আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

সমসাময়িক

করোনার দিনগুলিতে বাজেট


করোনা জনিত লকডাউনে ভারতের অর্থব্যবস্থা স্বাধীনতার পরে সর্ব বৃহৎ মন্দার মধ্যে, কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন অথবা তাদের আয় কমেছে, স্কুল-কলেজ বন্ধ, চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থা শোচনীয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্লান্ত অবসন্ন হেঁটে চলা পেরিয়ে এল ২০২১ সালের বাজেট। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাজেট নাকি তিনি পেশ করতে চলেছেন। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ কী পেল এই বাজেটে?

বাজেট ভাষণের শুরুতেই নির্মলা সীতারমণ বললেন যে স্বাস্থ্য খাতে নাকি বিপুল ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে - ১৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি। মিডিয়া উৎফুল্ল! কিন্তু সত্য কী? স্বাস্থ্য এবং সার্বিক জীবনমানের জন্য নাকি বারদ্দ হয়েছে ২০২১-২২ সালে ২২৩৮৪৬ কোটি টাকা। এই বিশাল অংকের দিকে তাকালে চোখ কপালে ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু চলে আসুন বাজেট বক্তৃতার পরিশিষ্টে। দেখবেন যে ২০২১-২২ সালে আসলে স্বাস্থ্য দপ্তরের মোট ব্যয় হবে ৭৪৬০২ কোটি টাকা, যেখানে ২০২০-২১ সালে খরচ হয়েছে ৮২৪৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের আসলে বাজেট বরাদ্দ কমেছে। তাহলে ১৩৭ শতাংশের গল্পটার কী হল? যা হল তা হল অনেকটা এমন যে আপনি বাজার থেকে ১০টা আম আর ৫টা তেতুল কিনে এনে বললেন যে ১৫টা আম কিনে এনেছেন। এই যে ২২৩৮৪৬ কোটি টাকা, এর মধ্যে রয়েছে বাড়িতে জল সরবরাহ করার জন্য বরাদ্দ ৬০০৩০ কোটি টাকা, কোভিড ভ্যাকসিনের জন্য বরাদ্দ ৩৫০০০ কোটি টাকা, এবং দেশের ফিনান্স কমিশন রাজ্যগুলিকে স্বাস্থ্যে খাতে ব্যয় করার জন্য যে টাকা দিচ্ছে তাও গোনা হয়েছে এখানে। কোভিড ভ্যাকসিন এককালীন খরচ, যা জরুরি কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফেরাবে না। আবার জোর গলায় বলা হয়েছে যে ৬৪১৮০ কোটি টাকা খরচ হবে প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর সুস্থ ভারত যোজনায়। কিন্তু তা খরচ করা হবে ৬ বছর ধরে। অর্থাৎ বছরে ১০০০০ কোটি টাকার একটু বেশি। এই বরাদ্দ মোট স্বাস্থ্য বাজেটেই ধরা আছে। তাই বক্তৃতায় ঘটা করে বলা হলেও আসলে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ কমেছে, যা আমরা আগেই বলেছি। কোভিড গোটা বিশ্বকে এই শিক্ষাই দিয়েছে যে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যদি সরকারী সাহায্যে বিপুল উন্নতি না করা হয়, তবে আগামীদিনে অন্য কোনো অতিমারিতে মানুষের আরো ভয়াবহ মৃত্যু হবে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার আত্মনির্ভর ভারত গড়তে চায়, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে। কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সেই কমানোকেই বাড়ানো হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

এবার আসা যাক কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গে। কোভিড লকডাউনের ফলে পরিযায়ী শ্রমিকরা বিপুল সংখ্যায় গ্রামে ফিরে যায় এবং ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে নাম লেখায়। ফলে ২০২০-২১ সালে ১০০ দিনের কাজে সরকারের খরচ হয় ১১৫০০০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২১-২২ সালে এই খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রায় ৪০০০০ কোটি টাকা ছাঁটাই করে মোট ৭৩০০০ কোটি টাকা এই খাতে খরচ করা হবে বলে বলা হয়েছে। বহু মানুষ এখনও বেকার, তবু সরকার কর্মসংস্থানে ব্যয় কমাচ্ছে। একইভাবে জিডিপি-র অনুপাতে গ্রামীন উন্নয়ন, কৃষি, খাদ্যে ভরতুকি, ইত্যাদি খাতে ২০২১-২২ সালে বাজেট বরাদ্দ কমানো হয়েছে। অতিমারির আবহে এই সংকোচনের নেপথ্যে সরকারের কোন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।

আসলে সরকার ভাবছে ২০২১-২২ সালে অর্থব্যবস্থা ঘুর দাঁড়াবে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। যা করার কর্পোরেট ক্ষেত্রই করবে। যাতে কর্পোরেট ও পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ বাড়ায়, তার জন্য বাজেটে বিশেষ কিছু ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমত, দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্ককে বেসরকারীকরণ করা হবে। এলআইসি-র মতন লাভজনক এবং সাধারণ মানুষের ভরসার বিমা কোম্পানির শেয়ার বাজারে বিক্রি করা হবে। চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাকে বেসরকারীকরণ করা হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার ২০২১-২২ সালে ১৭৫০০০ কোটি টাকা আদায় করার লক্ষ্যমাত্র ঘোষণা করেছে। দেশের সরকারের সম্পত্তি বেচে সরকার বাজেট ঘাটতি কমানোর কথা ভাবছে। কিন্তু বাজেট ঘাটতি কমানোর আরেকটি সহজ উপায় হল কর আদায় বাড়ানো।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে সরকার কর্পোরেট ক্ষেত্রকে লাগাতার কর ছাড় দিয়ে চলেছে। মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন কর্পোরেট কর এবং জিডিপি-র অনুপাত ছিল ৩.৫ শতাংশ, বর্তমানে যা কমে হয়েছে ২.৫ শতাংশ। ২০২১-২২ সালে কর্পোরেট কর খাতে সরকার যা রাজস্ব আদায় করবে তা ২০১৮-১৯ বা ২০১৯-২০ সালের তুলনাতেও অনেক কম। আবার ব্যক্তিগত আয় করের ক্ষেত্রেও কোনো বৃদ্ধি চোখে পড়ছে না। শুধুমাত্র পেট্রোল ও ডিজেলের উপর বাড়তি উৎপাদন শুল্ক বসিয়ে সরকার আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কর আদায় করার এই ঘাটতিকে সরকার মেটাতে চাইছে সরকারী সম্পত্তি বিক্রি করে। সরকারের এই হাল দেখে একটি উপমা বাঙালিদের মনে পড়বেই। ধনী জমিদার বা পুঁজিপতি প্রচুর ধন সম্পত্তি রেখে মৃত হয়েছেন। তাঁর অপদার্থ পুত্ররা রোজগারে অপারগ। তাই তারা বাপের সম্পত্তি বেচে সংসার চালাচ্ছে। বর্তমান মোদী সরকারের হয়েছে সেই হাল। পুঁজিপতিদের থেকে কর আদায় করার মত সাহস এই সরকারের নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দাবিয়ে রেখে তাদের উপর বাড়তি উৎপাদন শুল্ক চাপিয়ে, পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়িয়ে এবং বহু বছর ধরে তৈরি হওয়া সরকারী সম্পত্তি বিক্রি করে মোদী দেশ চালাচ্ছেন। অবাক হয়ে দেখতে হয় বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী যখন সরকারী সম্পত্তি বিক্রির ঘোষণা করছেন, সরকার পক্ষের বেঞ্চ থেকে হাততালি পড়েছে সর্বাধিক। এরাই আবার আত্মনির্ভরতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি বড়ো বড়ো কথা বলে।

আরেকটি বিষয় বেশ কিছু বছর ধরে হয়ে চলেছে যা নিয়ে মিডিয়াতে প্রায় কোনো আলোচনা চোখে পড়ে না। কোভিডের আগে (২০১৮-১৯ সাল) কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে মোট করের থেকে ৭৬১৫৪৫ কোটি টাকা দেয়, যা ২০২১-২২ সালে ৬৬৫৫৬৩ কোটি টাকা হবে বলে বাজেট অনুমানে বলা হয়েছে। রাজ্য সরকারগুলিকে উন্নয়ন খাতে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। কিন্তু ফিনান্স কমিশন মোট কেন্দ্রীয় করে রাজ্যদের অংশ বৃদ্ধি করলেও জিডিপি-র অনুপাতে রাজ্যের কর বরাদ্দ কমছে। ফলত রাজ্যগুলি সমস্যায় পড়ছে তাদের খরচ চালাতে। জিএসটি শুরু হওয়ার পর করের হার নির্ধারণ করার এক্তিয়ার আর কোনো রাজ্যের একক হাতে নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি মেনে বাজেট ঘাটতি মোট আয়ের ৩ শতাংশের বেশি করা চলবে না। অতএব, এই দুইয়ের চাপে রাজ্য সরকারগুলির ব্যয় করার ক্ষমতার উপরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির ভিতরে থেকেই রাজ্যগুলিকে কাজ করতে হচ্ছে। তদুপরি, কেন্দ্রীয় সরকার করের মধ্যে সেসের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছে, বিভিন্ন খাতে। করের উপর যেই সেস বসানো হয়, তাতে রাজ্যগুলিকে কোনো ভাগ দিতে হয় না। তাই সেস বাড়তে থাকলে রাজ্যের বরাদ্দ কমে। বিগত বছরগুলিতে তাই ঘটে চলেছে। কোভিড অতিমারির মধ্যে জিএসটি-র ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ রাজ্যগুলিকে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ হয়। সরাসরি একে চুক্তি খেলাপি বলা যায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে বেশি করে ধার নেওয়ার অনুমতি দেয় এবং নিজেও কিছু বাড়তি ধার নিয়ে রাজ্যগুলির বরাদ্দ মেটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজ্যগুলিকে বাড়তি ঋণ নেওয়ার জন্যও কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত শর্ত মেনে রাজ্যগুলিকে চলতে হবে। আবারো রাজ্যের নিজস্ব নীতি নির্ধারণ করার সীমাবদ্ধতা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বিজেপি-র প্রবল দাপটে রাজ্য সরকারগুলি চুপ। তারা কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো দাবি-দাওয়া তোলা না। এই বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ করের পরিমাণ কমে যাওয়ার পরেও রাজ্য সরকারগুলি কোনো আপত্তি জানিয়েছে বলে জানা যায়নি।

করোনার আবহে যে বাজেট পেশ হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ, রাজ্য সরকার, মধ্যবিত্ত কারোর জন্যই কোনো সুখবর নেই। একমাত্র সুখী হওয়ার কথা কর্পোরেট ক্ষেত্রের কেষ্টবিষ্টুদের যারা এই অতিমারির মধ্যেও নিজেদের সম্পদ বিপুল পরিমাণ বাড়িয়েছেন। এমন নয় যে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন বেসরকারী পুঁজি সম্পদ নির্মাণ করে তাই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে রাজনীতি করা চলবে না। অর্থাৎ কয়েক দিন পরেই তিনি বলবেন যে তার মিত্র দুই গুজরাটি শিল্পপতির বিরোধীতা করা চলবে না, করলে তাকে দেশদ্রোহিতা বলা হবে! সমাজতান্ত্রিক নয়, সাধারণ পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও ভারতের তুলনায় অনেক বেশি কর দিতে হয়। শুধু তাই নয়, বাজেট তথ্য ভালো করে ঘাঁটলে দেখা যাবে যে বড়ো কোম্পানিগুলি ছোটদের তুলনায় কম কর দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও এই নীতির মান্যতা দেয় না। কতিপয় শিল্পপতির হাত শক্ত করা পুঁজিবাদ নয়, ধান্দাতন্ত্র। অন্যদিকে, দেশের মানুষদের স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিতে যিনি পিছ পা হন না, তিনিই যখন পুঁজিপতিদের পক্ষে সংসদে দাঁড়িয়ে তাদের বিরোধীতা করা যাবে না বলে ভাষণ দেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, স্বঘোষিত ফকির কাদের পক্ষে।