আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

নবান্ন অভিযান ও সরকারি বর্বরতা


এই সম্পাদকীয় লেখা শেষ হওয়ার পরে, ওয়েবসাইটে তোলার আগে খবর এল বাম ছাত্র-যুবদের ডাকা নবান্ন অভিযানে অংশগ্রহণকারী মইদুল ইসলাম মিদ্যা পুলিশের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন (১৫-০২-২০২১)। মইদুল ইসলাম মিদ্যা বাঁকুড়ার বাসিন্দা। তিনি পেশায় অটোচালক। চাকরির দাবিতে আন্দোলন করতে এসে তাঁর মৃত্যু প্রমাণ করে তৃণমূল সরকার প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে কতটা নিষ্ঠুর। মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। চাকরির দাবিতে আন্দোলন করতে এসে একজন গরীব মানুষের পুলিশি অত্যাচারে মৃত্যুর আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।


'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়' - কবিতার পঙক্তি যেন বাস্তবিকভাবেই মূর্ত হয়ে উঠেছিল গত ১১ ফেব্রুয়ারি, যেদিন বাম ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির ডাকে শিক্ষা ও চাকরির দাবীতে নবান্ন অভিযানে কেঁপে উঠল কলকাতার রাজপথ। ব্যারিকেড ভেঙে দিয়ে তরুণের দল যখন এগিয়ে যাচ্ছিল ধর্মতলার বুক চিরে, মনে হচ্ছিল এই এতদিন পর অজস্র কুকথা, নীতিহীন দলবদল, সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি ও সস্তা চমকের মিথ্যে বেলুন ফাঁসিয়ে দিয়ে সত্যিকারের রাজনীতি কাকে বলে, কলকাতা দেখল। দেখল, তারুণ্যের স্পর্ধা কাকে বলে, এবং এটাও দেখল যে প্রকৃত রাজনীতি থাকে বামদিকেই। বিজেপি তৃণমূলের লোকহাসানো চাপানউতোরের বিপ্রতীপে যদি সত্যিকারের ইস্যুগুলিকে কেউ সামনে নিয়ে আসতে পারে, তা বামপন্থীরাই।

আর সেইসঙ্গে দেখল, তৃণমূল সরকারের পুলিশের চেহারা কী বিভৎস হতে পারে। গোটা ধর্মতলায় সার সার ব্যারিকেড তুলে সশস্ত্র পুলিশ দাঁড়িয়ে কাতারে কাতার, ফুটপাতে ওঠার রাস্তাগুলিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে এস এন ব্যানার্জি রোডে ফেলে দিয়ে আটকে দেওয়া হল চারদিক যাতে বদ্ধ জায়গায় পুলিশ মারতে পারে। আর তারপর জলকামান, টিয়ার গ্যাস ও লাঠি হাতে তেড়ে এল হিংস্র প্রাণির মত, কাদের দিকে? নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ মিছিলের দিকে, যে ছেলেমেয়েদের হাতে বন্দুক তো দূরের কথা, আধলা ইট পর্যন্ত ছিল না। সেদিনকার সংঘর্ষে বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে মারছে এমন দৃশ্য দেখা যায়নি। কিন্তু পুলিশের অত্যাচারের নমুনা দেখল গোটা পশ্চিমবঙ্গ! কারোর মাথা ফেটেছে, চোখ নষ্ট হয়েছে এক তরুণের, পেটে ক্রমাগত লাঠির বাড়ি খেয়ে বমি করে ফেলছে কেউ, এমনকি গলির ভেতর ঢুকেও রেহাই মেলেনি, পুলিশ সেখানে তাড়া করে মেরেছে। নারী মুখ্যমন্ত্রীর পুরুষ পুলিশ নির্মমভাবে আন্দোলতরত মহিলাদের উপর আক্রমণ করেছে যা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং নারী অধিকারের বিরুদ্ধে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার বিরোধীদের প্রতি গণতন্ত্র নয় স্বৈরাচারের ভাষাতেই কথা বলবেন এবং কার্যক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদীদের থেকে কোনও অংশে কম যাবেন না সেটা জানা কথাই। গতবারের নবান্ন অভিযানেও তার সাক্ষ্য মিলেছিল। কিন্তু এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বড়ই ব্যস্ত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনের ওপর নির্মম সরকারি আক্রমণের নিন্দায় সরব তাঁর দল। অথচ, নিজের রাজ্যের রাজধানীতেই, যখন নিরস্ত্র মিছিলের ওপর এভাবে বর্বর পুলিশকে লেলিয়ে দিচ্ছেন, তখন বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কিছু না বলাই ভাল। কার্যক্ষেত্রে তৃণমূল ক্ষমতায় থাকলে বিজেপির থেকে কম কিছু হবে না সেটা গত দশ বছরে বারবার প্রমাণিত যেখানে, তখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ফ্যাসিবিরোধী চেহারা খুঁজতে ব্যস্ত যে সব উদারনীতিকেরা, তাঁদের জন্য আপাতত মুচকি হাসি ছাড়া আর কিছুই বরাদ্দ থাকল না।

এবং এই আক্রমণটা হল কাদের ওপর? যাদের গায়ে জলকামান ছোঁড়া হল, কাঁদানে গ্যাস মারা হল, লাঠিচার্জ করা হল, তারা গত দশবছর বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলেছে। ঘুষ দিয়ে অন্যের ছেলেমেয়েরা, তৃণমূল নেতার বাড়ির লোকজন তাদের চাকরি খেয়েছে। দিনের পর দিন টিউশন পড়িয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে সংসারের জোয়াল টেনেছে এই আন্দোলনকারীরা। বার বার বঞ্চিত হয়েও নিজের লড়াই ছাড়েনি। দশ বছরের বেকারত্বের জ্বালা হাড় পাকিয়ে দিয়ে গেছে। তৃণমূল আর কতই বা মারবে? ওই হাড়ে পুলিশের লাঠির ঘা পৌঁছাবে এতটাও শক্ত কোনও ক্ষুদে ফ্যাসিবাদীর লাঠি নয়। তাই একসময়ে দেখা গেল টানা পাঁচ রাউণ্ড চালাবার পর টিয়ার গ্যাস ফুরিয়ে গেছে কিন্তু রাস্তায় ছাত্র যুবদের ঢল থামেনি। ক্ষমতায় বসে থাকা শাসকেরা আর তাদের পদলেহন করে সরকারি এঁটোকাঁটা পাওয়া বুদ্ধিজীবির দল, উদারনীতিকের দল হয়ত আতঙ্কিত যে এই বুঝি বিজেপির ভোট বেড়ে গেল। কিন্তু বাস্তবটা হল, ঘরের বাইরে প্রধান বিপদ বিজেপি হলেও ঘরের ভেতর প্রধান আপদের দাপাদাপিতে মানুষ যখন অস্থির হয়ে উঠেছে, তখন সেই মানুষকে আপনি ফ্যাসিবাদ বা হিন্দুরাষ্ট্রের বিপদ বোঝাতে গেলে একদলা ঘৃণা ছাড়া আপনার ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। আপনি বিষম চিন্তিত যে ফ্যাসিবাদ চলে আসলে আপনি গরু খেতে পারবেন না - এদিকে বর্তমান সরকারের আমলে চাকরি না পেয়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যে কিছুই না খেতে পাবার অবস্থায় পৌঁছেছে সেটুকু দেখবার সংবেদনশীলতাও আপনার নেই। এই সম্পাদকীয়র তরফ থেকে তাই নবান্ন অভিযানকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও অভিনন্দন এবং তার সমালোচনাকারীদের প্রতি তীব্র বিরোধিতা নিবেদন করা হল।

এবার কিছু বক্তব্য আছে বামপন্থীদের প্রতি। এ কথা ঠিক যে গত বছর গোটা লকডাউনের সময়কালে বাম ছাত্র যুবরা সারা রাজ্য জুড়ে অসাধারণ কাজ করেছে। বিপন্ন মানুষের পাশে যেখানে তৃণমূল বা বিজেপির টিকির দেখা পাওয়া যায়নি, সেখানে নিরলস কাজ চালিয়ে গিয়েছে তারাই, সে রেশন দেওয়া হোক বা শ্রমজীবী রান্নাঘর। এ কথাও ঠিক যে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার কাজটা, সরকারের দায়বদ্ধতার দিকটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানুষকে আন্দোলনের রাস্তায় নিয়ে আসা, ধর্ম জাত ইত্যাদি হাবিজাবি ইস্যু ছেড়ে চাকরি শিক্ষার মত আসল ইস্যু নিয়েও তারাই রাস্তায় লড়াই করছে। কিন্তু এত দেরি করে কেন? বেকারত্ব, শিক্ষা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে দাগ কাটার মতন আন্দোলন কী আগে করা যেত না? যেই আন্দোলন শুধুমাত্র নবান্ন অভিযানেই শেষ হবে না, দাবি আদায়ের জন্য মরনপণ দীর্ঘ লড়াইয়ে পরিবর্তিত হবে, এমন আন্দোলন বামেদের থেকে প্রত্যাশিত ছিল। মানুষ বাম ছাত্র-যুবদের লড়াই দেখলেন, কিন্তু বড় দেরিতে। আরও দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের দরকার ছিল।

দ্বিতীয়ত, পরেরদিন ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। এমন নয় যে ধর্মঘট অন্যায্য, কিন্তু তা এমন একটি অস্ত্র যার বেশি ব্যবহার হলে ভোঁতা হয়ে যায়। গত তিন মাসে তিনটি ধর্মঘট দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ - এমন এক সময়ে যখন লকডাউনের ফলে বিপন্ন মানুষজন আবার নতুন করে জীবিকা শুরু করতে চলেছেন। ঠিক এই সময়েই অন্য কোনও সৃজনশীল প্রতিবাদের পন্থা আবিষ্কার না করে ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত যেটা করতে পারে, তা হল সাধারণ মানুষকে বিমুখ করে দেওয়া। কোনো প্রগতিশীল ব্যক্তিই ধর্মঘটের বিরোধী হবেন না, কিন্তু তার যথেচ্ছ প্রয়োগও ভাল ব্যাপার না। থানা ঘেরাও, অবস্থান, করা যেত। আরো বিশাল অংশের মানুষকে নিয়ে সরাসরি রাস্তায় নামা যেত। দাবি তোলা যেত যে অত্যাচারী পুলিশ আধিকারিকদের শাস্তি ঘোষণা না হলে অবস্থান চলবে। অধিক সংখ্যক মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে এমন দাবি এবং আন্দোলনের পন্থা নিয়ে বামেদেরই ভাবতে হবে। ভোটের ফল যাই হোক না কেন, বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র বামপন্থীরাই। এত বড় ক্ষমতা যাদের, দায়িত্বটাও তাই বেশি করে তাদেরকেই নিতে হবে।

আর সবশেষে একটি সাবধানবাণী। 'যাহা নবান্ন তাহাই ছাপ্পান্ন' শুনতে ভাল, কিন্তু বামেদের প্রধান ও মূল শত্রু কিন্তু বিজেপি। তৃণমূল শত্রু বটেই, এবং তাকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বার প্রশ্ন নেই, কিন্তু চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে নবান্ন আর ছাপ্পান্নকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। দেশের সর্ববৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক লাইনও সেটাই। তৃণমূলকে পাখির চোখ করেই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে যেহেতু তারা ক্ষমতায়, কিন্তু বিজেপি-কে এক চুলও কম বিপদ ভাবলে শিয়রে সমন। তপ্ত কড়াই থেকে উনোনের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়, যদিও এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কড়াই তপ্ত হবার মূল কারণ সেটা উনোনের আগুনেই বসানো ছিল। কিন্তু মূল শত্রুর প্রতি কোনওরকম ঢিলেমি দিলেই যে সর্বনাশ, বরং ভবিষ্যতের আরও বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে সেই মূল শত্রুকে নিশানা করেই, এই কথাটা বারবার নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি।