আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দুর্বার স্রোতে এলো কোথা হতে...

বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী


...সমুদ্রে হল হারা। রবিঠাকুর যদিও জলদস্যুদের মাথায় রেখে এটা লেখেননি, কিন্তু এটা আক্ষরিক ভাবেই, তাদের জন্য খাটে। বিভিন্ন দেশ থেকে তারা এসে জড় হয়েছিল ক্যারিবিয়ানের নানান দ্বীপে, আর বেশিরভাগই নিজেদের জীবন সমুদ্রেই বিসর্জন দিয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন হয়তো নিজেদের শেষ জীবন (অপেক্ষাকৃত) শান্তিতে কাটাতে পেরেছে।

প্রশ্ন ওঠে, কেন এসেছিল তারা? ধরে নেওয়া যাক, বিভিন্ন কারণে সমাজচ্যুত হয়ে এসেছিল। যদি তাই হয়, তাহলে সে কারণগুলো কি? ‘র‍্যাডিক্যাল পাইরেট হিস্টোরিয়ান'রা (আছে আছে, এও হয়!) এই ঘটনার মধ্যে দ্বান্দিক দর্শন খোঁজেন, তবে একথা অনস্বীকার্য যে, সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত, বা নিষ্পেষণ, জলদস্যুতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার একমাত্র কারণ নয়। অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে ভালো, প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সদস্য, চোখ কান খোলা রেখেই, এবং সব জেনে-বুঝেই, জলদস্যুর পেশা অবলম্বন করেছে।

তবে, এই প্রসঙ্গে আলোচনা করার আগে জলদস্যু বলতে ঠিক কী বোঝায় সেটা বোধহয় একটু দেখে নেওয়া ভাল। ইংরেজিতে জলদস্যুর অনেকগুলো প্রতিশব্দ আছে, যা একার্থে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দগুলো হল buccaneer, privateer, corsair, filibustier (filibuster), sea dog, sea rover, freebooter, marooner, picaroon ইত্যাদি। এই প্রতিটা শব্দেরই ফরাসী প্রতিশব্দ আছে। জলদস্যু বা pirate শব্দটা সাধারণতঃ এদের সবাইকেই বোঝায় কিন্তু এদের মধ্যে ফারাক আছে। এই কারণে ফিলিপ গ্রস্ (১৯২৪) ‘পাইরেটস্‌ হু’স হু’ লিখতে গিয়ে বলেছিলেন ‘আসল মুশকিল হল এটা নিশ্চয় করা যে কে পাইরেট, আর কে নয়’।

এই কারণে একবিংশ শতাব্দীর লেখকরা পাইরেটের সংজ্ঞা ধরে নিয়েছেন যে যারা ‘hostes humani generis’, অর্থাৎ ‘মনুষ্যজাতির শত্রু’, তাদেরই পাইরেট বা জলদস্যু বলা চলবে। এদের জাত নেই, ধর্ম নেই, দেশ নেই, মালিক নেই, রাজা নেই (ni Dieu, ni Royaux, ni Maitre), যাদের টাকা বা পদ দিয়ে ভোলানো যায়নি বা যাবে না। এই খুব সংকীর্ণ সংজ্ঞাটা দরকার এইজন্য যে, অনেক নামকরা জলদস্যুর জীবনসূর্য যখন মধ্যগগনে, তখন তারা একটা ভারিক্কি পদের লোভ সামলাতে পারেনি, যেমন স্যার হেনরি মরগ্যান, বা স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক (যাকে রাণী এলিজাবেথ বলতেন ‘আমার নিজের জলদস্যু’)। দুজনের নাম করলাম, কিন্তু আরো অনেক আছে।

মোদ্দা কথায় ফিরে যাই। বুকানিয়াররা হল প্রাথমিকভাবে হিস্পানিওলাতে (আজকের হাইতি এবং ডোমিনিকান রিপাব্লিক) যারা বুনো জন্তু শিকার করে জাহাজীদের বিক্রি করতো। এরা প্রধানতঃ ফরাসী এবং সেন্ট ক্রিস্তফার-এর (অধুনা সেন্ট কিট্‌স্‌) প্রথম ঔপনিবেশিক। স্পানিয়ার্ডদের তাড়া খেয়ে জলদস্যু হয়ে যায়। এরাই নিজেদের প্রথম ‘ব্রেদরেন অফ্‌ দ্য কোস্ট’ বলে জাহির করে।

প্রাইভেটিয়ার তারাই যাদের ‘লেটার অফ মার্ক' (Letter of Marque) থাকত, যা দেওয়া হত সরকার থেকে - রাজা বা রানির ইচ্ছামতো। অর্থাৎ সরকারি মদতপুষ্ট জলদস্যু। কথাটা একটু অদ্ভুত শোনালেও সত্যি। এই ব্যাপারটাকে জ্যানিস থমসন বলেছেন, ‘privateering reflected state rulers’ efforts to build state power; piracy reflected some people’s efforts to resist that project’, অর্থাৎ, জলদস্যুতা যেখানে কিছু লোকের রাষ্ট্র এবং আমলাতন্ত্রের বিরোধিতার পরিচায়ক, সেখানে প্রাইভেটিয়ারিং ওই রাষ্ট্র এবং আমলাতন্ত্রের শক্তিবর্ধন করার প্রচেষ্টা।

ফিলিবুস্তিয়ের শব্দটা ফরাসী, যা প্রথম দিকে বুকানিয়ারদেরই বোঝাতো। এটা ইংরেজিতে হয়েছে ফিলিবাস্টার অনেক পরে, যদিও ইংরেজিতে এটা প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করা হত আমেরিকান সৈনিকদের দক্ষিণ আমেরিকাতে অবৈধ প্রবেশকারীদের বোঝাতে। করসেয়ার শব্দটা ব্যবহার হত প্রধানতঃ ভুমধ্যসাগরের জলদস্যুদের জন্য।অন্যান্য যে প্রতিশব্দগুলি দিয়েছি তা প্রধাণত হলিউডের স্ক্রিপ্টরাইটারদের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত। এবার দেখা যাক, এরা এল কোথা থেকে।

জন এস্কেমেলিং ছিলেন একজন বুকানিয়ার। নিজের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে বই লিখেছিলেন ১৬৮৪ সালে। ওই সময় বইটা এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে এক বছরের মধ্যে তিনটে ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেছেন, ফরাসীরা প্রথমে সেন্ট ক্রিস্টোফার দ্বীপে বসবাস শুরু করে। সেখান থেকে তারা তরতুগা দ্বীপে যায়, হিস্পানিওলা হয়ে, এবং সর্বত্রই উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৬২০ থেকে ১৬৫৫ অবধি তরতুগা ভোগ করা নিয়ে একদিকে স্পেন এবং অন্যদিকে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিকদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে। প্রথম যারা এসেছিল তারা অনেক গোরু, শুয়োর ইত্যাদি নিয়ে এসেছিল। কালক্রমে যখন তরতুগাতে এবং হিস্পানিওলাতে সাধারণ ব্যবসা করা প্রায় অসাধ্য হয়, তখন এই সব পশুধন বন্য জন্তুতে পরিণত হয়। বাকি যে সব ঔপনিবেশিকরা রয়ে গেল বিশেষত তরতুগাতে, তারা সেই সব জন্তু শিকার করে সেগুলো জাহাজীদের বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করত। কিন্তু এটাও স্পেনের সহ্য হল না। তারা আবার এই দ্বীপগুলো আক্রমণ করলে। সাধারণ শিকারীদের পালাতে হল। যারা পারল রুখে দাঁড়াল। নিজেদের ‘ব্রেদরেন অফ্ দ্য কোস্ট’ বলে জলদস্যু হয়ে গেল। এইসব বন্য পশুদের মাংস যাতে স্মোক করা হত সেই উনুনটাকে বলত ‘বুক্যান’ (boucan বা buccan) যার থেকে বুকানিয়ার শব্দটা এসেছে। এই বুক্যান শব্দটা অবশ্য এদের নিজেদের উদ্ভাবন নয়। এটা সেখানকার আদি জনগোষ্ঠীর (ঐতিহাসিকরা, এমনকি র‍্যাডিক্যাল পাইরেট হিস্টোরিয়ানরাও ‘ক্যারিব ইন্ডিয়ান’ কথাটা এখন পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছেন) মধ্যে একটা প্রচলিত শব্দ - বুক্যান নামটা তারাই দিয়েছিল।

এরা হল প্রথম দিকের জলদস্যু। তবে এখানে আরও একটু বলা দরকার। দ্বীপের অধিবাসীদের তিন ভাগে ভাগ করে যেত - শিকারী, ঔপনিবেশিক/প্লান্টার এবং জলের ডাকাত। প্লান্টাররা নিজেদের জমি চাষ করাতো নিজেদের চাকরদের দিয়ে। যদিও চাকরদের দাসখৎ দিতে হত তিন বছরের জন্য, কিন্তু মালিকরা সাধারণতই সেটা মানত না। তাদের ওপর যথেচ্ছাচার হত এবং তাদের বিক্রিও করে দেওয়া হত। এস্কেমেলিং বলেছেন যে প্লান্টাররা ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে গিয়ে যুবকদের নানারকমভাবে ভুলিয়ে নিয়ে আসত হিস্পানিওলা এবং অন্যান্য দ্বীপে। এখানে তাদের ওপর যে অত্যাচার হত, এস্কেমেলিং-এর ভাষায়, তা কহতব্য নয়। এদের সঙ্গে নিগ্রোদের থেকেও খারাপ ব্যবহার করা হত, কারণ নিগ্রোরা সারা জীবনের মত ক্রীতদাস, তাড়াতাড়ি মরে গেলে কেনার পয়সাটাই জলে গেল, আর সাদা চামড়া মাত্র তিন বছরের জন্য - অন্তত কাগজে - সেজন্য যতটা নিংড়ে নেওয়া যায় ততই ভাল। ইংরেজরা এ ব্যাপারে (এস্কেমেলিংএর মতে) ফরাসীদের থেকেও বেশী নৃশংস। ফরাসীদের বন্ডেড লেবার হত তিন বছরের, ইংরেজদের সাত। এক একজন মালিক পঞ্চাশ ষাটটা লোককে হামেশাই মেরে ফেলত (এস্কেমেলিং একজনের উদাহরণ দিয়েছেন যে অন্তত একশ জনকে বিভিন্ন ভাবে মেরে ফেলেছিল)। লোকটার নাম বেথিয়ার, একজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে এমনভাবে চাবুক মেরেছিল যে পুরো শরীর রক্তাক্ত, যদিও সে বেঁচে ছিল। তাকে ঐখানেই রেখে দিয়েছিল যতক্ষণ না লাল পিঁপড়ে বা বুনো কুকুর তাকে এসে জ্যান্ত খেয়ে না যায়। রোজ এসে তার অবস্থা দেখে হাসত। তিন দিন বেঁচে থাকার পর যখন সে মারা গেল তখন তার দেহের বেশীর ভাগ মাংসই কুকুর বা লাল পিঁপড়েতে খেয়ে গেছে।

মারা যাবার আগে লোকটা বেথিয়ারকে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল। এস্কেমেলিং-এর কথা অনুযায়ী, কিছুদিন পরেই বেথিয়ার পাগল হয়ে যায় - নিজেকে চাবুক দিয়ে মেরে মেরে একসময় ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে মারা যায়।

এই বুকানিয়াররা ছাড়া জলদস্যুদের দলে যোগ দিত সাধারণ জাহাজ থেকে পালানো নাবিকরা, বিভিন্ন প্লান্টেশন (ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং আমেরিকা) থেকে পালিয়ে আসা ক্রীতদাস আর বিভিন্ন দেশ থেকে পালানো খুনি, ডাকাত, এবং নিছক জমিদার বা মন্ত্রী-সান্ত্রীদের বিষনজরে পড়া লোকেরা যারা নিজেদের সবকিছু খুইয়েছে (অর্থাৎ যারা নিজেদের দু’বিঘা জমি খুইয়ে রিক্সা চালাবার বদলে প্রতিহিংসার পথ বেছে নিয়েছে) তারা। বিভিন্ন দেশ বলতে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ইউরোপের অন্যান্য দেশ, এবং পশ্চিম আফ্রিকা এবং উত্তর আফ্রিকা। পশ্চিম আফ্রিকা বলতে এখানে প্রধানতঃ গিনি, সেনেগাল, ঘানা ইত্যাদি দেশের লোক, যাদের আরবের ব্যবসায়ীরা (এবং আমেরিকান ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা) তাদের দেশ থেকে জোর করে বা ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে আমেরিকান প্লান্টারদের হাতে বিক্রি করে দিত।

জলদস্যুদের দলে ভিড়ে তাদের এক নতুন জীবন শুরু হত। ভগবান নেই (কেননা পাদ্রী নেই), রাজা তো অবশ্যই নেই, মালিকও নেই। জীবন সহজ, স্বাধীন, এবং সর্বোপরি সম-মনস্ক লোকেদের সঙ্গলাভ তো আছেই। ক্ষতি মানে জীবন খোয়ানো - তা জীবন তো অনেক আগেই চলে যেত, মালিকের চাবুকের ঘায়ে, বাকিটা তো উপরি - সুতরাং ভোগ করে নাও যতদিন বেঁচে আছ; আর যদি হাত-পা খোয়াও, তাহলে বাকি জীবনের জন্য যা টাকা পাওয়া যাবে, যথেষ্ট। যে জলদস্যুরা যুদ্ধে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত, তাদের 'কম্পেন্সেশন' দেবার পুরো নিয়মাবলী জলদস্যুদের চার্টারে। পরিষ্কার লেখা থাকত, একথা বিশদ ভাবে আগের একটা প্রবন্ধে বলেছি।

১৬৫০ সাল থেকে সময়টাকে জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ কেন বলে? একটু ইতিহাস খতিয়ে দেখা যাক। ১৪৯২ সালে কলম্বাস হিস্পানিওলা দ্বীপে নোঙর ফেলেন। ১৪৯২ থেকে ১৬২০-র মধ্যে স্পেন তার অধিকার বিস্তার করে ক্যারিবিয়ানে। অন্যান্য দেশের লোকেদের ওপর এবং বিভিন্ন আদি জনগোষ্ঠীদের ওপর চলে কঠোর অত্যাচার। এই পরিমাণ অত্যাচার যে বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৫২০ থেকে ১৫৫৫-এর মধ্যে ফরাসী জলদস্যুরা (প্রাইভেটিয়ার) স্প্যানিশ জাহাজের ওপর একের পর এক আক্রমণ করে। অবশ্য ১৫৩০ থেকেই ফরাসী জলদস্যুরা পুরো ক্যারিবিয়ানকেই নিজেদের শিকারের চত্বর হিসাবে ধরে নেয় (হ্যাপি হান্টিং গ্রাউন্ড)। ১৫৫০-১৬০০ ছিল প্রধানতঃ ইংরেজ প্রাইভেটিয়ারদের যুগ। এদের বলত ‘সী ডগস্‌’)। ফ্রান্সিস ড্রেক যাকে রানি এলিজাবেথ ‘আমার পাইরেট’ বলে সম্বোধন করতেন, এই সময়কার বিখ্যাত জলদস্যু। শিকার একটাই - স্পেনের জাহাজ। ১৬০০-১৬৩৫ এর মধ্যে ডাচ্‌ জলদস্যুদের আধিপত্য ইংরেজ এবং ফরাসীদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অনেকটা এদেরই জন্য ডাচ্‌ ব্যবসায়ীরা পুরো ক্যারিবিয়ানে নিজেদের ব্যাবসা অনেকগুণ বাড়িয়ে ফেললে। এই সময় থেকেই বুকানিয়ারদের অভ্যুদয়। তারা জংলিদের মতো থাকত - একজন ঐতিহাসিকের মতে ‘যাদের নাক সেন্সিটিভ, বুক্যানিয়ারদের সংস্পর্শ তাদের জন্য নয়’। কিন্তু তারা ছিল স্বাধীন, আর সেটাই তাদের বড় পাওয়া। ১৬২০ থেকে ১৬৫০ এর তিরিশ বছরে বুক্যানিয়াররা সংখ্যায় বাড়ল, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

১৬৫৫-১৬৯৭ এর মধ্যে অলিভার ক্রমওয়েল একের পর এক যুদ্ধজাহাজ পাঠালেন স্প্যানিয়ার্ডদের শায়েস্তা করার জন্য। ইংরেজরা জামাইকা দখল করে গেড়ে বসল। তার ফলে অনেক ইংরেজ বুকানিয়াররা, যারা আদতে ইংরেজ ছিল, দলে দলে জামাইকাতে ঘাঁটি গাড়লে। বুকানিয়ারদের মধ্যে একটা ভাগ হল। ইংরেজরা জামাইকাতে, আর বাকিরা তরতুগা আর হিস্পানিওলায়। ইংরেজ বুকানিয়ারদের এতই বাড়-বাড়ন্ত হল যে এক সময় জলদস্যুতাই জামাইকার অর্থাগমের প্রধান উপায় হয়ে উঠল। বুকানিয়ারদের সফরে এখন নৌকা আর নেই, তার বদলে প্রথমে একটা দুটো জাহাজ, তারপর দস্তুরমত নৌবাহিনী। কুড়ি বা তিরিশ জন জলদস্যু থেকে তাদের দলে এখন হামেশাই হাজার দু’হাজার লোক। কিন্তু ততদিনে বিভিন্ন উপনিবেশ এবং তাদের আদত রাষ্ট্ররা বুঝে গেছে যে এই ব্যবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না। বুক্যানিয়ারদের ওপর ভরসা করা আর বাঘের ল্যাজ ধরে ঘোরানো একই ব্যাপার।

১৬৭৩ সালের হেগের সন্ধিপত্র মারফত ডাচ্‌রা প্রথম প্রাইভেটিয়ারদের আইনের বহির্ভূত করলে। ইংরেজরা করলে ১৬৮০ সালে উইন্ডসর সন্ধিপত্রের দায়রায়, এবং সবশেষে ফরাসীরা, রিসুইকের সন্ধিপত্র অনুসারে। এসবের ফলে অনেকেই দস্যুতা ছেড়ে দিয়ে ঘরকন্না করলে। কিন্তু এতে উলটো একটা ব্যাপার হল। বেশিরভাগ বুকানিয়াররা বা প্রাইভেটিয়াররা দেখলে তাদের স্বাধীনতা যেতে বসেছে, তারা তখন প্রকৃত জলদস্যু হয়ে উঠল। তাদের পতাকা - জলি রজার, মাথার খুলি আর হাড়, কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে - প্রথম দেখা গেলো ১৭০০ সালে। পাইরেটরা জানত এখন ধরা পড়লে সোজা ফাঁসি, তাই মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তারা নিজেদের ফ্ল্যাগ ওড়াতে শুরু করলে। ভাবখানা, হ্যাঁ, আমরা জলদস্যু, আমরা ফ্রীবুটার, আমাদের হাতে ধরা পড়লে আমরা তোমাদেরও একই অবস্থা করব।

রাষ্ট্রশক্তি তখন যা করবার তাই করল। জলদস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল। আইনও পাশ হল। যেকোন‌ো জাহাজের সাতজন নৌসেনার অফিসার নিজেদের কোর্ট আখ্যা দিয়ে যা ইচ্ছা তাই শাস্তি দেবার অধিকার পেল। কিন্তু তার মধ্যে (১৭০১-১৭১৩) স্পেনে 'ওয়ার অফ সাক্সেশন' লেগে গেছে। আবার প্রাইভেটিয়ারদের দরকার পড়ল। পিটার আর্ল-এর ভাষায়, পাইরেটরা, আবার দেশপ্রেমী হয়ে পড়ল। স্পেনের যুদ্ধ শেষ হবার পর জলদস্যুতা আবার মাথা চাড়া দিল। কারণ তখন আর প্রাইভেটিয়ারদের প্রয়োজন নেই। ১৭১৬ সালে জলদস্যুতা একেবারে তুঙ্গে। তাদের ঘাঁটি তখন নিউ প্রভিডেন্স দ্বীপ। ১৭১৮ সালে ব্রিটিশ সরকার উড্‌স রজার্সকে পাঠালে নিউ প্রভিডেন্সের গভর্নর করে। রজার্স নিজে আগে প্রাইভেটিয়ার ছিল। ঘাত-ঘোঁত ভালোই জানত। নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে কিছু জলদস্যুকে বাগে আনা গেল, অন্যরা পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলে। যা ছিল শুধু ক্যারিবিয়ানে, এখন ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিম আফ্রিকা অবধি। এই সময়টাকে জলদস্যুর স্বর্ণযুগের সবথেকে ‘ভালো’ সময় বলা যায়। বিখ্যাত জলদস্যু কাপ্তানরা সব এই সময়কারই - এডোয়ার্ড টীচ্‌ (ব্ল্যাকবেয়ার্ড), বার্থলমিউ রবার্টস্, এবং মহিলা জলদস্যুরা - অ্যান বনী, মেরী রীড এবং আরও অনেকে।

এই যুগ শেষ হল রবার্টস্ আর তার দলবল শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই। আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে জলদস্যুতা শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ল, ক্যাপ্টেন উইলিয়াম ফ্লাই এবং অলিভিয়ের লাবুসের ফাঁসির পর। ১৭২৮ এর পর হাতে গোনা কয়েকজন জলদস্যু রয়ে গেল, যা আগে হাজার পাঁচেক ছিল।

পাঠক প্রশ্ন করবেন, ইতিহাস তো হল, কিন্তু সারার্থ কি? এই ইতিহাসকে সমাজতত্ব এবং নৃতত্ত্বর দিক দিয়ে কীভাবে দেখা যায় বা গেছে? আমাদের আজকের পৃথিবীর তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজের সঙ্গে এর তফাৎই বা কোথায়? এই প্রশ্নের এবার উত্তর দেবার চেষ্টা করব।

১। অসীম সমুদ্র - সমুদ্র চিরকালই অসীম। সমুদ্রে কোনো দেশের অথিকার নেই। এই হিসাবই চিরকাল চলে এসেছে। যারা সমুদ্রে বাস করে তাদের কাছে দেশের ভৌগোলিক অবস্থান বা তার সীমারেখার কোনো অর্থ নেই। ‘সী নোম্যাড’ বা পাইরেটদের পক্ষে কথাটা ভালোভাবেই খাটে। এর সঙ্গে জিপ্সীদের বা আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের তুলনা করা যায়। (রেড ইন্ডিয়ান কথাটা ব্যবহার করছি এইজন্য যে, এটাই প্রচলিত। পলিটিক্যালি কারেক্ট বলে যদি কেউ অন্য প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে চান, নির্বিচারে করুন।) রেড ইন্ডিয়ানরাও কোনো বাধা মানত না। পুরো আমেরিকাই ছিল তাদের ঘুরে বেড়াবার জায়গা। বাইসনের দল যেখানে যেত, তারাও সেখানে যেত। পাইরেটরাও তাই। যেখানে শিকার, সেখানে জলদস্যু। জলদস্যুদের সাথী হল সমুদ্রের হাওয়া, সমুদ্রের ঢেউ, আর শত্রুও তাই। এই বিস্তারিত চারণভূমিতে তাদের সম্পূর্ণ অধিকার বলে তারা মনে করত। এখানে যে-ই আসবে সে শিকার। একই অঙ্কে, যারা তাদের অস্তিত্বকে কোনোভাবে খন্ডন করার চেষ্টা করবে, তারাও শিকার। কথাটা কি খুব ভুল বলা হল? এই কথাগুলোই কি যে কোনো দেশের পক্ষে খাটে না? শুধু শিকারের বদলে দেশের শত্রু। তবে জলদস্যুরা কখনই সমুদ্রকে নিজেদের রাজত্ব বলেনি; বলেছে ‘আমরা সমুদ্রের, সমুদ্র আমাদের, সমুদ্রের কোনো বাঁধন নেই, আমাদেরও না।’ আর তাছাড়া, রেড ইন্ডিয়ানদের মত, জলদস্যুরাও এটা প্রমাণ করে গেছে যে মানুষ, মানুষ হিসাবে - তার সমস্ত দোষ-গুণ নিয়েই - পৃথিবীকে একটাই দেশ হিসাবে দেখে বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং জলদুস্যদের বিচার করতে হলে এটা নিশ্চয়ই একটা দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের মনস্তত্ত্ব এদিক দিয়ে বিচার করেছেন অনেকে, তবে নৃশংসতা এতে প্রমাণ হয় না। কিন্তু এটাও সত্যি কথা যে কিছু জলদস্যু ক্যাপ্টেন যেমন চরম নৃশংস, তেমনি উলটোটাও আছে। ক্যাপ্টেন নর্থ একজন বিখ্যাত জলদস্যু। কিন্তু তার বিচার ক্ষমতার এত খ্যাতি ছিল যে ম্যাডাগাস্কারের আদি জনজাতির মানুষেরা পর্যন্ত বিচারের জন্য তার কাছে যেত।

২। মুখ্য, কিন্তু প্রমুখ নয় - যে কোনো দেশের যে কোনো সময়ে জননেতা নিজেদের রাজা কিংবা ওই ধরনের কিছু প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে, এবং নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য তৈরি করেছে সেনাদল, মন্ত্রী, আমীর, আর তাদের মদত করার জন্য দলে দলে বুর্জোয়া। পাইরেটদের ক্ষেত্রে তা নয়। এক হিসাবে ক্যাপ্টেন দলের ব্যাঙ্কার, কিন্তু তার সঙ্গে থাকে কোয়ার্টারমাস্টার, যে সাধারণ জলদস্যুদের প্রতিভূ। ক্যাপ্টেন নিজেও নির্বাচিত। সুতরাং হের-ফের হবার অবসর নেই। জলদস্যু ক্যাপ্টেনের, নিজের দক্ষতা ছাড়া কোনো শাসকীয় অস্ত্র নেই, নিজের বুদ্ধি ছাড়া অন্যদের নিজের মতামত বোঝাবার কোনো উপায় নেই, দলের ইচ্ছা ছাড়া শাসন করার কোনো মাধ্যম নেই। এর মানে অবশ্যই এই নয় যে কোনো কোনো ক্যাপ্টেন নিজেদের আধিপত্য জাহির করার চেষ্টা করেনি। করেছে, কিন্তু তার ফল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাল হয়নি। সাধারণ জলদস্যুরা দল ছেড়ে চলে গেছে।

৩। কাজ - আমাদের সমাজ কার্য বন্টনের ওপর ভিত্তি করে (ডিভিশন অফ লেবর) গড়ে উঠেছে। জলদস্যুদের সমাজে এটা ছিল না। সবাই প্রায় সব কিছুই করত। এর একটা প্রধান কারণ ছিল যে জলদস্যুদের জাহাজে লোক অনেক বেশি। সুতরাং কাউকেই বেশি কিছু করতে হত না। তখনকার দিনে একটা ছোটো জাহাজ (একশ টনের) চালিয়ে নিত জনা বারো নাবিক মিলে। ওই রকম জলদস্যু জাহাজে লোক থাকত প্রায় সত্তর জন। বস্তুত, এক মাত্র অন্য জাহাজ আক্রমণ করার সময় ছাড়া জলদস্যুদের জাহাজে কাজ প্রায় ছিল না বললেই চলে। এই সবের ফল কী?

    ১।। অর্থ বা সম্পদ জমা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এস্কেমেলিং লিখেছেন, জলদস্যুদের হাতে যত সোনা-দানাই আসুক না কেন, তারা কিছুদিনের মধ্যেই সেটাকে খরচ করে আবার কোনো অভিযানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেত। এর একটা কারণ অবশ্যই যে তাদের নিজেদের, যাকে বলে ‘লাইফ এক্সপেক্টেন্সি’ সম্বন্ধে খুব নীচু ধারণা ছিল। দ্বিতীয়, পরিবার বলে কিছু ছিল না, এবং তৃতীয়, ফিরে গিয়ে বসবাস করার ইচ্ছে বা উপায় (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই) ছিল না। এই সব কারণ মিলিয়ে দেখলে প্রাচীন যাযাবর সমাজের সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যায়। হিস্পানিওলা দ্বীপে ফরাসী এবং স্প্যানিয়ার্ডরা আসার আগে 'তাইনো' নামে একটা গোষ্ঠী ছিল যারা বছরের শেষে বিরাট ভোজসভা আয়োজন করে যার যা উদ্বৃত্ত থাকত, সব খেয়ে ফেলত। অবশ্যই এই ধরনের মনোবৃত্তি আরো অনেক জায়গাতেই দেখা গেছে, এবং আমার মনে হয় সেটা এই চিন্তাধারারই পরিচায়ক যে, পুঁজিবাদী না হয়েও, বা পুঁজিবাদ না থাকলেও, সমাজ চলতে পারে। পুঁজিবাদের শক্তি যে কত সে তো গত কয়েকদিনেই দেখা গেলো। একটা প্রাইভেট কোম্পানি একটা শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্টের ‘মীন্স্‌ অফ কম্যুনিকেশন’ বন্ধ করে দিলে। কারোর কিছু করার নেই।

    ২।। ‘মীনস অফ প্রোডাকশন’ আর ‘ফোর্সেস অফ প্রোডাকশন’-এর মধ্যে কোনো দ্বান্দিক বিভেদ না থাকায় পাইরেট সমাজে শোষণের কোনো জায়গা ছিল না। সুতরাং ‘এলিয়নেশন’ ছিল না। সব লাভই নিজেদের জন্য, নিজেদের ইচ্ছামতো ভাগ করে নেবার জন্য। এঙ্গেলস্ বোধহয় একথা মনে রেখেই ‘অরিজিন্যাল কম্যুনিজ্‌ম’ এর কথা বলে ছিলেন (whatever was produced and used was common property)। একধাপ এগিয়ে সেহ্লিনের মত নৃতত্ত্ববিদরা একে বলেছেন ‘জেনারালাইজড্‌ রেসিপ্রসিটি’। বস্তুত ভাইকিংদের জাহাজেও এই একই ব্যবস্থা ছিল। ইতিহাস বলে, মধ্যযুগের আগে সাধারণ জাহাজেও এই একই ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু ক্রমশ মালিকানা পুঁজিবাদীদের হাতে চলে যাওয়ায় এবং সাধারণ নাবিকরা বেতনভুক শ্রমিক হয়ে দাঁড়ানোয় এই ব্যবস্থা লোপ পায়।

    ৩।। ওই শতাব্দীতে ক্যারিবিয়ানে অর্থ বৈষম্য চরমে উঠেছিল। একথা সত্য যে জলদস্যুরা তাদের লুঠতরাজ এবং অন্যান্য কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে যা হাতাত, সেটা আবার বিভিন্ন জায়গায় খরচ করে সেই সব শহরগুলোর অর্থনৈতিক চেহারা পালটিয়ে দিয়েছিল।

    ৪।। কে আগে?- ক্যারিবিয়ানে জলদস্যুরা আসার আগে বেশ কয়েকটা স্থানীয় জনজাতি ছিল। তাদের বেশ কিছু সামাজিক ব্যবস্থা যে জলদস্যুদের প্রভাবিত করেছিল সেটা অনেকেই স্বীকার করেছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, 'বুক্যান' জিনিসটা ক্যারিব-এর আদি বাসিন্দাদের উদ্ভাবন। ক্যারিবদের মধ্যে নেতা চয়ন করা হত সাহস আর দক্ষতা দেখে, কেউ বংশপরম্পরায় নেতা হত না। দলনেতার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ছিল না। মূর্তিপূজার কোনো প্রচলন ছিল না, সবকিছু সমানভাবে ভাগ করে নেবার ব্যবস্থা ছিল, সবাইকে শত্রু হিসাবে দেখবার অভ্যাস ছিল। আর তারা ছিল নরখাদক। লোলোনেই (l’Ollonais)-এর মতো কুখ্যাত (এবং নৃশংস) জলদস্যুকে শেষ পর্য্যন্ত এই নরখাদকদের শিকার হতে হয়েছিল।

অনেক আলোচনা হয়ে গেল। একটা ভুলে যাওয়া গোষ্ঠীর কথা বলার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীতে খুঁজলে নিশ্চয় এরকম আরও অনেক পাওয়া যাবে। তবে ক্রিমিনালদের মধ্যে এরকম ডেমোক্রাটিক ব্যবস্থা বিরল। এরপর সময় এবং সাধ্য থাকলে কিছু বিখ্যাত জলদস্যুদের সম্বন্ধে বলা যাবে।

 

[1] উল্রিক ক্লাউজম্যান, গ্যাব্রিএল কুন, মারিয়ান মেইঞ্জেরিন, উইমেন পাইরেটস এন্ড দ্য পলিটিক্স অফ দ্য জলি রজার, ১৯৯৭, ১৬৬-১৬৭।