আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

নয়া নাগরিকত্ব আইন আদৌ বাস্তবায়ন হবে?

গৌতম লাহিড়ী


এক বছর কেটে গেলো। দিল্লির বিজেপি সরকার অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই গত বছর ডিসেম্বরে দেশের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে আইন পাশ করালো সংসদে। যেদিন সংসদ অনুমোদন করলো সেইদিনই রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হস্তাক্ষর নিয়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিলো কেন্দ্রীয় সরকার। বিজেপির ধারণা ছিল এই নতুন আইন হবে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে তুরুপের তাস। সহজেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ করা সহজ হবে। দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে নতুন বছর। আজও সেই আইন বাস্তবাটিত হলো না। কেন?

ভারতে যে কোনো আইন বাস্তবায়নের জন্য নিয়ম হলো নিয়মাবলী বা রুলস তৈরি করতে হয়। সেই নিয়মাবলী সংসদের একটি কমিটি যা ‘সার্বোডিনেট লেজিলেসান কমিটি’ নামে পরিচিত তাদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এক বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সেই নিয়মাবলী তৈরি করতে পারলো না। সংসদের অধ্যক্ষ ওম বিড়লার কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মাবলী পেশ করার জন্য বাড়তি তিন মাস সময় চেয়ে নিয়েছিল। সেই তিনমাস সময় পেরিয়ে গেলো। এখনও জানা যায়নি কবে নিয়ম তৈরি হবে। নিয়ম তৈরি না হলে নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না। অথচ বিজেপির স্বরাষ্ট্রমনত্রী অমিত শাহ - বিজেপির সভাপতি জেপি নাড্ডা পশ্চিমবঙ্গে করোনার সধ্যেই জনসভা করলেন। হুংকার দিলেন নাগরিকত্ব আইন পশ্চিমবঙ্গে লাগু হবেই।

সুংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের উদ্দেশ্য পাকিস্তান-বাংলাদেশ-আফগানিস্তানে ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত হিন্দু, খ্রিস্টান, পার্শি, জৈন ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে। এমন একটা আইন প্রণয়ন করেও বিজেপির নেতারা হঠাৎ কেন নীরব হয়ে গেলেন? কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিম মেদিনীপুর ও বোলপুরে ঝোড়ো সফর শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এক অদ্ভুত জবাব দিলেন। বললেন - ‘প্রথমে করোনার টীকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হবে। তারপরে নাগরিকত্ব আইন চালু হবে।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কেন্দ্রীয় সরকার সময় অতিবাহিত করছেন। কেন?

সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে আলোচনার সময়ে বিরোধী সব দলই এই আইন প্রণয়নে আপত্তি জানিয়েছিলেন। প্রথমত - আইনটি ভারতের সংবিধানের বিরোধী। ভারতের সংবিধান ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বকে অনুমোদন দেয় না। অথচ এই আইনে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সম্পর্কে বিরূপ মতপ্রকাশ করে আইন প্রণয়নের নজির কোনো দেশে আছে কিনা সন্দেহ। হঠাৎ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই আইন নিয়ে শীতলতার নেপথ্যে বর্তমান সময়ের ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিশেষ ভুমিকা রয়েছে।

লাদাখে যখন চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ চরমে সেই সময়ে ভারতের অন্য সীমান্তগুলির স্থিতাবস্থা-শান্তি একান্ত জরুরী। জরুরী - প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্রের সহমর্মিতা। এখন উপমহাদেশে এক অনিশ্চিত বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চরম উগ্র দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলতে দ্বিধা করছে না। এমনকি আঘাত হেনেছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতিকৃতি ও মূর্তিতে। বঙ্গবন্ধুর পরে সুফি-ইসলামের আউল-বাউলের পীঠস্থান কুষ্ঠিয়ায় শহীদ বাঘাযতীনের মূর্তিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থায় ভারতের অঙ্গরাজ্যে কেবলমাত্র ভোটের স্বার্থে এমন কোনো আইন বাস্তবায়ন করা যৌক্তিক হবে কি? যে আইনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সামাজিক ব্যবস্থার সমালোচনা করা হচ্ছে। এই আইনের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার বেড়েও যেতে পারে বলে বাংলাদেশ থেকে আশংকা প্রকাশ করা হযেছে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশকেই সমাধান করতে হবে। এরজন্য ভারতের কোনো ভূমিকা পালনের অর্থ অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল হতে পারে।

এমনটা নয় যে সংখ্যালঘু মানুষদের উপর কোনো অত্যাচার হচ্ছে না। সেই ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরেও কি এমন ঘটনা ঘটছে না? এই অবস্থায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সজাগ-উদারবাদী-ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরাও সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের নিন্দা করেছেন। একই সঙ্গে ভারত সরকারের এই ধরনের আইন প্রণয়নেরও প্রশ্ন তুলছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জনতার চাপে পড়ছেন। সেই কারণে, তিনি এক আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন - ভারত সরকারের এই ধরনের আইন প্রণয়নের কোনো প্রয়োজন ছিল না।

এটা অস্বীকার করা যায় না যে, কেবলমাত্র সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে তাই নয়, চিন রাষ্ট্র এই সুযোগকে সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চাইছে। চিনের লগ্নি বাড়ছে বাংলাদেশে। কয়েকদিন আগেই চিনা প্রযুক্তিতে নির্মিত ছয় কিমি লম্বা পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এটা বাংলাদেশের গর্ব বলে সাধারণ মানুষ উৎসব পালন করেছেন। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে চিনা সাহায্য প্রতিবছর বাড়ছে। কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ভাবাবেগ দিয়ে ‘চিনা প্রেম’ রোখা সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় ভারত সরকারের ভোটের রাজনীতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কূটনৈতিক মহলে। সম্ভবত তাঁদের পরামর্শেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে আপাতত বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ধীরে চলার পরামর্শ।

গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উৎসবের উদ্বোধনে মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের কর্মসূচী স্থির হয়েছিল। সেই সময়েই ঢাকার রাস্তায় ইসলামি সংগঠনগুলি ঢাকা কার্যত অবরোধ করে ফেলেছিল। প্রতিবাদের কারণ - ভারতের নয়া নাগরিকত্ব আইন। সৌভাগ্যের বিষয়, করোনা অতিমারীর কারণে প্রধানমন্ত্রীর সফর স্থগিত হয়ে যায়। এই বছরে ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ভার্চুয়াল শিখর বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকে বিতর্কিত নাগরিক আইন উত্থাপিত হয়নি। তবে আগামী ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ফের ঢাকা সফরের কর্মসূচী চূড়ান্ত হচ্ছে। তার আগে নাগরিকত্ব আইনের মতো বিতর্কিত আইন লাগু করা সম্ভব নয়। অনেকটা এই কারণে আপাতত বিজেপি সরকার পিছু হঠছে।

এই আইন শেষ পর্ষন্ত বিজেপির গলার কাঁটা হয়ে উঠছে। একদিকে প্রতিশ্রুতি অন্যদিকে আর্ন্তজাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের বাধ্যবাধকতায় দোলাচলে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঢাকা সফরের পরে আচমকা এই আইন লাগু হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। বিজেপির ভোটব্যাঙ্কের মধ্যে দ্বিধা দেখা দিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্ব এখনও স্পষ্ট নয় যে কিভাবে এই আইন লাগু করবেন? এই আইনে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে যাঁরা ‘অত্যাচারিত’ হয়ে ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ছবছর কেটে গেলো। সংশোধনপূর্ব নাগরিকত্ব আইনে রয়েছে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যাঁরা ভারতে এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। তার সঙ্গে হঠাৎ ২০১৪ সালকে মিলিয়ে দেওয়া কি সঠিক?

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশে রাজনৌতিক অস্থিরতা ছিল। উনিশবার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হওয়ার ভিত্তিভূমি ছিল। উগ্র জামায়েত ইসলামিদের রমরমা চলছিল সেনা মদতে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা আসার পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। জনরোষ থাকলেও সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। ভারতে সরকারের আইনে শেখ হাসিনা সময়কালকেই কি নিন্দা করা হচ্ছে না? এতে প্রতিবেশিসুলভ নৈতিকতার বিশ্বাসে আঘাত হানবে না? ঘটনা হলো - ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের জনতার অনাস্থা বাড়ছে। অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। সেই পালের হাওয়া জোগাচ্ছে মৌলাবাদীরা।

দ্বিতীয়ত - নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কি ভাবে? তাও স্পষ্ট নয়। পূর্বের নাগরিকত্ব আইনে বলা ছিল কেউ যদি ভারতে একটানা সাতবছর বাস করেন, তাহলে তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়া যেতে পারে। বর্তমান আইনে সেই সময়সীমা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। অর্থাৎ আবেদনকারীকে ঘোষণা করতে হবে তিনি বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে পাঁচবছর বা তার বেশি সময় পূর্বে এসেছেন। একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হবে নাকি? যদি আবেদনের পরে নাগরিকত্ব না পান তাহলে তাদের নিয়ে কি করা হবে?

এই প্রশ্নটা ওঠে বাংলার এক নমঃশুদ্র মতুয়া সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে। এঁদের অনেকেই নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, অথচ ভারতের নাগরিকত্ব পাননি। এঁরাই পশ্চিমবঙ্গের কমপক্ষে ৪০টি বিধানসভায় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন বলে দাবি করা হয়। বিগত লোকসভা ভোটে এঁদের প্রতিনিধি বিজেপি দলের বনগাঁ ও রাণাঘাট কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। এঁদেরকে প্রভাবশালী ‘বড়-মা’ বীনাপাণিদেবীকে রাজনৈতিক দলে টানতে বিজেপি উদ্যোগ নেয়। এঁদের তথাকথিত নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে সুকৌশলে বাংলায় এই প্রথম জাতের রাজনীতিরও প্রবর্তন করলো বিজেপি। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পাশাপাশি জাত ভিত্তিক রাজনীতি।

প্রশ্ন হলো - এঁদের প্রতিনিধিরা লোকসভার সাংসদ হতে পারেন, বিধানসভার প্রতিনিধি হতে পারেন, কিন্তু এখনও নাগরিক নন? নাগরিকত্ব দেওয়াই কি প্রধান বিষয় নাকি নাগরিকত্বর ধুয়ো তুলে ধার্মিক মেরুকরণ প্রধান উদ্দেশ্য? আপাতত কূটনীতির বেড়াজালে পড়ে নয়া নাগরিকত্ব আইন যা ‘ক্যা’ নামে সমধিক পরিচিত শিকেয় উঠছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এই আইনের পক্ষে এতো জোরালো চাপ তৈরি করছে তাতে বিজেপি আর্ন্তজাতিক কূটনীতির যুক্তি দেখিয়ে কতদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারেন, সেটাই দেখার।আইন লাগু না হওয়ায় বিজেপি-র মতুয়া সাংসদ শান্তনু ঠাকুর সম্প্রতি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। এরপর বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে তাঁকে মুখ না খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে এই আইন নিয়ে হিতে বিপরীত হতে চলেছে অসমে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একই সময়ে অসমেও নির্বাচন। সেখানে সুধী সমাজ-ছাত্ররা রুখে দাঁড়িয়েছেন এই আইনের বিরুদ্ধে। কারণটাও প্রাদেশিক। তাঁরা মনে করেন, এই আইনের দরুণ বাংলাদেশীরা ভীড় করবেন। অসম চুক্তির অন্যতম শর্ত হলো - ১৯৭১ সালের পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না। অথচ এই নাগরিকত্ব আইন সেই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করছে বলে অহমিয়ারা ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশকে পাশার দান হিসাবে ব্যবহার করতে গিয়ে বিপাকে না পড়ে যায় ভারত সরকার। যে দেশের মাথাপিছু আয় অসম তো বটেই, ভারতের থেকেও উন্নত। উন্নত বিকাশ দর-আর্থিক উন্নয়ন। সেই দেশের মানুষ হঠাৎ রুটি রুজির সন্ধানে ‘গরীব’ দেশে কেন আসবেন? যুক্তিহীণতায় পূর্ণ এক আইন এই উপমহাদেশে শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে বসে। সেটাই এখন চিন্তার।