আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

সমসাময়িক

নাগরিকত্বের জুমলা


অমিত শাহ ঠাকুরনগর এলেন, দেখলেন, ভাষণ দিলেন কিন্তু কথা রাখলেন না। ঠাকুরনগর মতুয়া সমাজের কেন্দ্র স্থল, যা বনগাঁ লোকসভা আসনের অন্তর্গত। বহু বছর ধরে মতুয়া সমাজ নাগরিকত্বের দাবি জানাচ্ছে। ২০১৯ সালে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। আইন পাশ হওয়ার দেড় বছর পরেও আইনের অন্তর্গত রুল্‌স বা বিধি তৈরি হয়নি। তাই অমিত শাহ ঠাকুরনগরের সভায় মতুয়া সমাজকে বললেন ভরসা রাখতে, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে এবং করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ হলে মতুয়াদের নাকি নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।

বিজেপি এর আগে বলেছিল প্রত্যেক মানুষের ব্যাঙ্কে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে, নোট বাতিলের মাধ্যমে কালো ধন উদ্ধার হবে, পেট্রল-ডিজেলের দাম কমবে, আচ্ছে দিন আসবে, ইত্যাদি। প্রত্যেকটি প্রতিশ্রুতি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও মিথ্যা।

আসলে মতুয়া সমাজের থেকে দাবি ওঠে যে তাদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে। ২০০৩ সালে যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ভারতে পাশ করা হয়, তাতে প্রথমবার বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উদ্বাস্তুদের দাগিয়ে দেয়। বলা হয় যে বৈধ দলিল-দস্তাবেজ বা অনুমতিপত্র ছাড়া যারা ভারতে প্রবেশ করেছে সবাই অনুপ্রবেশকারী। এই অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, এবং তাদের সন্তানরাও কখনও ভারতের নাগরিকত্ব পাবে না। দেশভাগের ঘা গায়ে নিয়ে ভারতে যে অগুনতি মানুষ এসেছিলেন, তাদের হাতে কোনো কাগজ ছিল না। ২০০৩-এর আইনের ফলে তারা সবাই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হয়ে যান।

২০১৯-এর আইনের মাধ্যমে সরকার বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে যেই সমস্ত মানুষ ভারতে রয়েছেন, যারা ধর্মীয় অত্যাচারের দরুন বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে, যদি তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের না হন। ভারতে প্রথমবারের জন্য ধর্মকে নাগরিকত্বের একটি শর্ত হিসেবে হাজির করা হয় যা দেশের সংবিধানের মৌলিক ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর সরাসরি বিরুদ্ধে। তাই এই আইনকে অসাংবিধানিক বলা উচিত বলে ১৫০-র বেশি মামলা সুপ্রিম কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় দিন গুনছে।

মতুয়া সমাজের কিছু অংশ বিজেপি-র প্রচারে প্রভাবিত হয়ে এই আইনকে সমর্থন করে এই ভেবে যে এই আইনের মাধ্যমে তারা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব পাবেন। কিন্তু ২০১৯-এর আইনে কোনো নিঃশর্ত নাগরিকত্বের কথা বলা হয়নি। সিএএ ২০১৯-র ৩ নম্বর ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে "certificate of registration" অথবা "certificate of naturalisation", অর্থাৎ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে। শুধু তাই নয়, নিঃশর্তভাবে নয়, বরং কিছু শর্ত মেনেই এইরকম সার্টিফিকেট দেওয়া হবেঃ "subject to such conditions, restrictions and manner as may be prescribed, on an application made in this behalf..."। শুধু তাই নয়, সিএএ ২০১৯-এর ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করার আগে আবেদনকারীকে ন্যূনতম ৬ বছর ভারতে বসবাসকারী অথবা ভারত সরকারের অধীনে কর্মরত হতে হবে। অর্থাৎ, মতুয়া সম্প্রদায়ের যে প্রাথমিক দাবি যে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে, সেই দাবি ২০১৯-এর আইনে মানা হয়নি।

কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অমিত শাহ এবং মোদী সরকার খুব ভালোভাবেই জানেন যে ২০১৯-র নাগরিক সংশোধনী আইনের মাধ্যমে কাউকেই নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ প্রত্যেককেই আবেদন করতে হবে এই কথা মেনে নিয়ে যে এতদিন সে ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বসবাস করেছে। এহেন পরিস্থিতি এটাই স্বাভাবিক যে সরকার সিএএ-২০১৯-এর রুল্‌স জারি করতে টালবাহানা করছে। ভোটের লোভে মতুয়া সমাজকে বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু কীভাবে দেওয়া হবে যেখানে বলা থাকবে সেই রুল্‌স বানানো হচ্ছে না। বলা হচ্ছে যে করোনার জন্য নাকি রুল্‌স তৈরি করা যায়নি। অথচ, করোনা কালেই শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে, কৃষি আইন পাশ করা হয়েছে, নতুন শিক্ষা নীতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং কৃষি আইনের রুল্‌সও তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের রুল্‌স পাশ করলেই করোনা হয়ে যেত, অতএব তা করা হয়নি। এরকম হাস্যকর যুক্তি দিচ্ছে মোদী সরকার।

আসলে তাদের ধোকাবাজি ধরা পড়ে গেছে। তারা নাগরিকদের বেনাগরিক হিসেবে নিজেদের আবেদন করতে বলছেন। ঠাকুরনগরে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে যে আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের নাগরিকত্ব দেব‍! কিন্তু নাগরিক না হলে তারা ভোট দেবে কী করে সেই কথা উহ্য থেকে যাচ্ছে। এই কথা ঠিক যে মতুয়া সমাজ এবং উদ্বাস্তু বহু মানুষকে নানা প্রশাসনিক কাজে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অনেকের কাছেই পর্যাপ্ত কাগজ নেই। সেই সমস্যার বাস্তবসম্মত সুনির্দিষ্ট সমাধান করার চিন্তা না করে, কেন্দ্রীয় সরকার মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জটিলতা বাড়াচ্ছে।

সমাধান না বাতলে নাগরিকত্বের জটিলতা না বাড়ালে সরকারের চলবে কী করে? মানুষকে নাগরিকত্ব, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত রাখলে তারা আর অন্যান্য বিষয় প্রতিবাদ করার সময়ই পাবে না। অতএব, ২০০৩ সালের আইনে কোনো কারণ ছাড়া সমস্ত উদ্বাস্তুকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করা হল। তারপরে, আন্দোলন করলেন মতুয়া সমাজের মানুষরা। কিন্তু কোনো ফল হল না। এখন ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই আইনে নাগরিকত্ব পেতে হলে দরখাস্ত করতে হবে। স্বীকার করে নিতে হবে যে আপনি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। এই জটিলতার জন্যই রুল্‌স প্রকাশিত হচ্ছে না।

তাই শুধু সিএএ-২০১৯ নয়, ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিলের দাবি তোলা সমস্ত গণতন্ত্র প্রেমী ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। ঘটনা এটাই যে তৃণমূল, বামফ্রন্ট, বিজেপি, কংগ্রেস সবাই ২০০৩ সালের আইনের পক্ষে সেই সময় মত দিয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি খেয়াল করেনি যে কী ভয়ঙ্কর ফাঁদে তাঁরা পা দিচ্ছেন। এই আইনেই বলা আছে এনপিআর তৈরি করার কথা, যার ভিত্তিতে সন্দেহজনক নাগরিকদের চিহ্নিত করা হবে। মূল এনপিআর তালিকা থেকে সন্দেহজনক নাগরিকদের তালিকা বাদ দিলেই যা থাকবে তাই হল এনআরসি। অতএব, ২০০৩ সালের আইন বাতিল না করলে এনপিআর-এনআরসি-র আইনি ব্যবস্থা থেকে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের নির্বাচনে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ দল কি ইস্তেহারে লিখবেন যে তাঁরা ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন এবং ২০১৯ সালের সিএএ দুইয়েরই বিরুদ্ধে এবং তা পশ্চিমবঙ্গে চালু হতে দেবেন না? যদি তারা তা বলতে পারেন, তবেই বিজেপি বিরোধীতায় সততা থাকবে। নয়ত, বাঙালি জাতিকে হিন্দু মুসলমানে ভাগ করে, মুসলমান-দলিত-আদিবাসী-প্রান্তিক মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে সংঘ পরিবার রাজ্যের মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে দেবে। সংঘ পরিবারের বিরোধীতা করার অর্থ বর্তমানে তাদের সাম্প্রদায়িক ও বিভেদপূর্ণ নাগরিকত্বের বুনিয়াদী ধারণার বিপ্রতীপে দাঁড়ানো। ২০০৩ এবং ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল না করলে বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্বর ধারণাই মান্যতা পাবে।