আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দু-দিকে দুই পৃথিবী। মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া

গৌতম হোড়


স্থান সিঙ্ঘু সীমানা। একদিকে দিল্লি, অন্যদিকে হরিয়ানা। একদিকে সশস্ত্র পুলিশ, দাঙ্গারোধী বাহিনীর কর্মীরা, তাঁদের থাকার, খাওয়ার জায়গা, সাজসরঞ্জাম রাখার তাবু। গণ্ডায় গণ্ডায় সবুজ রঙা লো ফ্লোর ডিটিসি বাস। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মী ছাড়া আর কোনো জনপ্রাণী নেই।

আর অন্যদিকে কৃষকরা। হাজার হাজার ট্রাক্টর। সেখানে খড়ের উপর কম্বল, গদি রেখে রাত কাটাবার জায়গা। দুই পা এগোলেই লঙ্গর, চারপাশে মেলার চেহারা। হাজার হাজার কৃষক আন্দোলনে। তবে আন্দোলন, বিক্ষোভ মানে যে ভাবগম্ভীর চেহারার ছবি ভেসে ওঠে, সিঙ্ঘু সীমানার ছবিটা একেবারেই সেরকম নয়। আন্দোলনকে ঘিরে শুরু হয়েছে মেলা। রীতিমতো কার্নিভালের চেহারা।

এই দুই পৃথিবীকে মেলাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। বরং সীমানার এপার ওপারের ছবিটা দেখে নেওয়া যাক। হিন্দিতে যাকে বলে আঁখো দেখা হাল।

দিল্লির দিকে

দিল্লির সীমানায় বেশ কয়েকটি জায়গায় কৃষকরা এসে বসে পড়েছেন আন্দোলনে। তবে প্রতিটি জায়গায় তাঁরা আছেন সীমানার ওপারে, দিল্লির দিকে রাস্তা বন্ধ। কৃষকরা যাতে রাজধানীতে ঢুকতে না পারে, তার জন্য চলছে চব্বিশ ঘণ্টার প্রহরা। মজনু কা টিলা ছাড়িয়ে কার্নালের দিকে আধঘণ্টাটাক যাওয়ার পর দিল্লির সিঙ্ঘু সীমানা। তার অনেকটা দূরে ব্যারিকেড। গাড়ি রেখে সেই ব্যারিকেডের দিকে এগোনো গেল। ব্যারিকেড় পেরিয়ে রাস্তার দু-পাশে তাঁবু, পুলিশের থাকার বড় জায়গা পেরিয়ে কিলোমিটার খানেক হাঁটর পর আরেকটি ব্যারিকেড। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া, সামান্য জায়গা ছাড়া আছে। আবার হাঁটা। পথের পাশে পেরেক লাগানো লোহার তক্তা রাখা আছে। সেখান থেকে আধ কিলোমিটারের বেশি হাঁটার পর আবার ব্যারিকেড। আবার কাঁটাতারের বেড়া। সেটা পেরোতে গেলেই পুলিশ কর্মীরা ঝানালেন, ব্যস, ওই পর্যন্তই যাওয়া যাবে। কেন?অর্ডার আছে। কিছু জানতে গেলে ডিএসপি সাহেবের সঙ্গে কথা বলুন। ডিএসপি সাহেব বললেন, সাংবাদিকদেরও ওই ব্যারিকেড পেরোনোর অর্ডার নেই। সামনে রাস্তা পুরো বন্ধ।

তা হলে কি কৃষকদের কাছে যাওয়ার রাস্তা নেই? পুলিশের কর্তা জানালেন, প্রথম ব্যারিকেডের থেকে একটু এগোলেই গ্রামের দিকে রাস্তা যাবে। সেই রাস্তা ধরলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে জাতীয় সড়কের অন্য পারে। যেখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন কৃষকরা। অতএব সেই রাস্তা নেওয়া গেল। দুই পাশে খেত। ফুলকপি, বাঁধাকপি তুলে ভ্যানরিক্সয় তোলা হচ্ছে। ছোট রাস্তায় দু-পাশ দিয়ে গাড়ি যাওয়া-আসা করছে। গ্রামের মানুষ মাঝে মধ্যে একদিক বন্ধ রেখে অন্যদিকের গাড়ি ছাড়ছেন। সেই যাত্রার কথা অবান্তর, বরং সোজা যাওয়া যাক হরিয়ানার দিকে।

এ কেমন বিক্ষোভ

সাংবাদিক হিসাবে তো কম দিন হলো না, আর দিল্লিতে আন্দোলনও কম কভার করিনি। কিন্তু কোথাও তো এই ছবি দেখিনি। এপাশে ওপাশে ট্রাক্টর রাখা। কিছু ট্রাক্টর রাস্তায় যাতায়াত করছে। একটু এগোতেই দেখা গেল, রাস্তার পাশে বিরাট জল পরিশোধনের জন্য বিশাল আর-ও মেশিন। তার সঙ্গে বিশাল একটা জলের ট্যাঙ্ক। তাতে পরিশোধিত জল জমা হচ্ছে খাওয়ার জন্য। মানুষ আসছেন, জল খাচ্ছেন। উল্টোদিকেই একের পর এক লঙ্গর। বেশ বড়সড় একটি লঙ্গরে মক্কি কা রোটি, সরষো কা শাগ(মানে শাক)। লাইন করে সকলে ঢুকছেন, খাওয়ার নিচ্ছেন। তার পর এক গ্লাস ছাঁচ(ঘোল) নিয়ে খাচ্ছেন। কয়েকটা চেয়ারহীন উঁচু টেবিল রাখা আছে। পাশের লঙ্গরে দেওয়া হচ্ছে, হালুয়া। একটি লঙ্গরে গরম গরম পকোড়া ভাজা হয়ে ঝুড়িতে আসছে এবং মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার ফ্রুট জুস বিলি করছেন, কেউ জলের বোতল। যে কেউ ইচ্ছে করলে খেতে পারেন। এমন নয় যে, আন্দোলনকারী কৃষক দেখে তবেই খাবার দেওয়া হচ্ছে। শিখদের লঙ্গরের ঐতিহ্য মানা হচ্ছে অক্ষরে অক্ষরে।

সীমানার কাছে মঞ্চ। সে দিকে যেতে গিয়েই চোখ পড়ল, অস্থায়ী হাসপাতাল। একটা বড় জায়গা এমার্জেন্সি। পাশে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসক, নার্স মজুদ। আরেকটি অস্থায়ী হাসপাতাল গাড়িতে। পাঞ্জাবের একজন চিকিৎসক সেটা চালাচ্ছেন। সেটা মূলত ডেন্টাল ক্লিনিক। তবে আশ্চর্য হওয়ার তখনও বাকি ছিল। কোনও আন্দোলনস্থলে কখনও লাইব্রেরি দেখেছেন? আমি অন্তত দেখিনি। এখানে বড় একটা এলাকা নিয়ে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী লাইব্রেরি। বিনা পয়সায় বই পড়া যাবে। বই পড়ার জন্য তিনটি গদি রাখা। তিনটি আলমারি বইয়ে ঠাসা। টেবিলের উপর রাখা প্রচুর বই। সেখানে ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস যেমন আছে, তেমনই আছে ভগত সিং-এর উপর বই। তাছাড়া ইতিহাস, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের বই। গুরমুখি, হিন্দি ও ইংরাজিতে। বইয়ের টাকা জমা দিয়ে চার দিনের জন্য নিয়েও যাওয়া যায়। বই ফেরত দিলে মূল্যও ফেরত। লাইব্রেরির পরিচালকের দাবি, দিনে জনা পঞ্চাশ-ষাট জন আসেন বই পড়তে বা নিতে। যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিতে এসেছেন, তাঁরা যাতে বই পড়ে সময় কাটাতে পারেন, তার জন্য এই ব্যবস্থা। বইপ্রেমীরা নিঃসন্দেহে এই ব্যবস্থায় খুশি হতে পারেন। বই পড়ার অভ্যাস যখন কমছে, তখন আন্দোলনে নেমে বই পড়ার এই প্রবণতা আশা জাগানোর মতো ঘটনা বই কী।

চারপাশে কত কী হচ্ছে। একটা জায়গায় মাদারির খেলা চলছে। বাচ্চা মেয়ে মাথায় একের পর এক হাঁড়ি চাপিয়ে লাঠি নিয়ে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছে। রাস্তায় চাদর বিছিয়ে তার উপর কেউ ব্যাগ, কেউ জ্যাকেট বিক্রি করছেন। কেউ বেচছেন মোবাইল কভার, পাওয়ার ব্যাঙ্ক। কোথাও বিক্রি হচ্ছে, খেলনা। দরদাম, বিকিকিনি সবই চলছে। জমজমাট মেলার পরিবেশ।

ঠিক এই সময় কানে এলো স্লোগানের শব্দ। চোখ ফেরাতে দেখা গেল, জনা পনেরোর মিছিল। তাতে জনা দুয়েক পুরুষ। বাকিরা সকলেই মহিলা। সকলেই বয়স্ক। হাতে সাদা পতাকা। স্লোগান দিতে দিতে তাঁরা এগিয়ে গেলেন।

মূল মঞ্চটা বেশ বড়। বক্তৃতা চলছে। সামনে কয়েকশ মানুষ বসে নেতাদের কথা শুনছেন। মঞ্চের এলাকা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে লোহার বেড়া। তাতে একটা ফ্লেক্সের বোর্ড। সেখানে বেশ কিছু সাংবাদিকের ছবি। নীচে লেখা 'গদি মি়ডিয়া, দূরে থাক'। যাঁরা এই আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন, তাঁদের বলা হচ্ছে, গদি মিডিয়া। সেই গদি মিডিয়া সম্পর্কে সাবধান করে দিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।

একদিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন মহিলা। বয়স বেশি নয়। সকলেই আম্বালার বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে জনা দুয়েক চাকরি করেন সোনেপতে। ডিউটির সময় শেষ হলে চলে আসেন আন্দোলনস্থলে। কতদিন ধরে আসছেন জানতে চাইলে বললেন, দু-সপ্তাহ মতো হবে। কেন আসছেন? জবাব এলো, আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে। আমরা সবাই এক হয়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে আছি। সময় পেলেই চলে আসি। কতদিন আসবেন? যতদিন আন্দোলন চলবে। কতদিন চলবে? যতদিন সরকার দাবি না মানছে। সরকার তো বলে দিয়েছে, আর কোনো দাবি মানা হবে না? তা হলে আন্দোলনও চলবে।

কৃষকরা এমনিতে হাশিখুশি। কিন্তু আন্দোলনের প্রশ্ন আসতেই মুখগুলি কঠিন হয়ে উঠছে।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন তরুণ। জলন্ধরের কাছে গ্রাম থেকে এসেছেন। দিন পনেরো ধরে আছেন। এবার তাঁদের দশজনের দল গ্রামে ফিরবে। তারপর নতুন দল আসবে। তাঁদের গ্রাম থেকে সবসময়ই ১০ থেকে ১৫ জনের দল আন্দোলনস্থলে থাকছেন। অন্য গ্রামগুলির ক্ষেত্রেও একই কাহিনি। ফলে একদল ফিরছেন, একদল আসছেন। বিক্ষোভস্থল থেকে লোক ও ট্রাক্টর কমছে না। যেভাবে বিশাল জায়গা জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছেন কৃষকরা, যেভাবে তাঁদের অসংখ্য ট্রাক্টর পার্ক করা আছে, তাতে তাঁদের জোর করে উঠিয়ে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। আমি জানি না, এই বিপুল আয়োজনের অর্থ কোথা থেকে আসছে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা নিঃসন্দেহে অর্থবান। আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, তাঁরা সকলে সাধ্যমতো অর্থ দিয়ে সাহায্য করছেন। কৃষকদের দাবি, এটা তাঁদের জীবন-মরণের সমস্যা। তাই তাঁরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চান।

এক আন্দোলনকারীর দাবি, ''পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অদিকাংশ পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য সেনা বা আদা সামরিক বাহিনীতে আছেন। তার জন্য এবং ইতিহাসগতভাবেও ভয় জিনিসটা তাঁদের মধ্যে নেই। তাঁদের মাথায় একবার যখন ঢুকে গেছে, আন্দোলন করতে হবে, তখন করতে হবে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তাঁদের দিল্লিতে প্রবেশ বন্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু আন্দোলন থামানো যাবে না।''

এই আন্দোলন কতদিন চলবে, কবে শেষ হবে, কীভাবে সমস্যা মিটবে, এই সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। শুধু এইটুকু বলা যায়, এই আন্দোলনের চাল-চরিত্র-চেহারা অন্যরকম।