আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

অমানুষের ভাষা চর্চা

পল্লব বরন পাল


কৈফিয়ৎঃ

ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি আসতেই মনের মধ্যে উৎসবের ঢ্যাংকুনাকুড় - ভাষা পুজো। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হুকুমে বিশ্ব জুড়ে স্ব স্ব ভাষায় ভাসাভাসির দিন একুশে। সুতরাং, মাস পড়তেই আমাদের দৈনিক ভাষা-যাপনে হঠাৎ ধুলোটুলো ঝেড়ে সাজো সাজো ভাব - মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি... - গোটা মাস জুড়ে ‘ভাষা মেলা’ - দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র - প্রবন্ধ, ইতিহাস, ভাষার উত্থান ও পতন, সেমিনার নাটক লিটল ম্যাগাজিন ব্লগজিন ইত্যাদি ইত্যাদি -

এ সবকিছুর কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো মানুষ। মানুষের ভাষা নিয়েই এই উৎসব। ধ্বনি থেকে অক্ষর, অক্ষর থেকে শব্দ, শব্দ থেকে বাক্য - ধ্বনি থেকে বাক্য অবধি এই আস্ত সফরটাই ভাষার এক্তিয়ার। কিন্তু ভাষা কি কেবল মানুষেরই সম্পত্তি? এই উৎসবটা কি শুধু মানুষের?

বাকিংহাম থেকে বহরমপুর - পৃথিবীময় শ্রীব্যাকরণ সিং, B.A. খাদ্যবিশারদদের গাত্রবর্ণের বিভিন্নতা, দাড়ি ও লোমের ডিজাইন ও দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-ব্যাস-ওজন মায় রক্তচাপ ও চোঁয়াঢেকুরের তারতম্য থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তাদের প্রত্যেকের ভাষা একটাই - সে ভাষায় আবার সাকুল্যে একটাই মাত্র শব্দ - ব্যা। যদিও ‘ছাগলে কী না বলে’ ব’লে একটা কথা অধুনা আমাদের বাঙলার রাজনীতিতে অতিপ্রচলিত, যার মানে দাঁড়ায় - ছাগল সংস্কৃত ল্যাটিন ফরাসি ইংরেজি... ‘অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে’ থেকে ‘রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে’...‘সাজানো ঘটনা’ থেকে সেক্সপিয়র গ্যাব্রিয়েলা মার্কোস... স্বয়ংসেবী মদ্ভাগবৎ থেকে স্বরচিত জাতীয় সঙ্গীত... বন্দে মাতরম থেকে জয় শ্রী রাম... ‘মিত্রোওওওওওও’ থেকে ‘বোম মেরে দেবো’ - সবই বলতে পারে, কিন্তু দুঃখের কথা হলো - সত্যি সত্যি ছাগলে ‘ব্যা’ ছাড়া কিছুই বলেনা - কিম্বা হয়তো অনেক কিছুই বলে - আয়নার সামনে বা জনসভায়, ঘন্টাখানেকের তক্কাতক্কিতে অথবা জ্যান্ত মুখবইতে - কিন্তু আমাদের, মানে মানুষের কানে ঐ একটাই মাত্র শব্দ শুনতে পাই - ‘ব্যা’।

গুয়াতেমালার গরুদেরও নাকি গরুমারা জঙ্গলের গরুর মতোই ‘হাম্বা’য় আনন্দ, ‘হাম্বা’য় দুঃখ, ‘হাম্বা’তেই প্রেম-ফুর্তি-হৈহৈ আবার ভয়-ভাবনা-ভির্মিও - সে কুঁজওলা বা কুঁজহীন যাই হোক না কেন, ‘হাম্বা’ - সে কুঁজে সোনা থাকুক ছাই না থাকুক, ‘হাম্বা’ - সে গরুর মূত্রে করোনার অ্যান্টিবডি অথবা ভ্যাক্সিন থাকলেও ‘হাম্বা’, না থাকলেও ‘হাম্বা’ - গোবরে পদ্ম ফুটুক না ফুটুক, ফুল ‘হাম্বা’ - তার গায়ের রঙ সাদা কালো বাদামী যাই হোক না কেন, ‘হাম্বা’ বর্ণবিদ্বেষী নয় মোটেই - এমনকি নার্সারি রাইমসের বইয়ে লাফ দিয়ে চাঁদ ডিঙিয়ে যাবার সময়েও সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ ‘হাম্বা’।

কাজিপাড়া থেকে কামস্কাটকা - পৃথিবীর সর্বত্র কাকেশ্বরদের গলা ভাঙা - কাকেশ্বরীরাও কিন্বরীকন্ঠী নয় - শিরিসকাগজের মতো কর্কশ একটা অসম্ভব খ্যারখেরে ‘কা’-‘কা’ শব্দেই তারা বাবা-মা-মাসি-পিসিসহ দুনিয়াশুদ্ধ সবাইকে কাকা বলে সম্বোধন করে, খিস্তি থেকে আদর - ঐ ‘কা-কা’ই ওদের নিজেদের মধ্যে সবরকম ভাবের আদানপ্রদানের একমাত্র শব্দ। এক দেশ এক নেতার মতোন এক ভাষা এক শব্দ। খাদ্যটুকরোর চারপাশে বৃত্তবৈঠক বা ইলেক্ট্রিকের তারে ওদের সরলরৈখিক সারিবদ্ধ পার্টিসম্মেলনে উত্তেজিত ভাষণ বা কা-কাষণ আমরা প্রায় সকলেই দেখেছি বা শুনেছি।

টিটাগড় থেকে টিউনিশিয়ার ঘরের দেয়ালে বা সিলিঙে টিকটিকিদের গলাতেও একটাই শব্দ, একটাই ভাষা - ‘টিক-টিক’ - পৃথিবীর সর্বত্র ঘড়িদের মতন - সম্ভবত সেই কারণেই দেয়ালঘড়ির পিছনেই টিকটিকিদের আজন্ম বসবাস - তাই একই ভাষায় দুজনে কথা বলে - যদিও ঘড়ি আদপে একটি যন্ত্র, আর যন্ত্রের ভাষা ঠিক করে দিয়েছিলো আবিষ্কর্তা মিশরীয় মানুষ - যন্ত্রের নিজস্ব কোনো ভাষা হয়না - আচ্ছা, ঘড়ির ভাষা ‘টিক-টিক’ হলো কেন? আবিষ্কারের মুহূর্তে কোনো টিকটিকি ডেকে উঠেছিলো বলে কি? আমাদের সার্বজনীন সিধুজ্যাঠা ওরফে গুগুলদাদুকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে।

যতো হিঁদ-হিঁদ-হিঁদিক্কারী ফ্যাচাং তৈরি করেছে মানুষ - যারা নাকি এই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত প্রাণী, এবং সবচেয়ে জটিল প্রাণী - আচ্ছা, উন্নতির সঙ্গে জটিলতার সম্পর্কটা সমানুপাতিক কেন? এই যে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, সে কি এই বিশ্বায়িত উন্নতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? এমন উন্নতিই কী আমরা চেয়েছি, যা আমাদের শুধু কর্মহীন অলস এবং জটিল করে তুলবে? ভাবতে পারেন, পরিসংখ্যান বলছে - মানুষের পৃথিবীতে স্বীকৃত জীবিত ভাষার সংখ্যা - (লক্ষ্য করুন, ‘জীবিত ভাষা’ - মানে ভাষারও জীবন-মৃত্যু আছে - আমরা তো এযাবৎকাল জানতাম, একমাত্র প্রাণ থাকলে তবেই জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন - তবে কি ভাষারও প্রাণ আছে? ভাষাও কি মেরুদণ্ডী বা অমেরুদণ্ডী প্রাণী নাকি? শব্দ বুঝি সেই প্রাণীর শরীরের মাংসপেশি আর অক্ষর শিরদাঁড়ার হাড়? ওরে বাবা, আরো জটিল হয়ে সব গুলিয়ে যাচ্ছে যে!) - তো সেই স্বীকৃত জীবিত ভাষার সংখ্যা ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী ৭১০২টি, যার মাত্র ৬ শতাংশ ভাষা ব্যবহার করে পৃথিবীর ৯৪ শতাংশ মানুষ, এবং বলা বাহুল্য, অবশিষ্ট ৯৪ শতাংশ ভাষা ব্যবহার করে বাকি ৬ শতাংশ মানুষ! হাজার হাজার হাজরার মতো হাজার হাজার ভাষা, তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ শব্দ - কোটি কোটি প্রয়োগের নিয়মাবলী - কী যাচ্ছেতাই ব্যাপার! যত্তোসব!

ভাষা কী?

ভাষা কথা বলার একটা সাংকেতিক পদ্ধতি - এক বা একাধিক জীবগোষ্ঠীর সবাই যে যে সংকেতগুলো জানে এবং পদ্ধতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। এককথায় - ভাষা হলো মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মনের ভাব প্রকাশ করা যায় কথার মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে, অথবা চোখের দৃষ্টি বা শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন ইঙ্গিত বা ভঙ্গি দিয়ে। সেই সূত্রে মুখের বা লেখার ভাষা, চোখের ভাষা বা শরীরের ভাষা ইত্যাদি - ভাষার এরকম বিভিন্ন প্রকাশভেদ আছে। তার মানে ভাষা থাকলেই যে লিপি আছে, তা সব ক্ষেত্রে ঠিক নাও হতে পারে, তবে কোনো না কোনোরকমের সংকেত যে কোনো ভাষার ক্ষেত্রে অবশ্যই আছে। এবং যে কোনো ভাষারই প্রয়োগের প্রাথমিক শর্ত হলো - মন থাকতে হবে, সেই মনের আবার ভাব থাকতে হবে, যে ভাব শুধু থাকলেই হবে না, প্রকাশ করতেও হবে, অথবা অন্য স্বজাতি-স্বভাষীদের জানানোর তাগিদ থাকতে হবে।

প্রাণ যার আছে, তারই মন আছে, বোধ আছে - এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। আমরা জানি। সুতরাং, যে কোনো প্রাণীরই কবি সুনীলের ভাষায় ‘কথা আছে, ঢের কথা আছে’ - সেই কথা প্রকাশের তাগিদের জন্য কোনো না কোনো পদ্ধতি আছে, অর্থাৎ ভাষা আছে, মানে থাকবার কথা।

ব্যাস, এই অবধি লিখিয়াই স্বখাতসলিলে আমার নির্বিকল্প সমাধি হইলো, মানে ঝপ্‌ করিয়া স্বখোদিত ঝামেলাপুকুরে পপাত চ মমাত চ। প্রিয় পাঠক, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে তোল্লা মেরে তরতর করে গাছের মগডালে উঠে বসেছি ভাষার মতো ভয়ঙ্কর বোম্বাস্টিক বিষয় নিয়ে লিখতে। এখন কে বাঁচাবে আমাকে? ‘না বাঁচাবে আমায় যদি, মারবে কেন তবে?’ এই যে বললাম - যে কোনো প্রাণীরই ভাষা আছে - যে গাছের মগডালে এই মুহূর্তে বসে আছি, সেই গাছেরও তো প্রাণ আছে - তো, তার ভাষাটা কী? এই যে ছিয়ানব্বই কিলোর একটা মানুষ বা কুমড়োপটাশ বলা নেই কওয়া নেই হুড়মুড় করে মগডাল অবধি উঠে গেলো - গাছ তো একবারও ‘উঃ-আঃ-ওরে বাবারে’ মার্কা কোনো মন্তব্য করে উঠলো বলে শুনলাম না! তর্কের খাতিরে নাহয় ধরে নিলাম, আমি গাছ নই, তাই গাছের ভাষা শুনতে পাইনি। কিন্তু বলেছে নিশ্চয়ই পাশের গাছটার উদ্দেশে। তাহলে পাশের গাছটা অবশ্যই ওই ‘উঃ আঃ ওরে বাবারে’ শুনেছে - তো, শুনে উত্তরে সে কী বললো? ‘নাকিকান্না না কেঁদে কাঁধ ঝেড়ে ফেলে দে না হুমদো ব্যাটাকে’ - বললো? মানে নিজেদের ভাষাতেই বললো নিশ্চয়ই? কিন্তু কোথা থেকে বললো? শুনতে না পাই, কথা চালাচালি যে হলো - বুঝতেও পারলাম না তো! গাছের মুখ কোথায়? চোখ কান কোথায়? নাকি শুধুই শরীরী ভাষায় ওয়াইফাই হোয়াট্‌স্‌আপ - সাঙ্কেতিক কথোপকথন?

ছোটোবেলায় ইশকুলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে লেখা থাকতো - অমুক সম্পর্কে যাহা জান নিজ ভাষায় লিখ - এখনও এইরকম লেখা থাকে কিনা অবশ্য জানিনা - কিন্তু ‘নিজ ভাষায়’ কেন? মানে অতীতে আমার থেকেও কয়েক ডিগ্রি বেশি ফাঁকিবাজ ও দুষ্টুবুদ্ধির কোনো ছাত্র কখনো ১৬ নম্বরের প্রশ্নের উত্তরে ছাগলের ভাষায় একটি ‘ব্যা’ লিখে নম্বর দাবি করেছিলো? নাকি এই বাংলা প্রশ্নের উত্তরে কেউ এর আগে ব্রাহ্মী বা পালি ভাষায় উত্তর লিখেছিলো? তারপর থেকেই এই সাবধানতা? ও গুগুলদাদু, আপনি কি এ সম্পর্কে কিছু জানেন?

তো, যেভাবেই হোক, গাছে যখন উঠেইছি, তবে ভাষা প্রসঙ্গেও খানিক গেছো হয়েই থাকি না কেন? তবে, নিজভাষায় লিখতে হবে - শর্তটা না থাকলে একটা প্রকাণ্ড ‘ব্যা’ লিখে প্রবন্ধটা স্যাটাস্যাট লিখে হাত ধুয়ে ফেলতে পারতাম, কিন্তু সে গুড়ে বালি। শুনেছি, বহুকাল আগে গাছের ছাল দিয়ে নাকি তৈরি হতো লেখার পাতা। তারও আগে নিশ্চয়ই গাছের গায়েই মানুষ লেখালেখির কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলো। জলপাই কাঠের এস্রাজ বাজাতে বাজাতে আধুনিক এক কবি কয়েক দশক আগে ছুরি দিয়ে সব শাল গাছে গাছে তাঁর ইচ্ছে লিখেছিলেন - মানুষকবির সেই খোদিত ইচ্ছের আঘাতে শালগাছেদের রক্তক্ষরণ বা মর্মন্তুদ চীৎকার কোন ভাষায় কিভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো - মৃদুল দাশগুপ্ত স্বয়ং সম্ভবত জানেন না। জানলে নিশ্চয়ই তাঁর শালগাছের গায়ে লিখতে গিয়ে ছুরি কেঁপে উঠতো। মৃদুলের থেকে বয়সে অগ্রজ এক দাশগুপ্ত কবি মঞ্জুষ অবশ্য বলছেন অন্য কথা -

‘গাছের গায়ে কখনো লিখবোনা
আমি তোমার নাম
শব্দবিহীন রক্তপাতে গাছ
দিতেও পারে গান্ধারীর শাপ’

লক্ষ্য করুন পাঠক, কবি মঞ্জুষ কিন্তু গাছেদের ভাষার অস্তিত্ব সম্পর্কে একেবারে নিঃসন্দেহ - তাঁর একমাত্র আশংকা অভিশাপের ভাষা নিয়ে। গাছের গায়ে নাম লিখলে হয়তো তিনি সে শাপের সম্পর্কে বিষদ শুনতে পেতেন, কিন্তু লিখে উঠতে পারেননি, তাই গাছেদের ভাষা সম্পর্কে জানতেও পারেননি।

জানতে পেরেছিলেন একমাত্র বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু - গাছেরা আঘাত পেলে প্রতিক্রিয়ায় সে কী বলে, উনি শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর নিজের আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র দিয়ে। সে সব তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় শিশুদের উপযোগী করে লিখেও গেছেন তাঁর ‘আহত উদ্ভিদ’ ‘গাছের কথা’ সহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক রচনায়।

‘গাছের লিখনভঙ্গী ব্যাখ্যা অনেক সময় সাপেক্ষ। তবে উত্তেজিত অবস্থায় সাড়া বড় হয়, বিমর্ষ অবস্থায় সাড়া ছোট হয়, মুমূর্ষু অবস্থায় সাড়া লুপ্তপ্রায় হয়। ...এই যে সাড়ালিপি সম্মুখে দেখিতেছেন, তাহা লিখিবার সময় আকাশ ভরিয়া পূর্ণ আলো, বৃক্ষ উৎফুল্ল অবস্থায় ছিল, সেইজন্য সাড়াগুলির পরিমাণ কেমন বৃহৎ। দেখিতে দেখিতে সাড়ার মাত্রা হঠাৎ ছোট হইয়া গেল... বাহিরে আসিয়া দেখিলাম সূর্য্যের সম্মুখে একখানা ক্ষুদ্র মেঘখণ্ড বাতাসে উড়িয়া যাইতেছে... গাছ টের পাইয়াছিল, সে ছোট্ট সাড়া দিয়া তাহার বিমর্ষতা জ্ঞাপন করিল। ...যে সকল উদাহরণ দেওয়া গেল, তাহা হইতে বুঝিতে পারিবেন যে, বৃক্ষ লিখিত সাড়ালিপি দ্বারা তাহার জীবনের গুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে’।

হে পাঠক, ক্ষমা করবেন, আমার এই এক দোষ - খেই হারিয়ে আমি মাঝেমাঝেই বড্ডো বাজে বকি। ভুলে গেছিলাম - লিপি নয়, আমার অর্বাচীন বকবকের বিষয় ‘ভাষা’। বৃক্ষের সাড়ালিপি বা তাদের গুপ্ত ইতিহাস - সে সব অন্য প্রসঙ্গ, অন্যত্র সে নিয়ে বকবক করবেন জগদীশচন্দ্রের উত্তরাধিকারী কোনো বিজ্ঞানী বা গবেষক পণ্ডিত - এই মূর্খ রচনা-লেখকের কম্মো নয়, সে স্পর্ধাও নেই। আপাতত গাছের মগডালে আছি, আরো কিছু সময় সেখানেই থাকা নিরাপদ। কারণ, নিচে বন্দুক হাতে স্বয়ং আপনি ট্রিগারে আঙুল রেখে দাঁড়িয়ে।

‘গাছের বিষয়েও
আমরা বিশেষ কিছুই জানিনা -
এক একটা গাছের সঙ্গে
সারাজীবন থেকে যেতে ইচ্ছে করে’

কবি ভাস্কর চক্রবর্তী - কিন্তু ভাস্করদা, সারাজীবন কারুর সঙ্গে থাকতে গেলে তো নিদেনপক্ষে তার সঙ্গে কথাবার্তার সেতুবন্ধনটুকু দরকার, নইলে তো উন্মাদ হয়ে যেতে হয় - যদি গাছের ভাষা বোঝা যেতো, তবে হয়তো আপনার ইচ্ছাপূরণ হতো। তা হয়নি। কারণ, পূরণ হলে নিশ্চয়ই আপনি গাছের সঙ্গে সহবাস করতেন, লিখতেন, আমাদের জানাতেনও। আপনি পারেননি, অথচ বৃদ্ধ গাছদাদুর ভাষা বুঝতে পেরেছিলো মাত্র দেড় বছরের এক সামান্য শিশু - কবি জয় গোস্বামী খুব নিবিষ্ট চিত্তে সে সব দেখেছেন ও ধারাবিবরণীর ঢঙে লিখেওছেন -

...রাস্তার ওইপাশের ঢালু দিয়ে
খোয়া ভর্তি ঝুড়ি মাথায় উঠে আসছে মজুর মেয়ে
পেছন দিকে ঘুরে ঘুরেই তাকাচ্ছে - যেখানে
পথের পাশের দেবদারুটি বৃদ্ধ মাতামহ
দেড় বছরের ছেলেকে তার একটা-দুটো পাতা ফেলে ভুলিয়ে রাখছেন

মাটিতে এলোমেলো ফেলে রাখা দেবদারুপাতারা তাদের ফিসফিস কথা দিয়ে, ওড়াউড়ির ভঙ্গি দিয়ে গল্প করছে দেড় বছরের এক অবোধ শিশুর সাথে - যেমন যাবার বেলায় ‘গোলাপফুল’ কবি অমিতাভ দাশগুপ্তকে গভীর গোপন এমন কিছু কথা বলে গেছে ‘সে সব এতই ব্যক্তিগত, এত মধ্যযামিনী-র, যা প্রেমের চেয়ে বেশি, কবিতার চেয়ে আরও বেশি’। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ নিজের কানে শুনেছেন গাছের ভাষা - স্পষ্ট - রীতিমতো নিভৃত কথোপকথনও চালিয়ে গেছেন গাছের সঙ্গে -

‘ওগো বনস্পতি, জন্মমাত্র-ই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ যে আনন্দধ্বনি করে উঠেছিলো, সেই ধ্বনি তোমার শাখায় শাখায় - তার মধ্যে কতো রঙ, কতো গন্ধ, কতো রস... তোমার পাতারা বলছে - প্রাণ যতক্ষণ নেই ততক্ষণ সমস্তই কেবল স্তুপ, সমস্তই শুধু ভার।’

উরিস্যাবাস! বুঝুন, শুধু গাছের পাতাদের পরিষ্কার বাঙলায় বলা কথা শুনেছেন, তাই নয়| আবার গাছেদের ধ্বনির রঙ ধ্বনির গন্ধ - ধ্বনির আবার রঙ-গন্ধ - ভাবা যায়? ওনার গঞ্জিকাসক্তির আশঙ্কা করলে বিলক্ষণ গণধোলাই খাবো - তাই চোখ বুঁজেই বিশ্বাস করে নিলাম যে, উনি সে ধ্বনির রঙ সচক্ষে দেখেছেন, গন্ধ শুঁকেছেন ও আহ্লাদিত হয়েছেন, ভাষার রসপানও করেছেন| কিন্তু কিভাবে? কই, আর কেউ তো এমন করে পায় না! ‘গাছের কথা’ প্রবন্ধে জগদীশচন্দ্র বলেছেন -

‘...আমাদের খোকা অনেক কথা ফুটিয়া বলেনা; চক্ষু, মুখ ও হাত নাড়া, মাথা নাড়া প্রভৃতির দ্বারা আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা কয়, আমরা তাহা বুঝিতে পারি, অন্যে বুঝিতে পারে না। একদিন পার্শ্বের বাড়ী হইতে একটি পায়রা উড়িয়া আসিয়া আমাদের বাড়ীতে বসিয়া গলা ফুলাইয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল। পায়রার সঙ্গে খোকার নূতন পরিচয়, খোকা তাহার অনুকরণে ডাকিতে লাগিল। ...একদিন বাড়ী আসিয়া দেখি, খোকার বড় জ্বর হইয়াছে; মাথার বেদনায় চক্ষু মুদিয়া বিছানায় পড়িয়া আছে। ...আমার হাতের স্পর্শে খোকা আমাকে চিনিল ...তারপর পায়রার ডাক ডাকিল। ঐ ডাকের ভিতর আমি অনেক কথা শুনিলাম। বুঝিতে পারিলাম, খোকা বলিতেছে, “...খোকা তোমাকে বড় ভালবাসে”। আরও অনেক কথা বুঝিলাম, যাহা আমিও কোন কথার দ্বারা বুঝাইতে পারি না। যদি বল, পায়রার ডাকের ভিতর এত কথা কী করিয়া শুনিলে? তাহার উত্তর এই - খোকাকে ভালবাসি বলিয়া। তোমরা দেখিয়াছ, ছেলের মুখ দেখিয়া মা বুঝিতে পারেন, ছেলে কী চায়? অনেক সময় কথারও আবশ্যক হয় না। ভালবাসিয়া দেখিলেই অনেক গুণ দেখিতে পাওয়া যায়, অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়।”

কবিদের এই এক সুবিধে। স্বভাবপ্রেমিক। জয়ের কবিতার দেড় বছরের ঐ শিশুর মতো কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত বা রবিঠাকুরও জানতেন - গাছকে তেমনতেমন করে ভালোবাসলে তার ভাষা অবশ্যই বোঝা যায়, ভাবের আদানপ্রদান করা যায়। শুধু গাছকে? তা কেন? ভালোবাসা কি কোনোদিন এরকম কোনো সীমানা শর্ত মানে নাকি?

সৃষ্টি যার নাগাল পায়না, বিজ্ঞান যেখানে এখনও পৌঁছতে পারেনি, শুধুমাত্র ভালোবেসেই কবিদের সে সব স্টেশনে অবাধ অনায়াস যাতায়াত - বিনা টিকিটের ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মতো।

‘...সে নদীর দু’দিকে দুটো মুখ
এক মুখে সে আমাকে
আসছি বলে
দাঁড় করিয়ে রেখে
অন্যমুখে ছুটতে ছুটতে চলে গেল

আর যেতে যেতে বলে গেল -
আমি অমনি করেই যাই
অমনি করেই আসি

বুঝিয়ে গেল -
আমি থেকেও নেই
না থেকেও আছি

আমার কাঁধের ওপর হাত রাখল সময়
তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললে -
দেখলে? কাণ্ডটা দেখলে?
আমি কিন্তু কক্ষনো তোমায় ছেড়ে থাকি না।’

কবি সুভাষের নদী ও সময় তো যেন কবির একেবারে চায়ের দোকানের আড্ডাবাজ ইয়ার দোস্ত, শালা মাইরি সম্পর্ক, এবং নিতান্তই পাড়াতুতো বাঙালি আর বাঙলা ভাষায় তাদের রীতিমতো দার্শনিকের মতো অসম্ভব গভীর ব্যুৎপত্তি। রবিঠাকুর অবশ্য এ ব্যাপারেও অন্য সব কবিদের থেকে অনেক এগিয়ে - তাঁর এইরকম মহাজাগতিক দোস্তি সম্পর্কে সরাসরি নিজেই কবুল করেছেন -

আঁধার বাতায়নে
একলা আমার কানাকানি
ঐ আকাশের সনে।
...আজ আকাশের মনের কথা ঝরোঝরো বাজে

দোস্তি প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো - না পাঠক, এবারে আমি সাবধানী, কথার খেই হারাইনি - রবিঠাকুরের এক স্বনামধন্য দোস্তের নাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি - যাঁর ‘টুনটুনির বই’য়ের পাতায় পাতায় টুনটুনিপাখি শেয়াল কুমীর বাঘেরা তাদের নিজভাষায় নয়, মানুষের ভাষায় রাজা থেকে চাষী জোলা থেকে পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে অনর্গল কথা বলেছে। সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’-এ তো ছাগল কাক বেড়াল সজারু প্যাঁচা কুমীরসহ আস্ত চিড়িয়াখানাটাই মানুষের ভাষায় কথাবার্তা বলেছে। অথচ, আমরা মানুষ হয়ে ওদের ভাষায় কথা বলতে পারিনা। ছিঃ ছিঃ - ওরা পারে, আমরা পারিনা - ভাষাতেও ‘আমরা ওরা’ - এই অপমানের লজ্জ্বা মানুষ হিসেবে কোথায় লুকোই?

প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ সি এল বার্বের বলেছেন - It is language that distinguishes man from the rest of the animal world. কী সাঙ্ঘাতিক কথাবার্তা!! কী বর্বরোচিত বক্তব্য বার্বের সাহেবের? আমার সঙ্গে শুয়োরের বাচ্চার তফাৎ একমাত্র ভাষায়? ব্যাটা পাগল না পাশবালিশ? যদিও চেহারায় আমিও ছাব্বিশ ইঞ্চি ছাব্বিশ ইঞ্চি ছাব্বিশ ইঞ্চি (মাপ করবেন, ছাব্বিশের জায়গায় এখানে ছেচল্লিশ পড়তে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে) - তবে আমার স্ত্রী অবশ্য এ কথা শুনলে বিলক্ষণ আশ্বস্ত ও উৎফুল্ল হবেন, কারণ, তিনি বার্বেরবিরোধী - তাঁর মতে আমিও নাকি রেগে গেলে ঘোঁৎ ঘোৎ শব্দ করি - ওই ইয়ের বাবাদের মতোই।

কিন্তু বার্বের সাহেবের ওই কথাটা আরো একটু বোঝা দরকার, মানে জটায়ুর ভাষায় ‘কাল্টিভেট’ করা দরকার - নইলে বাকি জানোয়ারদের থেকে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সংশয় বিতর্ক থেকেই যাবে, শেষ হবেনা।

পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মানুষের ভাষা আর অমানুষের ভাষায় আসমান-জমিন ফারাক। মৌমাছি বা বাঁদরের মতো অমানুষদের ভাষায় ভাব প্রকাশের সম্ভাব্য উপায় বড্ডো কম, মানে গুটিকয়েক - সংখ্যাটা ঠিক কতো, দয়া করে আমাকে না জিজ্ঞেস করে কোনো অমানুষ ভাষাতাত্ত্বিককে ধরুন, তিনি বলে দেবেন।

আমি যেটুকু মোদ্দা জানি, সেটা হলো - মানুষের ভাষাশিক্ষা ঘটে খুব স্বাভাবিক পদ্ধতিতে - যে ভাষা-পরিবেশে সে জন্ম নেয় বড়ো হয়, শুনতে শুনতে বুঝতে বুঝতে সেই ভাষা সে আপনা আপনি শেখে। মাতৃভাষা। এ অবধি অবশ্য মানুষের সঙ্গে যে কোনো অমানুষ বা জন্তু জানোয়ারের কোনো তফাৎ নেই। কিন্তু মানুষের ভাষায় এই ভাব প্রকাশের উপায় অসংখ্য ও অনন্ত। এবং একমাত্র মানুষই নির্দিষ্ট কয়েকটি বর্ণ বা অক্ষর নিয়ে ভাব প্রকাশের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে - পুরনো শব্দকে ভাঙছে - নিত্য নতুন শব্দ বাক্য প্রতিনিয়ত তৈরি করছে, করেই চলেছে - যেখানে অমানুষেরা - পিঁপড়ে মাছি থেকে হাঙর বাঁদর, গরু ছাগল থেকে টিকটিকি কাক - সবার ক্ষেত্রেই - মূলত জীনগত কারণে সীমিত সংখ্যক উচ্চারণের মাধ্যমেই ভাবপ্রকাশ বা পারস্পরিক যোগাযোগ নির্ধারিত। সকলেই এ অন্যের সঙ্গে মনের ভাব আদানপ্রদান করে গুটিকয়েক সঙ্কেতের মাধ্যমে। ছাগল ভালোবেসেও বলে ‘ব্যা’, রেগে অগ্নিশর্মা হয়েও বলে ‘ব্যা’। মানুষ প্রথম ক্ষেত্রে গদগদ সুরে বলবে ‘চুমু খাবো’ আর পরের ক্ষেত্রে চীৎকার করে বলবে ‘প্যাঁদাবো’। একমাত্র মানুষই অনেক ধরণের ভাব প্রকাশের জন্য অনেকরকমের সঙ্কেত এককাট্টা করে ভাষা তৈরি করতে পেরেছে। পেরেছে তার কারণ, মানুষের উন্নততম মগজ - সেই মগজের বাইরের দিকে একটা speech centre বা বাচনকেন্দ্র আছে, যেটা নাকি শুধু মানুষেরই মাথার মধ্যে আছে - যাকে সংগঠিত শব্দনির্মাণ কেন্দ্র বললে বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে। সেইখানে তৈরি হয় শব্দ, তারপর স্নায়ু বেয়ে গলা জিভ মুখগহ্বর ঠোঁট ইত্যাদিতে বিভিন্ন রকম ঠোকাঠূকি খেয়ে মুখ দিয়ে ধ্বনি হয়ে বেরোয়। এখন এই বাচনকেন্দ্রও কিন্তু হঠাৎ একদিন সক্কালসক্কাল আকাশ থেকে টুপ করে মানুষের মাথার মধ্যে এসে ঢুকে পড়েছে, তা মোটেই নয়। এটারও হাজার হাজার বছরের সুদীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস আছে। মানুষের ভাষার সেই উৎস ও বিবর্তন নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের এখনও নিরন্তর গবেষণা চলছে চলবে।

অন্যান্য প্রাণিদের গোলা মাথায় ওসব বাচনকেন্দ্র-টেন্দ্র নেই, তাই ভাষাও নেহাৎই অজটিল এবং সংক্ষিপ্ত। মানে ওইসব ছাগল-গরু-টিকটিকি-কাকেদের মতো অমানুষদের মানুষের মতো ধুরন্ধর মগজ নেই, তাই ব্যাটারা সহজ সরল, আর তাদের ভাষাও তাই। যেহেতু তারা জটিল নয়, তাই এই অমানুষদের নিয়ে তেমন কোনো সমস্যাও নেই। কিন্তু আর এক ধরণের অমানুষ আছে, যাদের মানুষের মতোই ধুরন্ধর মগজ, কেউ কেউ বলে - সাধারণ মানুষের থেকেও ধুরন্ধরতর - হিংস্র জন্তুদের থেকেও হিংস্রতর - তারাও ‘টুনটুনির বই’য়ের অমানুষদের মতো মানুষের ভাষায় কথা বলে। শুধু তাই নয়, মানুষের শরীর নিয়ে মানুষের সমাজেই তারা মিশে আছে। বোঝার যো নেই। বিজ্ঞানসম্মত ভাষায় তারাও মানুষ। মানুষের মতো তাদের ভাষাও অত্যন্ত জটিল।

না না, আমি মানুষের অনভিধানিক গালাগালির ভাষার কথা বলছি না। সে তো শুনেই বোঝা যায় অমানুষের ভাষা। ব্যাপারটা অতো অজটিল নয়। এ ভাষা শুধু কানে শুনে বোঝার উপায় নেই। অমানুষের এই ভাষায় যা শুনি পড়ি বা বুঝি, আসল কথাটা ঠিক তা নয়। খুব গোলমেলে। এ ভাষায় লিভারপুল বললে বুঝতে হবে লক্ষ্মীকান্তপুর, রাঁচী শুনলে বুঝতে হবে রামকেষ্টপুর - অনেকটা সেই গেছোদাদার সন্ধানসূত্রের মতো - ‘তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারী। যদি মতিহারী যাও, তা’হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর। আবার সেখানে গেলে দেখবে, তিনি গেছেন কাশিমবাজার।’ ভগ্নাংশ বা ত্রৈরাশিকের চেয়েও অনেক জটিল শক্ত অঙ্ক।

এ ভাষা মানুষরূপী অমানুষদের ভাষা। আপাতনিরামিষ, কিন্তু আসলে এ ধ্বংসের ভাষা, হিংস্রতার ভাষা, শয়তানের ভাষা। যে ভাষায় একজন নিজেই নিজেকে ঈশ্বর বলে প্রচার করে অগুনতি মানুষকে দুর্বল অমেরুদণ্ডী নির্বোধ সরীসৃপ বানিয়ে নিজে রাজকীয় ভোগবিলাস লোভ-পাপ-বিকৃতকামে মত্ত থাকেন - যে ভাষায় একজন ‘অচ্ছে দিন’এর স্বপ্ন দেখিয়ে তথাকথিত ধর্মের বিকৃত ত্রিশূল-তরোয়ালে মানুষকে কুচিকুচি কাটেন - যে ভাষায় একজন মানুষ সাধারণ গলায় অনর্গল মিথ্যে কথা বলেন আর চীৎকার করে নিজেকে সততার প্রতীক বলেন এবং ধর্ষণকাণ্ডের মতো জঘন্য অপরাধীদের আড়াল করে ‘সাজানো ঘটনা’ বলেন, নিজেকে সর্বজ্ঞানী সর্বগুনসম্পন্ন বলে দাবী করে সেক্সপিয়র শেলী কীট্‌স্‌ রবীন্দ্রনাথদের সমসাময়িক বলে প্রকাশ্যে নির্লজ্জ বক্তৃতা করেন - একজন মানুষ যে জনপ্রতিনিধির ভাষায় ধর্ষিতাদের ‘হয় চীৎকার করো, নয় উপভোগ করো’ উপদেশ দেন, আর একজন ‘ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করে দেবো’ বলে প্রকাশ্য জনসভায় হুঙ্কার দেন - একটা দেশ, যার নিজের বয়স পাঁচশো বছরমাত্র, যে ভাষায় সে নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ দেশ ব’লে অন্য দেশের পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতাকে বেমালুম ধ্বংস করে চলে, রক্তের বন্যা বইয়ে গোটা পৃথিবীর কুর্ণিশ আদায় করে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে ঘোষণা করে - সেই উন্নততম প্রাণী বা জানোয়ারের ভাষায় আমরা মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করি, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে চীৎকার করে সমস্বরে কোরাসে ডেকে উঠি - ‘ব্যা’। এ রচনার শুরুতে ‘ব্যা’ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বাঙলার প্রচলিত কথাটা ফের মনে পড়ে গেলো - দ্বিতীয়বার লিখতে একটু ‘অম্বিকেশিক’ ভয় কাজ করছে - হে পাঠক, মার্জনা করবেন, যদি কথাটা ভুলে গিয়ে থাকেন, কষ্ট করে শুরুটা আর একবার চুপিচুপি পড়ে নেবেন। সাবধান, কেউ যেন দেখতে না পায়! আর ভুলে না গিয়ে থাকলে, দয়া করে এক্ষুণি ভুলে যান। নইলে আপনার ক্ষেত্রেও ঐ একই অম্বিকেশিয় বিপদ হতে পারে।

তুমুল জমায়েতের মলাটশিখর হয়ে দাঁড়িয়ে
হলুদ গাঁদার কন্ঠহারশোভিত নেতা-অভিনেতা
ভিলেন-বধ মুখে ঘোষণা করলেন -
‘আমার ছেলেরা সব ঘরে ঘরে ঢুকে...’
সমবেত সকলের দু’ঠোঁটের সন্ধিমুখে তোপ হর্ষধ্বনি
ও দু’পায়ের সন্ধিমুখে গোপন শঙ্খধ্বনির
উন্মাদ সিম্ফনিতে চরাচর ম ম করে উঠলো

একটু পরে সন্ধ্যে হলেই
পাড়ার সমস্ত তুলসীমঞ্চে জ্বলে উঠবে
পোড়ামাটির প্রদীপ নয়,
পোড়া ঘরের নীল দীর্ঘশ্বাসশিখায়
সারি সারি মোমবাতি

দ্বিপদী জন্তুরাই শেষমেশ তবে জিতে যাবে?
পৃথিবী কি ফের ফিরে যাবে
নখ-দাঁত আদিম জঙ্গলে?
হিংস্রতা একমাত্র ভাষা হবে সার্বজনীন?
শিরদাঁড়া হাড়গুঁড়ো আমাদের সরীসৃপ মুখে গালে
শুধুমাত্র রেপ-ঋদ্ধ রক্তের সুগন্ধী প্রসাধনী পাউডার?

যে মন্ত্রে এই গোধূলিতে শার্দুল থেকে মুষিক হলাম
সে কি তবে অবধারিত চক্রব্যুহের চিচিং ফাঁক?
আমরা সব অভিমন্যু?
শান্তিঘুমে উপভোগ্য ট্র্যাজিক হিরোর হাততালি?

শেষরাত্রে কমণ্ডলু ফের
উপচে যাক নবতর শব্দ আর অক্ষরগুঁড়োয়
হাড়মন্ত্র নির্মাণ হোক তাম্রপাত্র হিম অন্ধকারে

পুবের আকাশ শিরদাঁড়া টানটান করে
দুপায়ে দাঁড়িয়ে উঠে
নতুন ভাষায়
শুদ্ধ মানুষের স্বরে উচ্চারণ করুক -

ফের শার্দুল হ

সত্যিই আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জানোয়ার! ভাগ্যিস ভাষা বলে একটা ব্যাপার ছিলো, মানে আছে - নইলে অমানুষ জানোয়ারদের থেকে নিজেদের তফাৎ করতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হতো। ভাষা না থাকলে নিজেদের অমানুষিক বর্বর জানোয়ারত্বও এতো সহজে দেখা বা দেখানো যেতো কি? ভাষাই অনিবার্য সেই প্রাথমিক অস্ত্র, যাকে হাতিয়ার করে মানুষ এইসব মানুষরূপী অমানুষদের সঙ্গে লড়াই করবে, তাদের সমূলে ধ্বংস করবে - পৃথিবীকে আরো মানবিক ও সুন্দর করে তুলবে।

তুলবেই।

এ দায় মানুষেরই।

ধন্যবাদ বার্বের সাহেব।