আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষায় অন্নদাতা কিষান রাস্তায়

অম্বিকেশ মহাপাত্র


‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় -
আমি যেই দিকেতে চাই, দেখে অবাক বনে যাই -
আমি অর্থ কোনো খুঁজে নাহি পাইরে -
ও ভাই, অর্থ কোনো খুঁজে নাহি পাইরে।’

‘দেখ, ভালো জনে রইল ভাঙ্গা ঘরে
মন্দ যে সে, সিংহাসনে চড়ে।
ও ভাই, সোনার ফসল ফলায় যে তার
দুইবেলা জোটে না আহার।’

‘হীরার খনির মজুর হয়ে, কানাকড়ি নাই,
ও ভাই, হীরার খনির মজুর হয়ে, কানাকড়ি নাই,
ও তার কানাকড়ি নাই।
ওরে ভাইরে, ওরে ভাইরে, ভাইরে - কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।’

গানের কথাগুলি আমার নয়। কথাগুলি কার? চরণ দাসের। কে সেই চরণ দাস? অস্কার বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’-র চরণ দাস। উপরোক্ত কথাগুলি চরণ দাসের গানের অংশ বিশেষ। চরণ দাসের কথায় - ‘যবে থেকেই জ্ঞান, তবে থেকেই গান’। ‘জ্ঞান আর গান’চরণ দাসের ক্ষেত্রে সমার্থক।‘হীরক রাজার দেশে’ চরণ দাসের কীউপহার জুটেছিল, মনে পড়ে?‘হাত-পা-মুখ বেঁধে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে গর্তে নিক্ষেপ’ করা হয়েছিল।

মানুষের জীবনধারণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রাথমিক চাহিদা অতি অবশ্যই খাদ্য বা অন্ন। উল্লেখ্য - ‘পেটে খেলে পিঠে সয়, এতো কভু মিছে নয়’। তারপর বাকী চার - বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা। মানুষের প্রাথমিক মৌলিক চাহিদা খাদ্য বা অন্ন কে যোগান?কিষান। সেকারণেই কিষান বন্ধুদের বলা হয় ‘অন্নদাতা’।প্রাসঙ্গিকতায়প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর স্লোগান উল্লেখ্য - ‘জয় জওয়ান, জয় কিষান’। কী তার তাৎপর্য? দেশ রক্ষায় সীমান্তে জওয়ান - ‘জয় জওয়ান’এবং দেশবাসীর পেট ভরাতে কিষান - ‘জয় কিষান’। আপনি যে পেশায় থাকুন না কেন, আপনি যতই ধনশালী হোন না কেন, আপনি যত শিক্ষিতই হোন না কেন, আপনি যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন, দিনের শুরুতে আপনার পেটের খিদে মেটাতে চাই খাদ্য। ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা, হীরে-গয়না, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বংশ-পরিচয় আপনার পেট ভরাবে না।পেট ভরাতে খাদ্য সামগ্রীই চাই। সেই খাদ্য সামগ্রী খেতে-খামারে উৎপাদন করেন ১৩৪ কোটি দেশবাসীর মধ্যে প্রায় ৬২ কোটি কিষান। কিষান শুধু নিজেদের পরিবারের জন্যে রোদে পুড়ে জলে ভিজে দিনরাত এক করে ঘাম ঝরিয়ে মেহনত করে ফসল ফলান না, খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন করেন না। আমার-আপনার-তথা-দেশবাসীর এমনকি বিশ্ববাসীর পেট ভরানোর দায়িত্ব পালন করেন, পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তোলেন। এখানেই প্রাসঙ্গিক ‘হীরক রাজার দেশে’-র চরণ দাসের জ্ঞান থেকে গাওয়া গানের কথাগুলো - ‘দেখ, ভালো জনে রইল ভাঙ্গা ঘরে; মন্দ যে সে, সিংহাসনে চড়ে। সোনার ফসল ফলায় যে তার; দুইবেলা জোটে না আহার।’

আমাদের দেশের একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা কিষান আত্মহত্যা; বর্তমানে দিনে গড়ে ৩৮১ জন! কিষান কেন আত্মহত্যা করেন? এমনকি খেত-ভর্তি সোনালী ফসলকে স্বাক্ষী রেখে, খেতের পাশে! আত্মহত্যার নানান কারণ - ঋণের ফাঁদ, ফসলের দাম না পাওয়া, বন্যা-খরা-মড়ক-প্রাকৃতিক বিপর্যয়... ইত্যাদি। ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ ভারতবর্ষের ভূমি বৈচিত্র্য, জলবায়ু বৈচিত্র্য, কৃষি বৈচিত্র্য... ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে ড. এম এস স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট সহ সুপারিশ।অন্নদাতা কিষান সহ কৃষি বৈচিত্র্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় নানান সুপারিশ। দেশের ছোট বড় প্রায় ৫০০ কিষান সংগঠন স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করার দাবিতে সরব হয়েছেন, বারে বারে। সকল রাজনৈতিক দল সুপারিশগুলি কার্যকর করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিলেও, কার্যকর হয়নি! না হওয়ায় ‘অন্নদাতা কিষান’ যে তিমিরে সেই তিমিরেই? না কৃষি সমস্যা আজ সংকটে! সংকট এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, এক্ষেত্রেও দাঁড়িয়ে নেই। বেড়ে চলেছেকিষানের অসহায়তা, দুর্দশা এবং তার সঙ্গেকিষান আত্মহত্যার হার!

রাজ্যের এবং দেশের নির্বাচিত সরকারের কাছে অন্নদাতা কিষানদের ন্যূনতম, যুক্তিসঙ্গত এবং ন্যায়সঙ্গত দাবি - ‘ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ আর ‘খরা-বন্যা-প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল হানির জন্যে ফসল বীমার নিরাপত্তা’। পাশাপাশি দেশবাসীর চাহিদা - জীবনধারণের জন্যে ‘বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উচিৎ দাম’ এবং প্রয়োজনে গরীব মানুষের কাছে‘রেশন দোকানের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পৌঁছে দেওয়া’। যাতে কোনো দেশবাসীকে অনাহারে থাকতে না হয়। কোন দেশবাসীকে খালি পেটে ঘুমোতে যেতে না হয়। সেকারণেই দেশের এবং রাজ্যের সরকার সম্পর্কে বলা হয় - ‘by the people, of the people and for the people’।

২০২০ সাল, কার্যতঃ বছরভর, নব্য করোনা ভাইরাস আগমনেরকারণে সারা দেশের জনগণ অভূতপূর্বএবং নজিরবিহীন অতিমারীর আবহে।সঙ্গে অজানা আতঙ্ক, দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বাস্থ্যবিধি। মোকাবেলায় নেই প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ, তারসঙ্গেঅপরিকল্পিত ও আচমকা লকডাউন!রাস্তাঘাট, দোকানপাট, অফিস-কাছারি, আইন-আদালত, জমায়েত সহ বহু কিছুতে নানান বিধি-নিষেধ। গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রের পীঠস্থান আইনসভাগুলিও (বিধানসভা, লোকসভা ওরাজ্যসভা) কার্যত বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে রাতের অন্ধকারে জুন মাসে, যখন দেশবাসী ঘরবন্দি সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েদেশের সরকার কিষানদের জন্যে তিনটি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারী করলেন। পাশাপাশি শ্রমিক-বিরোধী আইন, শিক্ষা-বিরোধী শিক্ষানীতি পাস করেছেন। এরপরেই তড়িঘড়ি সেপ্টেম্বর মাসের শেষভাগে কিষান সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া, রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া (উল্লেখ্য, সংবিধান অনুযায়ী ‘কৃষি’ রাজ্য তালিকাভুক্ত), সংসদের উভয়কক্ষে বিস্তারিত আলোচনা ছাড়া, সাংবিধানিক প্রথা অমান্য করে কৃষি সংক্রান্ত তিনটি বিল (আদৌ কি কৃষি সম্পর্কিত?) জবরদস্তি পাস করানো হল, সম্পূর্ণ ফ্যাসিস্ত কায়দায়। এই অবস্থায় দেশব্যাপী কিষান সংগঠনগুলি এবং বিরোধী দলগুলির আপত্তি সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে আইনে রূপান্তর হয়ে গেল! সঙ্গে স্লোগান - ‘এক দেশ, এক আইন!’ অন্নদাতা কিষান শুধু নিজেদের বা নিজেদের পরিবারের জন্যে নয়, দেশবাসীর জন্যে খাদ্য নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার পরিবর্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থার যেটুকু অবশেষ ছিল, তা কেড়ে নিতে করোনা আবহে দেশের সরকার এই ‘তিন কৃষি আইন’ চালু করে দিলেন! এই তিনটি আইনের প্রয়োগের ফলে যা ঘটতে চলেছে - ১) কিষানের ফসলের সহায়ক মূল্যের আশা উধাও; ২) কিষান নিজের খেতে কী চাষ করবেন তার স্বাধীনতা উধাও হবে; ৩) সরকার এফসিআই তুলে দেবে। ফলে সরকার খাদ্য শস্য কিনবে না, রেশন ব্যবস্থা উঠে যাবে; ৪) কিষানের জমির মালিকানা কর্পোরেটদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা; ৫) কিষান কৃষি-শ্রমিকে রূপান্তরিত হবে। ৬) মজুতদার যত খুশি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মজুত করতে পারবে, ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না, কালো-বাজারি রমরমা হবে। কৃষক আলু ৫ টাকা কিলোগ্রাম প্রতি বেচতে বাধ্য হলেও ক্রেতাকে ৫০ টাকা কিলোগ্রাম প্রতি কিনতে বাধ্য থাকতে হবে। অনুরূপে পেয়াঁজ, তেল, ডাল, চিনি, ইত্যাদি। অর্থাৎ সরকার হাত গুটিয়ে নিয়ে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ বৃহৎ পুঁজিপতি আদানি-আম্বানি-রামদেবদের হাতে ছেড়ে দিতে মরিয়া। অপরদিকে সরকার তার দোসর বৃহৎ পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারে সামনে এনেছেন - ‘তিন কৃষি আইন’ দ্বারা কৃষকদের আরও আয় বাড়বে, আরওউন্নতি হবে। অর্থাৎ ৬২ কোটি কিষানদের জন্য‘তিন কৃষি আইন’ একটি উপহার!

৬২ কোটি কিষান নিজ অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন - এই ‘তিন কৃষি আইন’-র মাধ্যমে দেশের সরকার শুধুই কিষান পরিবারগুলোর সর্বনাশ করবে না, দেশবাসীর সর্বনাশ করবে। অপরদিকে বৃহৎ পুঁজিপতির পোয়া বারো হবে। সে কারণেই করোনা আবহের সুযোগে,দেশের সাংবিধানিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে, ফ্যাসিস্ট কায়দায় তড়িঘড়ি সরকারের এই উদ্যোগ। দেশকে ব্রিটিশরাজের ন্যায় বৃহৎ পুঁজিরাজে নিয়ে যাওয়ার কৌশলমাত্র। দেশের প্রায় ৫০০ সংগঠনের ‘সংযুক্ত কিষান মোর্চা’-র নেতৃত্বে লাখো লাখো অন্নদাতা কিষান ‘এই উপহার’ ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে দেশজুড়ে রাস্তায়, দু’মাস। দেশের সরকারের কাছে অন্নদাতা কিষান বিশেষ সুবিধা চাইছেন না, কোনো বিশেষ সুযোগ চাইছেন না। কেবল তথাকথিত ‘উপহার’ ফিরিয়ে নিতে রাস্তায়।তারসঙ্গে কৃষিজাত ফসলের সরকার নির্ধারিত ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’-এর আইনি গ্যারান্টি চেয়েছেন। সরকার একাধারে বধির, অপরদিকে অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রচার! নিরূপায়ে ২৬শে নভেম্বর সংবিধান দিবসে ‘দিল্লি চলো’ কর্মসূচি। ‘দিল্লি চলো’ আটকাতে রাজ্যের সীমান্তে (দেশের সীমান্তে নয়) সশস্ত্র পুলিশি ব্যারিকেড, জল কামান, কাঁদানে গ্যাস, ধারালো কাঁটা তারের ব্যারিকেড, জাতীয় সড়ক খুঁড়ে গভীর খাদ! অর্থাৎ দেশের কিষানদের দেশের রাজধানীতে প্রবেশে দেশের সরকারের সংবিধান-বিরোধী বাধা! সকল বাধা ডিঙিয়ে/পেরিয়ে লাখো লাখো কিষান দিল্লির ৫টি প্রবেশপথে এককাট্টা হয়ে ধর্ণা-বিক্ষোভে সামিল। খালিস্তানি, আতঙ্কবাদী, আরবান নকশাল, টুকরে টুকরে গ্যাঙ্গ,পাকিস্তান ও চিনের মদতে, বামেরা হাইজ্যাক করেছে... প্রভৃতি মিথ্যা-অপবাদ, হুমকি, গ্রেফতার সহ শত বাধা মোকাবেলা করেই, দিল্লির প্রবেশ পথে। দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টির মধ্যে রাত-দিন হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে ধর্ণা-বিক্ষোভের ৪০ দিন অতিক্রান্ত। ইতিমধ্যে ৪০ জনের বেশি কিষান শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুভয় তোয়াক্কা না করে শিশু ও পরিবারসহ অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কিষান, দেশ ও দেশবাসীকে বাঁচাতে, আজ দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে সামিল। অপরদিকে সংবিধান থেকে সংসদ, সংসদ থেকে মন্ত্রীসভা এখনও বিদ্বেষ-বিষ ছড়িয়ে চলেছেন, ফ্যাসিস্ত কায়দায়। গভীর সংকটে কিষান, কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা, দেশের অর্থনীতি! এই সংকট মোচনেকিষান আন্দোলন আজ তাই আজাদি লড়াইয়ে পর্যবসিত। তারই অংশ বিশেষ কিষান আন্দোলন আগামী ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজধানীতে ট্রাক্টর, ট্রলি নিয়ে ‘কিষান প্যারেড’ করবেন। এই স্বাধীনতা যুদ্ধে তথা আজাদির লড়াইয়ে একদিকে মোদী সরকার, পেছনে আদানি-আম্বানি-রামদেব... অপরদিকে কিষানদের নেতৃত্বে দেশের সাধারণ জনগণ। এই যুদ্ধ, শুধুমাত্র কিষান এবং তাঁদের পরিবারের জন্যে নয়। সেকারণে কিষানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছেও না। দিনে দিনে আন্দোলন বড় পরিসরে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এমনকি দেশ থেকে দেশান্তরে।আপনার স্বার্থে আপনিও এই যুদ্ধে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী সামিল হোন। এ যুদ্ধ জিততেই হবে। না হলে বৃহৎ পুঁজিপতিদের শাসনাধীনে দেশ সরাসরি চলে যাবে। ইতিমধ্যে রেল, বীমা, বিএসএনএল, এয়ারপোর্ট সহ অনেক কিছুই চলে গেছে।