরে একটু টানলেই মুখ বেরিয়ে আসে। তবু অবশ্য মুখোশেই ভোলানো যায় অনেক নারী, দলিত ও জনজাতির মানুষকে, যদিও প্রতিরোধও আছে। অনেক সময়ে হিন্দুত্বের মধ্যেই এসব নিয়ে গোলমাল বাঁধে। উমা ভারতী একটি দৃষ্টান্ত। তিনি নিচু জাত লোধাদের মেয়ে, উপরন্তু নারী। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র দুয়ের বিরুদ্ধেই তিনি লড়াই করার চেষ্টা করেছেন, হিন্দুত্বের ভেতর থেকেই। তাঁর নেতৃত্বক্ষমতা উচ্চতর নেতাদের কাছে মূল্যবান। তাঁরা উমাকে না পারেন ফেলতে, না পারেন গিলতে। নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যান। একাধিকবার তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে তাঁকে মন্ত্রী করে গঙ্গাপরিশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হল, গঙ্গা কিনা জাত বা অন্য সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে। আশা করা হল, উমা নিশ্চয়ই তাঁর র‍্যাডিকাল প্রতিবাদী ধরণ বদলাবেন তার ফলে। উমা নিজেই বলেছিলেন, এ হল তাঁকে ‘fire brand’ থেকে ‘water brand’-এ পরিণত করার চেষ্টা। তারপরেও তিনি পুনরপি প্রান্তিকায়িত।

দু’মুখো সাপ?

এইভাবেই মুখ আর মুখোশে ভারসাম্য বজায় রেখে হিন্দুত্বের রাজনীতি চলে। মুখোশ কমবেশি সব রাজনীতিরই প্রয়োজন। কিন্তু এদের মুখোশের আড়ালে মুখটাকে অনাবৃত করলে যতটা কদর্য, বিধ্বংসী চেহারা দেখা যায়, মানে মূল আদর্শের দিক দিয়েই সেটা এত কর্তৃত্বপরায়ণ, বৈষম্যবাদী, অমানবিক আর হি্ংস্র, অতটা অন্য কোনো রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মুখোশ খুলে মুখটাকে - ওদের কুটিল কপট চরিত্রকে - সবার সামনে তুলে ধরা দরকার। বিরোধীরা বড়জোর একেকটা ইশু নিয়ে চেঁচামেচি করে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে ওদের মুখোশটা খোলার চেষ্টা করে না। আর বেশিরভাগ ইশু্-র ক্ষেত্রেই ওরা ‘Whataboutery’ করে বিরোধীদের দিকেই পালটা তীর ছোঁড়ে। যেমন - ‘তোরা আমাদের দলের চোরদের ভাঙিয়ে নিয়ে নিজেদের দলে পুরছিস’ বললেই স্বাভাবিকভাবেই ওরা জবাব দেয়, ‘তা, তুই চোরদের এতদিন পুষেছিলি কেন?’ বিরোধী রাজনীতিকরা না হয় এতই অশিক্ষিত, চিন্তাভাবনাহীন, আধিপত্যবাদী, সুবিধাবাদী, দুর্নীতিগ্রস্ত যে তাদের এর বেশি কিছু করার মুখ নেই; কিন্তু খারাপ লাগে যখন দেখি ‘বুদ্ধিজীবী’ ‘বিদ্বজ্জন’রাও সচরাচর খুব বেশি কিছু করে উঠতে পারেন না। সমস্যার গভীরে যাওয়ায় অনীহার সঙ্গে গণতান্ত্রিক ভদ্রতাও তো আছে। লক্ষ করুন, গণতন্ত্রের দোহাই ওরা অন্য কারোর চেয়ে কম দেয় না - জানে ছলে-বলে-কৌশলে গণতন্ত্র আর তার সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওরাই তো দখল করে নিচ্ছে।

২০১৪ থেকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে হিন্দুত্বের ‘Modification’ হয়েছে, দ্বৈত অর্থে। এই পর্বে মনে হচ্ছে যেন মুখোশটাই মুখ আর মুখটাই মুখোশ। আসল মুখ যেন হিন্দুত্ব নয়, একটা ভোগবাদী পার্থিব জীবনের উজ্জ্বল চিত্র। আরএসএস-এর তরুণ প্রজন্মও বোধহয় এখন আর হিন্দুত্ব নিয়ে তত মাথা ঘামায় না, দেশে বিদেশে নব্য-উদার অর্থনীতির জয়যাত্রায় শামিল হওয়াতেই তাদের বেশি তাগিদ। ফলে এখন হিন্দুত্বের উদ্দেশ্য হল কর্পোরেটদের হাতে দেশকে তুলে দেওয়া আর নিজেরা তার ফয়দা লোটা। এটাকেই বলা হচ্ছে উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে কর্পোরেটের উন্নয়নেই তাদের সবার উন্নয়ন। যারা হিন্দুত্বে তেমন আগ্রহী নয় তাদের অনেকেই এতে ভুলছে। আবার এমন অনেকে আছে যাদের জীবনে উন্নয়ন অধরা বটে, কিন্তু তার ফাঁক ভরাচ্ছে হিন্দুত্বের আস্ফালন, তাদের সাংস্কৃতিক অস্মিতাকে তৃপ্ত করে। তাদের জন্যেই হিন্দুত্বকে হয়ত রাখতে হয়েছে মুখোশ হিসেবে। বস্তুত নব্য-উদার অর্থনীতি যতই মানুষকে সংকটে ফেলছে, ততই এই মুখোশের প্রয়োজন পড়ছে বেশি করে (বিশ্ব জুড়েই ধনতন্ত্র বিশেষত আজকের নব্য-উদার ধনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার যে রাজনৈতিক প্রয়াস, সেখানে ভারতে হিন্দুত্বের ভূমিকা নিয়ে গত সংখ্যাতেই আলোচনা করেছিলাম)। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে, যখন অর্থনীতি সম্পূর্ণ বেহাল, তখন হিন্দুত্বের ভিত্তিতে মেরুকরণই তো বিজেপিকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। (তবে এটাও লক্ষণীয় যে, আরএসএস যেহেতু সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে কাজ করে, সাধারণ মানুষের রুজিরোজগারের ওপর স্টীমরোলার চালিয়ে দেওয়ার যে নীতি বিজেপি নিয়েছে তাতে আরএসএস-এর অনেকের আপত্তিও আছে - সাম্প্রতিক শ্রম আইন, কৃষি আইন নিয়ে যেমন আপত্তি শোনা গেছে। অবশ্য ক্ষমতার লোভে আপত্তিকে বেশিদূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।)।

কিন্তু হিন্দুত্বকে নেহাত মুখোশ বলা কি ঠিক হবে? হিন্দুত্বও খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় কি? একেক সময় মনে হয় - আসলে এই রাজনীতি দু’মুখো সাপ, উন্নয়নদর্পী জাতি আর হিন্দুত্বদর্পী জাতি তার দুটো মুখ। দুটো মুখ দিয়েই সেই সাপ মানুষকে সম্মোহিত করে, লোককথার অজগরের মত। সমাজের বাইরের চাকচিক্য শুধু নয়, সমাজটাকে ভেতর থেকে গভীরভাবে বদলানোর প্রকল্পও ওরা চালু রেখেছে বই কি! একদা বাংলায় এবিভিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা পার্থ ব্যানার্জি পরে ঐ রাজনীতি থেকে সরে এসে In the Belly of the Beast নামে যে বই লিখেছেন, তাতে সেই পরিবর্তমান সমাজের একটা ভয়াবহ বর্ণনা আছে। ওঁর উপমা অবশ্য সাপ নয়, পোকা, একটা ভয়ঙ্কর পোকা। সংঘকে তাঁর একটা প্রাচীন গুটিপোকার মধ্যে বাস করা বিকট পোকা বলে মনে হয় - ‘সে সমানে পরিব্যক্তির প্রক্রিয়ায় নিজেকে বদলে নিয়ে বড় হচ্ছে আর যা সামনে পাচ্ছে তাই ধরে গিলে ফেলছে, কিন্তু কিছুতেই নিজের খোলের মধ্যে থেকে বেরোচ্ছে না। ব্যাপারটা এত ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে ঘটছে যে কেউ বুঝতেই পারছে না পোকাটি কতটা বিপজ্জনক। একটা কারণ এই যে, তাকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না। কেউ দেখছে চমৎকার বনভূমির এক কোণায় একটা বিরাট গুটিপোকা মনের আনন্দে যা পাচ্ছে চিবিয়ে চলেছে, লোকে বড়জোর তার কদর্য চেহারা নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করে। ...কিন্তু একদিন লোকে বুঝতে পারে যে সুন্দর বাগানটাতে আর কোনো সবুজ অবশিষ্ট নেই। সবটাই ধূসর, ঊষর, নিস্তেজ, বিষণ্ণ। ...আর এখন সেই পোকাটা এক অতিকায় জন্তুতে পরিণত হয়েছে, সে যা চায় তা থেকে তাকে আটকানোর হিম্মত আর কারোর নেই।’ প্রায় দু দশক আগে ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত এই বইতে পার্থবাবু আরো বলেছিলেন - ‘আগামী দিনে ভারতের সামাজিক বুনোটটা এমন করে বদলে যাবে যে তা আর কোনোদিনই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। ইতিমধ্যেই তা অনেকটা পালটে গেছে।’ এই ২০২১-এ সমাজটা কতখানি পালটে গেছে তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। পার্থবাবুর বর্ণনায় সেই নতুন সমাজে বাচ্চারা খেলা করবে না, প্রেমিকযুগল বসে বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করবে না...। বাগানটা হয়ে উঠবে কদাকার জানোয়ারটার রাজত্ব। এবং পার্থবাবুর বক্তব্য - সামাজিক স্তরে ওদের কার্যকলাপ নিয়ে অন্যদের অজ্ঞতা আর উপেক্ষার সুযোগেই সংঘের এই বাড়বাড়ন্ত।

কথাটা ভেবে দেখুন। ভাবুন, এরকম একটা সমাজ আমাদের কাঙ্ক্ষিত কিনা! যদি কাঙ্ক্ষিত না হয়, যদি প্রতিরোধ করতেই হয়, তবে কিন্তু শত্রুকে চেনার চেষ্টা করতে হবে। আর তার আসল শক্তির জায়গায়, মানে সামাজিক স্তরে, তার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে হবে।