আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

শ্রমিক আন্দোলনের সেকাল-একাল

কালীময় মৈত্র


বঙ্গে এখন বিধানসভা নির্বাচন। তার ওপর দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে সীলমোহর দিয়েছেন আন্দোলনজীবী নামের এক শ্রেণিকে। আসলে সবটাই নিজে বললে সত্যি, অন্যে বললে মিথ্যে। সেই হিসেবে কোনো রাজনৈতিক নেতা নিজে আন্দোলন করলে তা ঐতিহাসিক, অন্যদলের ক্ষেত্রে তা নীতিহীন ঝঞ্ঝাট। এরকম চলতে থাকলে অবশ্যই আন্দোলনের ইতিহাস গুলিয়ে যাবে। আর আজকের রাজনীতির দস্তুর তেমনই। তবে ইতিহাসের বই দিয়ে উনুন জ্বালানোর আগে অন্তর্জালে লেখা ছেপে ফেললে একটাই সুবিধে যে সেটাকে মুছে ফেলা শক্ত। তাই তৃণমূল বিজেপি তিরাশি শতাংশের ফাঁক গলে এই বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস ফিরে দেখার একটা প্রেক্ষিত এই মুহূর্তে আছে, বিশেষ করে আগতপ্রায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে। আন্দোলনের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি, এবং কীভাবে এই জায়গায় পৌঁছলাম, তার ধারাবৃত্তান্ত আজকের অদ্ভুত দলবদলের রাজনীতিতে চূড়ান্ত অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও, গভীর এবং গম্ভীর ভাবনায় তাকে অস্বীকার করা শক্ত।

শ-দুয়েক বছর আগে ফেরা যাক। সিপাহী বিদ্রোহের একটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে ঔপনিবেশিক শাসন দেশজ কুটিরশিল্প ও কৃষি নির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আবার শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি তখন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। অসম বিকাশের মধ্যে এবং একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণে বাড়ছিল দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। বিশাল সংখ্যক মানুষের এই সমস্যাসঙ্কুল এবং যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়ে ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণির জন্ম। এর সঙ্গে যোগ হতে শুরু করল বিদেশি জিনিসপত্রের আমদানি। ততক্ষণে শিল্পবিপ্লব ইউরোপে সফল। ফলে কম খরচে উৎপাদনের উপায় তাদের জানা। তুলনামূলকভাবে সস্তার সেই জিনিসপত্র আমাদের কুটিরশিল্পকে চরম বিপদে ফেলে দিল। সঙ্গে ছিল চুক্তিচাষের কারণে কৃষি অর্থনীতিতে সাধারণ চাষির বিপর্যয়। বিশাল অংশের জনগণ, বিশেষ করে ভূমিহীন প্রান্তিক কৃষক এবং গ্রামীণ কুটির শিল্পের কর্মচ্যুত মানুষ স্বাভাবিক নিয়মেই দরিদ্র শ্রমিকশ্রেণিতে ঢুকে গেল। জন্মলগ্ন থেকেই এই শ্রেণিকে সংঘাতে যেতে হয়েছিল দুটো মূল বিরোধী শক্তির সঙ্গে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক শাসন, অন্যদিকে দেশীয় ও বিদেশী পুঁজিপতির শোষণ। বিদেশি শাসকের উৎপাতে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণির লড়াই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়াতেই থেমে থাকে নি। ব্রিটিশ তাড়ানোর তাগিদে স্বাধীনতা সংগ্রামেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল শ্রমিক আন্দোলন।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে সরাসরি শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পেশ করা মুশকিল। নথি বলছে ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টের সূচনা ১৮৯০ সালে বোম্বেতে (অধুনা মুম্বাই)। আন্দোলন শুরু হয়েছিল বোম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে। তারপর রেলশ্রমিকদের আন্দোলন ১৮৯৭ তে, কলকাতায় ছাপাখানার কর্মীদের লড়াই ১৯০৫-এ, মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) আর কলকাতায় ডাককর্মীদের প্রতিবাদ ১৯০৭-এ। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই বাল গঙ্গাধর তিলকের কথা আসবে। তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ ওঠে তিনবার - ১৮৯৭, ১৯০৯ এবং ১৯১৬ সালে। একাধিক বার জেলে যেতে হয় তাঁকে। মনে রাখতে হবে ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত ভারতবর্ষে বিভিন্ন কলকারখানায় ধর্মঘট চলেছিল। বিশেষ করে ১৯০৮ সালে বাল গঙ্গাধরের কারাবাসের রায় বেরোনোর পর বোম্বেতে বিভিন্ন কলকারখানায় বেশ কয়েকদিন তীব্র ধর্মঘটের প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তালিকায় আসবে ১৯১৮ সালে আমেদাবাদ এবং বোম্বের মিল শ্রমিকদের ধর্মঘটের কথা। অনেক ক্ষেত্রে উঠেছিল দশ ঘণ্টা কাজের দাবি। এই ধর্মঘটগুলোর উল্লেখ এই কারণেই যে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। কখনও রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, কখনও বা কাজের সময় কমানোর দাবিতে এই কর্মসূচিগুলোর সঙ্গে জুড়ে গেছিল বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সেইজন্য গত শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে দেশাত্মবোধ একটা বড় জায়গা করে নিয়েছিল। সেই লড়াই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চরিত্রের মিশ্রণে একটা তীব্র আকার ধারণ করেছিল, যার চরম প্রতিক্রিয়া ১৯৪৬ এর নৌবিদ্রোহ।

এবার আসা যাক শ্রমিক আন্দোলনের দ্বিতীয় স্তরে, অর্থাৎ স্বাধীনতা-পরবর্তী অংশে। মনে রাখতে হবে যে কংগ্রেস রাজত্বে ঔপনিবেশিক শাসনের আদলে আধা-পুঁজিবাদী আধা-সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বজায় ছিল। কংগ্রেসী শাসকের আনুগত্যে ১৯৪৭ এর মে মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় আইএনটিইউসি। স্বাভাবিকভাবেই তার সমর্থন থেকে গেল শাসকের দিকে। তুলনায় ১৯২০ তে প্রতিষ্ঠিত এআইটিইউসি ভারতীয় শ্রমিকশ্রেণিকে সুসংবদ্ধ করে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবনায় বামপন্থী এই সংগঠন ছিল আইএনটিইউসি-র বিপরীত মেরুতে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব বেশি জঙ্গি আন্দোলনের পথ নেয় নি ডাঙ্গে-পন্থী এই শ্রমিক সংগঠন। এই প্রেক্ষিতে আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের কথায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই দেশভাগের অভিশাপে পূর্ববঙ্গের লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিল। এই বিশাল জনসংখ্যার চাপ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করল স্বাভাবিক নিয়মেই। পাঞ্জাবও বিভক্ত হয়েছিল দেশভাগের ফলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় অনুদানের দাক্ষিণ্য পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে ছিল অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি দিল্লির সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ স্বাভাবিক কারণেই তাই এ রাজ্যের এক বড় অংশের মানুষকে কেন্দ্রবিরোধী করে তোলে। ফলে রুটি রুজির প্রশ্নে যে তীব্র আন্দোলন শুরু হয় বাংলায়, তার অনেকটাই কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে ধাবিত। এর এক চরম পরিণতির উদাহরণ ১৯৫৯ সালের অগাস্টে কৃষকদের রাজভবন অভিযানে, যেখানে পুলিশের আক্রমণে নিহত হন পঞ্চাশের বেশি আন্দোলনকারী। অবশ্যই বিধান রায় বাংলার সফল মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু শাসক এবং শাসিতের মধ্যে দূরত্ব থেকে যায় সব কালেই। এখানে সারমর্ম হল ষাটের দশকের শুরু থেকে যে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন দেখা গিয়েছিল, তার মূল কারণ তীব্র কেন্দ্রীয় বঞ্চনা। যেহেতু রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার চালাত একই দল কংগ্রেস, এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রতি অবিচার ও বিমাতৃসুলভ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তদানীন্তন রাজ্য সরকার বিশেষ সদর্থক ব্যবস্থা নেয়নি, সেই কারণে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন অনেক বেশি তীব্র ও সংগঠিত ছিল। এর আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পূর্ববঙ্গের প্রেক্ষিতে। যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রচন্ড দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তাদের কিছু অংশ বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত ছিলেন - তাদের ক্ষোভ ও বঞ্চনা শ্রমিক আন্দোলনকে এ রাজ্যে আরো তীব্র করে তোলে।

এই প্রসঙ্গে তুলনায় সুবিধাভোগী শ্রেণি হলেও সরকারি ও বেসরকারি কর্মীদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মীদের নেতৃত্বদানের বিষয়টি ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মচারীদের দাবিদাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন উচ্চশিক্ষিত সরকারি কর্মচারিরা। মনে রাখতে হবে এইসময় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের অগ্রগমন ছিল যথেষ্ট। সরকারি পরিচালনায় ইস্পাত বা কয়লাশিল্প, সার কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্র যথেষ্ট বিস্তৃতি লাভ করায় প্রতিটি কলকারখানায় বহুসংখ্যক শ্রমিকের জমায়েতের সুযোগ হয়। এখানেই চলে ভাবের আদানপ্রদান, যার একটা রূপ সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি। আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে থেকেও দক্ষ নেতৃত্ব উঠে এসেছিলেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবে এঁরা বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় সেই ভিত্তিতেই এই আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশক থেকে বামপন্থী আন্দোলন এবং শ্রমিক আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার সচেতনভাবে এ রাজ্যে নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে ধীরগতিতে এগোতে লাগল। পোক্ত শ্রমিক সংগঠন অবশ্যই বেসরকারি সংস্থাকে পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহী করার একটি কারণ। সঙ্গে যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া রাজ্যে শিল্প স্থাপন করার সুযোগ ছিল না, তাই পশ্চিমবঙ্গের শিল্পক্ষেত্র সংকুচিত করায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিল কেন্দ্রীয় সরকার। সফলভাবে চালু বেসরকারি সংস্থাগুলোও এরাজ্যে তাদের লভ্যাংশের অতিরিক্ত সরিয়ে নিয়ে অন্য রাজ্যে নতুন শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করল। এই প্রসঙ্গে রণজিৎ রায়ের লেখা "দি অ্যাগোনি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল" বইটি উল্লেখযোগ্য।

বামপন্থী আন্দোলন মানেই নিজেদের মধ্যে তর্ক থাকবে না এমন নয়। তাই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্বে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে ভাগ হলো। সেই পথেই পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মূল শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি ভেঙে সিআইটিইউ (সিটু) প্রতিষ্ঠিত হল ১৯৭০ এ। যে বছর আমরা পার হয়ে এলাম, অর্থাৎ দুহাজার কুড়ি, তা এআইটিইউসি-র শতবর্ষপূর্তি আর সিটুর পঞ্চাশ বছর। সিপিআইএম এর শ্রমিক ফ্রন্ট হিসেবে সিটু শুরুর দিন থেকেই কেন্দ্রের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলনের গতিপথকে এগিয়ে নিয়ে চলে। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যে গত শতকের ষাটের দশক থেকেই সারা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক আন্দোলন যুক্ত হয়ে গিয়েছিল কৃষক, শিক্ষক ও কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে। এরকম যৌথ মঞ্চের একটি উদাহরণ হল বারোই জুলাই কমিটি। অর্থাৎ বোঝাই যায় যে সমাজের সর্বক্ষেত্রের মেহনতি মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে চলার ভাবনা ছিল সেইসময়ের শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৯৬৬ সালে সারা ভারত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের ত্রিভান্দ্রমে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে যে সমস্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রথম দাবি ছিল সারাদেশে আমূল ভূমি সংস্কারের। অন্যদিকে ১৯৭৪ সালে রেল শ্রমিকদের ১৪ দিনের নজিরবিহীন ধর্মঘটের কথাও বলতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ এবং শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষক-কর্মচারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সারাদেশে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলেছিল। অর্থাৎ আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলন শুধুমাত্র শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া বা পুজোর বোনাস চাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশের অন্যান্য অংশের খেটে খাওয়া মানুষ অর্থাৎ ক্ষেতমজুর থেকে শিক্ষক, প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গে মিশে আন্দোলনের একটা বৃহৎ প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল।

কিন্তু আশির দশকের শুরু থেকে এই অবস্থার একটা গুণগত পরিবর্তন দেখা দিল। শ্রম-নিবিড় শিল্প-কারখানার জায়গায় মগজ-নির্ভর প্রযুক্তি জায়গা করে নিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অত্যাধুনিক আবিষ্কার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের আমদানি বাড়ালো। শ্রমিকের কর্মচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। একের পর এক কারখানা বন্ধ, লকআউট ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ (এর অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গবাসীরাও), কারখানা থেকে কর্মচ্যুত শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরের বিশাল অংশ নিজেদের রাজ্য ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হল। রূপায়িত হল পরিযায়ী শ্রমিকে। ফলে যা দাঁড়ালো তা এরকম। নিজের অঞ্চলে একটা কারখানায় সকালে কাজ শুরু হওয়ার সময় (প্রবেশ) এবং কাজ শেষে (প্রস্থান) দলবদ্ধ শ্রমিক আড্ডা মারার (পড়ুন আলোচনা করার) সুযোগ পেত। কিন্তু পরিযায়ী অবস্থায় এবং জীবন সংগ্রামের টানাপোড়েনে দাবিদাওয়া ও মালিকের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে জমায়েত এবং চিন্তাভাবনার আদান-প্রদানের জায়গাটা কমে গেল। সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি অসংগঠিত হতে শুরু করলো। এই অবস্থা চরম আকার ধারণ করল ১৯৯১ এর পর থেকে। উদারীকরণের ফলে লাইসেন্স-রাজের অবলুপ্তি ঘটল বটে, কিন্তু শ্রমনিবিড় শিল্পের খোঁজ সেভাবে মিলল না। অন্যদিকে বাড়ল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংখ্যা। শিল্প মালিকেরা উৎপাদন পদ্ধতিতে গুঁজে দিলেন আউটসোর্সিং এর তত্ত্ব। গড় কর্মক্ষমতা হয়ত বাড়ল, তবে তা অসহনীয় শোষণের মাধ্যমে। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা নিয়ে কোনো নতুন ভাবনা দেখা গেল না। আর আউটসোর্সিং এর অনুসিদ্ধান্তে আরও বেশি করে নির্ধারিত হয়ে গেল শ্রমিকদের একজোট হওয়ার অসুবিধা। হয়ত কারণ একই, অথবা অন্য, তবে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক এখানে আলোচনা করা দরকার। ষাটের দশক থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত (গত শতাব্দীতে) বিভিন্ন কলকারখানায়, অফিস-আদালতে আন্দোলনের একটা ধারা ছিল সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। কবিতা, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলন সমৃদ্ধ হয়েছিল। আবার এই আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছিল অনেক গল্প, নাটক, কবিতা। উৎপল দত্ত, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরি এঁদের কথা এই প্রসঙ্গে আসবে। আজকের দিনে আন্দোলনের ধারায় সাংস্কৃতিক কর্মসূচির যে মান, তা অবশ্যই ষাট-সত্তর-আশির দশকের থেকে অনেক নিম্নমানের। আধুনিক প্রযুক্তির চাপে শ্রমহারা মানুষ তাই আজকে একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক মগজটুকুও হারাতে বাধ্য হচ্ছে।

উপসংহারে আর কয়েকটি বিষয় স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা যাক। শুধু বেসরকারি ক্ষেত্র নয়, সরকারি ক্ষেত্রেও অনেক জায়গায় পঞ্চম, ষষ্ঠ, এবং সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী অভূতপূর্ব বেতন বৃদ্ধি হয়। বর্তমানে এই শ্রেণির আন্দোলন বিমুখতা লক্ষ্যণীয়। মনে রাখতে হবে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব অনেক সময়েই এই শ্রেণির কাছ থেকে আসত। আজকে কাজের সময় বৃদ্ধি এবং উচ্চ বেতনের অমোঘ বৃত্তে এঁদের পক্ষে রাজনীতি অনুশীলনের সময়টুকুই নেই, আন্দোলন তো অনেক দূরের কথা। শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব তাই আজকের দিনে নিজেদের থেকেই উঠে আসা ছাড়া গতি নেই। আর সেই আশাতেই সবশেষে বলা যায় যে সভ্যতার চলার পথে আন্দোলন-সংগ্রাম কখনও থেমে থাকে না। হয়তো তার পদ্ধতি বা রূপ পরিবর্তিত হয়। এখনও সংগঠিত শ্রেণির আন্দোলন প্রসঙ্গে ব্যাংক, এলআইসি, কিংবা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের উল্লেখ করতেই হবে। এ আন্দোলন মূলত সম্পন্ন এবং সুবিধাভোগী শ্রেণির। উল্টোদিকে একেবারে প্রান্তিক ক্ষেত্রে এখনও স্তব্ধ হয় নি চটকল শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার শ্লোগান। গোটা দেশের প্রেক্ষিতে আজকের দিনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন। গত কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি অতিদীর্ঘ কৃষক মিছিল হয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। গত দু'মাসের বেশি সময় ধরে দিল্লি-সীমান্তে সমাবেশ আন্দোলনের নতুন দিশা দেখাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, শেষ এক বছর ধরে কোভিড অতিমারী পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে যে অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তাতে আন্দোলনের রূপরেখা হয়ত কিছুটা বদলাতে পারে। আবার এটাও বলতে হবে দেশ-বিদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কিন্তু থেমে থাকে নি। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বেসুরো ভাষণ শুনতে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে যদি কোভিড না ছড়ায়, তাহলে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনও থেমে থাকার বিশেষ কারণ নেই। তবে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে যে মানহারা রাজনীতির প্রকোপ আমরা দেখছি, তাতে সুস্থ আন্দোলনের পরিবেশ এবং পরিস্থিতিটাই অনুপস্থিত। অপেক্ষা তাই আগামীর।