আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

সমসাময়িক

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা


এক দেশ এক নির্বাচন। ক্ষমতার শীর্ষ থেকে এই প্রস্তাব উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিত্র-ভক্তবৃন্দ সোচ্চার। বাদবাকি সকলেই প্রস্তাবের বিরোধিতায় মুখর। আর এহেন কথা-তরজার মধ্যেই শুরু হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে নতুন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা গবেষণা। ভালো ফল পাওয়া গেলে নতুন পদ্ধতি প্রসার লাভ করতে পারে।

পরীক্ষার প্রথম পর্যায়ে বেছে নেওয়া হল কেরলের পঞ্চায়েত নির্বাচন। গত নভেম্বরে আয়োজিত কেরলের ত্রিস্তর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে ১৪টি জেলা পঞ্চায়েতের মধ্যে ১১টি, ১৫২টি ব্লক পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০৮টি এবং ৯৪১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৫১৪টিতে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সংক্ষেপে এলডিএফ জয়লাভ করেছে। ২০১৮ সালের ভয়াবহ বন্যা এবং ২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণ মোকাবিলায় রাজ্য সরকার ও স্থানীয় সংস্থাসমূহ যেভাবে কাজ করেছে, কেরলের মানুষ তাকে বিপুলভাবে সমর্থন করার জন্য এই সাফল্য এসেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প যেমন লাইফ মিশন (আবাসন), আরড্রাম (স্বাস্থ্য) ইত্যাদি এবং সরকারি বিদ্যালয়গুলির উন্নতিকরণ, সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি প্রভৃতি এই সাফল্যের প্রধান উপকরণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কেরলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহর ক্রিয়াকর্মাদি সারা দেশের কাছে উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এমনকি ২০১৫-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের থেকেও এলডিএফ বেশি আসন পেয়েছে। ফলে, কেরলে এলডিএফ-এর জয় সারা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছে।

১৯৯৬-এ কেরলের তৎকালীন এলডিএফ সরকার কার্যকরভাবে স্থানীয় সংস্থাগুলিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু করে। তাদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রদান করতে আইন করা হয়। কেরালার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলির মাধ্যমে ক্ষমতা ও দায়িত্বের পরিষ্কার বিভাজন করা রয়েছে। জেলাস্তর পর্যন্ত স্কুল ও হাসপাতাল, কৃষি, মৎস্য, ক্ষুদ্র সেচ, ক্ষুদ্র শিল্পের মতো বিষয়গুলি যেগুলি জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেগুলিকে এই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়াও রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ এবং আবাসন, শৌচাগার ও পানীয় জলের মতো মৌলিক পরিষেবাগুলি পৌঁছে দেবার দায়িত্বও এই সংস্থাগুলির উপরই অর্পিত। এই মৌলিক পরিষেবাগুলি জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার কাজ যথেষ্ট ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে। গত সাড়ে চার বছরে এলডিএফ সরকারের নেতৃত্বে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ভয়াবহ বন্যা ও ২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণের মোকাবিলায়ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলি নজিরবিহীনভাবে কাজ করেছে। একইভাবে কোভিড সংক্রমণ সম্পর্কে সচেতনতা প্রচার, সংক্রমিতদের তথ্য একত্রিত করা, নিভৃতবাসের নিয়মাবলি রূপায়ণ এবং কোভিড আক্রান্তদের কাছে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য/পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতি দেশে তো বটেই সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

এলডিএফ’র জয় সেই উন্নয়ন-অধ্যায়ে অবশ্যই বাড়তি উৎসাহ-প্রেরণা সঞ্চার করবে। সাফল্যের উদ্দীপনার মধ্যেই কিন্তু এক অজানা আশঙ্কার পদধ্বনি অনুভব করা যাচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে কিটেক্স (KITEX) নামের এক কর্পোরেট সংস্থা ঘোষণা করে যে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিঝাক্কমবালম, মাঝুভান্নুর, আইক্কারানাড, কুন্নাথুনাড এবং ভেঙ্গোলা ব্লক পঞ্চায়েতের (পশ্চিম বঙ্গের পঞ্চায়েত সমিতির মতো) অন্তর্ভুক্ত সবকটি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে অসরকারি সংস্থা টোয়েন্টি২০ (Twenty20) নাম নিয়ে আদতে কিটেক্স-এর মনোনীত প্রার্থীরা ওরফে কর্মীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

কিঝাক্কমবালম কেরলের একটি ব্লক পঞ্চায়েত। ১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত এই ব্লক পঞ্চায়েতের ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনে ২০১৫-র নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দল জয়ী হয়নি। কিটেক্স-এর মনোনীত প্রার্থীরা টোয়েন্টি২০-র হয়ে জয়লাভ করেছিলেন।

এলাকার জল ব্যবহার এবং জল দূষিত করা নিয়ে ২০১২-য় কিটেক্স-এর সঙ্গে কিঝাক্কমবালম ব্লক পঞ্চায়েতের প্রবল বিবাদ-বিতর্ক হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে কিটেক্স পরবর্তী পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৩-য় চ্যারিটেবল সোসাইটস্ অ্যাক্ট অনুসারে কিটেক্স-এর উদ্যোগে অসরকারি সংগঠন টোয়েন্টি২০ নথিভুক্ত হওয়ার পর কিটেক্স-এর কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি (সিএসআর) বা সংস্থার সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পঞ্চায়েতের কাজে খরচ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৭৮-এ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর গ্রাম উন্নয়নের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থার সাফল্যের দৃষ্টান্ত সামনে রেখে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৯০-এর দশক থেকে দেশের সর্বত্র পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। পঞ্চায়েতের নিজস্ব আয় এবং সরকারের অনুদান নিয়ে নির্বাচিত পঞ্চায়েত স্থানীয় স্তরে উন্নয়নের কাজ করে। কর্পোরেট সংস্থা কিটেক্স বেনামে টোয়েন্টি২০ অসরকারি সংস্থার সুবাদে কিঝাক্কমবালম-এর পঞ্চায়েত সমিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর নিজের সিএসআর বাবদ বরাদ্দ অর্থ এই পঞ্চায়েতে বিনিয়োগ করে। ফলে রাজ্যের অন্যান্য পঞ্চায়েত সমিতির তুলনায় কিঝাক্কমবালম-এ ২০১৫-২০২০ সময়সীমায় অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে ২০২০-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে আরও বেশি জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

এরনাকুলাম জেলার কিঝাক্কমবালম গ্রামে ১৯৬৮-তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আন্না-কিটেক্স কোম্পানির অ্যালুমিনিয়াম কারখানা। ১৯৭০ নাগাদ সংস্থাটি একই এলাকায় ৪০০টি পাওয়ারলুম সংস্থাপন করে। পঁচিশ বছরের মধ্যে সংস্থাটি তৈরি জামাকাপড় অর্থাৎ গার্মেন্টস্ উৎপাদনে জড়িয়ে পড়ে। পনেরো হাজারের বেশি কর্মী কিটেক্স-এর সম্পূর্ণ রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্টস্ কারখানায় তখন কর্মরত। এবং কারখানায় কোনও ট্রেড ইউনিয়ন নেই। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৯৭-এ সিটু-র উদ্যোগে কেটিক্স-এ ৪৫০ দিন ধরে আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। ধীরে ধীরে কিটেক্স কেরলের সবচেয়ে বড়ো কর্পোরেট সংস্থায় পরিণত হয়। বর্তমানে কিটেক্স-এর মূলধন প্রায় বারোশো কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিঝাক্কমবালম ব্লক পঞ্চায়েতের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে টোয়েন্টি২০-র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ ২০১৫-র তুলনায় ১৭-র থেকে একটি বেশি আসন পেয়েছে টোয়েন্টি২০। মাঝুভান্নুর ব্লক পঞ্চায়েতের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৬টিতে জয়ী হয়েছেন টোয়েন্টি২০-র প্রার্থীরা। আইক্কারানাড ব্লক পঞ্চায়েতের ১৪টি আসনের সবকটিতেই টোয়েন্টি২০ জয়ী। কুন্নাথুনাড ব্লক পঞ্চায়েতের ১৮টি আসনের মধ্যে ১১টিতে টোয়েন্টি২০ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। ফলে ব্লক পঞ্চায়েতের পরিচালনার দায়িত্ব পেতে চলেছে টোয়েন্টি২০। ভেঙ্গোলা ব্লক পঞ্চায়েতের ২৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ১০টিতে প্রার্থী দিয়েছিল টোয়েন্টি২০। এবং ১০টিতেই তাঁরা জয়লাভ করেছেন।

গ্রাম উন্নয়ন খাতে বাড়তি ব্যয় বরাদ্দের সুযোগ থাকায় টোয়েন্টি২০ অসরকারি সংস্থার প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা আপাত দৃষ্টিতে বেশি। তবে যে কথাটা বলা হচ্ছে না তা হল,- একটা হোক বা পাঁচটা, মূল কর্পোরেট সংস্থা কেটিক্স-এর সিএসআর বাবদ বরাদ্দ অর্থ কিন্তু একই থাকবে। আইন অনুযায়ী ট্যাক্স দেওয়ার পর বাৎসরিক মুনাফার ২ শতাংশ সিএসআর হিসেবে খরচ করতে হয়। একটার জায়গায় পাঁচটা পঞ্চায়েত সমিতির দখল পেলে স্বাভাবিকভাবেই সিএসআর পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ততদিনে গ্রামবাসীদের ধোঁকা দিয়ে চারটি ব্লক পঞ্চায়েত দখলের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে।

আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আগামী দিনের বিপদ সঙ্কেত। কেটিক্স-এর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামী দিনে কর্পোরেট জগতের রাঘববোয়ালরা দেশের সর্বত্র সমস্ত পঞ্চায়েত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে পারে। এবারের কেরলের আরো কয়েকটি কোম্পানি এগিয়ে এসে এই ধরনের মঞ্চ বা সংগঠন তৈরি করেছে। কোচিতে পুরসভার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ভিফরকোচি (V4Kochi) নামের একইধরনেরর একটি মঞ্চ। অন্যান্য জেলার বেশ কিছু পৌর ও পঞ্চায়তে নির্বাচনে আরও কয়েকটি একই ধরনের মঞ্চ (যাদের পেছনে কোনো না কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে) অংশ নিয়েছে। কিন্তু টোয়েন্টি২০-র সাফল্যের ধারেকাছেও কেউ যেতে পারেনি।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে কর্পোরেটের অংশগ্রহণ কিন্তু গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। কর্পোরেট সংস্থা সিএসআর-এর টাকায় সংগঠন তৈরি করে পঞ্চায়েত বা পুরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়া একধরনের বিনিয়োগ ছাড়া অন্য কিছু নয়। টোয়েন্টি২০ ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে কেরলের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনেও তারা প্রার্থী দেবে অর্থাৎ আর আড়াল থেকে নয় সরাসরি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ময়দানে প্রার্থী নিয়ে হাজির হবে। কেরালার স্থানীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে বা সাময়িক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে কি বিষয়টি বিবেচিত হবে? নাকি আগামী দিনের অশনি সঙ্কেত? কেরলের বিধানসভা নির্বাচনে সফল হলে তার প্রভাব আগামীদিনে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিটেক্স এবং উদারীকরণ অর্থনীতির প্রবক্তাদের মতে এটাই নাকি একুশ শতকের রাজনীতি; রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ মানুষ নাকি কিটেক্স-এর পথে দেশ শাসনেও সরাসরি কর্পোরেট পেশাদারিত্ব চাইছে। অন্তত স্থানীয় স্তরের প্রশাসনে তো বটেই। বাস্তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কর্পোরেট সংস্থাসমূহ নিজেদের আয়ত্ত্বে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উৎপাদন ও পরিষেবা ব্যবস্থার দখলদারি নেওয়ার পর কর্পোরেট সংস্থাসমূহের হাতে কৃষি ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার পরীক্ষানিরীক্ষা কাজ শুরু হয়ে গেছে। চলমান কৃষক আন্দোলনের দাপটে সেই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এখনও সাফল্য লাভ করেনি। স্বল্প পরিসরে হলেও একটা বিষয় মানতেই হবে যে গ্রামীণ গণতন্ত্র নিজের মুঠোয় আনার প্রাথমিক পরীক্ষায় কিন্তু কর্পোরেট সফল। সেই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে তারা এইবার বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের উদ্দেশ্য যাচাই করে নিতে চাইছে। ভবিষ্যতে সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রাস করে নেওয়ার সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না।

কেরলের পরীক্ষাগারে সাফল্য লাভ করেই নতুন মতলব ভাঁজা শুরু হয়ে গেছে। এবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই নিলামে চড়ানোর পরীক্ষা শুরু হল। ২০২১-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত মহারাষ্ট্রের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই নতুন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ আসে যে বেশ কয়েকটি জেলার অনেক গ্রাম পঞ্চায়েতের জন্য মাত্র একজন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। খোঁজ করতেই পুরো ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে চলে আসে। পুনে জেলার ৭৪৬-টি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে ৮১-টিতে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। নন্দরবার জেলায় ৮৭-টির মধ্যে ২২-টিতে এমন ঘটনা ঘটেছে। বীড় জেলার ১২৯-টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৮-টিতে একজনের বেশি মনোনয়ন পত্র দাখিল করেননি। কোলাপুর জেলায় মোট ৪৩৩-টি গ্রাম পঞ্চায়েত। তার মধ্যে ৪৭-টি আসনে একজন প্রার্থী। আর লাতুর জেলায় ৪০১-টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ২৫-টিতে একজনের বেশি প্রার্থী নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এলাকার এই জেলাগুলোতে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয়। ২০১৮-র মুম্বাই অভিযান এবং বর্তমানে চলমান কৃষক আন্দোলনে বিদর্ভ এলাকার কৃষক সংগঠনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

রাজ্য নির্বাচন কমিশন এখনও পর্যন্ত মাত্র দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচন বাতিল করেছে। নাসিক ও নন্দরবার জেলার একটি করে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে একজন প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র দাখিলের কারণে বাতিল করা হয়েছে। অভিযোগ অনেক এলেও এই দুটি গ্রামের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের আসন নিলাম প্রক্রিয়ার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। অন্যগুলোর জন্য সরকারি স্তরে তদন্ত চলছে।

নিলাম প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ। গ্রামের মাতব্বর ব্যক্তিরা সমবেত হয়ে স্থির করেন যে পরের পাঁচ বছরে গ্রামের কোন বাসিন্দা গ্রামের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ দর দেওয়ার কথা বলেন তিনিই পেয়ে যান গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার ছাড়পত্র। এর বিরোধিতা করার সাহস এবং ক্ষমতা কোনো গ্রামবাসীর নেই। বিরোধিতা করলে সামাজিক বর্জন দিয়ে শুরু করার পর প্রতিবাদকারী এবং তাঁর পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

নিলামের দর কেমন চলছে? সবগুলো জানা যায়নি। যে দুটো গ্রামের নির্বাচন বাতিল হয়েছে তার একটির জন্য সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ২ কোটি টাকা। অন্যটির ৪৬ লক্ষ।

মজার ব্যাপার হলো যিনি নিলামে সর্বোচ্চ দর হাঁকেন তিনি কিন্তু মাতব্বরদের সমাবেশে অনুপস্থিত। তবে কথার নড়চড় নেই। কোনো কারণে নিলামে জয়ী ব্যক্তি মনোনয়ন পত্র জমা দিতে না পারলে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। মোদ্দা কথা একবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে তা কার্যকর হবেই হবে।

নিলামে যিনি গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচিত হবেন বা হলেন তিনি তো আর ঘরের টাকায় গ্রামের সেবা করবেন না! নিলামে জমা দেওয়া টাকা বা বিনিয়োগ ঘরে ফিরিয়ে আনাই হবে তাঁর প্রথম কাজ। যাঁরা এমন নিলামের আয়োজক তাঁরাও সেটা ভালো করে জানেন। দুর্নীতি ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রথমেই দুর্নীতিকে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অধোনমন এবং প্রাতিষ্ঠানিক তথা সামাজিক দুর্নীতির স্বীকৃতি দেওয়ার এই পরীক্ষা নিঃসন্দেহে একেবারেই নতুন। কেরলের কর্পোরেট পঞ্চায়েতের সাফল্য এবং মহারাষ্ট্রের পঞ্চায়েতের নিলামে বিক্রি কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই বিপদজনক প্রবণতা বন্ধ করার জন্য এখনই সোচ্চার না হলে ভবিষ্যতে কিন্তু সারা দেশে সমস্ত স্তরেই গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে।