আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে কিছু কথা

বরুণ কর


সংবাদে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনকে পাখির চোখ করে সর্বোচ্চ স্তরের উদ্যোগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে বিজেপি। রাজ্যকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করে সুনীল দেওধর, দুষ্যন্ত গৌতম, বিনোদ শোনকর, হরিশ দ্বিবেদী ও বিনোদ তাওড়ের ওপর দায়িত্ব বর্তেছে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে কাজ করার। শোনা যাচ্ছে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি নিয়ম করে মাসে একবার রাজ্যে আসবেন প্রচার-কাজের তদারকিতে। নভেম্বর মাসের ৫ তারিখ বাঁকুড়ার চতুরডিহি গ্রামের আদিবাসী বিভীষণ হাঁসদার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত হন অমিত শাহ। পরদিন, তৃণমূলের নেতারা পৌঁছে যান সেই বাড়িতে - তুলে দেন খাবার, পোষাক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন বাগুইআটিতে এক বাড়িতে অন্নগ্রহণ করছেন। গৃহকর্তা মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ ঘটনা নতুন নয়। ২০১৭ সালে নকশালবাড়িতে রাজু মাহালি ও গীতা মাহালির বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজে যান অমিতজি। পরদিন আবার মন্ত্রী গৌতম দেব তার দলবল নিয়ে হাজির রাজুর কাছে। সংবাদ, রাজু তৃণমুলে নাম লেখান। আদিবাসী, দলিত বা কোনো অন্ত্যজের বাড়িতে যাওয়ার বা মধ্যাহ্নভোজনে আপত্তি নেই। শুধু একটা প্রশ্ন - সময়কাল কি তবে নির্দিষ্ট, কেবল মাত্র নির্বাচনের আগে?

রাজনৈতিক আলোচনায় ইদানিং ‘বাইনারি’ কথাটির প্রয়োগ বেশি। সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখলেই বা কান পাতলে জানা যাচ্ছে রাজ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত দুটি দলের মধ্যে - শাসক তৃণমূল ও বিজেপি। ২০১১ সালের নির্বাচনে একদিকে ছিল সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট; বিপক্ষে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল ও অবশিষ্ট দল। আসন্ন নির্বচনে প্রধান বাম দল যখন তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস সহ সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জোট করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত, পত্র-পত্রিকায় ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ইঙ্গিত এই জোট যতটা না বিজেপি বিরোধী, তার চাইতে বেশী তৃণমূল বিরোধী। স্পষ্ট বার্তা - বামদলগুলি তৃণমূলকে যতটা বিপজ্জনক ভাবছে, তৃণমূল আদৌ তা নয়; বিজেপি মূল শত্রু। উদ্দেশ্য পরিষ্কার।

আপাতদৃষ্টিতে, নানা ঘটনায় তৃণমূল ও বিজেপি পরস্পর বিরোধী মনে হলেও দল দুটি যে একে অপরের সহায়ক শক্তি সেটা বুঝে নিতে ঘুব কষ্ট হবার কথা নয়। সারদা চিট ফান্ড কান্ডে তৃণমূল নেতাদের জড়িত থাকার বিষয়টি যাতে জনমনে প্রতিষ্ঠা না পায়, সেই লক্ষ্যে তৃণমূল সরকার সিবিআই তদন্ত ঠেকাতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দরবার করেছে। সে চেষ্টা সফল হয়নি বটে তবে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া তদন্তের রিপোর্ট আজ অবধি দিনের আলো দেখেনি। ইউপিএ-২-এর শাসনকালে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাদের পরাজয়ে মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপির এনডিএ জোটের সরকার এখন সেই তদন্তের তদারকিতে। ২০১৬ সালে রাজ্যে নির্বাচনের আগে প্রচারে বিজেপি নেতাদের গলায় ‘ভাগ দিদি ভাগ, ভাগ মুকুল ভাগ’ রাজ্যবাসী শুনেছে। মুকুল কোথায় ভেগেছে সবাই জানে। নারদ কাহিনী টিভির পর্দায় ভেসে উঠতেই মুখ্যমন্ত্রীর উক্তি - আগে জানলে প্রার্থী করতাম না। সে তদন্তও চলছে একই গতিতে। কোনো এক ব্যবসায়ীর (ছদ্মবেশী) কাছ থেকে সাংসদদের টাকা নেওয়ার অভিযোগ সংসদের এথিকস্ কমিটি খতিয়ে দেখার সময় পায়নি আজও। কমিটির শীর্ষে কে না আদবানিজি। কী সুন্দর বোঝাপড়া!

বিজেপি মনে করে কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। তৃণমূল নেত্রীর গলায় একই সুর - তার ডাক রাজ্যকে ‘বিরোধী শূন্য’ করার। সুতরাং নির্বাচনে পরাজয় সত্ত্বেও বহাল নানা কৌশলে দল ভাঙ্গানোর খেলা। দুটি দলই এ কাজে পটু। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে দেখুন - দুটি দলের নেতাদের মধ্যে দলবদলের কারসাজি। কে কখন কোন দিকে বলা মুশকিল। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত কিশোরীকে উচ্চ সম্প্রদায়ের চার যুবকের ধর্ষণ ও চরম নির্যাতনে তার মৃত্যুর ঘটনা যদি আপনাকে বিচলিত করে তবে তো সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনে পড়ে যাওয়ার কথা মধ্যমগ্রামের সেই ষুবতীর কথা। ধর্ষণের নালিশ থানায় জানাতে গেলে যাকে দ্বিতীয় বার ধর্ষিতা হতে হয়, আগুনে দগ্ধ হতে হয়। উত্তরপ্রদেশের পুলিশ কিশোরীর মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে না দিয়ে রাতের অন্ধকারে গোপনে দাহ করে। এখানেও প্রায় একই কান্ড। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে দ্বন্দ্ব বলে চালাবার চেষ্টা করে প্রশাসন, গোপনে মৃতদেহ দাহ করার চেষ্টা করে। প্রয়াত সিটু নেতা শ্যামল চক্রবর্ত্তী ও শ্মশান-সংলগ্ন বাসিন্দাদের তৎপরতা ও উদ্যোগে সে চেষ্টা বিফলে যায়। প্রধানমন্ত্রী সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে সংসদে প্রবেশ করলেও সংসদ এড়িয়ে চলেন সুচতুর কৌশলে। মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভায় যোগদান মর্জিমাফিক। সভায় বিরোধীদের উদ্দেশে তাকে মাঝে মাঝে চুপ করে থাকার পরামর্শ দিতে দেখা যায়। মুখ্যমন্ত্রীর ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রীর রহস্য যেমন অজানা; ঠিক তেমনি বিতর্ক প্রধানমন্ত্রীর ‘চা ওয়ালা’ ভূমিকা নিয়ে। একজনের গলায় যদি বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি শোনা যায় তো অন্য জনের কথায় লাখ লাখ চাকরি দেওয়ার আস্ফালন। অথচ দেশে বেকারির হার নাকি রের্কড ছোঁওয়া। একজন পৃথিবী পরিভ্রমণে তো অন্যজন দলবল জুটিয়ে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে জেলা সফরে। প্রচুর অর্থব্যয়ে সেই সব প্রশাসনিক বৈঠকে দলীয় নেতাদের সামনেই চলে সরকারি আধিকারিকদের কাজের বিচার, জোটে ধমক, তিরস্কার। সাংবাদিককুল বিগলিত, উদ্বাহু। একজন দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গুটিয়ে নেন তো অন্যজন পরিকল্পনা ছাড়াই ঘোষণা করতে থাকেন নানা নির্দেশ, সিদ্ধান্ত। এবং কি আশ্চর্য বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই অভিসন্ধিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ক্লাব খয়রাতি, দুর্গাপূজার অনুদান, ইমাম ভাতা, পুরোহিত ভাতা এমন অজস্র উদাহরণ।

পরস্পরের মধ্যে চাপান-উতোর চমকপ্রদ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি ইদানীং সভা-সমিতিতে মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের বিরুদ্ধে সিঙ্গুরে টাটার মোটর কারখানা বিতাড়নের অভিযোগ তুলছেন। কিন্তু সেই অভিয়োগ তোলার সময় তাদের মনে থাকছে না সিঙ্গুরের অবস্থানে বা ধর্মতলার অনশনে বিজেপি নেতাদের উপস্থিতির কথা। দিল্লীর সরকারের যে কোনো নীতির বিরোধিতা যিনিই করুন, নিমেষে তাকে দেশ-বিরোধী তকমা এঁটে দেওয়া হবে। শহুরে নকশাল, চীন বা পাকিস্থানপন্থী হিসাবে চিহ্নিত করে চেষ্টা চলবে তাকে নাস্তানাবুদ করার। ওজন বুঝে জেলে পাঠানোর ঘটনাও বিস্তর। এই প্রসঙ্গে সোস্যাল মিডিয়ায় তথাকথিত ট্রোলের কথা না হয় বাদই দিলাম। শিক্ষাসহ গণতন্ত্রের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান আজ আক্রান্ত। এবার রাজ্যের দিকে তাকান যাক। কামদুনির দুই প্রতিবাদী মহিলা, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, তানিয়া ভরদ্বাজ - যারাই সরকারের বিরুদ্ধে মুখর, তারা হয় মাওবাদী নয়ত সিপিএমের দালাল। হাল আমলে আরামবাগ টিভির সাংবাদিকের কথাও কি আলাদা কোনো ঘটনা? কিন্তু সংবাদমাধ্যমের মুখে কুলুপ আঁটা। সব কটি সংবাদমাধ্যম সরকারী বিজ্ঞাপনের আনুকুল্য পেলেও সিপিআই(এম)-র মুখপত্র ‘গণশক্তি’র বেলায় সরকার বিমুখ যদিও তৃণমূলের ‘জাগো বাংলা’ এর ব্যতিক্রম। মোদী যদি বলেন ষাট বছরে কংগ্রেস সরকার যা করেছে ভাজপা সরকার সে কাজ পাঁচ বছরে করেছে তো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বা লেখাতে জানা যায় ‘বামফ্রন্ট সরকার ৩৪ বছরে যা করতে পারেনি, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ প্রথম ছ’মাসে করেছে আমাদের সরকার’। একজন বিকাশ পুরুষ; অন্যজন উন্নয়নের কান্ডারী। একজন হুঙ্কার ছাড়েন ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’; অন্যজন ‘সততার প্রতীক’ হিসাবে বিরাজমান রাস্তায় ঘাটে। সে সব ফ্লেক্স আজ কোথায়! সিবিআই, ইডির মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সী একটু তৎপর হলেই তিনি নড়েচড়ে বসেন। কথনও ছুটে যান দিল্লী বা কথনও বসে পড়েন মেট্রো চ্যানেলে কোনও পুলিশ কর্তাকে আড়াল করতে। করোনা আবহে দুর্গাপূজায় কোর্টের নিষেধাজ্ঞায় মুখ্যমন্ত্রী সহ দলীয় নেতাদের ভীষণ গোঁসা হয়। অর্থনীতির ধুয়ো তুলে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত ছুটে যেতে হয়। রবীন্দ্র সরোবর, সুভাষ সরোবরের মতো জলাশয়ে ছটপূজার নিষেধাজ্ঞায় সেই একই রকম উষ্মার প্রকাশ। দিল্লীর দিকে চোখ রাখুন। নদী ও অন্যান্য জলাশয়ে কেজরীবালের সরকার ছটপূজা নিষিদ্ধ করায় বিজেপি ক্ষুদ্ধ। দুর্গা জনসেবক ট্রাস্ট হাইকোর্টে যায় তার বিরুদ্ধে। দিল্লী হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছে সেই আপত্তি। ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে দুই দলেরই চেষ্টা নিরন্তর। রামনবমীকে ঘিরে দু'বছর আগে দুটি দলের আস্ফালন সম্ভবত এখনও রাজ্যবাসী মনে রেখেছে। বিজেপির ভোট ম্যানেজাররা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বহিরাগত। তাঁর দলের ভোট ম্যানেজার অথচ ভিন্ রাজ্যের প্রশান্ত। এমনকী তাঁর সাধের ‘বিশ্ব বাংলা’র ব্র্যান্ড অ্যামবাস্যাজর তিনি রাজ্যে খুঁজে পান না; দ্বারস্থ হতে হয় বলিউডের।

এবার, রাজ্যে পরিবর্তনের-পটভূমিকা নিয়ে মমতা ব্যানার্জির লেখা ‘পরিবর্তন’ নামে একটা বই পড়ে কিছু কথা জেনে নেব। ‘১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরির পর যখন প্রথম বিজেপি-র সঙ্গে আমাদের আসন সমঝোতা হল, তখন খুব কাছ থেকে দেখে তাঁদের ব্যবহারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম’। তারপর ২০০১ সালের ১৫ই মার্চ তহেলকা কান্ডে ‘আবেগাপ্লুত’ হয়ে মন্ত্রীসভা ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর প্রধানমন্ত্রীকে তিনি দূত মারফৎ জানিয়ে ছিলেন ‘আমরা আপনাদের শত্রু নই। কখনো যদি মনে করেন সরকারের অনিশ্চয়তা এসেছে, আমাদের জানাবেন। আমরা বিনা দ্বিধায় আপনাদের পাশে দাঁড়াব’। এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এলেও জানাচ্ছেন ‘বিরুদ্ধে ভোটও দিইনি সংসদে’। গুজরাটের ‘ভয়াবহ দাঙ্গা’ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলে আসেন ‘নরেন্দ্র মোদীকে সরান’, তবু স্থায়িত্বের প্রশ্নে বিরুদ্ধে ভোট দেননি। লিখেছেন ‘ঈশ্বর জানেন, মানসিকভাবে আমরা কতটা অসুখী ছিলাম’। এদিকে এই প্রশ্নে তাঁর দলের সাংসদ (কৃষ্ণা বসু) বিজেপির ওপর বিরক্ত হয়ে সংসদীয় দলের সভায় দল ‘সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিক’ দাবি জানালে তাঁর ওপর হুইপ জারি করা হয়। সারা দেশ এও জানে দাঙ্গা পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের পর মমতা মোদীকে পুষ্পস্তবক পাঠিয়ে অভিনন্দন জানান। পালা পরিবর্তনের আগে তিনি বলেছেন ‘এ রাজ্যে মাও ফাও’ কিছু নেই। আর তাঁর দলের প্রাক্তন সাংসদ কবীর সুমন তাঁর ‘নিশানের নাম তাপসী মালিক’ বইয়ে লিখেছেন, তৃণমূল ভবনে দুই মাওবাদীর সঙ্গে মমতার সাক্ষাতের কথা। কার কথা শুনব আমরা? আরএসএসের কমিউনিস্ট বিরোধিতার কথা সবাই জানেন, জানেন মুসলমান ও খ্রীষ্টান বিরোধিতার কথাও। তাদের কাছে তিনি তাই নির্দ্বিধায় আহ্বান জানাতে পারেন বাংলায় বাম শাসনের অবসানকল্পে সহযোগিতার জন্য। ‘কমিউনিস্ট টেররিজম’ বইয়ের উদ্বোধনে সংঘের নেতাদের সার্টিফিকেট দেন ‘আপনারাই হলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক’। ‘পরিবর্তন’ বইয়ে আবার লিখে জানাচ্ছেন ‘বাবরি মসজিদ ভাঙার পর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় দাঙ্গা ঠেকাতে ঘুরে বেড়িয়েছি। জ্যোতি বসু বা সিপিআই(এম)-র কোন নেতা তখন কিন্তু রাস্তায় নামননি’। সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের ভার পাঠকসাধারণের ওপর ছাড়লাম।

বাম শাসনে রাজ্যে ভাল কাজ কম হয়নি। সে সব কাজে জনকল্যাণ অগ্রাধিকার পেয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রসারিত হয়েছে। প্রশাসনে কেন্দ্রিকতার ঝোঁক কমেছে। কিন্তু কিছু নেতার ঔদ্ধত্য, গাফিলতি, স্বজন-পোষণ ও দুর্নীতি মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ক্ষোভ প্রশমনের পরিবর্তে তা চাপা দেবার চেষ্টা হয়েছে; নিষ্পত্তির বদলে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তা আবার কিছু ক্ষেত্রে অতিসক্রিয়তা ক্রমশ সমস্ত বাম বিরোধী শক্তিকে এক জায়গায় এনে যখন দাঁড় করাল, বামেরা তখন তার মোকাবিলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

বামদল ও নেতাদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বেশি, তাই তাদের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিও জনসাধারণ সইতে নারাজ। খুব সহজে নিরাশ হন তারা। কিন্তু এই অবসরে আমরা কি গত দশ বছর ধরে  চলা বর্তমান সরকারের মূল্যায়ন করতে ভুলে যাব? রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতা কী? রাজ্যকে বিরোধীশূন্য বানাবার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সব ক'টি নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। বিরোধী নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে সাজানো হয়েছে জামিন-অযোগ্য নানা মামলা।

রাজ্যের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পঞ্চায়েত ও পুর প্রশাসনে দুর্নীতি, স্বজন-পোষণের সাথে অর্থের বিনিময়ে অন্যায় কাজ কর্মের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত। শিল্পশূন্য রাজ্যের সরকারী নিয়োগ শিকেয় উঠেছে, মামলার জালে বন্ধ শিক্ষক নিয়োগ। কোনো কিছু নিয়েই আন্দোলন নিষিদ্ধ প্রায়। আইনশৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি। নারী নির্যাতন, পূজা, মেলা, খেলার নামে চাঁদার জুলুম সহ তৃণমূলকর্মীদের নানা ধরনের উৎপাতের শিকার সাধারণ মানুষ। জুয়ার আসর, মদের আসর, পিকনিকের মোচ্ছবে ডিজে নামক যন্ত্র দানবের উৎপীড়নে জেরবার সাধারণ মানুষ। এর সাথে কয়লা, বালি, মাটি, পাথরের খাদান ও তার দখলদারি ঘিরে দলীয় বিবাদ শুধু সামাজিক জীবনে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে তা নয়, ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে গোটা রাজ্যকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, একশো দিনের কাজের মজুরি যে দিকে তাকাবেন অন্যায় আর অন্যায়। ত্রাণ দুর্নীতি, লুঠপাটের কাহিনি নিয়ে আলাদা কিছু বলার প্রয়োজন আজ আর নেই - পত্র-পত্রিকায় তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়ে গেছে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই কিন্তু টাস্ক ফোর্সের ঢক্কা-নিনাদ কম নয়। নেতা নেত্রীদের ভাষণে শুধুই মেকি শ্রমিক ও কৃষক দরদের কথা। ফ্লেক্সে ‘আমি তো আছি’ দেখে আপনার মনে বলিউড নায়কের কথা মনে পড়লে করার কিছু নেই। এদিকে সব দেখে-শুনেও পরিবর্তনপন্থী হিসাবে চিহ্নিত বুদ্ধিজীবির দল শীতঘুমে। সাংবাদ মাধ্যমের সিংহভাগ সরকারী বিজ্ঞাপনের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে ভুলতে বসেছে তথ্যনিষ্ঠার পাঠ; তৃণমূল ও বিজেপির দ্বৈরথ ও পরিকল্পিত সংঘর্ষের খবরে ব্যস্ত রেখেছে নিজেদের। সরকারী ভাষ্যের সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো চেষ্টা দেখা যায়না তাদের মধ্যে। তদন্তমূলক প্রতিবেদন তো দূর অস্ত। বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরি নেই, স্কুল-কলেজে পঠন-পাঠনে নিয়মানুবর্তিতা নেই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে নেই কোনো চিন্তা ভাবনা এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের দীনযাপনের ন্যূনতম সুবন্দোবস্ত নেই। অর্থ ও পেশীবলে নির্ভর করে কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে ‘আমার হেলিকপ্টার গোটা রাজ্যে মোট ১৫৬টা টেক অফ আর ল্যান্ডিং করেছিল’ - এই উক্তি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর। বুঝুন অবস্থা।

এমতাবস্থায়, শুধুমাত্র বামপন্থীদের নিন্দা করে আমাদের দায় কি ঝেড়ে ফেলতে পারব আমরা? যাবতীয় অব্যবস্থা, অনিয়মের শিকার যেহেতু আমরা, আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা সুতরাং আমাদের আরও কার্যকরী ভূমিকা তো নিতেই হবে। শিল্পপতি-পুঁজিপতি-নিয়ন্ত্রিত সংবাদ ও দৃশ্যমাধ্যমের সাজানো বানানো ও একঘন্টার তরজায় নেচে উঠে প্রশ্ন করতে ভুলে গেলে চলবে না - চিট ফান্ড কান্ডে সিটের তদন্ত রিপোর্ট কোথায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? সিবিআই তদন্ত ঠেকাতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত সরকারকে কেন দৌড়াতে হয়েছিল? সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের ফেরত দেওয়া জমির কী অবস্থা? আলু, পেঁয়াজ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারের ব্যবস্থা কী? সরকারী পরিবহণ, ট্যাক্সি ইত্যাদির ভাড়া নির্ধারণে সরকারে গড়িমসির কারণ কী? কেন্দ্রের কাছে রাজ্য সরকারের পাওনা নিয়ে সোচ্চার হলেও শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ন্যায্য পাওনা নিয়ে টালবাহানার কারণ কি? দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থাদি।

একই সাথে বিজেপি নেতাকর্মীদের কাছে সরাসরি এই প্রশ্ন রাখতে হবে - নোটবন্দী কার স্বার্থে? একের পর এক রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার কারণ কী? প্রবল শীতে কৃষকেরা রাস্তায় কেন? পেট্রল-ডিজেলের দাম কেন শুধুই ঊর্দ্ধমুখী? শ্রম আইনে সংশোধন কেন? খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিক্ষান্তে চাকরির প্রশ্নে সরকারের ভুমিকা কী? ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবিকতা রক্ষায় কেন অনীহা?

কোনো অস্পষ্টতা রাখা চলবে না এই সব প্রশ্নের উত্তর আদায়ে। দুটো দলের কেউ যেন সুযোগ না পায় উত্তর এড়িয়ে যাবার। সেই চেষ্টা জারি রাখতে হবে বামপন্থীদের, নিতে হবে বিশেষ ভূমিকা। তৃণমূল, বিজেপি’র বোঝাপড়ার সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে রাজ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কাজে বামপন্থীদের যদি বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা থাকে তবে এখনই মনোযোগী হতে হবে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচী স্থির করে বিজেপি, তৃণমূল বিরোধী সমস্ত ভোটকে একত্র করার চেষ্টায় প্রচার কাজে নেমে পড়া। ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমিক-কৃষক ও কর্মচারী ঐক্য গড়ে উঠবে তখনই যখন এই অংশের মানুষ বামেদের গলায় আবার শুনতে পাবেন তাদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। দেশের আজ সত্যিই প্রয়োজন বামপন্থীদের; কারণ তারাই পারবে জাতি, ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখে সব রকম বিভাজনকে রুখে দিতে। এ দেশ মুষ্টিমেয় শিল্পপতি, পুঁজিপতির সম্পদবৃদ্ধির নিরাপদ যন্ত্র নয়; এ দেশ আমার, আপনার, সবার - এই দৃপ্ত উচ্চারণের হিম্মত একমাত্র বামপন্থীদেরই আছে। রাজ্যে এই উচ্চারণের সুফল পাওয়া গেলে তার ঢেউ আগামী দিনে প্রসারিত হবে আরও আরও রাজ্যে, সারা দেশে। তাই আওয়াজ উঠুক - তৃণমূল নয় বিজেপিও নয়; বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির মেলবন্ধনে পরাস্ত হোক কায়েমী স্বার্থের অদৃশ্য জোট।