আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

আরএসএস মেয়েদের মুঠোর আলোটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে...

সুব্রতা ঘোষ রায়


বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে গেল পট পরিবর্তন। ৩০৬ ইলেকটরাল ভোট পেয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হলেন জো বাইডেন। প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে ছিল তাঁর এই দিনটির অপেক্ষা। এর আগে ২০০৮-২০১৬ তিনি ওবামার উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার সামলেছেন। কিন্তু এবারে চাপ অনেক বেশি। কোভিডের ছায়ার সঙ্গে আছে দুর্বল অর্থনীতি। ট্রাম্পের আমলে চিন শক্তি বাড়িয়ে ফেলেছে অনেকটাই, রাশিয়াও পরাক্রম দেখাচ্ছে। এই অবস্থায় এই জয়ে কিছুটা হলেও নেপথ্য অনুঘটক ছিলেন কমলা হ্যারিস। এবারই প্রথম, আমেরিকায় কোনো ভারতীয় ও আফ্রিকান বংশদ্ভুত মহিলা উপরাষ্ট্রপতি হলেন। ফলে আমেরিকার শিক্ষিত মহিলারা, কৃষ্ণাঙ্গরা, এশিয়ানরা ভোট দিয়েছেন মনপ্রাণ ঢেলে। শপথগ্রহণের ঐতিহাসিক মুহূর্তে কমলা স্মরণ করেছেন তাঁর মায়ের কথা। যিনি একদিন তামিলনাড়ু থেকে আমেরিকা গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। সেই শ্যামলা গোপালনের মেয়ে আজ বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মুখ হিসেবে শিলমোহর পেয়ে গেলেন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বমহিমায় উজ্জ্বল কমলা হ্যারিস যখন মেয়েদের হয়ে ছক্কা হাঁকাচ্ছেন - তখন ইন্ডিয়া যেখানে শাইনিং হওয়ার পথে যথেষ্ট বিজ্ঞাপিত, তখন ভারতের মেয়েদের সম্পর্কে ভারী ভারী রাজনৈতিক ও দলীয় পদাধিকারিরা কী ভাবছেন তা কিন্তু ছিটকে ছিটকে তাঁদের কথাবার্তায় ছলকে ছলকে উঠছে! প্রধান বিচারপতি বলছেন - মেয়েদের প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। ইউপির মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন - হিন্দু মেয়েদের অসবর্ণে বিয়ে করা উচিত নয়। মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন - মেয়েদের কাজে বেরোলে তাঁদের গতিবিধি নজরদারীর মধ্যে রাখা উচিত। আর আরএসএস প্রধান বলেছেন - মেয়েদের শুধুমাত্র বাড়ির বৌ হয়েই থাকা উচিত।

আরএসএস সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে আরএসএসের ইতিহাস একটু দেখে নেওয়া ভালো। ১৯২৫ সালে আরএসএসের প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠা করেন ডঃ হেডগেওয়ার। পরে আরএসএসের পরিচালক হন এমএস গোলওয়ালকর। তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত একটানা ৩৩ বছর এই দায়িত্ব সামলেছেন। আজ আরএসএসের কর্তাদের যেসব নিদান বা বক্তব্যে আমরা আঁতকে আঁতকে উঠছি - এঁদের একমাত্র নির্দেশিকা হল মনুস্মৃতি। ভারতীয় সংবিধানকে এঁরা প্রায় গ্রাহ্যের মধ্যেই ধরেন না। ভারতীয় গণপরিষদের পণ্ডিতরা মনুস্মৃতির মতো প্রাচীন ভারতের নিয়মকানুন কেন ভারতীয় সংবিধানে রাখেন নি, এই বিষয়ে যথেষ্ট আক্ষেপ ও উষ্মা আছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকদের। মনুস্মৃতির ১২ টি অধ্যায়ের ২৭০০টি শ্লোক টইটম্বুর মেয়েদের মনসত্তাকে উপেক্ষা করেই সম্পূর্ণ দেহসত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে কেবলমাত্র পুরুষদের উপভোগ্য জৈবসত্তা হিসেবে সম্পূর্ণ অমর্যাদায়।

যদি ফিরে যাই ১৯৬০ সালের ১৭ ডিসেম্বরে, দ্বিতীয় সঙ্ঘচালক এমএস গোলওয়ালকর গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে তাঁর বক্তৃতায় যা বলেছিলেন তার মোটামুটি মর্মার্থ হল - ক্রস ব্রিডিং-এর পরীক্ষা নিরীক্ষা অন্যান্য প্রাণীদের ওপর করানো হয়, কিন্তু মানুষের ওপর করানোর সাহস হয় নি। যেকোনো শ্রেণির বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা হওয়া উচিত, তারপর তার স্বামী দ্বারা বাকি সন্তানদের জন্মগ্রহণ করাতে পারেন। অর্থাৎ নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ সব শ্রেণির মহিলাদের সম্ভোগ করাবার লাইসেন্স যাতে পেয়ে যায় তার চেষ্টা! বিভিন্ন “সাধুবাবা”দের এই প্রবণতার ঘটনা মাঝেমাঝেই খবরে আসে। আরএসএসের মুখপাত্র ‘অর্গানাইসার’ পত্রিকার ২ জানুয়ারি ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় এই খবর প্রকাশ হয়েছিল।

২০১৭ সালের ৭মে, বিবিসি বাংলা নিউজ খবর করেছিল উত্তম সন্তানের জন্য আরএসএসের প্রকল্পঃ - এই খবরে জানতে পারা যাচ্ছে যে অভিভাবকদের তিনমাসের এক “শুদ্ধিকরণ” করা হবে, যাতে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী যৌন মিলনের দিনক্ষণ নির্ধারণ, স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পর যৌন সংসর্গ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকে বিশেষ খাবার গ্রহণের নিয়মে থাকার নির্ঘন্ট। এনডিটিভির এক রিপোর্টে এই প্রকল্প বিষয়ে বলা হয় যে আরএসএসের স্বাস্থ্য শাখা আরোগ্য ভারতীর এই প্রকল্পের নাম “গর্ভ বিজ্ঞান সংস্কার”। এই প্রকল্পের ফলে নিখুঁত, যেমন চাই তেমন সন্তান পাবেন বাবা-মা। আরোগ্য ভারতীর জাতীয় আহ্বায়ক ডঃ হিতেশ জানি বলেন - এই প্রকল্পে নিম্ন বুদ্ধিমত্তার বাবা-মা মেধাবী সন্তানের জন্ম যেমন দিতে পারবে, তেমনি খর্বকায় কৃষ্ণবর্ণের বাবা-মা পেতে পারেন উজ্জ্বল বর্ণের সন্তান। এসব পদ্ধতির কথা হিন্দু শাস্ত্রে আছে! এই প্রকল্পের আহ্বায়ক ডঃ করিশ্মা মোহনদাস নরওয়ানি জানিয়েছেন গুজরাট রাজ্যে এই প্রকল্প বহুদিন ধরেই চলছে। এরপর উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে চালু হবে। প্রায় চার দশক আগে জার্মানি থেকে সিনিয়র এক নেতা এই ধারণা পেয়েছিলেন বলে সংঘের এক কর্মকর্তার কাছে জানা যায়।

একসময় সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে আরএসএসের পথ চলা শুরু হলেও তার মূল দর্শন ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ভারতে বসবাসকারী সকলেই নাকি আরএসএসের মতে হিন্দু। গোলওয়ালকার মনে করতেন হিন্দুরা একজোট হলেই মজবুত রাষ্ট্র গঠন হবে। তা না হলে তারা বিশ্বের প্রগতিতে যুক্ত হতে পারবে না। ভারতে বসবাসকারী অহিন্দুদের সমান নাগরিক অধিকার দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না গোলওয়ালকর। তবে এই মতে আরএসএস ও বিজেপির সকলে সহমত ছিলেন না। প্রথম দিকে এদের রাজনীতিতে যুক্ত হবার উচ্চাশা ছিল না। আস্তে আস্তে বদলে গিয়েছে অভিমত ও পথ। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে অবস্থান তাদের বদল হয় নি। আজ বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক জায়গায় ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে প্রবলভাবে। এরা রবীন্দ্রনাথের ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে’র দলে নয়। এরা ভীষণভাবে সংকীর্ণমনা। বিদেশীদের, ও অন্য ধর্ম ও পথের মানুষজনে এদের চূড়ান্ত অনাস্থা। এই উগ্রবাদ ধার ধারে না সুযুক্তির। অন্যায় প্রভাবে ভারসাম্য কেটে যায় সমাজের সব ক্ষেত্রে। শাসকের বা শক্তির নির্দেশ ও পরাক্রম যেন হতে চায় শেষ কথা!

সাম্প্রতিক বোম্বে হাইকোর্ট ১২ বছরের শিশু নির্যাতন কেসে যে রায় দেয়, তাতে আমাদের বিস্ময় কাটে না! পোশাকের ওপর যৌন নিগ্রহ হলে তা দোষ নয়? ভারতে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে অভিযুক্তকে নির্দোষ ধরে নিয়ে মামলা চলে। কিন্তু শিশু নির্যাতন করে কেউ যাতে পার না পায় তাই এই পকসো আইনের ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে অভিযুক্তকে দোষী ধরে মামলা এগোয়। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার দায় অভিযুক্তর ওপরেই তখন বর্তায়। এক্ষেত্রে নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েও উচ্চ আদালতে তাকে নির্দোষ বলা হয়! যদিও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪ (শ্লীলতাহানি) এবং ৩৪২(জোর করে আটক রাখা) ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয় অভিযুক্ত। একই অঙ্ক বিভিন্ন নিয়মে করলে উত্তর কিন্তু একই হওয়ার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে তা ঘটে না! বিচার ব্যবস্থার এই পরস্পর বিরোধীতায় ও হালের বিভিন্ন বিচারের রায়ে আমরা বিভ্রান্ত!

আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি ইন্দোরের একটি সভায় বলেছিলেন তার অসামান্য মতামত! - “বিবাহ হল চুক্তি। ছেলেরা বিবাহ করে সুখ পাবার জন্য। মেয়েরা বিয়ে করে ছেলেদের সুখ দেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের পেট চালানোর জন্য। এই চুক্তি যদি মেয়েরা পূরণ করতে না পারে, তাহলে পুরুষদের ওদের ছেড়ে দেয়া উচিত”। - এক্ষেত্রে স্বভাবতই মনে হয়, সত্যিই তো ! এই সব ছেড়ে দেওয়া পুরুষ যদি একটি বারো বছরের বালিকাকে লাঞ্ছনা করে, তবে পকসো আইনের আঁটুনি যতই বজ্র হোক না কেন গেরো যেন ফস্কাই থাকে! তবে না বিচার!

ইতালির একীকরণের সময় মাৎসিনি বলেছিলেন ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিলিয়ে দেবার কথা। তার মতে ধর্ম ছাড়া রাজনীতি ফলপ্রসূ হয় না। এমন ভাবনাই পোষণ করে আরএসএস ও তাদের ছায়াধন্য বিজেপি। এই সংঘ ও ফ্যাসিবাদ বা একনায়কতন্ত্রের সম্পর্ক বড় নতুন নয়। যখন দেশে একটি নির্দিষ্ট গভীরতাহীন জাতীয়তাবাদ শক্তি অর্জন করে এবং সংকীর্ণ ভাবনায় বর্ণবাদের ঢক্কা নিনাদে বিভেদ সৃষ্টি করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তখন আসে ফ্যাসিবাদ। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গণমাধ্যমকে কব্জা করার প্রবণতা যখন হয় তখন আসে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ এলে সামগ্রিক জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। নিত্যনতুন ভয় ও নিত্যনতুন শত্রু সৃষ্টি করে ফ্যাসিবাদ। সংখ্যালঘুদের অবদমন ও লাঞ্ছনা ও সেই খাতে নতুন নতুন ধারা আনার প্রয়াস যখন হয়, তখন আসে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ আসে চরম পরমত অসহিষ্ণুতায়। বৌদ্ধিক মননে আঘাত নিয়ে আসে ফ্যাসিবাদ। ধর্মীয় মোড়কে রাজনীতি মুড়ে নির্বাচন ব্যবস্থা ও দেশ পরিচালনায় স্বশাসিত সংস্থা ও গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলোকে প্রায় পকেটে পুরে এসে যায় ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ আসে যখন সরকার জনগণের ভাবনার চেয়ে পুঁজিপতির লাভের ভাবনা বেশি ভাবে। ফ্যাসিবাদ তখন আসে যখন সরকার বেসরকারি আধিপত্যে নিজেকে বিকিয়ে দেয়। সারা দেশজুড়ে চলতে থাকে প্রহসন! এভাবেই চলতে চলতে হয়তো একদিন দানা পাকতে থাকে জনজাগরনের। এই জন জাগরণ থেকে হয় গণ অভ্যুত্থান। কালের চাকা ঘোরে, স্বৈরাচারী দোকান গোটায়...