আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

একটি আরেক রকম বই

শুভময় মৈত্র




সম্প্রতি এভেনেল প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লিম্পসেস’ নামের বইটি। দাম ভারতীয় মুদ্রায় ২,৫০০, মার্কিন ডলারে চল্লিশ। এই লেখায় যখন অক্ষর জুড়ছি, তখনও অন্তর্জালে আমাজন অববাহিকায় বইটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অতিমারী আক্রান্ত ২০২০-র শেষের দিকে হাতে পাওয়া (যদিও প্রকাশনা তারিখ পয়লা জানুয়ারি, ২০২০) এই বইটির প্রতিটি পাতায় মিলবে বাংলা আর ইংরিজিতে লেখা কিছু কথা, আলোকচিত্র, আর কিছুটা স্বস্তি। কারণ এই বইতে কোভিড নেই। বাংলা ছবি-লেখার জগতে বেশ অভিনব সংযোজন এই প্রচেষ্টা। অবশ্যই অসম্পূর্ণতা কিছু আছে, তবে সেসব ছাপিয়ে মসৃণ এই পাতাগুলি অন্য ধরনের এক বার্তা বয়ে আনে। সে বার্তা একান্তভাবেই লেখকের। শেষ পাতার ভেতরের দিকে পরিচিতিতে খুঁজে পাওয়া যায় পরমেশ গোস্বামীকে। বর্ধমানের মানুষ। পড়াশোনায় অসাধারণ, কারণ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন আইআইটি খড়গপুর থেকে। লেখালেখির শখ বহু বছরের। ভাবেন প্রকৃতি এবং পরিবেশ নিয়ে। ১৬৬ পাতার প্রতিটিতেই ছবি লিখেছেন আলোকচিত্রে, কথা এঁকেছেন বাংলা আর ইংরিজিতে। ছবি বিষয়টি ভাষাতীত। তা কোনোদিনই দেশকালের গণ্ডি মানে না। এখানেও সেকথা সত্যি। সম্ভবত ছবিগুলির উপর ধারাভাষ্য ও তার আঙ্গিকের আবেদন অবাঙালিদের কাছেও পৌঁছে দিতে চেয়েছেন লেখক। তাই প্রতি পাতার ধারাভাষ্য ইংরেজিতে, নিচে তার বাংলা তর্জমা। সেই দিক থেকে বইটি দ্বিভাষিক। অন্য ভাষাটি যেহেতু ইংরিজি, তাই পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের পক্ষেই বইটি সরাসরি পাঠযোগ্য। বইটির গঠন বিলিতি পরিভাষায় হার্ডকভার। এর আকৃতি এবং পাতায় পাতায় ছবির প্রাধান্য দেখে পাঠকের মনে অবধারিতভাবে একটি কফি টেবল বুকের কথা মনে আসবে।

বইটির পরিচয় দিয়ে সাহেবভাষায় জ্যাকেটে যা লেখা আছে তার বঙ্গানুবাদ অনেকটা এরকম - ‘‘রাস্তায় চলতে চলতে ক’জনই বা পথপার্শ্বের দৃশ্য দেখেন? সম্ভবত আমরা প্রত্যেকেই দেখি, তবে অবশ্য যখন বিশেষ তাড়া থাকে না তখনই। এসব স্মরণে রাখবার বিষয় নয়। কখনও কখনও দৃশ্যগুলো মনের মধ্যে আপনিই জায়গা করে নেয়। সে দৃশ্য হতে পারে কোনো শিশুর দিকে চেয়ে থাকা, হতে পারে কোনো ব্যক্তির ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কিংবা হতে পারে ঝড়ের আগে আকাশে মেঘ জমা হয়ে ওঠা। অকস্মাৎ পরিপার্শ্বকে ভুলিয়ে দিয়ে সেই দৃশ্য মনোজগতের সবটুকুকে অধিকার করে নেয়। তখন আমাদের তা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় কোন এক বাস্তবের, যা এতদিন দেখেও দেখা হয় নি। ‘গ্লিম্পসেস’ বইটিতে পরমেশ গোস্বামী চলার পথে এইরকম সব ছবি দেখেছেন আর তা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন ধারাভাষ্য সহযোগে। অর্থাৎ এটি নাটক নভেলের মতো এক নিঃশ্বাসে পড়ার বই নয়।’’ প্রকাশকের মত মেনে নিয়ে একথা বলাই যায় যে-কোন পাতা উল্টে পড়তে পারি এই বই। ধারাবাহিকতার দায় নেই, কারণ প্রতিটি পাতাই এখানে স্বাধীন। ১৬৬ পাতার এই বইটির প্রথম পৃষ্ঠা শুরু হয়েছে ‘‘বিশ্রাম’’ দিয়ে, অন্তিম পৃষ্ঠা শেষ হয়েছে ‘‘আমিই জগৎ’’ শুনিয়ে। প্রতিটি পাতাই যেন এক একটি স্বতন্ত্র অণুগ্রন্থের মতো। এ যেন এক প্রাসাদ, যার ১৬৬টি জানালা। পাঠক ইচ্ছামতো একের পর এক খুলতে পারেন, কখনও পরপর, কখনও বা যদৃচ্ছ, এলোমেলো।

মলাট দেখে বইয়ের বিচার করা কঠিন। একথা পরমেশ গোস্বামীর ‘গ্লিম্পসেস’-এর ক্ষেত্রে অনেকটাই খেটে যায়। প্রথম দর্শনে মনে হয় ‘কফি-টেবিল’ বই। পাঁচতারা হোটেল বা সম্পন্নের বৈঠকখানায় কফি টেবিলের উপর যেমন বই সাজানো থাকে যা কিনা দৃষ্টিনন্দন। তবে পাতা ওলটালে সেই ধরনের বইয়ের ভেতরে কখনও অন্তঃসারশূন্যতার ছোঁয়া মেলে, কখনও শুধু বাহ্যিক রূপ দেখে ঠকতে হয়। এই বইটি কিন্তু অনেকটাই অন্য কথা বলে। মলাট উল্টে একবার ‘গ্লিম্পসেস’-এর ভিতরে ঢুকলে অন্য দুনিয়া - গভীর, কখনও বা গম্ভীর কিন্তু একেবারেই ধোঁয়াটে নয়। বিকেলের অদ্ভুত আলোয় পাঠকের যদি দলছুট হতে ইচ্ছে করে, তাহলে এই বই তাঁকে স্পর্শ করবেই। পাঠিকার চিত্তে যদি ‘যারে যায় না পাওয়া তারই হাওয়া’ ছুঁয়ে যায়, তাঁর আঁচল হয়ত সামান্য দুলিয়ে দিয়ে ভেসে বেড়াবে এই বইয়ের ধারাভাষ্য। বইটির প্রতি পাতায় আছে দুটি সংক্ষিপ্ত পর্ব - প্রথমে একটি ছবি, তারপর নিচে ইংরাজি আর বাংলায় কিছু কথা - সেগুলি আছে আপন আপন বর্ণমালায়, আপন আপন অক্ষরে। শুধু লেখক নয়, সাধুবাদ প্রাপ্য লেখক ছাড়াও অন্যান্য চিত্রগ্রাহকের, যাদের নাম আছে ভিন্ন ভিন্ন ছবির নিচে। সাধুবাদ প্রাপ্য ছাপাখানার সেই শিল্পীর, যিনি ছাপিয়েছেন এই বই।

বইটির প্রতি পাতায় লেখক একজন দর্শক। তাঁর ভাবনায় আসে সেই ছবির বর্ণনা। সাধারণ দৃশ্য প্রাণময় হয়ে ওঠে সরলতম বর্ণনায়। আগেই বলেছি, বইয়ের এক পাতার সঙ্গে অন্য পাতার বক্তব্য বিষয়ে কোনো বাহ্য মিল নেই। অথচ এক পাতার সঙ্গে অন্য পাতার রয়েছে এক প্রগাঢ় সম্পর্ক, অশ্বত্থের গায়ে জড়িয়ে থাকা বনলতার মত। এক পাতার ছবিতে দুই যাত্রী বাংলার এক অনামী রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছেন, তো আরেক পাতায় একলা কোনো মানুষ চলেছেন কুয়াশা ঢাকা সবুজ এক পথ বেয়ে ইউরোপের কোনো এক অনামী গ্রামে। এই আপাত তফাৎ সত্ত্বেও লেখক বুনছেন এক বিনা সুতোর মালা। সম্ভবত তিনি সুর মেলাতে চাইছেন, জাগাতে চাইছেন অজানার খোঁজ। সেই বোধে ছেয়ে আছে ‘গ্লিম্পসেস’-এর প্রতিটি পাতা, পাঠককে যা বেঁধে ফেলতে পারে এক মোলায়েম পাটদড়িতে। যে পাঠক-পাঠিকা স্বেছায় দলছুট, ‘গ্লিম্পসেস’ হাতে তিনি শরিক হতে পারেন এক অদ্ভুত যাত্রার। নমুনা হিসেবে তুলে ধরা যাক লেখকের ধারাভাষ্য। এক অতি সাধারণ বিষয় হল ‘রুটিন’। তাই নিয়ে শিরোনাম ‘‘লিমিটস অফ রুটিন’’। ছবিতে জানালার কাঁচের মধ্যে দিয়ে ফাঁকা মাঠ, সবুজে ঢাকা, দূরে একটা টালির বাড়ি। এই নিয়ে বইটির দ্বিতীয় পাতায় তিনি লিখছেন, ‘‘জানালা দিয়ে হঠাৎ দৃষ্টি চলে যাওয়াটা নিয়ম মেনে হয় না। সেই হঠাৎ-দৃষ্টির মধ্যে রুটিনের ছেদ আছে। রুটিনের মধ্যে থেকে চোখ নতুন কিছু দেখতে পায় না। পৌনঃপুনিকতা মানুষকে অসংবেদী করে তোলে। নতুন সংবেদন, অর্থাৎ সৃষ্টি, তখনই সম্ভব হয় যখন একটি ক্ষণে এসে ধারাবাহিকের বিনাশ হয়। তখন আকস্মিক জায়গা পায়। সৃষ্টি আকস্মিক। ধারাবাহিক কেবল ইনিয়েবিনিয়ে পুরনোকে পুনর্নির্মাণ করতে পারে, নতুনকে সৃষ্টি করতে পারে না।’’ কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে রবিবাবুর আবছায়া?

সোজা কথায়, পাঠক যদি এমন এক বই চান যা তিনি যে-কোনো মুহূর্তে যে-কোনো অংশ থেকে পড়ে ফেলতে পারেন, যদি ছোট্ট একটি অংশ পাঠেই এক সামগ্রিক চিত্রের সন্ধান খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছে থাকে, তাহলে এ বই বেশ ভালো লাগার কথা। এ যেন দৃশ্যমান জগত-জীবনের এক সহজ পাঠ। লেখক এক একটি দৃশ্যপট জুড়েছেন আলোকচিত্রে, আর মানসপটে তাঁর ব্যঞ্জনাকে ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই রূপদান করেছেন। লেখকের বসার ঘরের জানালা থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া দৃষ্টি, আবার পরক্ষণেই অতীতের ভ্রমণ পিপাসু লেখকের ইউরোপ ডায়েরি থেকে তুলে আনা কোনো স্মৃতিচিত্র। নানা ভাবনা আখ্যায়িত হয়েছে পরমেশবাবুর কথাছবিতে। সেই সূত্রে বাধাহীনভাবে প্রকাশ পেয়েছে রবি ঠাকুরের আঁকা ছবির আলোকচিত্রও।

তবে যে কোন সৃষ্টিতে কিছু দুর্বলতা থাকবেই। গ্রন্থ সমালোচনায় একটা রুটিন কাজ সেরকম কিছু খুঁত খুঁজে বার করা। যেমন ১০৪ পাতায় ফাঁকা রেলস্টেশনের ছবি দিয়ে লেখা ‘‘এই ছোট্ট স্টেশনে ট্রেন থেকে নামেনি কেউ’’। অসাধারণ সরল কয়েকটি শব্দ। পাশে একটা পুকুরের ছবি। সেই প্রসঙ্গে লেখা, ‘‘ওই পুকুরের শান্ত জল, তার ওপরে বিম্বিত নীলাকাশ, আর মহিলাদের ওই স্নানরত দৃশ্য মুহূর্তকে ধারণ করে আছে, অনন্তকে ধারণ করে আছে।’’ ছবিতে বেশ খুঁটিয়ে দেখেও স্নানরত কোনো দৃশ্য সেভাবে খুঁজে পাওয়া গেল না (কোভিদকালে গ্রন্থ সমালোচকের প্রায় বছরখানেক চক্ষু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি), এবং সেটা এই ছবির মুখ্য বিষয়ও নয়। বরং আলোকচিত্রে অনেক বেশি আবেদন আনে ফাঁকা সাদা সিমেন্টের রেলস্টেশন। পরের পাতাতেই কিছু ছাগল, ভেড়া, গরুর সঙ্গে লাঠি হাতে এক মহিলার ছবি, যাকে লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন ‘‘রাখালী’’ শব্দে। কিন্তু এ ছবিতে গ্রাম্যতা কম, কারণ রাখালীর ডান দিকে একটি আস্ত মোটরবাইক রসভঙ্গের কারণ ঘটিয়েছে। একাধিকবার ইউরোপ ভ্রমণ করা লেখক কি কল্পনায় প্রথম বিশ্বের গ্রাম আঁকতে চান? নাকি উন্নত বঙ্গের বিজ্ঞাপন, যেখানে প্রত্যন্ত গ্রামেও দুয়েকটা মোটরবাইক থাকে! এই ছবিটির সঙ্গে সাজানো ইংরিজি বা বাংলা বাক্যমালাতেও প্রাণের টান কম। এমনটা অবশ্য হতেই পারে যে এইরকম গাদ্যিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে সচেতনভাবে। গ্রামীণ জীবনকে নিয়ে শহুরে মন যে সস্তা রোম্যান্টিসিজমকে উস্কে তোলে, তার প্রতিকার হিসেবে কি এই শব্দচয়ন? এই ফ্ল্যাটনেস অফ ডেস্ক্রিপশন? দ্বিভাষিক বই হওয়ায় বোঝা যায় না ভাষান্তরের ত্রুটি ইচ্ছাকৃত, নাকি কয়েকটি ক্ষেত্রে তা ভাষাগত দুর্বলতা। সঙ্গে একথাও বলতে হয় যে গোটা বইটিতে সবকটি ছবির মান সমান নয়। আলোকচিত্রের আলোচনা কিংবা সমালোচনা করা এ অধমের পক্ষে শক্ত। তবে কিছু ছবি ভালো লেগেছে বেশ, কিছু ততটা নয়। ভালোর দিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সৈরিক সেনগুপ্তের তোলা কিছু ছবির। ১৫৬ নম্বর পাতায় ‘‘লুমিনাস এন্ডিং’’ অসাধারণ, আর তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত লেখকের, ‘‘অস্তসূর্যের প্রভা সেই অমেয়র ঐশ্বর্যে পূর্ণ।’’

সব মিলিয়ে এই বইটি মনে রাখার মত। অন্যরকম এবং আরেক রকম। বড়লোকের আপ্যায়নঘর থেকে মধ্যবিত্তের যত্নে সাজানো বুককেস, মানিয়ে যাবে সবেতেই। দামটা একটু বেশি, তবে গ্রন্থের পেলব স্পর্শ পেতে সে যাতনা সইতেই হবে। সঙ্গে নতুন বইয়ের গন্ধ ফ্রি।


Book Name: Glimpses
Author: Paramesh Goswami
Publisher: AVENEL PRESS
Publication Date: 1 January, 2020
Language: English/Bengali
Price: INR 2500, US$ 40 (Price at Amazon: INR 2250)