আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

বাংলার পার্টিশন-কথাঃ একটি জনগবেষণার অভিমুখ

হিমাদ্রি লাহিড়ী


ঝুম্পা লাহিড়ীর ছোটো গল্প ‘When Mr. Pirzada Came to Dine’-তে মার্কিন নিবাসী দশ বছর বয়সী এক বালিকা চরিত্রের অবতারণা করা হয়েছে। লিলিয়া নামের এই বালিকাটি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত। বস্টন শহরের কাছের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মি.পিরজাদা স্বল্প সময়ের জন্য গবেষণা করতে এসেছেন। সময়টা ১৯৭১ সাল - মুক্তিযুদ্ধের লড়াই চলছে পূর্ব পাকিস্তানে। দেশ থেকে বহু দূরে থাকায় লিলিয়ার বাবা-মা নস্টালজিয়ায় ভোগেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেকটরিতে পরিচিত বাঙালি নাম-পদবী দেখতে পেলেই বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। আচার-ব্যবহারে আদ্যোপান্ত বাঙালি মি. পিরজাদা। তাকে ভারতীয় বলে মনে করে লিলিয়া। ভুল ভাঙাতে লিলিয়ার বাবা তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের জটিল ইতিহাস বোঝাতে চেষ্টা করেন। মানচিত্রে ব্যবহৃত রঙের রকমফের দেখিয়ে লিলিয়াকে বোঝান হয় ভারত ও পাকিস্তান দুই ভিন্ন দেশ, ভারতীয় নাগরিক ও পাকিস্তানি নাগরিক তাই এক হতে পারেন না, লিলিয়াকে বুঝতে হবে পার্থক্যটা। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের পার্টিশনের পরে অন্তত মি. পিরজাদার মতো মানুষকে আর ভারতীয় বলা যাবে না। লিলিয়াকে বলা হয় “মি. পিরজাদা বাঙালি, কিন্তু তিনি মুসলিম” (পৃ. ২৬)। ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলিম’ এই দুই আইডেন্টিটির দ্বন্দ্ব লিলিয়ার বুদ্ধিতে ধরা পড়ে না।

ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির জটিল অঙ্ক, ভাষাভিত্তিক ও ধর্ম-ভিত্তিক বিভাজনের বিচিত্র চিত্র গল্পটির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। সাহিত্যের মাধ্যমে ইতিহাস-পাঠ নেওয়ার বিশাল সুবিধা এই যে ঘটনার গূঢ় অর্থ মর্মে ঢুকে যায় সরাসরি। পার্টিশন-সাহিত্যে শিশু বা উন্মাদ চরিত্রের অবতারণা তাই বিশেষ অর্থবহ। পাঠক হিসেবে তাদের প্রতিটি গতিবিধি, চিন্তাভাবনা আমরা নজরে রাখি। সাদাত হাসান মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের উন্মাদ চরিত্র ভারত- পাকিস্তান বর্ডারে ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ দাঁড়িয়ে আপাত-সুস্থ রাজনীতিবিদ্‌দের অসুস্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে কত সহজে! একইভাবে ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্পে শিশু লিলিয়া কত সহজে বিভাজনের রাজনীতির অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতার মূলে টান মারতে পারে। সে জানান দেয় যে, বাঙালির থেকে বাঙালিকে আলাদা করার যে রাজনীতি, যা ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত থেকেই শুরু হয়, তা তার কাছে কত অর্থহীন। মি. পিরজাদা ও তার মা-বাবা একই রকম দেখতে, একই ভাষায় কথা বলেন, একই রসিকতায় হেসে ওঠেন। তাঁরা হাত দিয়ে একই খাবার খান, জুতো খুলে ঘরে ঢোকেন, মদ্যপান করেন না (পৃ. ২৫)। লিলিয়া প্রশ্ন তোলে, তারা আলাদা হ’ন কীভাবে? ১৯৪৭-এর পর সাত দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু এই প্রশ্নের অনুরণন এখনও থামেনি।

লিলিয়ার প্রশ্ন মূলত উত্তর-প্রজন্মের প্রশ্ন। হানাহানির ইতিহাস থেকে বেশ কিছুটা দূরে বসে, না-থামা বিদ্বেষের আঁচ পেতে পেতে, বর্তমান প্রজন্ম খুঁজতে থাকে সম্প্রীতির সড়ক। আজকের পার্টিশন-চর্চা শুধুমাত্র ১৯৪৭-এর রক্তাক্ত ইতিহাসের পুনর্দর্শন নয়, এক অর্থে বিদ্বেষমুক্তির উপায় সন্ধানও বটে। এই গোলক-ধাঁধা থেকে বেরোতে গেলে রাষ্ট্রের সহযোগিতা যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন সাধারণ মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা। ১৯৭১-এর নারকীয় হত্যালীলার জন্য পাকিস্তানের কাছ থেকে যেমন বাংলাদেশি নাগরিক অপরাধ স্বীকারের দাবি করে আসছেন, তেমনই সাধারণ পাকিস্তানি নাগরিক ব্যক্তিক অর্থে ও দেশের পক্ষ থেকে ক্ষমা-প্রার্থনা করতে পারেন। উর্বশী বুটালিয়া বলেছেন, রাষ্ট্র সহজে ক্ষমা স্বীকার করে না, নাগরিকদের পক্ষে যা করা সম্ভব। তিনি উল্লেখ করেছেন, “Many years ago, in a women’s meeting in Lahore, Pakistani women’s groups exercised this option when, over a day of moving music and intense conversation, they offered a formal apology to their Bangladeshi sisters.” কথাগুলি বুটালিয়া বলেছেন Anam Zakaria–র বই 1971: A People’s History for Bangladesh, Pakistan and India (2019)–এর সমালোচনা প্রসঙ্গে। বইটির Part I (‘Journeys: Past and Present’)-এর প্রথম অংশে (‘Selective Silences, Slective Remembrances’) Zakaria বাংলাদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। কীভাবে একটি সভায় বক্তারা তাঁকে লক্ষ্য করে ১৯৭১-এর অত্যাচারের বিবরণ দিয়ে গেছেন তা শুনিয়েছেন। চরম অস্বস্তির মধ্যে মধ্যে তাঁকে সময় কাটাতে হয়। একসময় মঞ্চে উপবিষ্ট আনম (ও তাঁর স্বামী) আর তাঁদের দেশ পাকিস্তান সমার্থক হয়ে যান। আনম বলেন, “I am, therefore, Pakistani, I am the Pakistan Army, I am Punjabi hegemony” (পৃ. ৩৩)। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার পার্থক্য মুছে দেওয়া হয়। এই অস্বস্তি থেকে রাষ্ট্রের অপরাধের দায়িত্ব বোধ করে ব্যক্তি। ব্যক্তিকে ঠিক করতে হয়, দেশের হয়ে ক্ষমা স্বীকার তাকেই করতে হবে; এ তার নৈতিক দায়িত্ব।

Jacques Derrida তাঁর On Cosmopolitanism and Forgiveness বইতে ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করার কথা আলোচনা করেছেন। ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করা যখন এক বিন্দুতে মিলিত হয়, তখনই কেবল বিদ্বেষের কালো মেঘ কেটে যেতে পারে এবং বন্ধুত্বের শুরু বা পুনর্বাসন হতে পারে। কিন্তু শুধু প্রথামাফিক ক্ষমা চাওয়া যথেষ্ট নয়। Derrida নিঃশর্ত ক্ষমার কথা আলোচনা করেছেন, বলেছেন যা ক্ষমার অযোগ্য (‘unforgivable’) তাকে ক্ষমা করার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে যথার্থ ক্ষমার ক্ষমতা। এদিক থেকে, পার্টিশনে বিবাদমান গোষ্ঠীগুলি যদি একে অন্যকে ক্ষমা করতে না পারে, অথবা ১৯৭১-এর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি নাগরিক যদি বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করতে না পারে বা বাংলাদেশি নাগরিক ‘ক্ষমার অযোগ্য’ অপরাধকে যদি ক্ষমা করতে না পারে, তবে বন্ধুত্বের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া মুশকিল। Bapsi Sidhwa-র ‘Defend Yourself Against Me’ শীর্ষক গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে এই ধরণের ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করার সম্পর্কের উপর। মার্কিন দেশে অনুষ্ঠিত একটি পার্টিতে মি. সিকান্দর খানের সঙ্গে গল্পের বক্তা মিসেস জ্যাকবের আলাপ হয়। পরে সিকান্দরের বাড়িতে পাকিস্তান থেকে আগত তার মা’র (আম্মিজি) দেখা পান। মমতাময়ী এই মহিলার ব্যবহারে মিসেস জ্যাকব খুশি হন। হঠাৎই এই শান্ত-শিষ্ট মহিলা তাঁর দুই নাতনির প্রণয়প্রার্থী দুই শিখ যুবককে দেখেন এবং মুহূর্তে তাঁর চেহারা পাল্টে যায়। তিনি চিৎকার করে ওঠেন। পার্টিশনের ভয়াবহ স্মৃতি জেগে ওঠে তাঁর মনে। অন্যান্য মহিলাদের মতই আম্মিজি লালসার শিকার হয়েছিলেন, শিখ দাঙ্গাবাজরা মহিলা বেচাকেনার খেলায় মেতে উঠেছিল। দুই শিখ যুবক নতজানু হয়ে ক্ষমা চায়, তারা বলে, “Ammiji-ji, forgive us; Forgive the wrongs of our fathers” (পৃ. ২৪৫)। ক্রমশ আম্মিজি স্বাভাবিক হয়ে আসেন। তিনি বলেন, “My sons, I forgave your fathers long ago... How else could I have lived?” (পৃ. ২৪৮)। পার্টিশন সাহিত্য গত দু’এক দশক থেকে এই নৈতিকতার ডিসকোর্স তুলে ধরছে। Anam Zakaria-র পূর্বোক্ত বইটি তার এক নিদর্শন।

পার্টিশন-চর্চায় উত্তর-প্রজন্ম যেমন এথিক্‌স নিয়ে ভাবিত, তেমনই আরও দু’টি দিক নিয়ে আলোচনায় তারা আগ্রহী। ‘নতুন গবেষণা’ ১৯৪৭ সালের পার্টিশনকে বিশ শতকীয় কালপর্বের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাইছে না - এটা আগেই আমরা দেখেছি। ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্পের আলোচনাতেই তা স্পষ্ট। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে একই সূত্রে গাঁথতে চেষ্টা করছেন তারা। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম সামগ্রিকভাবে এই উপমহাদেশের ইতিহাসকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির নিরিখে ধর্ম, বর্ণ, বাঙালি জাতিসত্তার বিষয়গুলিকেও ভিন্ন আলোকে দেখতে শুরু করেছি আমরা। নানা স্বরক্ষেপের বিচারের মধ্যে দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি, উপমহাদেশের তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানুষ কীভাবে দেশভাগের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করেন। এতদিনে আমরা মেনে নিয়েছি পার্টিশন আসলে চলমান বিভাজনের প্রক্রিয়া (Vazira Fazila-Yacoobali Zamindar যাকে ‘Long Partition’ বলেছেন), এর ‘প্রলম্ব ছায়া’ (Urvashi Butalia ব্যবহার করেছেন ‘Long Shadow’ শব্দবন্ধটি) থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি আমরা। দ্বিতীয়ত, পার্টিশন সাহিত্য ও সমালোচনা অধুনা অতীত-খননে ব্যস্ত, তুলে আনতে চাইছে না-বলা কথা। উর্বশী বুটালিয়া, কম্‌লা ভাসিন, রীতু মেনন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ১৯৮০-র দশক থেকেই এই কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন, বিশেষ করে সাধারণ মহিলাদের জীবনভাষ্য গ্রহণের মাধ্যমে; গত দু’এক দশকে তা আরও গতি পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রান্তীয় জন-গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া। বাংলার পার্টিশন, যা এতদিন অবহেলিত ছিল, তা সাহিত্যে, জীবনভাষ্যে ও সমালোচনা-সাহিত্যে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। গবেষণায় মেথড হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে সার্ভে ও সাক্ষাৎকার। উঠে আসছে নতুন আকর-সংগ্রহ। এই ধারার গবেষণার নবতম সংযোজন বাংলার পার্টিশন কথাঃ উত্তর প্রজন্মের খোঁজ (২০২১) গ্রন্থটি।

মননকুমার মণ্ডল সম্পাদিত বাংলার পার্টিশন-কথাঃ উত্তর প্রজন্মের খোঁজ (প্রস্তাবনা ও গ্রন্থনাও তাঁর) বাংলার পার্টিশনকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করবে। এই বইতে দেশভাগের ইতিহাসকে শুধুমাত্র ১৯৪৭-এর নিরিখে দেখা হয়নি, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনীতিকে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও ১৯৭১-এর নতুন রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গেও সংযুক্ত করা হয়েছে। আর একটি কারণেও বইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলার পার্টিশনকে গ্রাম-মফস্বলে ছড়িয়ে থাকা বাস্তুচ্যুত সত্তর-ঊর্ধ্ব সাধারণ নরনারীর বয়ানে ধরা হয়েছে। কেবলমাত্র বাংলার পার্টিশন চর্চায় নয়, উপমহাদেশের বিভাজনের ইতিহাসচর্চায় বইটি নতুন মাত্রা যোগ করবে।

গ্রন্থটি নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পার্টিশন বিষয়ক গবেষণা প্রকল্পের ফসল। এই প্রকল্পের অধীনে গড়ে উঠেছে একটি ডিজিটাল সংগ্রহশালা (বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরি) যা গবেষকদের মূল্যবান উপাদান সরবরাহ করবে। সমীক্ষা, সাক্ষাৎকার এবং একই সঙ্গে সাবেক গবেষণার উপকরণের উপর দাঁড়িয়ে আছে বইটি। গবেষণা প্রবন্ধগুলি অনেকটাই আর্কাইভ নির্ভর। শ্রী মণ্ডল সম্পাদনা করেছেন দক্ষ হাতে - কোথাও বাড়াবাড়ি নেই। প্রস্তাবনায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও কর্মপরিধি ব্যাখ্যা করেছেন। সুদীর্ঘ ভূমিকায় পার্টিশনচর্চার (বিশেষত বাংলার পার্টিশনচর্চার) ইতিহাসের বিশ্লেষণ করেছেন। দেখিয়েছেন কীভাবে গত শতাব্দীর আটের দশক থেকেই পার্টিশন গবেষণা বাঁক নিতে শুরু করে। সরকারি মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজ, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চিঠিপত্র ও অন্যান্য লেখালিখি নির্ভর ইতিহাস-নির্মিতি থেকে সরে এসে মাটির কাছাকাছি মানুষজন ও তাদের জীবনযাপনের দিকে নজর দিয়েছে সাম্প্রতিক গবেষণা। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী নয়, সাধারণ মানুষই নব্য ইতিহাসের চরিত্র হয়ে উঠেছে। তাদের জীবনভাষ্য এই ইতিহাসের উপজীব্য। বাস্তু হারানোর গল্প, পথচলার কথা, পুনর্বাসন-পুনর্জন্ম ইত্যাদি ঢুকে পড়ে ইতিহাসের অলিন্দে। সংখ্যা-তথ্য-তত্ত্বের বাইরে পথচলার অভিজ্ঞতা, আবেগের ইতিহাস, স্মৃতি-উদ্ভাসনের কাহিনি, সব কিছুই নতুন গবেষণার প্রকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়। উত্তর-প্রজন্ম এই সবের মধ্যে আত্ম-পরিচিতির উপাদান খুঁজে পায়। আলোচ্য পুস্তকটিও এই ধারার গবেষণার ফসল।

বাংলার পার্টিশন-কথাঃ উত্তর প্রজন্মের খোঁজ তিন খণ্ডে পরিকল্পিত গ্রন্থ, তার প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হল সম্প্রতি। বাকি দু’খণ্ড প্রকাশিত হবে আগামীতে। প্রস্তাবনায় প্রকল্পটি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে। প্রকল্পের অধীনে নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলির বৈশিষ্ট্য হল, সাক্ষাৎকারদাতারা প্রত্যেকেই সত্তর-ঊর্ধ্ব, তাঁরা মূলত গ্রাম-মফস্বল থেকে উঠে আসা মানুষ। পশ্চিমবঙ্গে থিতুও হয়েছেন শহর থেকে দূরে - গ্রামে-গঞ্জে, রেলস্টেশনের পাশে গড়ে ওঠা শহরতলিতে অথবা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। অনেকেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তাদের বক্তব্য খবরের কাগজ বা বই-এর পাতায় সেভাবে স্থান পায় নি। তাঁরা নিজেরাও কোনোদিন লেখেন নি জীবনকথা, ভাবেন নি কোনোদিন লিখবেন। অথচ নিয়তই স্বজন-সন্ততিদের শুনিয়ে গেছেন সেই অফুরান ভাঙন ও অর্জনের গল্প। এখানে গ্রন্থিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার এমনই তিরিশ জন মানুষের জীবনভাষ্য। আলোচ্য গ্রন্থটির মূল গুরুত্ব এখানেই। তিরিশটি জীবনভাষ্যই পাঠক সাধারণ বা গবেষকদের কাছে সমান গুরুত্বের।

যারা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাদের অনেকেই সাক্ষাৎকার প্রদানকারীদের চেনা মানুষ, একাধিকবার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাদের ‘জীবনের গল্প’ তুলে আনা তাই অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে। ‘জীবনভাষ্য’ নির্মাণে তিনটি ভাগকে লক্ষ করা হয়েছেঃ শৈশব থেকে যৌবনকাল (পূর্ববঙ্গের স্মৃতি ইত্যাদি); পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাসনের সময়ে গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সম্পর্কে স্মৃতি; ও পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুজীবনের কথা। এভাবে দেশভাগের পূর্বাপর সময়ের আর্থ-সামাজিক জীবনের খুঁটিনাটি উঠে আসে, উঠে আসে উদ্বাসনের অভিজ্ঞতা, পাওয়া না-পাওয়ার গল্প। স্পষ্ট হয় স্মৃতির চলন-পথ। নৃশংসতার পাশে পাশে দেখা দেয় সম্প্রীতির ছবি। সাম্প্রতিক নতুন ধারায় পার্টিশন চর্চায় সম্প্রীতির গল্প রক্তক্ষয়ী হানাহানির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে না। Anam Zakaria’s The Footprints of Partition: Narratives of Four Generations of Pakistanis and Indians (2015), Kavita Panjabi-র লেখা ‘A Unique Grace’ রচনায় (যা Urvashi Butalia সম্পাদিত Partition: The Long Shadow (2015) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত) এবং এইরকম বেশ কিছু আলোচনায় এই ধরণের সম্প্রীতির ভাষ্য উঠে আসে। প্রতিবেশী, প্রতিযোগী রাষ্ট্রগুলির রনংদেহি হুংকারের মাঝে দুই দেশের সাধারণ মানুষের সম্প্রীতিবোধ আশা জাগায় বৈকি।

প্রবন্ধ অংশে আছে ছয়টি মূল্যবান প্রবন্ধ। তার মধ্যে দু’টি সমীক্ষামূলক। প্রতিটি প্রবন্ধই অনুপুঙ্ক্ষ গবেষণার ফসল, কয়েকটি স্পষ্টতই রিপোজিটরি থেকে সংগৃহীত তথ্য-নির্ভর। শক্তিনাথ ঝা গবেষক হিসেবে সুপরিচিত। এখানে উনি দেশভাগ ও হিন্দু-মুসলিম বিরোধের চিত্রের মাঝে বাউল, ফকির সম্প্রদায় কীভাবে সম্প্রীতির আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন তা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বাউল-ফকির জীবনচর্যা ও গানের উজ্জ্বল উদ্ধারের পথে শক্তিনাথবাবু এক আত্মবিশ্বাসী অনুসন্ধান করেছেন লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যে সম্প্রীতি ভাবনার। দেশভাগের পরও এই ধারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনিন্দিতা দাশগুপ্ত আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেতার প্রচারের গুরুত্ব নিয়ে। সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী ধ্বংসলীলার মাঝে বেতার প্রচার সাধারণ মানুষকে সাহস জুগিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ দিয়েছিল। পাক সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়ার অব্যবহিত পরেই বেতার প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন কীভাবে ‘শব্দসৈনিকেরা’ মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট তৈরি করেন এবং নানা প্রতিকূলতার মাঝে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যান। উত্তমকুমার বিশ্বাস বাংলার পার্টিশনের পরিপ্রেক্ষিতে শত্রু-সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, সেটির প্রয়োগ ও জটিলতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভারতে ও পূর্ব পাকিস্তানে/বাংলাদেশে বিভিন্ন কেস-স্টাডি পর্যালোচনা করেছেন, তাদের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন এবং সাহিত্যে কীভাবে এর প্রতিফলন হয়েছে তা দেখিয়েছেন। তথ্যনির্ভর, সুলিখিত এই প্রবন্ধটি বাংলা পার্টিশনের কম আলোচিত একটি দিক তুলে ধরেছে। শুভাশিস মণ্ডল রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন নবপর্যায়’ পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে অক্লান্ত লিখে গেছেন এই পত্রিকায়। স্বদেশ নিয়ে তৎকালীন লেখকেরা (যেমন অক্ষয়কুমার মৈত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) বাঙালি জাতিসত্তা ও তার বিভাজনের প্রচেষ্টা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। সেগুলিতে কীভাবে বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে তার বিশ্লেষণ আছে এই প্রবন্ধে। স্বদেশভাবনা, দেশগঠন পরিকল্পনা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লেখাগুলির একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন লেখক। ভবিষ্যৎ গবেষণায় এই তালিকা সহায়ক হবে। দুটি সমীক্ষামূলক লেখা নদিয়ার কুপার্স মহিলা ক্যাম্প ও সীমান্তবর্তী গ্রাম ‘চরমেঘনা’ ও প্রতিকূল সম্পত্তির জনজীবন নিয়ে। প্রথমটি লিখেছেন প্রদীপ অধিকারী ও দীপিকা মণ্ডল, দ্বিতীয়টি লিখেছেন অনুদেব মজুমদার। প্রথমটিতে মহিলা কুপার্স ক্যাম্পে যাঁরা এখনও আছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। স্মৃতি-কথায় উঠে এসেছে মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের মানবিক পরিচয়, ক্যাম্পে সুব্যবস্থার কথা। বর্তমানে যে দুরবস্থার মধ্যে তাদের সেই ক্যাম্পেই জীবনযাপন করতে হচ্ছে তার বিবরণও তাঁরা দিয়েছেন। অনুদেব মজুমদারের প্রতিবেদনমূলক প্রবন্ধটিও একটি মূল্যবান সংযোজন। চরমেঘনায় গড়ে ওঠা প্রতিকূল সম্পত্তি দেশ-বিভাগের বিষফল। এখানকার যারা অধিবাসী তাদের জীবন যন্ত্রণার নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে এই নিবন্ধটিতে।

পরিশিষ্টে গ্রন্থিত হয়েছে ‘বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরি’র প্রথম পর্যায়ে গৃহিত ২৫৪টি সাক্ষাৎকারের পূর্ণাঙ্গ ক্যাটালগ, যা কাজে লাগবে ভবিষ্যতের গবেষকদের। মুদ্রণপ্রমাদ দু’একটি চোখে পড়েছে, কিন্তু তা সামান্যই। এ বাদে, বইটির প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সম্পাদনার কাজ বিশেষ প্রশংসনীয়। বইটি যে পাঠকসমাজে সমাদর পাবে সে বিষয়ে এই সমালোচকের কোন সন্দেহ নেই।


তথ্যসূত্রঃ
• Butalia, Urvashi, ed. Partition: The Long Shadow. New Delhi: Zubaan, 2015.
• Butalia, Urvashi, “’1971’ Review: Twists in a Common History”.
• htttp://www.thehindu.com/books/books-reviews/1971. Accessed on 12 Feb, 2021.
• Derrida, Jacques. On Cosmopolitanism and Forgiveness. London, Routledge, 2001.
• Lahiri, Jhumpa. “When Mr. Pirzada Came to Dine”. Interpreter of Maladies: Stories of Bengal, Boston and Beyond. New Delhi: Harper Collins, 1991.
• Manto, Saadat Hasan. “Toba Tek Singh.” Kingdom’s End: Selected Stories. Tr. Khalid Hasan. Gurgaon: Penguin, 2007. p.9-17.
• Sidhwa, Bapsi. “Defend Yourself Against Me”. Their Language of Love. Bapsi Sidhwa. New Delhi: Penguin, 2013. 208-249.
• Zakaria, Anam. 1971: A People’s History for Bangladesh, Pakistan and India. New Delhi: Random House, 2019.

________________________________________
আলোচ্য পুস্তকঃ বাংলার পার্টিশন কথাঃ উত্তর প্রজন্মের খোঁজ
প্রস্তাবনা, সম্পাদনা ও গ্রন্থনাঃ মননকুমার মণ্ডল
প্রকাশকঃ নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
পরিবেশকঃ দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

রয়্যাল সাইজ। ৩৫২ পৃষ্ঠা। ৫৫০ টাকা।