আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

প্রবন্ধ

করোনা ভ্যাকসিনঃ বিতর্কের মহামারী

শুভ্র সমুজ্জ্বল


পৃথিবী জুড়ে করোনা অতিমারীর এক বছর অতিক্রান্ত। দশ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত, বাইশ লক্ষের বেশি মৃত। দুনিয়া জোড়া লকডাউন, অর্থনীতি চরম ক্ষতিগ্রস্ত। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের নিরাময়ের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই, প্রথম বিশ্বের দেশেও স্বাস্থ্যপরিষেবা চূড়ান্ত নাকাল। মানব সভ্যতা বসে আছে প্রতিষেধকের প্রতীক্ষায়।

করোনার প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে প্রথম থেকেই। কারণ এ অতিমারীর গতি রোধ করতে হলে উপযুক্ত প্রতিষেধক টিকা ছাড়া গতি নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম সম্ভাব্য ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলেছে। নতুন প্রযুক্তি যা ছিল এতদিন পরীক্ষার স্তরে, যেমন ভাইরাল ভেক্টর, তাদের নিয়েও চেষ্টা চলেছে।

সমস্যা হল সময় এবং সংখ্যা। এত কম সময়ের মধ্যে কখনো কোনো সম্পূর্ণ নতুন টিকা তৈরি হয়নি। পৃথিবীজুড়ে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকেও এত কম সময়ের মধ্যে টিকা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। শুধু টিকা প্রস্তুত করলেই তো হল না, দেখতে হবে তার কার্যকারিতা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। খুঁজে বার করতে হবে তার সঠিক ডোজ। প্রথমে পরীক্ষাগারে মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে, তারপর সুস্থ মানুষের শরীরে। স্বেচ্ছাসেবকদের শরীরে সেই টিকা প্রয়োগ করে দেখতে হবে আ্যান্টিবডি তৈরি হলো কি না, করোনা সংক্রমণ পর্তিরোধ করা গেল কিনা; পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াই বা মানুষের মধ্যে কী হচ্ছে। তাও একবারে নয়, দফায় দফায়, তিন দফায়। এই তিন দফার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পেরিয়ে যদি দেখা যায় টিকা কার্যকরী হচ্ছে, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও কম, তবেই বাণিজ্যিক উৎপাদনের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যায়। জৈব প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির জন্য পরীক্ষাগারে টিকা তৈরির কাজটি কয়েক মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। সময় লেগেছে এবং লাগছে মানুষের শরীরে তিন দফার পরীক্ষার জন্য।

ভরাতবর্ষে দুটি টিকা জরুরী ভিত্তিতে অনুমোদন পেয়েছে (restricted emergency use authorisation)। তার একটি হলো কোভিশিল্ড, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানির যৌথ প্রয়াস, দেশে উৎপাদন করছে পুনার সিরাম ইনস্টিটিউট। শিম্পাঞ্জি এডেনোভাইরাস ভেক্টরের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হচ্ছে করোনাভাইরাসের সারফেস প্রোটিন, যার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে এবং করোনা ভাইরাসজনিত অসুখ প্রতিহত করবে। তৃতীয় দফার পরীক্ষা হয়েছে ইংল্যান্ড এবং ব্রাজিলে। অন্য টিকাটি হলো কোভ্যাক্সিন, নির্মাতা হায়দ্রাবাদের ভারত বায়োটেক, সহায়তায় আইসিএমআর। সম্পূর্ণভাবে ভারতে তৈরি টিকাটি তে রয়েছে নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস (whole virion)। মানব শরীরে দুই দফার পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এই টিকাটির।

বিতর্ক শুরু হয়েছে এখান থেকেই। তিন দফা পরীক্ষা সম্পূর্ণ করার আগেই কোভ্যাক্সিন টিকাটিকে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার। আবার কোভিশিল্ড টিকার পরীক্ষা হয়েছে ইংল্যান্ড এবং ব্রাজিলে, ভারতে নয়। বিদেশে পরীক্ষিত টিকার ভারতে অনুমোদন পাওয়ার ব্যাপারেও রয়েছে বিতর্ক। এমনকি দুই টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থার প্রধানের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ির ঘটনাও সামনে এসেছে।

দেশজ টিকা কোভ্যাক্সিনকে স্বাগত জানিয়েও অনেক বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ তিন দফা পরীক্ষা সম্পূর্ণ করলে তবে তার কার্যকারিতা ও পার্শ্ব পর্তিক্রিয়া মোটামুটি ভাবে জানা সম্ভব। আর সুস্থ মানুষের শরীরে প্রয়োগের জন্য যে কোনো ওষুধ বিশেষত টিকার ক্ষেত্রে সুরক্ষার তথ্য অতি আবশ্যক। তাঁরা বলেছেন স্বদেশী টিকাকে তড়িঘড়ি অনুমোদন দিতে গিয়ে বিজ্ঞানের নীতিকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ভারতে করোনা সংক্রমণের হার যখন নিম্নগামী, মৃত্যুহারও সামান্য, তখন এই অবৈজ্ঞানিক অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল না। এর বিপরীতে ৪৯ জন বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের বক্তব্য স্বাস্থ্যমন্ত্রক প্রচার করে যেখানে তাঁরা কোভ্যাক্সিনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। মজার কথা হল তাঁরা কিন্তু টিকাটির কার্যকারিতা বা সুরক্ষার বিষয়ে মন্তব্য করেন নি, প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিরোধিতা করেছেন। সমস্যা হল বিজ্ঞান তথ্য নিয়ে চলে, বিশ্বাস দিয়ে নয়।

এই টিকাটি যে অনুমোদন পেয়েছে তাতে বলা হয়েছে এটি দিতে হবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মোড-এ। অর্থাৎ মানবদেহে পরীক্ষার সময় যে নিয়মাবলী অনুসরণ করা হয় তা এই কোভ্যাক্সিন টিকা প্রদানের পরেও করতে হবে। যিনি টিকা নেবেন তাকে টিকা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য জেনে বুঝে অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে (informed consent)। প্রতিটি ডোজ নেওয়ার পরে সাত দিন শরীরে কোনো অসুবিধা হলে তা নির্দিষ্ট ফর্মে লিখে রাখতে হবে। আবার টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা থেকে ফোন করে এক মাস পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থার নজরদারি করা হবে। এমনকি টিকার কারণে শারীরিক ক্ষতি হলে সংস্থা তার ক্ষতিপূরণ দেবে। এটি কিন্তু সম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নয়, কারণ তুলনা করার জন্য কোনো প্ল্যাসিবো (টিকার মত, কিন্তু টিকা নয়) পাওয়া জনগোষ্ঠী নেই। সম্ভবত তৃতীয় দফার পরীক্ষায় প্রাপ্তব্য তথ্যের অভাবে, অনুমোদনের সময় এই বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কোভ্যাক্সিন প্রাপ্ত এত মানুষকে নজরদারি করার বিষয়টি বাস্তবসম্মত বলে বোধ হয় না। ভোপালের হাসপাতালের ট্রায়ালে নজরদারি ঠিকঠাক না করার অভিযোগ সামনে এসে গেছে।

নিষ্ক্রিয় সম্পূর্ণ অণুজীব দিয়ে অন্যান্য টিকা অনেক দিনই চালু আছে, খুবই কার্যকরী, প্রতিক্রিয়াও অতি সামান্য। কোভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রেও পশু ও মানবদেহে প্রথম দু'দফার পরীক্ষায় তা প্রমাণিত। কিন্তু সরকারি সংস্থার চটজলদি অনুমোদনের ফলে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের এই প্রশংসনীয় আবিষ্কার প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। মুশকিল হল যাঁরা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন তাঁরাও মুখ খুলছেন না অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে অনেক সময়ই পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠে গেছে এই গণটিকাকরণের পদ্ধতি নিয়েও। ১৬ জানুয়ারি ২০২১ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরেই শুরু হয়েছে কোভিড টিকা প্রদান। প্রথমে সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকাকরণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, কিন্তু যাঁরা বিগত ৯ মাস কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তাঁদের অনেকের মধ্যেই টিকা গ্রহণ করতে অনীহা দেখা যাচ্ছে। আবার নির্দেশ এসেছে যে প্রতিটি টিকা কোউইন ইন্টারনেট পোর্টালের মাধ্যমে নথিভুক্ত করে তবে প্রদান করতে হবে। সারাদেশের হাজারেরও বেশি কেন্দ্র একসঙ্গে কোউইন পোর্টালে কাজ করতে গিয়ে পোর্টালটি অচল হয়ে গেছে। প্রত্যেকের নথি যাচাই করে পোর্টালে তুলে তবে টিকা দিতে গিয়ে সময়ও লাগছে বিস্তর। কখনো টিকা প্রদানের দিনক্ষণ জ্ঞাপক বার্তা টিকা প্রার্থীর ফোনে যাচ্ছে না, কখনো বা টিকা প্রদানের পরের বার্তা আসছে না। পশ্চিমবঙ্গে প্রথমে এসেছে কোভিশিল্ড, এটি কয়েকদিন দেবার পরেই ঢুকে গেল কোভ্যাক্সিন। অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর বিচার করেত সমস্যা হচ্ছে যে কোন টিকাটি নেবেন। আবার কোভ্যাক্সিন টিকার জন্য আলাদা একটি তথ্য প্রদান ও অনুমতি সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কিন্তু মোটের উপরে টিকা গ্রহণের হার একদমই আশাব্যঞ্জক নয়। দুটি টিকাই তরল অবস্থায় থাকে এবং টিকার শিশি খুলে ফেললে চার ঘন্টা পর্যন্ত রাখা যায়। কোভিশিল্ডের শিশিতে থাকে দশটি করে ডোজ, আর কোভ্যাক্সিনের শিশিতে কুড়িটি করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেওয়া না গেলে বাকি ডোজগুলি নষ্ট হবেই, সমস্যা হচ্ছে তা নিয়েও।

প্রশ্ন উঠেছে কেন্দ্রীয় সরকারের সামগ্রিক পরিকল্পনা এবং ডিজিটাল মাধ্যম ও ইন্টারনেটের উপর অতি নির্ভরতা নিয়েও। টিকা প্রদানের মত সহজ একটি ব্যাপার , যা ভারতে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে, কাগজ-কলম বাদ দিয়ে নেট আর ফোনের ভরসায় তাকে অনর্থক জটিল করা হল। কম সময়ে দেশ জুড়ে গণটিকাকরণের মত একটি বিরাটকায় কাজকে কেন্দ্রিকতায় মুড়ে রাখলে যা হবার তাই হয়েছে। হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রগুলি চেয়ে আছে জেলার দিকে, জেলা রাজ্যের মুখাপেক্ষী, আর রাজ্য কেন্দ্রের নির্দেশের অপেক্ষায়। রোজই জুম মিটিং, রোজই কিছু নতুন নির্দেশ!

বিগত প্রায় এক বছর এই অতিমারীর সঙ্গে কাটিয়ে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়েছেন, প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, উপার্জন কমে গেছে, মুখোশ পরা, অনলাইনে ক্লাস করা, নব্য স্বাভাবিক এই জীবনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি ক্রমশ। ভাবা গেছিল করোনার টিকা আবিষ্কৃত হলে মানুষ এবং সর্বাগ্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা সবাই মিলে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু টিকাকরণের প্রাথমিক উত্তেজনা এখন স্তিমিত, মিডিয়ারও উৎসাহ নেই। এর কারণ কি করোনার সংক্রমণের হার কমে যাওয়া, নাকি করোনা টিকার কার্যকারিতা বা সুরক্ষা নিয়ে বিতর্ক? অথবা টিকাকরণ কর্মসূচির পরিকল্পনা ও রূপায়নের গলদ? ভবিষ্য‍ৎ কি উত্তর দেবে!