আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

আসন্ন নির্বাচন-নীতি, কৌশল ও কৃৎকৌশল

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


সাংবাদিকদের এক ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়, কীভাবে কোন রাজনীতিবিদের মুখোমুখি হতে হবে। বড় সংবাদগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে নানা বিষয়ে। দল বিশেষে মুখোমুখি হওয়ার ধরনও ভিন্ন হয়ে যায়। একটি দল বা সেই দলের কোনো ব্যক্তিনেতার সম্পর্কে ধারণা না থাকলে তার সাথে একান্ত আলাপচারিতায় প্রবেশ করাও অসম্ভব। ওটা না হলে রাজনৈতিক নেতাদের আলাপচারিতা থেকে সংবাদ নামক সারকথাটুকু তুলে আনাও অসম্ভব হয়ে যায়। সাধারণভাবে, একটি সংবাদপত্র গোষ্ঠী বা একজন সাংবাদিকের সংবাদ-আদর্শই স্থির করে দেয় একটি আলাপচারিতার কোন অংশকে কীভাবে তুলে এনে সংবাদ তৈরি করবে। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে একজন রাজনৈতিক নেতা হয়তো অনেক কথাই বললেন। কিন্তু তার সব ক’টি কথা যেমন সংবাদ মাধ্যমে আসে না, তেমনি সব সংবাদ মাধ্যমও সেই নেতার একই কথাকে সংবাদ করে না। আবার কোন সাংবাদিক কতটা খবর বের করে আনতে পারেন বা কোনো বিশেষ উক্তির সংবাদমূল্য বুঝতে পারেন তার ওপরই ওই সাংবাদিকের কৃতিত্বের হেরফের হয়। বড় বড় সংবাদপত্রে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের জন্যে আলাদা বিট বা বিভাগ থাকে। ওই বিভাগের সংবাদকর্মীরা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ইতিহাস, মতাদর্শ, রাজনৈতিক কৌশল, ব্যক্তিনেতা ও দলের অভ্যন্তরের গোষ্ঠীগুলির শুলুক সন্ধান রাখেন।

রাজনৈতিক নেতারা পক্ষান্তরে এমন কোনো পূর্বপ্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবনে ঢোকেন না। বিজেপি ছাড়া আর কোনো দল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া বা সার্বিকভাবে সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করা নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন বলে শুনিনি। একজন রাজনৈতিক নেতা নানাভাবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। টেলিভিশন বিতর্ক, সাংবাদিক সম্মেলন, কোনো ঘটনার পর একঝাঁক ক্যামেরা ও মাইকের মুখোমুখি হওয়া বা একান্ত সাক্ষাৎকার দেওয়া। রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকের মুখোমুখি সংযোগের এই নানা স্তরের ভাষা ও ভঙ্গী আলাদা হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতার সম্পর্কটি বিচিত্র। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ, অথচ একে অপরকে ব্যবহার করতে চান, ব্যবহৃত হতে চান না। একজন রাজনৈতিক নেতা চান তার প্রতিটি কথা যেন সাংবাদিকের কাছে সংবাদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। আবার সাংবাদিক চায় তার মনোমত কথা যেন রাজনৈতিক নেতাকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া যায়। বা অন্তত ওই নেতা এমন কিছু বলুন যার সংবাদমূল্য থাকবে। টাকা পয়সা ক্ষমতা প্রতিপত্তি বা উপঢৌকন দিয়ে সংবাদ করার বিষয়টি অবশ্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, যদিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এটার পরও ব্যবহার ও ব্যবহৃতের একটি দ্বৈরথ সবসময়ই চলতে থাকে এই সংযোগের মুহূর্তে।

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে এই সর্বজনবিদিত কথাটি বললাম এ জন্যেই যে এই নির্বাচনে নীতি এবং কৌশল যতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে তার চেয়ে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ হবে না নির্বাচনী রাজনীতির নানা কৃৎকৌশলের বিষয়ও। এই কৃৎকৌশলের মধ্যে এতক্ষণ আলোচিত হওয়া বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। রাজনীতিতে নীতি বা কৌশল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হয়তো সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাও যে, কী ভাষায় বা রূপে সেই নীতি বা কৌশলকে মানুষের সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিজেপির মত দল এই বিষয়গুলি পেশাদারী সংস্থাকে দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমীক্ষা করিয়ে তার উপর নির্ভর করেই তাদের রণনীতি ও কৌশল সাজায়। রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসও এটা করত। এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ করেছে এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই। সেদিনের কংগ্রেস বা এখনকার তৃণমূল কংগ্রেস এ ধরনের পেশাদারী সংগঠনকে নিযুক্ত করলেও ততটা ফলাফল পায় না যতটা বিজেপি এমন পেশাদারী পরামর্শদাতাদের সুফল নিতে পারে। তার কারণ বিজেপি এবং তাদের নিয়ন্ত্রক আরএসএস মূলগতভাবে ক্যাডারভিত্তিক। একটি ক্যাডারভিত্তিক দলে যেভাবে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায় সেটা কংগ্রেস বা তৃণমূলের দলে হয় না। বামপন্থীরা এটা সেভাবে করে উঠতে পারে না মূলত আর্থিক অসঙ্গতির কারণেই। তবে শুধু এটা হয়ত কারণ নয়। বামপন্থীদের শত দুর্বলতা সত্ত্বেও যে বিচিত্র ক্ষেত্রের মেধাশক্তি সম্পন্ন সদস্য ও সমর্থক মণ্ডলী রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই অনেক সার্থকভাবেই এই বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারত। কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ নেওয়ার মতো এই ক্ষেত্রগুলিতেও হয়তো বামপন্থীরা একটা সময়ে মন দেবেন এবং স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে কিছুটা বিলম্বে।

পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোটে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ছক এই লড়াইকে শুধুমাত্র ভোটকে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যেকার দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ফলে সেই ছক থেকেই মূলধারার সংবাদ মাধ্যম আবর্তিত হচ্ছে তৃণমূল ও বিজেপি নেতাদের চাপান উতোরকে ঘিরেই। নীতিগত প্রশ্ন নিয়ে অলোচনা সেখানে প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সংবাদের সমস্ত প্রহরগুলিকে দখল করে রেখেছে এই দু’টি দলের ব্যক্তিনেতাদের কলহ বিবাদ ও নিম্নরুচির চীৎকার চেঁচামেচি। অন্য দলগুলির প্রতিনিধিদের যখন বাইট নেওয়া হচ্ছে, তখন সেখানে তাদেরকেও প্রায় বাধ্য করা হচ্ছে, তাদের প্রতিক্রিয়াগুলিকেও তৃণমূল বিজেপি চাপান উতোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে। অন্য কোনো কথা জিজ্ঞেস করা হয় না বা বলার সুযোগও দেওয়া হয় না। বাম বা কংগ্রেস দলের নেতাদের কাছে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের প্রশ্নই থাকে শুধু মমতা বনাম দিলীপ বা অভিষেক বনাম শুভেন্দু বিষয়ক। ফলে বাম বা কংগ্রেসের নেতারা ওই প্রশ্নের বাইরে নিজেদের কোনো কথা বলে উঠতেই পারেন না বেশিরভাগ সময়। সংবাদ মাধ্যমের পক্ষপাত ওই দু’টি দলের প্রতি থাকলেও বিজেপি নেতারা এই বিষয়গুলিতে যথেষ্ট কুশলী। তারা এক মিনিটের বাইট হোক আর টেলিভিশন পর্দার বিতর্কই হোক, যে কোনো বিষয়ের আলোচনাকে ঘুরিয়ে তারা মুসলিম বিরোধী, পাকিস্তান বিরোধী, দেশদ্রোহ-দেশপ্রেম বয়ানে টেনে নিয়ে আসেন। ফলে ওদের রাজনীতি প্রায় সবসময়ই সংবাদ মাধ্যমে ভাসমান থেকে যায়।

এই কৃৎকৌশলের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী পক্ষ এখনও পিছিয়ে আছে। সংবাদমাধ্যমকে ম্যানেজ করার অসাধু রাস্তাটি বাদ দিয়েও কতগুলি সুপরিকল্পিত কৃৎকৌশলের মাধ্যমেও তুলনায় আরেকটু বেশি নিজেদের বয়ানকে সংবাদ মাধ্যমে আনা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময়েই সাংবাদিকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে যান। মমতা-শুভেন্দু চাপান উতোরের একটি পর্যায়ে যখন নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে মমতা বললেন, তিনি আসন্ন নির্বাচনে ওখান থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তখন সংবাদ মাধ্যম ব্যস্ত হয়ে যায় ‘পালিয়ে গেছেন’ আর ‘সম্মুখসমরে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছেন’ এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যারেটিভে। এখানে তৃতীয় পক্ষের সত্যিই কি কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার অবকাশ আছে? কিন্তু ‘তু-তু ম্যা ম্যা’র সান্ধ্য আসর উত্তপ্ত ও উত্তেজক রাখতে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা বামপন্থীদেরও এতে শামিল করিয়ে ছাড়েন। তৃণমূল বিরোধিতায় বিজেপির বয়ানের চেয়ে বামপন্থীদের বয়ান সুনির্দিষ্টভাবেই ভিন্ন। আবার বিজেপি বিরোধিতায় তৃণমূলের ভাষায়ও বামপন্থীরা বক্তব্য রাখতে পারেন না নীতিগত কারণেই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিজেপি-র মুসলিম বিরোধিতা ও তৃণমূলের পালটা অবাঙালি বিরোধিতার কোনোটিই বামপন্থীদের বয়ানে স্থান পেতে পারে না। মূলধারার সংবাদ মাধ্যম, রাজনীতিকে এই ‘জয় বাংলা’ বনাম ‘জয় শ্রীরাম’ এ দাঁড় করাতে চায়। এই দ্বৈরথের থেকে দূরত্ব রচনা করেই বামপন্থীদের তথাকথিত ‘মুসলিম তোষণ’ ও ‘হিন্দি আগ্রাসন’-এর সংকীর্ণতাবাদী বয়ানের বাইরে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক বহুত্বের স্বপক্ষে রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। এই সংকীর্ণতাবাদী দ্বৈরথেও মাঝেমাঝে খেলিয়ে দেয় সংবাদ মাধ্যম। সাধারণ কর্মী থেকে নেতাদেরও কেউ কেউ সেই সংকীর্ণতাবাদী ভাষ্যের স্রোতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না।

কিন্তু মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি কি সত্যিই এতটাই দ্বিমেরুসর্বস্ব হয়ে আছে? ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর মনে হয়েছিল বামপন্থীরা হয়তো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কেন্দ্র থেকে ছিটকে গেছে। মূল সংবাদ মাধ্যমগুলিও এই বয়ানেই চারধার ভরিয়ে রেখেছিল। বামপন্থীরা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হবে তৃণমূল-বিজেপি দ্বৈরথেই। বামপন্থী বলে পরিচিত মানুষদের একটি অংশও বলছিলেন যে বিজেপি বিরোধী সমস্ত অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে এখন তৃণমূলের পেছনেই দাঁড়াতে হবে। বলা বাহুল্য, ২০১১ পরবর্তী সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত একদা-বামপন্থীরাই এই বর্গের মানুষের মুখ্য অংশ। অতিমারী আক্রান্ত গত এক বছরের রাজনৈতিক সালতামামি কিন্তু এ কথা বলে না। লকডাউন পরবর্তী সময়ে বামপন্থীরাই সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান থেকেছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। কমিউনিটি কিচেন থেকে শ্রমজীবী ক্যান্টিন, আমফান দুর্গতদের সাহায্যার্থে কর্মকাণ্ড ইত্যাদি জনসেবামূলক কাজের পাশাপাশি সারা রাজ্য জুড়েই মানুষের জ্বলন্ত দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথে সোচ্চার থেকেছে বামপন্থীরা। প্রকৃতপক্ষে ২০১১ পরবর্তী সময়ে বামপন্থীদের এতটা সক্রিয়তায় দেখেনি মানুষ। সম্প্রতি দিল্লি সীমান্তের কৃষক সমাবেশকে কেন্দ্র করেও রাজ্যের জেলায় জেলায় ইতিবাচক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় মানুষের সাড়াও অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। ২০১৯-এর নির্বাচনী বিপর্যয়ের কতগুলি সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এটা কোনোভাবেই বামপন্থীদের প্রতি মানুষের মনোভাবের সূচক নয়। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের পৌর ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ধরনের রাজনৈতিক হিংসা প্রত্যক্ষ করেছে এই রাজ্য ওই নির্বাচনী ফলাফল ছিল তারই সরাসরি প্রতিফলন। এই অভূতপূর্ব হিংসার মুখে দাঁড়িয়ে বামপন্থীরা সে অর্থে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি। আতঙ্কিত মানুষ ও বামপন্থী সমর্থকদের বৃহত্তম অংশটি এই বিভীষিকাময় রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে মুক্তি পেতেই বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিল। তারা ভেবেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিতে বলীয়ান বিজেপি হয়তো এই সর্বগ্রাসী সন্ত্রাসের হাত থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে। এটা বিজেপি-র প্রতি ইতিবাচক সমর্থন ছিল না। ছিল তৃণমূলের রাজনীতির প্রতি প্রত্যাখানের বার্তা। এই ফলাফলে প্রবলভাবে উৎসাহিত হয়ে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নানা ধরনের কৌশলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ছক করেছে। বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে তারা নেমেছে সংবাদমাধ্যম ম্যানেজ থেকে ‍তৃণমূল দল ভাঙানোয়। সিবিআই-এর জুজু দেখিয়ে দলে দলে মন্ত্রী বিধায়কদের বিজেপিতে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যে বিভিন্ন জেলায় কার্যত তৃণমূলের সাংগঠনিক অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখাই দায় হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম ও অন্যান্য পথে রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যথেষ্টই তরল। তৃণমূল দলের সাংগঠনিক অস্তিত্ব যেমন বিপন্ন, তেমনি দলে দলে তৃণমূলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের বিজেপিতে যোগদান সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজেপিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিগত সময়ের উচ্ছ্বাসে ভাঁটা ধরিয়েছে। তৃণমূল বিরোধী জনমত বিজেপিকে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে ভেবে নিতে পারছে না। এই তরল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বামপন্থীদের ঘুরে দাঁড়ানোর এক বিরাট সুযোগ এনেছে। কিন্তু সেটা এতটা সহজ নয়।

বামপন্থীদের সামনে চ্যালেঞ্জ মূলত তিন ধরনের। এক, সংগঠনকে আবার গতিশীল করা। দুই, শুধুমাত্র বিরোধিতার রাজনীতির আবর্ত থেকে বেরিয়ে মানুষের সামনে বিকল্পের ইতিবাচক রাজনীতিকে উপস্থিত করা। তিন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ, ২০১৯ সালের ভোটে ছিটকে সরে যাওয়া পরম্পরাগত বামপন্থী গণভিত্তিকে আবার নিজের পক্ষে ফিরিয়ে আনা। প্রথম কাজটি দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় কাজটিকে শুরু করতে যাওয়ার আগে একে স্পষ্ট ভাষায় সংজ্ঞায়িত করাটিও একটি জরুরি কাজ। যেহেতু ৩৪ বছরের বাম শাসনের অসংখ্য ইতিবাচক অর্জনের পাশাপাশি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলীও ছিল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করার খেসারতই দিতে হয়েছে ২০১১ সালের নির্বাচনে। আগামী ভোটের বামপন্থীদের বিকল্প কর্মসূচিতে একই সঙ্গে তিনটি বিষয় বলতে হবে। এক, অতীতের কী কী বিষয় ফিরিয়ে আনা হবে। দুই, অতীতের কোন কোন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়কে সচেতনভাবেই ফিরিয়ে আনা হবে না। তিন, নতুন কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এক ও তিন হয়তো খুব কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু দু’নম্বর প্রশ্নেই যে রাজনৈতিক সাহসের প্রয়োজন তার সুস্পষ্ট উচ্চারণ এখনও শোনা যায়নি। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্থাৎ ২০১৯-এ ছিটকে যাওয়া পরম্পরাগত জনসমর্থনকে ফিরিয়ে আনার কাজটিতে অংশত সাফল্য এলেও রাজ্যে রাজনীতির চালচিত্র আমূল বদলে যাবে। দলে দলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিজেপিতে যোগ দেওয়া দেখে হতাশাগ্রস্ত সংখ্যালঘু সমাজের বড় অংশ বামবৃত্তে ফেরার জন্যে অপেক্ষায় রয়েছে। তারা শুধু নিশ্চিত হতে চায় ২০১৯ সালের বিজেপি-র দিকে ছিটকে যাওয়া গণভিত্তি কতটা পুনরুদ্ধার হচ্ছে তার উপর। আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তাদের নজরও এদিকেই।

সব মিলিয়ে নীতি, কৌশল এবং অবশ্যই কৃৎকৌশলের যথার্থ নিরুপণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নির্বাচনী রাজনীতির ভবিষ্যৎ।