আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

একটু পা চালিয়ে, ভাই

প্রবুদ্ধ বাগচী


তোড়জোড় যেভাবে চলছে তাতে অনেকেরই অনুমান এই রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়তো ঘোষিত হবে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, যার অর্থ, এপ্রিলের মধ্যেই গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে। সরকারিভাবে বর্তমান বিধানসভার মেয়াদ ফুরোবে উনিশে মে, ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নতুন সরকারের রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে যেতে কোনো অসুবিধে নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করা নির্বাচন কমিশনের কাজ, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের বাড়তি আগ্রহ থাকার কথা নয়। মানুষের কৌতূহল নির্বাচনের রাজনৈতিক সংগ্রামটুকুর দিকে - কোন দল হারে কোন দল জেতে এ নিয়ে আগ্রহ আর চর্চা ইতিমধ্যেই বাংলার সামাজিক পরিসরে শুরু হয়ে গেছে। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলি আগুয়ান হয়ে উঠেছে ওপিনিওন পোল প্রচারে। গত দেড় দশক ধরে এগুলিও দেশের সব নির্বাচনের অঙ্গ, তার অব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও।

কিন্তু এই বারের রাজ্য নির্বাচন সব দিক দিয়েই ব্যতিক্রমী। কারণ, স্বাধীনতার পর এই প্রথম রাজ্যের ভোট হাওয়ায় বইতে চলেছে অভূতপূর্ব একটা সমীকরণ যার তুলনীয় ঘটনা সাম্প্রতিককালে দেশের কোথাও ঘটেছে বলে স্মরণে আসে না (খুব ছোটভাবে ত্রিপুরার এপিসোড বাদ দিলে)। স্বাধীনতার পরের কুড়ি বছর ছেড়ে দিলেও গত চার/পাঁচ দশকে আমাদের বেড়ে ওঠার সময়কালে আমরা রাজ্যে কংগ্রেস ও বামদলগুলির মধ্যেই দ্বৈরথ দেখে এসেছি। বিগত বাইশ বছরে কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস - ১৯৯৮ এর লোকসভা নির্বাচন থেকে তারাই ছিল বামফ্রন্টের প্রধান বিরোধী। তাদের হাতেই দশ বছর আগে বাম সরকার পরাজিত। গত বিধানসভা নির্বাচনের (২০১৬) পর্বেও বামশক্তি নিজেদের হারানো শক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি, লোকসভা নির্বাচনে (২০১৯) একটিও সংসদীয় আসন না পেয়ে তারা আরও হীনবল।

গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে, বামপন্থী দলগুলি রাজ্যের রাজনীতি বিষয়ে একটি তত্ত্ব সামনে এনেছিলেন - তাঁদের বিবেচনায় মনে হয়েছিল তৃণমূল ও বিজেপি মূলত একই মুদ্রার এপিঠ - ওপিঠ তাই নির্বাচনের ময়দানে দুজনের বিরুদ্ধেই কথা বলা দরকার। নির্বাচনের আগে এই পার্টিলাইন প্রচারিত হয়েছিল সর্বত্র । স্পষ্টত কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবে নয়, কিন্তু নিজের রাজনৈতিক ভাবনা থেকে মনে হয়েছিল এই প্রচার ভুল বার্তা দিচ্ছে এবং বামদলের নিচু তলার সমর্থকরা এতে বিভ্রান্ত হবেন। ব্যক্তিগতস্তরে কোনও কোনও বাম সমর্থককে এই কথা বলেছিলাম, কিন্তু যেহেতু দলীয় লাইন তাই প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেননি। কিন্তু নির্বাচনের ফলে দেখা গেল, এই প্রচার কাজে এল না। তৃণমূল বিরোধী ভোট বেশিটাই চলে গেল বিজেপির ঝুলিতে, বামেরা ফিরে গেলেন শূন্য হাতে। এবং ভোটের হিসেব দেখিয়ে দিল, বামেদের ২৩ শতাংশ ভোট চলে গেছে বিজেপির বাক্সে, অথচ তৃণমূল ৪% ভোট বাড়িয়েছে। এই ফলাফল কি প্রত্যাশিত ছিল? দেশের সংসদে বামপন্থীদের অবস্থান হয়ে গেল আণুবীক্ষণিক। মনে হয়েছিল, এই ফল তাঁদের আত্মসমালোচনার দিকে ঠেলে দেবে - কিন্তু রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনের প্রাক্কালেও তাঁদের দলীয় মূল্যায়ন পরিবর্তন হয়েছে এমন কোনো ইঙ্গিত এখনও নেই। ওই বিশেষ ভাবনা নিয়েই তারা প্রচার করছেন, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বক্তব্য রাখছেন। এটা বিস্ময়কর যেমন, একইসঙ্গে তা বিপজ্জনক - কারণ, এবারে নির্বাচন পশ্চিমবাংলাকে গুরুতর এক জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

কেন তা বলি। বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল দলের সখ্যের যেসব নিদর্শন বামগোষ্ঠী তাঁদের প্রচারে তুলে আনেন, তার কোনোটাই অস্বীকার করার জায়গা নেই। এই কথা ঠিক, বিজেপিকে এই রাজ্যে পালে হাওয়া লাগাতে তৃণমূল কংগ্রেস সাহায্য করেছে, তাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করে। আবার প্রয়োজনে তাদের হাত ছেড়ে দিদি ফিরেছেন কংগ্রেসের জোটে। তৃণমূল সুপ্রিমো নিজের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করতে যখন যেমন খুশি দলের সঙ্গে আপোস করেছেন, অনেক আলগা মন্তব্য করেছেন - তার মধ্যে আর এস এস বিষয়ে প্রশংসাও আছে । দীর্ঘদিনের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তত তাঁর প্রথম সরকারের সময় (২০১১-১৬) এমন অনেক উদ্ধত ও অগণতান্ত্রিক আচরণ তাঁর সরকার করেছেন যা নিশ্চয়ই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তাঁর দলের সকলেই সমালোচনা ও দুর্নীতির পাঁকের বাইরে এটাও কেউ বলছে না, সময়ে সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ও যে তারা পায়নি এমনও নয়। বিজেপির উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা ধর্মীয় অংশকে তোষণ করে ইমামভাতা, মোয়াজ্জিনভাতা প্রচলন নিয়েও প্রশ্ন আছে - কারণ এইসবের ফলে সামগ্রিক মুসলিম সমাজের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, এমন নয়। একইভাবে সমালোচনা হতে পারে তার বিপরীতে পুরোহিত ভাতা নিয়ে, ক্লাবের পুজো অনুদান নিয়ে। তীব্র বিরোধিতা করা সম্ভব, বিপক্ষ বিধায়ক বা পুর প্রতিনিধি অথবা জেলা পরিষদ সদস্যদের ভাঙিয়ে জেলা পরিষদ বা পুরসভা দখল করার। প্রতিবাদ করা উচিত, পঞ্চায়েত ভোটে বিরুদ্ধ দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে বাধা দেওয়া ও জোর করে ভোট দেওয়ার। কিন্তু এই বিষয়ে সমালোচনা করে তাঁকে বিজেপির অন্য পিঠ বললে পালটা কিছু অভিজ্ঞতার কথাও তো আমরা তুলে ধরতে পারি।

১৯৯৮ ও ১৯৯৯ এর লোকসভা নির্বাচনে দমদম আসনটি কীভাবে বিজেপি জিতেছিল সেই বিষয়ে নানা লোকশ্রুতি আছে। ওই এলাকার অসীম প্রভাবশালী এক বাম নেতা ও ওজনদার মন্ত্রীর আশীর্বাদ যে বিজেপির ওই প্রার্থীর পক্ষে ছিল এটা ওপেন সিক্রেট। কারণ, এমন নয় যে রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ তখন বাম প্রার্থীদের প্রতি বিরাগ পোষণ করতেন - সারা রাজ্যেই বামপন্থীরা ভাল ফল করেছিলেন - শুধু ওই একটি আসনে কেন বিরুদ্ধ দল হিসেবে বিজেপি জিতে গেল, আজও সেটা একটা রহস্য, যাকে পাশ কাটিয়ে লাভ নেই। আরএসএস-এর সদর দফতরে গিয়ে যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি পতাকা তুলে তাদের সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তির সাথে বাম দলগুলির শেষ দিন অবধি সুসম্পর্ক ছিল, বামেদের বদান্যতায় তিনি রাজ্যসভার প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন, এটা নথিবদ্ধ সত্যি। দলের আঞ্চলিক নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে বামফ্রন্টের নেতারা যে তেমন পুরোমাত্রায় সক্রিয় ছিলেন না তার সব থেকে বেশি উদাহরণ আমরা পেয়েছিলাম হলদিয়ার জনৈক নেতার সাম্রাজ্যে; লালগড়ে এমনই এক নেতার প্রাসাদোপম বাড়ি জনরোষে ধূলিস্যাৎ হয়েছিল - টিভির পর্দায় সেই দৃশ্য আমরা অনেকেই দেখেছি। এ শুধু হিমশৈলের চূড়া মাত্র। একটা সময় বাম দলগুলির লোকাল কমিটি আলো করে বসে থাকত এলাকার প্রোমোটাররা - এ নিয়ে অনেক বাম নেতা প্রকাশ্যে আক্ষেপ করে দলের মূল স্রোত থেকে নির্বিবাদে সরে যেতে চেয়েছেন। পঞ্চায়েত বা পুরভোটে হিংসা,বুথ দখল, বিরোধীদের প্রার্থী দিতে না দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছিল বাম আমলেই, এটা কি এড়িয়ে যাওয়া যাবে? আর পঞ্চায়েতে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা, স্থানীয় ঠিকাদারদের থেকে দলীয় চাঁদা, ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় ও দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই প্রথম দেখছেন, এমন বললে মনকে চোখ ঠারা হয়। আপাতভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়নের প্রতি বামপন্থীরা দায়বদ্ধ, এই থিওরিটাও অসার প্রমাণিত হল যখন বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পর্যায়ে সাচার কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেল, এই রাজ্যের মুসলমান সমাজ আর্থ-সামাজিক নিরিখে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। ঔদ্ধত্যের প্রশ্নেও একদা বাম নেতাদের বিশেষ সুনাম ছিল না, তার প্রকাশ ঘটেছে বারবার। বিশেষ করে, জোর করে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে শিল্প কারখানা করার বিষয়ে সপ্তম বামফ্রন্ট যখন মরিয়া তখন সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এমন সব মন্তব্য করেছেন যা আজও ভাবলে আমাদের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। তৎকালীন এক বর্ষীয়ান নেতার সিঙ্গুরের বাসিন্দাদের প্রতি ‘উপদেশ’ ও নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে ‘হুমকি’ প্রায় প্রবাদপ্রতিম হয়ে শঙ্খ ঘোষের কবিতায় পর্যন্ত স্থান নিয়েছিল ! কাজেই নৈতিক পরিসর বলে যে জায়গাটা আছে বলে এখনো আমরা মনে করি সেখানে এই রাজ্যের সাবেক বামপন্থীরা খুব পরিচ্ছন্ন অবস্থানে আছেন এমন ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। মনে করা যেতে পারে, প্রথম তৃণমূল সরকারের সময় যখন নানা সমালোচনা উঠেছিল তখন কেউ কেউ তুলনা করে বলতেন, বাম সরকারের ছেড়ে যাওয়া জুতো পরেই নাকি তৃণমূল সরকার পথ হাঁটছেন। তাই আজকের পরিস্থিতিতে এইসব প্রসঙ্গ তুললে আদপে বিগত সরকারে থাকা বাম দলগুলি কি নিজেদের পালটা সমালোচনার তোপ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারবেন?

কিন্তু বিষয়টা এই তৃণমূল বনাম বামফ্রন্টের সমালোচনা পালটা-সমালোচনার বাইনারির থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি-তৃণমূলকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ ভাবার তত্ত্ব কিংবা তাদের মধ্যে গোপন গড়াপেটার কাহিনিকে ‘মোদিভাই দিদিভাই’ রসিকতার বয়ানে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টার মধ্যে কোথাও একটা স্থূলে ভুল আছে বলেই মনে হয়। তাই আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে এই ধরনের একটা সূত্র ভাসিয়ে দিলে তার পরেও কিছু কথা থাকে। কথাটা হল, আদপে তৃণমূল কোনো রাজনৈতিক দল নয়, প্রায় বলতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ফ্যান ক্লাব যার কোনো সুগঠিত রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীও তেমন কিছু নেই, নেই কোনো সুসংবদ্ধ সাংগঠনিক কাঠামো । এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই তার কাজকর্ম, নির্বাচনী যুদ্ধ, সরকারি কর্মসূচী। বিগত লোকসভা নির্বাচনে মাননীয়া স্বীকার করে নিয়েছিলেন, সব কটি লোকসভা আসনে আসলে তিনিই প্রার্থী । কংগ্রেস দলের মধ্যে থেকে একটা বিক্ষুব্ধ অংশকে সরিয়ে এনে একেবারে একক প্রচেষ্টায় ও নিজস্ব ক্যারিশ্মায় এই দল গড়েছেন তার সুপ্রিমো, যার সঙ্গে অনেকটা দক্ষিণ ভারতের রাজনীতির সাদৃশ্য আছে । রাজনীতির ময়দানে মোটামুটি আলগাভাবে কংগ্রেসেরই শিক্ষা ও ভাবধারাই তার সঙ্গী। নিজের ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতার সঙ্গে থাকার জন্য তাই কারোর সঙ্গেই পথ চলতে তার অসুবিধে হয়নি। আর রাজ্যে ক্ষমতায় এসে নিজেকে সকল সমস্যার ত্রাণকর্তা, এমন এক ‘লারজার দ্যান লাইফ ইমেজ’ তিনি তৈরি করেছেন খুব সচেতনভাবেই। সরকারে ও দলে তিনিই সর্বময় কর্ত্রী, বিকল্প কাউকে তিনি নিজেও জায়গা দিতে রাজি নন। একে বৃহত্তর অর্থে সুবিধেবাদী বলতে আপত্তি নেই।

বিপরীতপক্ষে, বিজেপি খুব স্পষ্টভাবে আরএসএস-এর ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে চালিত ও পরিচালিত এক রাজনৈতিক শক্তি, সুদীর্ঘকাল ধরে সারা ভারতের জন্য তাদের একটা রাজনৈতিক আজেন্ডা আছে। প্রায় একশ বছর আগে ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদের আওতায় তাদের জন্ম, বাম রাজনীতির মতোই তাদেরও রয়েছে কিছু চিন্তাগুরু যাদের ভাবনাচিন্তায় ঘোষিতভাবে সাম্প্রদায়িক ছোঁয়া - তাদের কাজে বক্তব্যে এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার অকপট ফন্দি। এইকথা, সবাই জানেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে এরা নিজেরা শুধু অংশ নেননি তাই নয় সেই মহতী সংগ্রামকে তারা তত্ত্বগত ভাবে স্বীকারই করে না । হিটলারের জাতিচিন্তার মতোই তারা মুসলিম সম্প্রদায়কে নিকৃষ্ট জাতি বলে মনে করেন, মুসলিম শাসনের অবসানে ব্রিটিশ শক্তির শাসন তাদের কাছে ছিল পরম আরাধ্য। দেশের সামাজিক ও সাংবিধানিক ফ্যাব্রিককে নষ্ট করে একটা এককেন্দ্রিক চিন্তা ও রাষ্ট্রভাবনা চাপিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে তারা মরিয়া। সেই সঙ্গে কর্পোরেট পুঁজিকে যেনতেন প্রকারে প্রশ্রয় দিয়ে, জনবিরোধী সংস্কার করে দেশের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বনের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া ও প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিজেদের দেশপ্রেমী হিসেবে প্রচার করা তাদের নিয়মিত কর্মসূচী । সেই সঙ্গে যে কোনো বিরোধী স্বরকে দমন করা, গণতন্ত্রের আড়ালে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সারস্বত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করাই তাদের অগ্রাধিকার। গত ছয় বছরে এই সর্বগ্রাসী আক্রমণ কীভাবে সারা দেশে ঘটেছে ও আজও ঘটে চলেছে সেই বিষয়ে বাড়তি কথা বলার আর কতটুকু পরিসর আছে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় তো সেগুলো হাড়ে হাড়ে জানি।

বিষয় হল, তৃণমূল দল এমন কোনো সাঙ্ঘাতিক আদর্শ উদ্দেশ্য নিয়ে আদৌ তৈরি নয়। তাদের সুপ্রিমো মূলত কংগ্রেস রাজনীতির ফসল, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা বা ভেদবুদ্ধি এগুলো তার মধ্যে নেই। তাছাড়া সেই দল চেষ্টা করেও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে পারে না, একটা রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে তার সম্ভাবনা নেই। দেশের সংবিধান, বিচারব্যবস্থা বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার ক্ষমতা বা বাসনা তৃণমূল দলের আছে এমন কোনো অভিযোগ কেউ করতে পারবেন না । বরং মূলত পশ্চিমবাংলার প্রথাগত ঐতিহ্য সংস্কৃতি ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের প্রতি তারা আস্থাশীল। কোনো বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁরা বিদ্বিষ্ট বা তাদের বিরুদ্ধে এই দলের কোনো গোপন কর্মসূচী আছে এই কথা তাদের অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না । আর গত দশ বছরে তৃণমূল সরকারের কাজে একটা জনমুখী দিক নিশ্চয়ই আমাদের চোখ এড়ায়নি। নানা সরকারি প্রকল্প যেমন তৈরি হয়েছে, একেবারে নিচুস্তরে তার রূপায়ণ হয়েছে, তার মধ্যে দুর্নীতির ছোঁয়া থাকলেও। কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, বাংলার বাড়ি, গতিধারা, শিক্ষাশ্রী ইত্যাদি কর্মসূচী তো একটি বামপন্থী সরকারের আমলেই প্রত্যাশিত ছিল। কারণ তাঁরা তো সংসদীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে গরিব ও প্রান্তীয় মানুষকে রিলিফ দেওয়ার কথা বলতেন, কিন্তু তা তো সর্বার্থে হয়নি। গত কয়েক বছরে সরকারি কাজে সমস্ত দফতরে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের নিয়মিত কাজকর্ম ও পরিষেবার গুণগত মান বাড়ানো হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান এগুলো কি সাধারণ মানুষের স্বার্থবাহী নয়? খেয়াল রাখা দরকার, এই দশ বছরে বেশ কিছু হাসপাতাল উন্নত পরিকাঠামো পেয়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিস্তৃততর হয়েছে। অন্যদিকে, ‘নীতিগতভাবে’ বেসরকারিকরণের বিপ্রতীপে থাকা বাম আমলের শেষ দিকে সারা কলকাতায় ও রাজ্যে সরকারি জমির ওপর একের পর এক বেসরকারি হাসপাতাল তৈরির কাজ হয়েছে, প্রতিশ্রুতি দিলেও সেখানে বিনামূল্যে গরিব মানুষের চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সেই আমলেই যাদবপুরের সরকারি যক্ষ্মা হাসপাতালে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই রাজ্যে এখন কয়েক কোটি মানুষ দুটাকার বিনিময়ে খাদ্যশস্য পান, করোনা-কালে বিনামূল্যে রেশন পাচ্ছেন প্রচুর মানুষ । ডোল পলিটিক্স বলে এগুলোকে ব্যঙ্গ করে লাভ নেই, সাবেক বামপন্থীরা এমন অনেক দাবি আগে তুলেছেন যার চেহারা একই ধরনের। তাছাড়া, একশ্রেণির মানুষ যাই বলুন, আমাদের দেশে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু ভর্তুকি, সরকারি সাহায্য তো প্রয়োজন,এটা বামপন্থীরা নিশ্চয়ই স্বীকার করেন। রাজনীতিতে আদর্শ নীতি এগুলো অবশ্যই কাম্য কিন্তু দেশের রাজনীতিতে সরকারি কর্মসূচী ও রূপায়নের একটা অংশও কিন্তু মানুষের বিচার্য হয়ে ওঠে - দক্ষিণের রাজ্যগুলি এর বড় উদাহরণ।

বিপরীত পক্ষে, ৩৪ বছরের বাম আমলের একটা পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পঞ্চায়েত সবটাই দলের নিয়ন্ত্রণে যেভাবে চলে গিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা এখনও আমরা ভুলিনি।ভুলিনি পঞ্চায়েতে দুর্নীতির কথা, এলাকায় এলাকায় তৈরি হওয়া জায়গিরদারদের কাহিনি। প্রাথমিক শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য এমন কোনো উল্লেখ্য উচ্চতায় সেই আমলেও ওঠেনি। আর দলীয় আদর্শ ও সাংগঠনিক কাঠামোয় এমন ঘুণ ধরল যে আজও দশ বছরে বাম দলগুলি ঘর গুছিয়ে উঠতে পারেনি, তাদের রক্তক্ষয় অব্যাহত। একদা বিরোধী , বহুল সমালোচিত ও ঘোর নিন্দিত কংগ্রেস দলের হাত ধরে এই রাজ্যে বামদলদের টিকে থাকতে হচ্ছে, গত বিধানসভায় তারা বিরোধী দলের মর্যাদাটুকুও হারিয়েছেন । দলবদল করে তাদের অনেক সাথী তৃণমূল এমনকি বিজেপি দলেও নাম লিখিয়েছেন। অথচ টিভি চ্যানেলে বা ফেসবুকে রাজ্য সরকারের যেসব কাজের সমালোচনায় তারা নিয়ত মুখর সেসব নিয়ে খুব সুগঠিত গণ-আন্দোলনও যে গড়ে তুলতে পেরেছেন এমন নয়।

এই পরিস্থিতিতে, বিজেপি নামক আগ্রাসী ফ্যাসিস্ত শক্তিকে ঠেকাতে একটা কোনো পক্ষ নেওয়া দরকার। পক্ষটা শক্তিশালী হওয়া দরকার, যারা ভোটের ময়দানে বিজেপির সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। শুনতে খারাপ লাগলেও বামপন্থীরা আর এখন সেই জায়গায় নেই। অথচ বিজেপি প্রবল বিক্রমে নেমে পড়েছে বাংলা দখলে, যে কোনো প্রকারে এই রাজ্য তাদের চাই, তার জন্য যতদূর যেতে হয় তারা যাবে। রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় এসে তারা কী করছে সেটা আমাদের অজানা নয়। আর বাংলার ঐতিহ্যশালী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে তারা যে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেবে ক্ষমতায় আসার আগেই তার হুঙ্কার আমরা শুনতে পাচ্ছি। এখানে যদি তৃণমূল বিজেপিকে এক পাল্লায় ওজন করে তাদের বিচার করা হয় তবে সেটা আরো একটা ঐতিহাসিক ভুল। ভোট আসার অনেক আগে থেকেই যেভাবে বিজেপি তাদের সর্বভারতীয় শক্তি নিয়ে এই রাজ্য ‘দখলের জন্য’ ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের স্মরণকালের মধ্যে তেমন উদাহরণ নেই। আর দখল শব্দটাই যেন একটা আগ্রাসনের ইঙ্গিত দেয় - নির্বাচনে জিতে একটি রাজ্যের ক্ষমতায় আসা নয়, এটা যেন একটা রাজ্য জয়। হিন্দি হিন্দু ফ্যাসিবাদের দর্পিত আগমন - তারা সারা রাজ্যের সামাজিক কাঠামোর সেকুলার চরিত্রকে ধর্ষণ করে তাকে ফেট্টিবাদী গেরুয়ার রঙে রাঙিয়ে দেবে, রাজ্যের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাকে পরিয়ে দেবে গেরুয়া পোশাক যে পোশাকে সেজে উঠে ‘লাভ জিহাদ’ হয়ে যাবে আইনসিদ্ধ, যে কোনো বিরুদ্ধ মতকেই অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, সুস্থ ও মুক্ত চিন্তার পরিসর উধাও হয়ে যাবে চারপাশে। ঠিক যেভাবে চলছে দেশটার আরো কিছু অঙ্গরাজ্য। বিচারের বদলে এনকাউন্টার, দলিত নিপীড়ন, মুক্তচিন্তকদের গুলি করে হত্যা, মহিলাদের ওপর নজিরবিহীন আক্রমণ তাদের সামাজিকভাবে নতুন করে নির্যাতনের হুমকি (এই লেখা লিখতে লিখতে খবর পাওয়া গেল টালিগঞ্জের এক অভিনেত্রী কোন টিভি চ্যানেলে কী বলেছিলেন বলে তাঁকে গণধর্ষণ ও মুন্ডচ্ছেদের হুমকি দিয়েছে কোন এক দু’আনার বিজেপি নেতা!) - শুধু একটা নির্বাচনের জয় পরাজয় নয়, এটা একটা রাজ্যের সামূহিক সংস্কৃতির পিছু হটা। আমাদের অস্তিত্বের নির্বাপণ আশঙ্কা নিয়ে যেন এটা একটা নতুন স্বাধীনতার লড়াই।

এই লড়াইয়ে কী করবেন বামপন্থীরা? তৃণমূল নামক একটা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে একই দাড়িপাল্লায় রেখে ওজন করবেন এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বিজেপিকে? ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের সঙ্গে এক করে দেখবেন নিছক একটি সংসদীয় দলের বেহিসেবি কাজকর্মকে? নিজেদের প্রচারে একশো কথা বললে তার আশি শতাংশ বলবেন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আর বিশভাগ বলবেন বিজেপিকে নিয়ে? কারা প্রধান শত্রু? আমরা বিশ্বাস করি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত শক্তি নিয়ে লড়ার যোগ্যতা আছে বাম মতাদর্শের যারা মহান সাম্যবাদের আলোয় সমস্ত রকম ভেদাভেদের বিরুদ্ধে গলা তুলতে পারেন। কিন্তু সময়,পরিপ্রেক্ষিত, আপেক্ষিক অবস্থান এগুলো একটা বড় ফ্যাক্টর। সংসদীয় রাজনীতি করতে গেলে সেই পরিপ্রেক্ষিত ও তার ভিত্তিতে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করাটাই সব থেকে বড় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সূচক। কেরালার বামপন্থীরা তাদের মতাদর্শ ও সরকারি কর্মসূচী দিয়ে তাদের মতো লড়াই করছেন, তাতে তারা সাড়া পেয়েছেন। পাশের রাজ্য বিহারে সমস্ত বামশক্তি এক হয়ে জোট বাঁধল বিজেপির বিরুদ্ধে, তারা অনেকদূর অবধি সফল হলেন। অথচ বিহারে একটা সময় বাম দলগুলির সঙ্গে (মূলত লিবারেশন) যাদবপন্থীদের অনেক রক্তক্ষয়ী বিরোধ হয়েছে, হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গেও - কিন্তু বিজেপি বিরোধিতার বৃহত্তর প্রশ্ন সামনে রেখে মুলতুবি রাখা হল সেইসব। মনে রাখতে হবে জাপানের ফ্যাসিবাদকে রুখতে মাও দেশের মধ্যে তার বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, হিটলারকে রুখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও রাশিয়ার মতো পরস্পরবিরোধী শক্তি এক হয়েছিল। একসময় বিজেপিকে রুখতে বামপন্থীরা কেন্দ্রে জোট করেছিলেন যেসব দলের সঙ্গে তাদের সঙ্গে তার আদর্শের যোগ নেই, আজ যে কংগ্রেসের হাত ধরেছেন তারা সেই কংগ্রেস দলের সরকারের ওপরেই তো সমর্থন তুলে নিয়েছিলেন মার্কিন ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে। সে তো বেশিদিন আগের কথা নয়। আজ সেই হিটলার মুসোলিনির নাতিপুতিরাই আমাদের সদর দরজায় কড়া নাড়ছে, রক্তচোখ দেখাচ্ছে বাংলার সমাজ ভাষা রাজনীতি সংস্কৃতি সব কিছুর ওপর - ইতিহাস ডাক দিচ্ছে তাদের রুখে দেওয়ার। সেই ডাকে সাড়া দেওয়া বাম আদর্শের নৈতিক দায়।

আজকে এই রাজ্যের বাম দলগুলি কী করবেন সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু তারা যে ভঙ্গিমায় বিজেপি আর তৃণমূলকে একই মুদ্রার দুপিঠ বলছেন, তাতে কি কোথাও লঘু হয়ে পড়ছে না বিজেপির আসল বিপদ? বামপন্থীরা ভোট পান, আসন পান - আমরাও চাই । কিন্তু তাদের ভোট যাতে ফ্যাসিবাদীদের বিষবৃক্ষের গোড়ায় জল না দেয় সেই ব্যাপারে সাবধান হতে হবে না? একেবারে একশোভাগ সঠিক না হোক সদ্য এই রাজ্যের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে একটি জনমত সমীক্ষা প্রকাশ হয়েছে (১৮ জানুয়ারি), সেখানেও দেখা যাচ্ছে, বাম জোটের ভোট বেশিটাই সরে যাচ্ছে বিজেপির দিকে - বিগতক্ষমতা বামপন্থীরা সময়ের আহ্বান শুনতে পাচ্ছেন তো?

একটি ঐতিহাসিক পদযাত্রা শুরু হয়ে গেছে - একটু পা চালিয়ে, ভাই!