আরেক রকম ● নবম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ মাঘ, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

সত্যমেব জয়তে


৬ জানুয়ারি ২০২১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি কলঙ্কময় দিন। সেদিন যখন মার্কিন সংসদ আক্রমণ করে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সমর্থকদের দল। তারা মনে করেছিল যে ট্রাম্পকে অন্যায়ভাবে পরাজিত করা হয়েছে, আসলে নাকি ট্রাম্প জিতেছেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প নির্বাচনের শুরু থেকেই বলে আসছিলেন যে এই নির্বাচনের একটিই ফলাফল গ্রহণীয় - তিনি জিতছেন। অন্য যে-কোনো ফলাফল এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ যেখানে ভুয়ো ভোটারদের মাধ্যমে ডেমোক্রাটিক পার্টি জিত হাসিল করবে। সত্যিই যখন ফলাফল তাঁর বিরুদ্ধে গেল, তারপরেও এই প্রচারে কোনো লাগাম টানা হল না, একের পর এক মামলা মার্কিন কোর্ট ছুড়ে ফেলে দিল, তবু প্রচার চলল যে ট্রাম্প হারেননি। সেদিন যারা মার্কিন সংসদ দখল করতে আক্রমণ চালিয়েছিল তারা কোনো গর্হিত অপরাধ করছে বলে তারা মনে করেনি। বরং তারা ভেবেছিল তারা দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে দেশপ্রেমিকের কাজ করছে। তারা মনে করেছিল তারাই সত্যের পক্ষে।

এবারে আসুন আমাদের দেশে। ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের ভিতর জোর করে রামের মূর্তি বসানো হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই কথা লেখা আছে। বাবরি মসজিদের নিচে কোনো হিন্দু মন্দিরের অবশেষ পাওয়া যায়নি। কোনো রাম মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ বানানো হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। অথচ ১৯৯২ সালে হিন্দুত্ববাদীদের ধ্বংসাত্মক আন্দোলন সেই বাবরি মসজিদকে গুড়িয়ে দিল মাটিতে। একটি মিথ্যের উপর ভর করে ভারতের ইতিহাস পরিবর্তনকারী একটি বিধ্বংসী আন্দোলন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিতকেই নড়িয়ে দিয়েছে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে লাখো হোয়াট্‌সআ্যাপ পোস্ট - মুসলমানদের তোষণ করা হচ্ছে, মুসলমানরা দেশের শত্রু, রবীন্দ্রনাথও নাকি মুসলমান বিরোধী ছিলেন, ইত্যাদি। মানুষ বিশ্বাস করছেন, মিথ্যাবাদীদের দলে নাম লেখাচ্ছেন, এক উগ্র দেশপ্রেমের নামে ভারতের সংখ্যালঘু মানুষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন, পিটিয়ে মারতেও দ্বিধা করছেন না তারা। মিথ্যার অন্ধকার আজ ঢেকে দিয়েছে সত্যের সূর্যকে। সত্য কী, মিথ্যা কোনটি মানুষ যেন তার খেই হারিয়ে ফেলেছে। চলছে মিথ্যার আশ্রয়ে বিদ্বেষপূর্ণ আন্দোলন যা ভারতের আত্মার যে বিবিধের মাঝে ঐক্যের বাণী তার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে।

মিথ্যার এই নবকলেবরে বিশালাকার অবতারকেই বলা হচ্ছে পোস্ট ট্রুথ দুনিয়া। সত্য উত্তর দুনিয়ায় কোনটা সত্যি, কোন তথ্যটি সঠিক, কোনটি মিথ্যা তা আর বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ টিমোথি স্নাইডার বিশ্লেষণ করে বলছেন আসলে পোস্ট ট্রুথ হল প্রাক-ফ্যাসিবাদী একটি সামাজিক অবস্থা। ফ্যাসিবাদের জন্ম হয় পোস্ট ট্রুথ বা মিথ্যার জঠরে। একদিনে ইহুদীদের হত্যা করার জন্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প গড়ে ওঠেনি। লাগাতার সংবাদমাধ্যমে, সমাজে, যে বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল ইহুদীদের বিরুদ্ধে তার পরিণতি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। কাজেই আজ যারা ভারতে বসে ভাবছেন যে আখলাখকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা নিয়ে এত হইচই করার কিছু নেই বা মুসলমান অনুপ্রবেশ নিয়ে দিলীপ ঘোষ বা অমিত শাহ যা বলছেন তা রাজনীতিবিদদের স্বাভাবিক প্রগলভতার পরিচয় তারা ভুল ভাবছেন। এই মিথ্যার আশ্রয়ে দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেই ঘৃণা লাগাতার প্রচারিত হয়ে চলেছে তার পরিণতি সাংঘাতিক হতে পারে যদি না তাকে অবিলম্বে রোখা যায়।

এই রুখে দেওয়ার খেলা সহজ নয়। ব্যক্তি মানুষের কাছে তথ্যের পরিমাণ সীমিত। বিভিন্ন স্থান থেকে সে তথ্য পায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেই তথ্যকে ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে। গণতান্ত্রিক উদারবাদী পুঁজিবাদের মধ্যে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল তাদের দায়িত্ব ছিল সঠিক তথ্য যাতে পরিবেশিত হয় তা সুনিশ্চিত করা। যেমন একের পর ফেক নিউজের ঘটনা দেশে ঘটে গেলেও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ তার বিরুদ্ধে দেখা যায়নি। সংসদ, পুলিশ-প্রশাসন বা আদালত কেউই মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যকে তুলে ধরা বা মিথ্যাকে বেআইনি ঘোষিত করার মতন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি এমন ঘটনাও ঘটছে যেখানে সত্যবাদী সাংবাদিকদের পোরা হচ্ছে জেলে - সত্য পরিবেশনের জন্য। সত্যমেব জয়তে শুধু ভারতের জাতীয় প্রতীকে লেখা কিছু কথা হিসেবেই রয়ে গেছে, দেশের সমাজ বা রাজনীতিতে তার আর কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে হচ্ছে না।

তবু প্রশ্ন তুলতেই হয়, কেন এত মানুষ মিথ্যা তথ্যকে বিশ্বাস করছেন? কেন ক্যাপিটলের আক্রমণকারীরা মনে করছেন যে তারাই সত্যের পথে রয়েছেন, কেন বহু ভারতীয় হিন্দু মনে করে যে বাবরি মসজিদ রাম মন্দির ভেঙেই তৈরি হয়েছিল? এর কারণ জটিল। প্রাথমিকভাবে যেটা বোঝার যে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হোক বা ভারত বা তুর্কি, সব দেশেই মানুষকে বোঝানো হয়েছিল যে এই গণতান্ত্রিক উদারনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই সর্বস্তরের মানুষের উন্নতি সাধন হবে। অথচ হয়েছে তার বিপরীত। ধনী আরো ধনী হয়েছে, গরীব আরো গরীব। মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থানের দাবি আদায় হয়নি। বরং রাষ্ট্র সমস্ত ক্ষেত্র থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাতেই লাভবান হয়েছে এক শ্রেণির মানুষ। সাধারণ মানুষ দেখছে এই এলিট সম্প্রদায় নিজেদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি ঘটিয়েছে, তারাই আবার রাজনীতিবিদ, পুলিশ অফিসার, প্রশাসক, বিচারপতি। মানুষের মনে তাই এই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে তবে কি এই ব্যবস্থায় যারা সুবিধাভোগ করলেন তারাই গণতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির শীর্ষে থেকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা করছে? বাম আন্দোলন বিবিধ কারণে, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে দিশাহারা, হীনবল। এই পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জীবনের এই নিত্যনৈমিত্তিক হতাশা থেকে যে রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠছে তার জবাব আসছে জনপ্রিয়তা মূলক দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদদের হাত ধরে।

তারা বলছেন যে হ্যাঁ এই এলিট সম্প্রদায় সমস্ত সমস্যার মূলে। কিন্তু ‘আমি’ এই এলিটদের অংশ নই, আমি বহিরাগত। তাই আমিই পারি এদের শায়েস্তা করতে। ট্রাম্প প্রথাগত রাজনীতিবিদ নন, মোদী নিজেকে চা-ওয়ালা পরিচয় দিয়ে এই বহিরাগত সত্ত্বাকেই মানুষের সামনে হাজির করতে চেয়েছেন। আমিই জনগণের একমাত্র ত্রাতা, আমিই জনগণের সমস্যা বুঝি এবং তার সমাধান করতে পারি, তাই আমিই তথ্যের একমাত্র উৎস। বাকি যা তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে তা ভুয়ো এবং ষড়যন্ত্রমূলক। তবে এই পরিবর্তন করতে হলে প্রয়োজন হয় একটি মতাদর্শের। এখানে জাতীয়তাবাদকে নিজেদের মতাদর্শ হিসেবে হাজির করেছেন ট্রাম্প বা মোদী। জনগণের বিবিধতাকে একটি একমাত্রিক জনগণের ধারণার মধ্যে অবলুপ্ত করা হয়েছে। মুখে বলা হচ্ছে যে জনগণের বিরুদ্ধে যারা তাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন মোদী বা ট্রাম্প। কিন্তু আসলে যা বোঝানো হচ্ছে তা হল জনগণ মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাদা চামড়ার মানুষ এবং ভারতে হিন্দু। একটি সংকীর্ণ পরিচিতিকে জনগণের পরিচিতির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যার ফলে সৃষ্টি করা হচ্ছে এক অপর সত্ত্বার যা স্থান বিশেষে কোথাও কালো মানুষ, আর কোথাও মুসলমান।

এই প্রক্রিয়ায় যথারীতি পুঁজিপতি এবং ধনী সমাজ দ্বিধাহীনভাবে এই জনপ্রিয়তাবাদী নেতৃত্বের পক্ষে। মিডিয়ার মালিকরা পরিণত হয়েছে মোদীর পোষ্যতে। তাই লাগাতার মিডিয়ার মাধ্যমে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে একপেশে খবর। মানুষের মনে তার প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোশাল মিডিয়ায় প্রচুর টাকা খরচ করে নিজেদের কথাকে বহু সংখ্যক মানুষের সামনে লাগাতার হাজির করা হচ্ছে। সোশাল মিডিয়ায় আপনি যেই ধরনের পোস্ট লাইক করেন বা শেয়ার করেন, সেই পোস্টগুলিই বেশি করে আপনার কাছে আসবে। আবার যারা নিজেদের পোস্টের পেছেনে ফেসবুক বা টুইটারকে বেশি টাকা দেবেন তাদের পোস্ট বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। এই দুইয়ের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় সোশাল মিডিয়ায় আসলে আমরা যেই পোস্টগুলি পড়তে পাই তা আমাদেরই মনের প্রতিবিম্ব যা আসলে নিয়ন্ত্রণ করছে ফেসবুক এবং তার পৃষ্ঠপোষকরা। তাই ভিন্ন মত আর আমাদের সামনে ফুটে ওঠে না ফেসবুকে। লাগাতার আমরা যা দেখতে চাই বা দেখতে অভ্যস্ত তাই আমাদের দেখানো হয়। ফলে মানুষ নিজের নিজের বিশ্বাসে তৈরি বুদবুদে বাস করতে শুরু করে। এবং সেই বুদবুদই আমাদের দুনিয়া হয়ে ওঠে, অন্য মত আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় না, পৌঁছলেও ট্রোলরা এসে তাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে।

অতএব সত্যের জন্য লড়াই আজ গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই। সত্যের জয় হবেই কথাটি অর্ধসত্য। সত্যের জয়ের জন্য এই সমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন দরকার। একমাত্র সেই প্রতিস্পর্ধার রাজনীতির মাধ্যমেই সত্যের জয় হবে। তাই বিকল্প মিডিয়াকে উৎসাহ দেওয়া নিজেদের মতন মিডিয়া তৈরি করা, সমস্ত স্তরে সঠিক তথ্য সংবলিত কথা মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া আজ প্রগতিশীল রাজনীতির কর্তব্য। সত্যমেব জয়তে তাই আজ শুধু ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক নয় হয়ে উঠুক প্রগতিশীল বাম রাজনীতির স্লোগান।