আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ৩-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

আন্দোলনজীবি!


দেশদ্রোহী দিয়ে শুরু। তারপর একে একে খলিস্তানি, মাওবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, টুকরে টুকরে গ্যাং, আরবান নকশাল থেকে আরও কত নাম শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনের ওপর তকমা সাঁটা হল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পাশাপাশি প্রচার করা হল যে এঁরা সব পাঞ্জাবের ধনী কৃষক। বিদেশ থেকে আসা আর্থিক সহায়তায় চলছে এই অবস্থান আন্দোলন। কোনোটাই ধোপে টিকল না। না আন্দোলনকারীরা এইসব প্রচারের পরোয়া করলেন, না দেশের অন্যান্য প্রান্তের মানুষ এমন মনগড়া মন কী বাত ধর্তব্যের মধ্যে আনলেন। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে নতুন শব্দবন্ধ - আন্দোলনজীবী।

সংসদের দুই কক্ষে উচ্চারিত এই নতুন শব্দবন্ধ শোনার পর শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয় সমগ্র বিশ্বের গণতান্ত্রিক সমাজ বিস্মিত। দেশে বিদেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঔদ্ধত্য কমেনি। নতুন আইন প্রত্যাহার করতে রাজি নয়। আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে যে এমএসপি বহাল থাকবে। এবং সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশ অনুসারে আগামী দেড় বছর আইন কার্যকর হবে না।

শুধু মুখের কথার ‘ভরসা’য় দেশ চলে না। আইন আছে, সংবিধান আছে। তার উপরে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ২০১৪-র প্রাক্-নির্বাচনী আশ্বাসবাণী থেকে শুরু করে নোট বাতিল, জিএসটি, সিএএ, এনআরসি, এনপিআর, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করা ইত্যাদি বিষয়ে ধারাবাহিক জনবিরোধী কীর্তিকলাপে দেশব্যাপী বিপর্যয় নেমে এসেছে। সুতরাং শাসকের মুখের কথায় বিশ্বাস নেই। 'সবকা বিস্-ও-য়াস্' অর্থাৎ সকলের বিশ্বাস শাসকের লব্জ হলেও মানুষের মধ্যে তার কোনো ছাপ পড়েনি। প্রতিদিন যতবার এই নবলব্ধ শব্দবন্ধ প্রচারিত হয় ততই যেন শাসকের প্রতি মানুষের অবিশ্বাসের মাত্রা বাড়তে থাকে।

গত বছর জুন মাসে কৃষি পণ্যের বাণিজ্যকরণ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করার পর দেশব্যাপী কৃষিজীবী মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলতে থাকা আন্দোলনগুলিকে না প্রশাসন গুরুত্ব দিয়েছে না সংবাদমাধ্যমে আন্দোলন সংক্রান্ত সংবাদ সম্প্রচার করা হয়েছে। তারপর সেপ্টেম্বর মাসে সংক্রমণ জনিত কারণে অবরুদ্ধ দেশে সমস্ত রকমের সংসদীয় রীতিনীতি লঙ্ঘন করে জবরদস্তিতে সংখ্যাধিক্যর দাপটে অধ্যাদেশকে তিনটি নতুন আইনে পরিণত করা হল। জীবন ও জীবিকার স্বার্থে নতুন কৃষি আইন মেনে নেওয়া কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই নতুন আইন কৃষকের কাছে মৃত্যু পরোয়ানা ছাড়া অন্য কিছু নয়। কোনোরকমে উৎসবের মরসুম পেরিয়ে ফসল কাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুরু হয় কৃষকের সঙ্ঘবদ্ধ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।

শাসকের দরজায় প্রতিবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাজধানীর দিকে রওনা দিলেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। জাতীয় সড়ক খুঁড়ে রাজধানীর সীমান্তে সঙ্ঘবদ্ধ কৃষকের যাত্রাপথ রুদ্ধ করে দেওয়া হল। জাতীয় সড়কের ক্ষতিসাধন আইনত দণ্ডনীয় জানা সত্ত্বেও প্রশাসনের উদ্যোগে এমন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লাখে লাখে কৃষক দিল্লির সীমান্তে রাজপথে অবস্থান শুরু করে দিলেন। শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন নিয়ে শাসক প্রথম দিকে নির্বিকার আচরণ করেছে। কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। অবস্থান আন্দোলন ক্রমশঃ শক্তিশালী হতে থাকে। প্রতিদিনই সমাবেশে নতুন নতুন কৃষক উপস্থিত হচ্ছেন। তাঁদের সমবেত কন্ঠের একটাই দাবি - তিনটি আইন প্রত্যাহার করতে হবে।

অতঃপর প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসে। বৈঠকের পর বৈঠকের বাহানায় সময় কেটে যায়। শাসকের ধারণা ছিল না যে প্রবল শৈত্য, কুয়াশা, বৃষ্টির মধ্যেও কৃষক দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থানের মানসিক প্রত্যয় নিয়েই পথে নেমেছেন। ফলাফল - শাসকের সঙ্গে কৃষকের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে গেছে। শাসকের ঔদ্ধত্যের মাত্রা যেমন যেমন বেড়েছে পাল্লা দিয়ে দৃঢ় হয়েছে কৃষকের আত্মপ্রত্যয়।

শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন ক্রমশ সংহত হয়েছে। দৃঢ় হয়েছে ঐক্যবদ্ধ আচরণ। পুলিশি আক্রমণে আন্দোলন দমে যায়নি। প্রজাতন্ত্র দিবসের হঠকারিতা যে আদতে শাসকের ষড়যন্ত্র ছিল তা এখন সর্বসমক্ষে উন্মোচিত।

সরকারি প্রচার ব্যবস্থা ধারাবাহিক ভাবে নতুন আইনের গুণকীর্তন শুরু করে দেয়। প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভক্তবৃন্দ। আন্দোলনকারীদের গায়ে নানারকমের দেশদ্রোহী তকমা এঁটে চলতে থাকে একতরফা প্রচার। কিন্তু পথে নামা কৃষক নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবিতে অবিচল।

আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসা ব্যক্তি-সমষ্টির উপর নেমে আসে আইনি আক্রমণ। অভিযোগ দায়ের করে গ্রেপ্তার শুরু হয়েছে। কৃষক আন্দোলনের খবর সম্প্রচারের জন্য সংবাদমাধ্যমের দপ্তরে, সম্পাদকদের বাসস্থানে চলেছে একটানা তল্লাশি। অন্যান্য প্রচারমাধ্যম ভয়ে বা ভক্তিতে অথবা অন্য কোনো অজ্ঞাত কারণে কৃষক আন্দোলনের খবর সম্প্রচার সীমিত করে দিয়েছে। নেহাত না দিলেই নয় বলে কৃষকদের নিয়ে দৈনিক খবরেরকাগজে দু' চার লাইন খবর ছাপা হয়। একটানা আশি দিন ধরে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনকে দেশবাসীর চোখের আড়ালে লুকিয়ে ফেলার অবিরাম প্রক্রিয়া অব্যাহত।

প্রতিদিন তেলের দাম, যখন খুশি গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলাও সামগ্রিক পরিকল্পনার অন্যতম উপাদান। নিত্যদিনের নিজের সমস্যার সমাধান করতে মানুষের সময় কেটে গেলে কৃষকদের জীবন জীবিকার লড়াই নিয়ে ভাববার সময় কোথায়! সংসদের অধিবেশনে কৃষক আন্দোলন নিয়ে কোনো বিবৃতি নেই। দু'শোর বেশি কৃষক আন্দোলনের ময়দানে মারা গেছেন। সংসদ নীরব। কোনও সহানুভূতি প্রদর্শনের বালাই নেই। শাসকের আচরণে 'চক্ষুলজ্জা' বলে শব্দটিও বোধ হয় 'লজ্জা' পেয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছে 'চোখের চামড়া নেই।'

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শাসক দিশেহারা। আগ্রাসী ঔদ্ধত্য বজায় রাখার জন্য উদভ্রান্তের মতো আচরণ করে চলেছে। কৃষকের প্রতিস্পর্ধায় শাসক বিচলিত। সমগ্র উত্তর ভারতে শাসকের ভক্তবৃন্দ সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাদের বৃন্দগান স্তব্ধ। নিজের নিজের প্রাণ-মান বজায় রাখার জন্য দলীয় পদ, জনপ্রতিনিধিত্ব ত্যাগের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতকিছুর পরও শাসকের আচরণ পাল্টায়নি। বরং নিত্য নতুন আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনমুখী রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঘন ঘন সফর করে ছড়িয়ে চলেছে বিভাজনের বিষাক্ত প্রচার। কোথাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে প্রচার হচ্ছে। কোথাও ভাষাগত অনৈক্যকে প্রকটভাবে প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে। সর্বোপরি নাগরিকত্ব নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে।

সঙ্কীর্ণ গোঁড়ামি ছাড়া যাঁদের কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই তাঁদের পক্ষে আধুনিক পৃথিবীর প্রকৃত বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। আধুনিকতম প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁরা বিভেদের বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হলেও মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধ্যানধারণা নেই। গোঁড়ামি দিয়ে যুক্তিনির্ভর বিচার বিবেচনা করা সম্ভব নয় বলেই ঔদ্ধত্যকে সম্বল করেই তাঁদের জীবনযাপন করতে হয়। মানুষের সমস্যা নিয়ে ভাবনার অবকাশ না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা কোনোদিন কোনও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন বলে এমন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম হোক বা রোটি-কাপড়া-মকানের লড়াইয়ে তাঁদের কোনো ভূমিকা ছিল বলে এমন দুর্নাম করা যায় না। সকলের জন্য শিক্ষা, সকলের জন্য সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার আন্দোলনে তাঁদের দেখা যায়নি। প্রকৃত অর্থে মানুষের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই। ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টিতেই তাঁরা সিদ্ধহস্ত। ফলে, আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। মৃত্যু পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলনে অংশ নেওয়া কৃষককে আন্দোলনজীবী আখ্যা দিয়ে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বসে হয়তো আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায় অথবা শ্রেণি স্বার্থ রক্ষা করা যায়, কিন্তু সামগ্রিক বিকাশ হয় না। সঙ্ঘবদ্ধ সংহত সুশৃংখল শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন গণ আলোড়নে রূপান্তরিত হলে তার দায় সামলানোর সামর্থ আছে কিনা বলা মুশকিল। তবে আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে রাজধানীকে রক্ষা করতে শাসক এখন চিন্তিত। আন্দোলনের ঢেউ রাজধানীতে আছড়ে পড়লে কী হতে পারে সেই ভাবনায় তাঁরা শঙ্কিত। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশের কৃষকের সঙ্গে কর্ণাটক, মহারাষ্ট্রের কৃষকও আজ অবস্থান আন্দোলনে সমবেত। ধনী কৃষকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথে রয়েছেন ভূমিহীন গরিব কৃষিজীবী। এই ঐক্যকে ভাঙবার চেষ্টা করে লাভ হয়নি। অবস্থানস্থলে সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধা অস্থায়ী ভাবে তৈরি হয়েছে। তিনটি নতুন কৃষি আইন বাতিল না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বুঝতে পেরেই এখন আইন লঙ্ঘন করে জাতীয় সড়কের উপর কাঁটা লাগানো কংক্রিটের দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। পাহারায় রয়েছে হাজার হাজার সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী। দেশের প্রকৃত সীমানার পাহারা থেকে তুলে এনে দেশের মধ্যে গড়ে তোলা কৃত্রিম সীমান্ত রক্ষা এখন সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব। ইতিহাসের শিক্ষা, প্রবল জন-আলোড়নে একদা বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটেছিল।