আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

সমসাময়িক

গণতন্ত্রের সংকট


বেশ কিছুকাল আগে, তখন করোনাজনিত লকডাউনে নাগরিকজীবন বিপর্যস্ত, আরেক রকমের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল যে করোনার সংকট শুধুমাত্র চিকিৎসা বা জনস্বাস্থ্যের সংকট নয়, বরং এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে পুঁজিবাদের সংকট ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিপর্যয়ের প্রশ্নটুকু। এই বক্তব্যকেই সম্প্রতি মান্যতা দিল ইকোনমিস্ট পত্রিকার বিশ্লেষণ। তারা বিশ্ব রাজনীতির গণতন্ত্রগুলোর তুলনামূলক আলোচনায় দেখিয়েছে যে অতিমারীর ফলশ্রুতি হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে মূল দিক-নির্দেশিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে গণতান্ত্রিকতার হ্রাস, এবং ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী ও একনায়কতন্ত্রী প্রবণতার দিকে ঝুঁকে পড়া। ভারতবর্ষের অবস্থা বিশেষ করুণ, কারণ গতবছরের তুলনায় তার অবনমন ঘটেছে, এবং এই মুহূর্তে ভারতকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র হিসেবে।

সাধারণত প্রতি বছর, অথবা এক বছর অন্তর ইকোনমিস্ট পত্রিকা তাদের এই প্রতিবেদন পেশ করে, বিশ্বের ১৬৭টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে। পাঁচটা আলাদা বিষয়ের অন্তর্গত মোট ৬০টা সূচকের উপর ভিত্তি করে ফলাফল নির্ধারিত হয়। এই পাঁচটা বিষয়ের মধ্যে পড়ে বহুত্ববাদ, নাগরিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইত্যাদি। এই গণনার ওপর ভিত্তি করে দেশগুলির যে স্থানাংক নির্ণয় করা হয়েছে তার চেহারাটা কীরকম?

গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, হাস্যকরভাবে, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দলে গিয়ে ভিড়েছে। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সেখানে নাগরিক সমাজের ভেতর রাজনীতির চর্চা এতই কম, অথবা হলেও ট্রাম্প-জাতীয় জনমোহিনী রাজনীতির বাইরে তা চোখই মেলত পারে না, যে সামগ্রিকভাবে দেশটির গণতন্ত্রের অধঃপতন চোখে পড়বার মত। চিলি, উরুগুয়ে অথবা কোস্টারিকার মত তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্রের দলে পড়ছে, সেখানে তাদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানো মার্কিনীদের নিজের অভ্যন্তরেই যে গোলমাল, সেই হৃদয়বিদারক সত্য সামনে চলে এসেছে এতদিনে। কিন্তু সমস্যাটা একমাত্র সেখানেই, এমন নয়।

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ইউরোপের অনেক দেশেই, যেখানে গতবছর অবধি পূর্ণ গণতন্ত্র ছিল, ২০২১ এ এসে তারা স্থান পেয়েছে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের সারিতে। এদের মধ্যে আছে গ্রীস, ইতালি, ফ্রান্স ও পর্তুগালের মত দেশগুলি। লক্ষ্যণীয়, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগালে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে করোনার কারণে। শুধু প্রাণহানিই নয়, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবেই ভেঙে পড়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক একই সময়ে তাদের গণতন্ত্রের মধ্যেও অবনমন এসেছে। বস্তুত, ব্রিটেন আর জার্মানি বাদে এমন দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে করোনার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও গণতন্ত্র পূর্ণরূপে বিকশিত আছে। সে ব্রাজিল হোক বা মেক্সিকো কি ইন্দোনেশিয়া। অপরদিকে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড অথবা কানাডাতে করোনার ততটাও খারাপ প্রভাব পড়েনি এখনো পর্যন্ত, এবং গণতন্ত্র পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান বলেই দেখা যাচ্ছে। অবশ্যই ব্যতিক্রম থাকবেই, ব্রিটেন ও জার্মানির কথা বলাই হল, কিন্তু তা সত্ত্বেও যে প্রশ্নটি উঁকি দেয় - তাহলে কি অতিমারীর সুযোগ নিয়ে সার্বিকভাবে শাসকগোষ্ঠী নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের পথে কিছুটা হলেও সফল হচ্ছে?

আমেরিকার কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল কারণ সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক কুগ্রহের প্রভাবে গণতন্ত্র এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত, এবং করোনা না হলেও হয়ত এই ফলাফলই হত। কিন্তু অন্য দেশগুলোর অবনমন বেশ চোখে পড়বার মতই। লকডাউন হোক অথবা ব্যাপকহারে জনজীবনে কড়াকড়ি, যেগুলো অবশ্যই দরকারি পদক্ষেপ - কিন্তু সেগুলোই কি গণতন্ত্রকে খর্ব করবার রাস্তাও প্রশস্ত করছে? নাহলে ফ্রান্স, যাকে বলা যায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্মস্থান, সেখানে কী হিসেবে এমন ফলাফল? দীর্ঘদিন ধরে লকডাউনের ফলে সংসদের অচলাবস্থা, জনমানসের মধ্যে সঞ্চারিত ভীতি, নিরাপত্তার অভাববোধ - এরকম পরিস্থিতিতে কঠোর প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষ তাঁদের সমর্থন দুহাত ভরে ঢেলে দিয়েছেন, এমন ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম নয়। জার্মানিতে বিসমার্ক অথবা পরে হিটলারের উত্থান, ইতালিতে মুসোলিনি, এঁদের ইতিহাস একই কথা বলে। আজকের পৃথিবীতে সরাসরি নাজিবাদের দিকে যাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু পুঁজিবাদ প্রথমেই যেটা করতে পারে - অবাধ পুঁজির চলাচলের পথ সুগম করবার উদ্দেশ্যে গণতন্ত্রকে যে কোনো অজুহাতে যতটা সম্ভব নিজের পকেটে পুরে রাখা। এবার একটি দেশে দীর্ঘদিন লকডাউন যদি চলে, যেখানে বিরোধী দল, নির্বাচন ইত্যাদি ব্যাপারগুলো অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে, সংবাদপত্রগুলি দাবী করে যাচ্ছে কঠোর প্রশাসনিক বজ্রমুষ্টির, নাগরিকের যথেচ্ছ চলাচলের অধিকার ন্যায্য কারণেই সীমিত, সেখানে বাজারও স্বাভাবিকভাবেই বিপর্যস্ত। সেক্ষেত্রে পুঁজিবাদ আরও আগ্রাসী হতে চাইবে স্বাভাবিকভাবেই, এবং শাসকগোষ্ঠীর হাতে যদি তখন অতিমারীর কারণেই বহু সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা স্বতস্ফূর্তভাবেই তুলে দেয় দেশের মানুষ, তাহলে পুঁজিবাদ সেই ক্ষমতাগুলিকেই ব্যবহার করবে নিজের স্বার্থে। ফলাফল হিসেবে গণতন্ত্রের খণ্ডীকরণ অস্বাভাবিক নয়। ভারতবর্ষের কথাই যদি ধরা যায়, যেখানে অনেক রাজ্যেই ২০২০ সালের নির্বাচন স্থগিত ছিল, অতিমারীর সুযোগ নিয়ে প্রায় বাধাহীনভাবে রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়ে গেছে, সরকারবিরোধী সমালোচনার কারণে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান থেকে সাংবাদিক, পরের পর এফআইআর-এর গুঁতো খাচ্ছেন, ঠিক সেরকম পরিস্থিতিতেই মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি প্রতি ঘণ্টায় নব্বই কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই অবস্থা আদানীরও। মানে, বেসরকারি পুঁজির বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে অতিমারীর কোথাও একটা যোগ আছে, বলা যায় অতিমারীর সুযোগ নিচ্ছে পুঁজিবাদ।

এবার, এর ফলে কি একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে এই দেশগুলি? এখনই এরকম চটজলদি সিদ্ধান্ত টানা যাবে না। যেসব দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী অথবা কিছুটা মাত্রায় ক্রিয়াশীল, সেখানে দুম করে পট পরিবর্তন হয়ে খুল্লামখুল্লা একনায়কতন্ত্র চলে আসবে, এ জিনিস আগে হত। কিন্তু এখন সামাজিক ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তের দিনে সেটা হওয়া কঠিন। কিন্তু যেটা হতে পারে, তা হল গণতন্ত্রের ধোঁকার টাটি সামনে ঝুলিয়ে রেখে স্বৈরাচারের বিকাশ, যে জিনিস বিজেপি করছে ভারতবর্ষে। মনে রাখতে হবে ৩৭০ ধারা বিলোপ বা রামমন্দির কি সিএএ কোনওটাই বিজেপিকে গায়ের জোরে করতে হয়নি, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সংসদীয় ব্যবস্থায় বিল পাশ করিয়ে করা হয়েছে। আর একই সময়ে করোনাকালে নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ হোক বা থালা বাজানোর পরামর্শ - সব কিছু মিলিয়েই সুচতুর পাবলিক রিলেশন্সের দক্ষতায় তাঁর একটি কঠোর (আবার প্রয়োজনে কোমল) পেট্রিয়ার্কের ভাবমূর্তিও নির্মাণে সফল হয়েছে বিজেপি। এবার এই গোষ্ঠীপতির ভাবমূর্তি সম্বল করে বহু অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকেই সংসদীয় রাজনীতির মুখোশ পরিয়ে সফল করানো সম্ভব, কারণ হিসেবে দেখানো হবে - পিতৃপ্রতীম মোদীজি এই সংকটকালে দেশকে টেনে নিয়ে চলেছেন নিজের কাঁধে - এরকমই কিছু। সংকটের অজুহাতে চেপে দেওয়া হবে নাগরিক অধিকার, আরও বেশি বেশি করে।

কাজেই, আজ বাদে কাল করোনা চলে যাবে, কেটে যাবে অতিমারীর ভয়াবহতাও। কিন্তু যে গভীর সংকটকে আরও গভীর করে দিয়ে গেল এই অতিমারী, তার জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন আবিষ্কার করবে কোন মানবতা?