আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

সমসাময়িক

একটি পরিকল্পিত ধ্বংস প্রকল্প


যোধপুরের রাজা উমেইদ সিংহ ১৯২৯-এর ১৮ নভেম্বর রাজ্যের রাজধানীতে একটি নতুন প্রাসাদের ভূমিপূজা করলেন। ১৯৪৩-এ নির্মাণ শেষ হওয়ার পর প্রায় সাড়ে তিনশো ঘরের এই রাজপ্রাসাদের নাম হল - উমেইদ ভবন, যা এখনকার যোধপুরের অন্যতম দ্রষ্টব্য। যোধপুর রাজ্যে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। এহেন দুঃসময়ে প্রাসাদ নির্মাণ মোটেই অমানবিক অপচয় নয়, বরং রাজধর্ম পালন বলে ধারণা করা হয়েছিল। এতে নাকি বুভুক্ষু প্রজাদের রুটি-রুজির সংস্থান হবে।

তারপর কেটে গেছে কতকাল। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। শাসকের মানসিকতা পাল্টিয়েছে কি? ১০ই ডিসেম্বর, ২০২০ ভারতের রাজধানী দিল্লির কেন্দ্রস্থলে বর্তমান সংসদ ভবনের অদূরে নতুন সংসদ ভবনের শিলান্যাস করে ভূমিপূজা করা হল।

সংক্রমণের দাপটে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত। অর্থনীতি বেহাল। রাজকোষে টানাটানি। করোনা পরিস্থিতিতে ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের নগদ টাকা দিতে পারছে না কেন্দ্র। রাজ্যগুলির পাওনাও বাকি। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বারেবারে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে এই সময় সরকারের খরচ বাড়ানো দরকার। মানুষের কাছে নগদ টাকা পৌঁছে দেওয়া উচিত। কে শোনে কার কথা! অর্থমন্ত্রী বলেছেন, টাকা নেই। সংসার চলছে ধার করে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করা চাই-ই চাই। কাজেই ৬৪,৫০০ বর্গমিটার জায়গার উপরে তৈরি হবে ত্রিভূজাকৃতি নতুন সংসদ ভবন। আনুমানিক খরচ ৯৭১ কোটি টাকা। বর্তমান বৃত্তাকার সংসদ ভবনটি ভবিষ্যতে ‘পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন’ হিসেবে থেকে যাবে বলে জানানো হয়েছে।

নগরোন্নয়ন ও আবাসন মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, এই প্রকল্প অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন সংসদ ভবন সহ দিল্লির রাজপথের আশেপাশের এলাকা বা ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ সাজানোর কী প্রয়োজন, সেই প্রশ্ন আগেই উঠেছিল। মন্ত্রীর যুক্তি, এই প্রকল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বিপুল কর্মসংস্থান হবে। পেশাদার কূটনীতিক, নগরোন্নয়ন ও আবাসন মন্ত্রীর মতে ৯৩ বছরের পুরোনো বর্তমান সংসদ ভবনে এখনকার চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধে, সাংসদদের পৃথক ঘর বা দফতরের জায়গা নেই। কারণ, দুই কক্ষের সংসদের জন্য ভবনটি তৈরি হয়নি। কৃষি ভবন, উদ্যোগ ভবনের মতো অন্যান্য সরকারি দফতরের বয়সও পঞ্চাশ পেরিয়েছে। সেখানেও কাজের জায়গা, পার্কিং লটের অভাব। এই জন্যই অভিন্ন কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের পরিকল্পনা। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত সেন্ট্রাল ভিস্টা নয়াদিল্লির প্রধান বুলেভার্ড ও পর্যটন কেন্দ্র হলেও সেখানেও পার্কিং, শৌচালয়ের অভাব। কাজেই এই দুর্যোগের দিনে এমন রাজকীয় আয়োজন!

সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে নতুন সংসদ ভবন ছাড়াও নতুন কেন্দ্রীয় সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির নতুন বাসভবন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন সংসদ ভবনের শিলান্যাসের আগেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, শিলান্যাস হলেও নতুন সংসদ ভবনের জন্য কাজ শুরু করা যাবে না। চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত শীর্ষ আদালত গোটা প্রকল্পের কাজই বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। সরকার অবশ্য প্রথম থেকেই বলে আসছে, নতুন সংসদ ভবন ও নতুন সচিবালয় তৈরি করা প্রয়োজন। কারণ বর্তমান ভবনে প্রবল চাপ পড়ছে।

পৃথিবীর কয়েকটি বিখ্যাত সংসদ ভবন যেমন জাপানের ডায়েট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল বিল্ডিং এবং গ্রেট ব্রিটেনের প্যালেস অব ওয়েস্ট মিনিস্টর - এই তিনটি সংসদ ভবন নানা সময়ে আগুনে বা যুদ্ধের কারণে ধ্বংস হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা সেখানেই সেগুলির সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করেছে। বিশ্বের অন্যান্য অনেক সংসদ ভবনের তুলনায় ভারতীয় সংসদের বর্তমান ভবনটি এত পুরানো নয় যে সেটা ভেঙে ফেলে নতুন একটা সংসদ ভবন গড়ে তুলতে হবে বলে বিশিষ্ট স্থপতিরা জানিয়েছেন।

কোনও সন্দেহ নেই যে, ভারতীয় সংসদ ভবনটি রাজকীয় এবং এর আভিজাত্য ও মহিমা কেবল ভারতের কয়েকটি মাত্র বিশিষ্ট ভবনের সঙ্গে তুলনীয়। একই সঙ্গে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন, যা গোড়া থেকেই অনেক ঐতিহাসিক, আইনি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ঘটনার সাক্ষী। যে কোনও মূল্যে ঐতিহ্যশালী এই স্থাপত্যের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন রেখে এটিকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন ছিল। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সেই কাজ মোটেও অসম্ভব নয়। সংসদ ভবনের মতো একটি প্রাচীন ইমারতের প্রতিটি ধূলিকণায়, তার আনাচেকানাচে কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন ভবন হয়তো অনেক আধুনিক, অনেক বিলাসবহুল হবে। কিন্তু সেখানে কি ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে? একটা ভবন তো শুধু ইট, কাঠ, পাথরের, কড়িবরগার ইমারত নয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গোটা জাতির আবেগ।

প্রস্তাবিত সেন্ট্রাল ভিস্টায় যা হতে চলেছে রাষ্ট্রপতি ভবন-ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত রাস্তার ভোলবদলের পরিকল্পনা। প্রকল্পের রূপরেখায় যা বলা হয়েছে -

• ত্রিকোণাকার নয়া সংসদ ভবনে দুই কক্ষ মিলিয়ে ১,২২৪ জন সাংসদ বসতে পারবেন।
• নয়া সংসদ ভবনে থাকবে ‘সংবিধান হল’। সংবিধানের প্রথম স্বাক্ষরিত সংস্করণ সেখানে রাখা থাকবে। সংসদে কাগজের ব্যবহার কমাতে গড়ে তোলা হবে আধুনিক ডিজিটাল পরিকাঠামো।
• একটি কেন্দ্রীয় সচিবালয়ও তৈরি হবে।
• সাউথ ব্লকের কাছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন আর নর্থ ব্লকের কাছে তৈরি উপরাষ্ট্রপতির নতুন বাসভবন নির্মিত হবে।

সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প রূপায়ণের জন্য যে ধ্বংসলীলা শুরু হতে চলেছে তাতে প্রথম বলি হবে ১৯৬০-এর দশকে নির্মিত শ্রম-শক্তি ভবন ও পরিবহণ ভবন। তারপর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে শাস্ত্রী ভবন, উদ্যোগ ভবন, নির্মাণ ভবন, কৃষি ভবন এবং উপরাষ্ট্রপতি ভবন। নয়া প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের সমস্ত দপ্তরগুলিকে এক ছাদের নীচে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। তার জায়গা তৈরি করতেই ভাঙতে হবে পুরনো ইমারত।

সেন্ট্রাল ভিস্টা এলাকার জমির ব্যবহারে বদলের অনুমতি, পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে মামলা হওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে ছিল যে তাদের সবুজ সঙ্কেত না পাওয়া পর্যন্ত এর নির্মাণকাজ শুরু হবে না। কিন্তু ৫ জানুয়ারি ২০২১-এর রায়ের পর সে বাধাও কেটে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে এই প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। জমির ব্যবহারে বদল নিয়ে ভিন্নমত হয়ে একজন বিচারপতি আলাদা রায় দিয়েছেন তিনি। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে সংখ্যাধিক্যর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মহামান্য আদালতে সংখ্যাধিক্যর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংসদের অনুপ্রেরণা অথবা অনুসরণে হয়েছে কিনা বলা মুশকিল।

এর আগে তিন তালাকের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা পুরোপুরি একমত হতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্ট সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে ছাড়পত্র দিলেও প্রশ্ন ওঠে, এটা কি আইনি বিষয়? সরকারের অগ্রাধিকারের প্রশ্নটি বোধ হয় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত ছিল। এই সংকটকালে ২০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প এক আত্মমুগ্ধ, নিরঙ্কুশ শাসকের ইচ্ছেমতো উপায়ে ইতিহাসে নিজের নাম খোদাই করে যাওয়ার চেষ্টা বলে অভিযোগ আনা হচ্ছে। তা কি অপ্রাসঙ্গিক?

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে স্বগতোক্তির মতোই প্রশ্ন তুলেছেন, আদালতের কাছে কি কেন্দ্রীয় সরকারকে নীতি বাতলে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে? উন্নয়নের একটি বিশেষ দিকে নজরের ক্ষেত্রের সরকারের বিচক্ষণতা নিয়ে কি আদালত প্রশ্ন তুলতে পারে? আইনের ভিত্তি ছাড়া আদালত কি সরকারকে নৈতিক বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারে? আদালতকে শেষ পর্যন্ত আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয় বলেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তাঁরা।

বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। গণতন্ত্রের এ এক বিচিত্র মহিমা। যুক্তি বিশ্লেষণ নয় সংখ্যাধিক্যই যেন শেষ কথা।

পুরাতন বর্জন। নতুনকে বরণ। এটাই তো চিরকালের রীতি। সারা বিশ্বে এই পদ্ধতির প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী অট্টালিকার সংরক্ষণ সর্বত্র স্বীকৃত সংস্কৃতি। কিন্তু সম্পূর্ণ প্ৰপতন? হয়তো এক এবং একমাত্র ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। তবে গুঁড়িয়ে দিলেই কি সবকিছু হারিয়ে যায়?