আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দুখিনী সকিনা কান্দে

অনিন্দিতা রায় সাহা


সর্বনাইশ্যা ঘূর্ণি আইস্যা

“সর্বনাইশ্যা ঘূর্ণি আইস্যা বিরান করলো উড়ির চর/ দুখিনী সকিনা কান্দে কোথায় তাহার নতুন বর”। যে কোনো দেশ বা কালেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি বলি হন প্রান্তিক মানুষেরা। অকস্মাৎ কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে জীবনযাপনের ন্যূনতম উপাদান সংগ্রহ করে টিকে থাকা পরিবারের যে কোনো সদস্যের পক্ষেই দুরূহ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার মধ্যেও বোধ হয় বেশি দুর্দশার সম্মুখীন হন সকিনারা। শুধু নতুন বর নয়, হারিয়ে যায় সেই মেয়ের ঘর-গৃহস্থালি। তছনছ হয়ে যায় খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সেই মেয়েদের এমনিতেই দুর্বল জীবনধারণের কাঠামোটা। গরীব সমাজের সকিনাদের ওপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বোঝাটা যেন একটু বেশি রকমের ভারী, তার পিতা-স্বামী-পুত্রের তুলনায় অনেকখানি অতিরিক্ত।

ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে নিত্য ঘটনা। গত বছরের অম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বংসী প্রভাব মাপার কাজ এখনো শেষ হয় নি। প্রাথমিক সমীক্ষা থেকে যেসব চিত্র পাওয়া গিয়েছে, তাতে স্পষ্ট দেখা যায়, এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব মহিলাদের ওপর নিঃসন্দেহে বেশি এবং সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায়। দুর্যোগের সময় সবার আগে সমস্যা দেখা দেয় খাদ্য আর পানীয়ের তাৎক্ষণিক সংস্থান নিয়ে। গত বছর অম্ফানের আগে থেকেই অতিমারীর কারণে অন্ন বস্ত্র নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ নিরন্ন মানুষের ওপর ঘূর্ণিঝড় আরো অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছিল । এই ধরনের অভাবের পরিস্থিতিতে মহিলারা নিজে না খেয়ে বা কম খেয়ে খাবার তুলে দেন পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মুখে। শুধু তাই নয়, এই বিপন্ন সময়েও রসদ সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে জ্বালানি খুঁজে আনা, এইসব পারিবারিক ‘সেবা’ ও ‘পরিষেবা’ অলিখিত নিয়মেই মহিলাদের দায়িত্বে রয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, মাতৃরূপা মহিলারা স্বেচ্ছায় অন্নপূর্ণার ভূমিকা পালন করেন। উন্নয়নশীল দেশের পুরুষশাসিত সমাজের এই দস্তুর চিরপরিচিত। চিরকালীন বঞ্চনার শিকার এই মহিলারা বিপর্যয়কালেও পালন করে চলেন এই অলিখিত সমাজ-নির্দিষ্ট পারিবারিক ভূমিকা। এমনিতেই স্বাভাবিক সময়ে মহিলা আর শিশুদের অপুষ্টি আর রক্তাল্পতার নজির চিরপরিচিত। সাম্প্রতিক কালের সরকারি রিপোর্টগুলি নাড়াচাড়া করলেও তা পরিষ্কার দেখা যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় দীর্ঘকালীন অপুষ্টির ভিতে আরো চুন বালি পড়ে, লিঙ্গ বৈষম্যের পাহাড় আরো মজবুত হয় দীর্ঘতর ভবিষ্যতের দিকে।

দুর্যোগের কালে মেয়েদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার আরো কিছু মাত্রা আছে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অম্ফানের সময় প্রভাবিত মহিলাদের প্রায় ৫০% সন্তান ধারণের বয়ঃসীমার মধ্যে এবং ২৫% গর্ভবতী ছিলেন। এ ছাড়া রজঃস্বলা মহিলার সংখ্যা তো গোনাই হয় নি। এই মেয়েলি সমস্যাটি স্বাভাবিক সময়েও তেমন গুরুত্ব পায় কই ! আর মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবার মতো সামাজিক চেতনা তো সুদূর পরাহত। এসবের সঙ্গে জুড়ে আছে মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও। অনেক সময় রিলিফ ক্যাম্প আর শেল্টারগুলি কমবয়সী মেয়েদের পক্ষে অতিরিক্ত ভীতির কারণ হয়ে ওঠে। মাত্রাতিরিক্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মেয়েদের দেহ ব্যবসায়ে যোগদানের ঘটনাও অজানা নয়। সুনামীর পরে তামিলনাড়ুতে এমন ঘটনার অনেক পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে। এই দৈনন্দিন ও শারীরিক সমস্যাগুলি ছাড়াও খতিয়ে দেখা যেতে পারে অর্থনৈতিক মালিকানা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নটি। দরিদ্র মানুষেরা বিপর্যয়ের ক্ষতি সামলাতে না পেরে অনেক সময়ই ছোটোখাটো জমিজমা সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হন। একটু লক্ষ্য করলে লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্রটি এ ক্ষেত্রেও দেখা যাবে। বর্তমান কালে এইসব পরিবারে মহিলাদের ওপর অর্থোপার্জনের দায় থাকে পূর্ণ মাত্রায়। অথচ দুর্দিনে সম্পত্তি বিক্রি করা বা অন্যান্য আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা থাকে না। বাংলাদেশে অম্ফান পরবর্তী সমীক্ষায় ৬৫% মহিলা সে রকম অভিজ্ঞতার কথাই জানিয়েছেন। এ ছাড়া উন্নয়নশীল সমাজে মায়েদের সঙ্গে মেয়ে শিশুরাও বহুবিধ অসাম্যের শিকার। যেমন দেখা যায়, এ ধরনের বিপর্যয় মিটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর যখন স্কুল খোলে, তখন প্রথমে পড়তে যায় বাড়ির ছেলেটি। ছোট মেয়েটি বাড়িতেই থাকে, মায়ের সঙ্গে কাজ কর্মে অংশ নেয়। এমনই নানা না-পাওয়ার গল্প মেয়েদের, মায়েদের। ভারত, বাংলাদেশ পেরিয়ে গেলেও একই ছবি আফ্রিকার খরাক্লিষ্ট প্রান্তরে, তিব্বতের শীতল মরুভূমিতে কিংবা মার্কিন মুলুকের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের কালো মানুষদের বসতিতে। চিত্রপট পালটাতে থাকলেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে দুখিনী সকিনাদের কাহিনি একইভাবে বোনা হতে থাকে।

কাঠ কুড়ানী, ঘুঁটে কুড়ুনি আর জলকে চলা সই

স্বাভাবিক সময়েও পরিবারের সকলের মুখে খাবার জোগানোর দৈনিক কর্তব্য মহিলাদের। পুরোনো শ্রম বিভাজন অনেকখানি বদলে গেলেও এই বিশেষ পারিবারিক ব্যবস্থাটিতে এখনো তেমন কোনো পরিবর্তন আসে নি। প্রত্যন্ত গ্রামে ভোরবেলা মেয়েরা বেরিয়ে পড়েন সাধারণ মালিকানার প্রাকৃতিক সম্পদের (common property resources) খোঁজে । জঙ্গলের কাঠ, লতাপাতা আর ফলমূল সংগ্রহ হয় জ্বালানি হিসেবে, আবার খাবারের রসদ হিসেবেও। জঙ্গলের অধিবাসী অথবা গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির মানুষ, মোটামুটি সব পরিবারে এমনটিই জীবনযাপনের ধারা। আর এই কাজের একতরফা দায়িত্ব মেয়েদের। ঘুঁটে কুড়ুনি আর কাঠ কুড়ানি মেয়েদের রাজরানী হয়ে যাওয়ার গল্পগুলো উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক মেয়েদের জন্য নেহাতই অলীক রূপকথা।

রান্নার জ্বালানি হিসেবে কাঠকুটো নিম্নমানের। গোবর থেকে তৈরি ঘুঁটে রান্নার জ্বালানি হিসেবে বহুল প্রচলিত। কিন্তু এইসব জ্বালানির শক্তি হিসেবে দক্ষতা কম। এমনকি গোবর গ্যাস বা সম্প্রতি বহু-আলোচিত নানারকম জৈবিক জ্বালানিও (bio fuel) অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের বলেই গণ্য হয়। তার ফলে রান্না করতে দীর্ঘ সময় লাগে। সেই সঙ্গে আছে ধুলো ধোঁয়া থেকে তৈরি পরিবেশগত সমস্যা যা সরাসরি স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। মহিলারা নিজের অজান্তেই তার শিকার হন। শক্তির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে একটা সিঁড়ির (energy ladder) ধারণা আছে। বলা হয়, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এই শক্তির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। সিঁড়িটির ধাপগুলি নোংরা জ্বালানি থেকে ক্রমশ পরিষ্কার জ্বালানির দিকে এগিয়ে চলে। উন্নত দেশের ইতিহাসের ধারা এভাবে এগোলেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই সিঁড়িটি বেয়ে মেয়েদের উঠতে আজও তেমন দেখা যায় নি। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মহিলারা এখনো বহুলাংশে নিম্ন শ্রেণির জ্বালানি ব্যবহার করেন। বিভিন্ন দেশের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গ্রামীণ কৃষিজীবী পরিবারে কোনো এক রকম জ্বালানির পরিবর্তে নানারকমের জ্বালানি মিশিয়ে ব্যবহার হয় (fuel stacking)- গ্যাস, কেরোসিন স্টোভ, কয়লা, কাঠ, গুল ইত্যাদি। এর অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে ভাবা যায়, বিভিন্ন প্রকার জ্বালানির দামের তারতম্য, যোগানের অপ্রতুলতা, পুরোনো ধাঁচের চুলার ব্যবহার, জ্বালানি সংগ্রহের জন্য অতিক্রম্য দূরত্ব ইত্যাদি অনেক কিছু। সেই সঙ্গে বেশ কিছু অপ্রত্যাশিত সামাজিক কারণও এর পিছনে কার্যকরী বলে দেখা গিয়েছে। আঞ্চলিক সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতির সাথে সাথে রয়েছে জাত, ধৰ্ম, লিঙ্গ নামক প্রতিষ্ঠানগুলি। মহিলাদের সামগ্রিকভাবে এগিয়ে চলার পথে যেমন, জ্বালানি নির্বাচন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তেমনি এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতাগুলি কাজ করে। কোনো বিশেষ রন্ধন প্রণালী, জ্বালানি অনুযায়ী স্বাদের তারতম্য, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের রুচিপছন্দ এবং সামগ্রিকভাবে মহিলাদের হেঁশেল-পরাধীনতা, সবই তো সামাজিক প্রচলনের ভিত্তির ওপর খাড়া হয়ে আছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যেসব পরিবারের প্রধান মহিলা, সেখানে উন্নততর জ্বালানি ব্যবহারের মাত্রা বেশি। আবার সেই মহিলাদের শিক্ষাগত মানের সঙ্গে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহারের সরাসরি যোগ রয়েছে। অর্থাৎ জ্বালানির নির্বাচন অনেকটাই নির্ভর করে মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সচেতনতা আর পারিবারিক প্রাচীন ধ্যানধারণা পিছনে ফেলে আধুনিক জীবনযাত্রার অভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা ও পরিস্থিতির ওপর।

গার্হস্থ্য জীবনের আরেকটি নিত্য প্রয়োজন হল পানীয় জলের সংস্থান। শুষ্ক উষর এলাকায় জল আনতে যাওয়ার কাজটিও একতরফাভাবে মেয়েদের ওপর ন্যস্ত। রাজস্থানের মরুভূমি সংলগ্ন গ্রামের দৈনন্দিন চর্যার এই পরিচিত ছবিগুলি রঙের বিচারে উজ্জ্বল, হয়তো বা ফটোগ্রাফির প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক পুরস্কারও এনে দিতে পারে। কিন্তু সেই ক্যানভাসের সিল্যুয়েটে রয়েছে আরেক গোষ্ঠীর সকিনারা। সেই দুখিনীরাও কাঁদে, যখন জলকে চলে, প্রতিনিয়ত, গ্রাম থেকে বহু দূরে, বালির রাস্তা ধরে দূরান্তে। ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতবর্ষের ‘জলপুরুষ’ শ্রী রাজেন্দ্র সিংহ দেখিয়েছেন এই ‘জলকে চলা’ আর উন্নয়নের কি নিবিড় সম্পর্ক! তাঁর পরিচালনায় তরুণ ভারত সঙ্ঘ রাজস্থানের যে গ্রামগুলিতে বৃষ্টির জল জমিয়ে, বাঁধ দিয়ে এবং জলসেচ করে কৃষিকাজের ও সেই সুবাদে গোটা গ্রামের সর্বাঙ্গীন কল্যাণসাধন করেছেন, সেখানে এই জল বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজে এসেছে বৃহত্তর পরিবর্তন । ওঁর নিজের কথায়, গ্রামের সব শিশু এখন ইস্কুলে যায়। তার কারণটা বোধ হয় কল্পনা করাও কঠিন আমাদের মতো শহুরে উন্নয়নবিলাসীদের পক্ষে। যেহেতু জল আনতে মায়েদের এখন আর দূরে যেতে হয় না, তাই তাঁরা রোজ সকালে বাড়িতেই থাকেন এবং শিশুদের নিয়মিত ইস্কুলে পাঠাতে পারেন । অনুমান করে নিতে ইচ্ছে করে যে, এর মধ্যে আছে গ্রামের মেয়ে শিশুরাও। আশা করতে ইচ্ছে করে যে, তাদের জীবন আর তাদের মায়েদের মতো হবে না।

ঘরের মধ্যে ঘর

ছোটবেলায় একটা ধাঁধা ছিল, “ঘরের মধ্যে ঘর, তার ভেতরে পুড়ে মর”। এই হেঁয়ালির উত্তর খেলাচ্ছলে যাই হোক না কেন, আমাদের মতো গরিব দেশের মহিলাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নের একটা গূঢ়তর ব্যঞ্জনা অনুধাবন করা যায়। আর সেই ধাঁধার প্রকৃত সমাধান তাঁদের কাছে আজও অধরা। এখনো কিছু না জেনেই তাঁরা প্রতিদিন তিলে তিলে মরছেন রান্নাঘরের অন্ধকূপে। জ্বালানির প্রসঙ্গ আগেই এসেছে। এবারে একটু খেয়াল করে দেখা যাক এই জ্বালানি ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের (indoor air pollution) প্রভাব মহিলাদের বদ্ধ ঘরের ভেতর কতখানি। বাইরের বায়ুদূষণ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। সরকারি তরফ থেকে এর বিভিন্ন বিপদসীমা ঘোষণা করা আছে। কিন্তু বদ্ধ ঘরের প্রদূষণ নিয়ে তেমন সচেতনতা কোথায়! কেন্দ্রীয় প্রদূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ (Central Pollution Control Board) অভ্যন্তরীণ প্রদূষণ সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনো নির্দেশিকা জারি করে নি। হয়তো বা এই তারতম্যের কারণটিও অনেকাংশে লিঙ্গবৈষম্যেই নিহিত।

উন্নয়নশীল দেশে মহিলাদের স্বাস্থ্য কোনোদিনই বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। অথচ তাঁদের নিজের স্বাস্থ্যই শুধু নয়, এর ওপরে নির্ভর করে গোটা পরিবার এবং বিশেষত শিশুদের সুস্বাস্থ্য। আমাদের দেশে মহিলাদের একটি বড়ো অংশ বাড়ির ভিতরে থাকেন, যার ফলে দিনের অনেকটা সময় রান্নাঘরের ধুলিকালির মধ্যে ক্রমাগত তাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে থাকে। ফলত, ঘরের মধ্যের বাতাসে জমা সালফার ও কার্বনের অক্সাইড আর ভেসে থাকা সূক্ষ্ম ধূলিকণা তাঁদের ফুসফুসে পৌঁছায়। তার থেকে জন্ম নিতে পারে হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসের নানারকমের সমস্যা। এ ছাড়াও হতে পারে কিছু বিশেষ ধরনের চোখের রোগ। তার সঙ্গে আছে দীর্ঘকালীন ক্ষয়ের সম্ভাবনা, ধীরে ধীরে প্রতিরক্ষা শক্তি হ্রাস পেতে থাকা ইত্যাদি। এর ফলে গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতা ও সন্তানের জন্মের সময় মায়েদের জীবন সংশয় পর্যন্ত হতে পারে। সদ্যোজাত শিশুর ওপরেও পড়তে পারে জন্মগতভাবে নানারকম ক্ষতিকর প্রভাব। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারে ব্যবহৃত অপরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়াও আরো নানা প্রকারের বিষাক্ত যৌগ উৎপন্ন হয়, যেমন, বেনজিন, ফরমাল্ডিহাইড ইত্যদি। কাঠের চুলাতে প্রায় শ’খানেক জৈবিক যৌগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে অনেকগুলি নানারকম ক্যান্সারের কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, অনুন্নত আফ্রিকার বহু দেশের মতো ভারতবর্ষের বহুল সংখ্যক মহিলারাও বদ্ধ ঘরে ভেসে থাকা মোট প্রদূষক ধূলি কণা (total suspended particle) ও ক্ষতিকর যৌগ বেনজিল অ্যামিনো পিউরিন দ্বারা সৃষ্ট নানারকম জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার। এই প্রদূষণজাত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দৈনিক কুড়ি প্যাকেট সিগারেটের সমান। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, বার্ষিক প্রায় চার থেকে পাঁচ লক্ষ মহিলা ও শিশুর মৃত্যুর কারণ অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ।

শুধু গ্রাম নয়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় সমীক্ষা চালিয়েও মোটামুটি একই ধরনের আভ্যন্তরীণ প্রদূষণজাত সমস্যার ছবি পাওয়া গিয়েছে। শহরাঞ্চলের নিম্ন, মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের মধ্যে শতকরা প্রায় আশি ভাগ শ্বাস প্রক্রিয়ার গুরুতর সমস্যা COPD (chronic obstructive pulmonary disease) নামক রোগে আক্রান্ত হন। সাম্প্রতিক কালের কোভিড সংক্রমণের ভয় এই রোগীদের জন্য প্রায় চারগুণ বেশি। অথচ অনেক মহিলা সঠিক অবহিত নন, কতখানি রোগ বা রোগের সম্ভাবনা নিয়ে তাঁরা বেঁচে আছেন প্রতিনিয়ত। যে ঘরকে তাঁরা সর্বদা মনে করেছেন চরম নিরাপত্তার জায়গা, যে রন্ধনশালাকে তাঁরা মনে করেছেন পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবার পবিত্র কর্মশালা, সেই রোগের সুতিকাগারেই রয়েছে তাঁদের মৃত্যুর পরোয়ানা।

সূর্য উঠবে কবে

পরিবেশের সমস্যা গোটা বিশ্বের। অর্থনৈতিক প্রগতি আর কারিগরী উন্নতির যুগে পরিবেশের সংকট ঘনিয়ে এসেছে পৃথিবীর সব দেশে। কিন্তু তার মুখাবয়ব আলাদা, কারণ তার চালচিত্রটি দেশ কাল পাত্রভেদে ভিন্ন। উন্নয়নশীল দেশে এমনিতেই হাজারো সমস্যা। তাই পরিবেশগত অসুবিধাগুলিও অন্য মাত্রা পায়। উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক বেশি এখানে দারিদ্র্য, অসাম্য আর প্রাত্যহিক জীবন যাপনের লড়াই। লিঙ্গবৈষম্য তারই এক অনিবার্য প্রতিরূপ। জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও ক্রমহ্রাসমানতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা শক্তিসম্পদ ব্যবহারের ক্ষতিকারক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া- সব ক্ষেত্রেই এইসব দেশের মহিলারা বহন করছেন এক অসম ভার। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি এই প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে, এক বৃহত্তর বঞ্চনার বৃত্তে মহিলাদের আবদ্ধ করে রাখে আজীবন।

রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার, এই তিনটি স্তরেই বড়ো মাপের পরিবর্তন প্রয়োজন। কাজটি সহজ নয়, রাতারাতি সম্ভব নয়। দায়িত্ববান সরকার ও উন্নয়নমুখী সমাজের কর্তব্য এই বিষয়গুলিকে সামগ্রিক পরিকল্পনার মধ্যে আনা। মহিলারা যদি হন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, যদি তাঁদের দিতে হয় অর্ধেক আকাশ, তবে উন্নয়নের অর্থনীতিতে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে উপযুক্ত জায়গা। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে পরিবেশ নীতি পর্যন্ত সর্বত্র মহিলাদের সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। যে নারীকে বলা হয় প্রকৃতি-স্বরূপা, যে নারী প্রকৃতির পরিচর্যা করে চলেছে মানব ইতিহাসের গোড়া থেকে, সে নারী প্রকৃতি ও পরিবেশের অবক্ষয়ের চরম ভুক্তভোগী। তাই প্রকৃত নারীকল্যাণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে মহিলাদের মুক্তি দিতে হবে রান্নাঘরের দাসত্ব থেকে, ছুটি দিতে হবে সম্পদ সংগ্রহের বিষম ভার থেকে, সুরক্ষা দিতে হবে বিপর্যয়ের আগে-পরে। অপুষ্টি আর অসুখের অন্ধকার গহ্বর থেকে তবেই তো বেরিয়ে আসতে পারবেন মেয়েরা। সেই নতুন দিনের পরিবেশনীতি যথার্থ জায়গা দেবে মহিলাদের, টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্য কেবল কাগজে নয়, রূপান্তর আনবে প্রত্যেকটি দুখিনী সকিনার জীবনে।


তথ্যসূত্রঃ

• Cheng, C. Y., & Urpelainen, J. (2014). Fuel stacking in India: Changes in the cooking and lighting mix, 1987–2010. Energy, 76, 306-317.
• Choudhuri, P., & Desai, S. (2020). Gender inequalities and household fuel choice in India. Journal of Cleaner Production, 121487.
https://genderandsecurity.org/projects-resources/research/gendered-nature-disasters-women-survivors-post-tsunami-tamil-nadu
https://reliefweb.int/report/bangladesh/rapid-gender-analysis-cyclone-amphan
• Singh, R (2020); Water conservation in India; lecture delivered as part of ‘Ecology Environment and Sustainability’ series, IPCollege, University of Delhi.
• Smith K R (2000); Indoor Air Pollution in developing countries and acute respiratory infections in children, Thorax; 55: 518-32.
• World Health Organization (2000), World Health Report, Geneva.