আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ● ২-১৭ মাঘ, ১৪২৭

সমসাময়িক

পুঁজিপতিদের কাগুজে বাঘ


ভারতের অর্থব্যবস্থা গভীর সংকটে। নিত্য নতুন সংকটের দিকে দেশের অর্থব্যবস্থাকে ঠেলে দেওয়ার অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছে মোদী সরকার। ২০১৬ সালে নোট বন্দী এবং ২০১৭ সালে জিএসটি প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থব্যবস্থা, বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছে। ২০২০ সাল দেশের জনজীবনে নিয়ে এসেছে একদিকে করোনা ভাইরাসের প্রবল আক্রমণ অন্যদিকে সরকারের সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত লকডাউন মানুষের জীবন-জীবিকার ধ্বংস সাধন করেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকাশিত হল ২০২০-২১ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র প্রথম পূর্বাভাস। মনে রাখতে হবে ২০২০-২১ অর্থবর্ষ শেষ হবে মার্চ মাসে। তবু ২০২০ সালের অক্টোবর মাস অবধি উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে দেশের পরিসংখ্যান দপ্তর গোটা অর্থবর্ষের তথ্যের আগাম পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে। পরে এই সংখ্যাগুলি পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবু, আপাতত দেশের অর্থব্যবস্থার হাল বুঝতে সাহায্য করবে এই তথ্য।

যেমন এই তথ্য বলছে ২০২০-২১ সালে দেশের জিডিপি-র বৃদ্ধির হার হবে মাইনাস ৭.৭ শতাংশ। স্বাধীনতার পরে এর আগে মাত্র তিনবার কোনো বছর দেশের বৃদ্ধির হার ঋণাত্বক হয়েছিল, শেষবার হয়েছিল ১৯৮০-৮১ সালে। এই বিষয় কোনো সন্দেহ নেই যে করোনা জনিত লকডাউনের জন্যই দেশের বৃদ্ধির হারের এই বিপুল পতন হয়েছে। তবু, মনে রাখতে হবে যে করোনা হওয়ার আগেও দেশের বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছিল। ২০১৭-১৮ সালে ভারতের বৃদ্ধির হার ছিল ৭.২ শতাংশ, ২০১৮-১৯ সালে তা কমে হয় ৬.১ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে বৃদ্ধির হার আরো কমে হয় ৪.২ শতাংশ। অর্থাৎ, করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার বহু বছর আগে থেকেই আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নগামী। করোনা জনিত লকডাউন এই প্রবণতাকে আরো বাড়িয়েছে, যার ফলে ২০২০-২১ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার মাইনাস ৭.৭ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

জিডিপি-র বিভিন্ন ক্ষেত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে দেশে কৃষি ব্যতীত সমস্ত ক্ষেত্রেই আর্থিক সংকোচন হবে ২০২০-২১ সালে। ম্যানুফাকচারিং বা উৎপাদন শিল্পে বৃদ্ধির হার হবে মাইনাস ৯.৪ শতাংশ, নির্মাণ শিল্পে মাইনাস ১২.৬ শতাংশ, খুচরো-পাইকারি ব্যবসা, হোটেল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাইনাস ২১.৪ শতাংশ। মনে রাখতে হবে এই ক্ষেত্রগুলিতেই সর্বাধিক কর্মসংস্থান হয় ভারতে। তাই এই ক্ষেত্রগুলির ব্যাপক সংকোচন হলে দেশে বেকারত্বের সমস্যাও বাড়বে। ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে যে দেশে কয়েক কোটি মানুষের চাকরি চলে গিয়েছে। বহু মানুষ বেকার এবং বহু মানুষ হতাশ হয়ে গিয়ে চাকরিও আর খুঁজছেন না, বাড়িতে বসে রয়েছেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় এক কোটি ৪৭ লক্ষ মানুষ কম মানুষ কর্মরত রয়েছেন। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে যত মানুষ কাজ করতেন তার থেকে প্রায় ১.৫ কোট মানুষ বিয়োগ করলে বর্তমান কর্মরত মানুষের হিসেব পাওয়া যাবে। তদুপরি বহু মানুষ কাজের বাজার ছেড়ে চলে গেছেন, যারা আর কাজ খুঁজছেন না। এই পরিস্থিতিতে শ্রম বাজারে অংশগ্রহণের হার লাগাতার কমছে আমাদের দেশে। সব মিলিয়ে আর্থিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া এবং কর্মসংস্থানের সংকট এক প্রবল আকার ধারণ করেছে।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রেক্ষাপটে বাজেট পেশ করতে চলেছে। অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে এমন বাজেট নাকি দেশের ইতিহাসে কখনও পেশ করা হয়নি, যা তিনি ১ ফেব্রুয়ারি করবেন। সেই পূর্ব-ঘোষিত ঐতিহাসিক বাজেট দেশের মানুষের আশু সমস্যার সমাধান করবে নাকি মোদী-মিত্র পুঁজিপতিদের পকেট স্ফীত করবে সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ২০২০-২১ সালে কোষাগারের যে হিসেব এখন অবধি পাওয়া যাচ্ছে তার থেকে মনে হচ্ছে দেশের মানুষের দুর্দিন এত সহজে কাটবে না।

বিগত বছরে বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে ২০২০-২১ সালে রাজস্ব আদায় আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বাড়বে। এই অনুমানের নেপথ্যে ছিল বর্তমান মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশ বাড়বে এই আশা। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার ঋণাত্বক হয়ে গেছে। ২০১৯-২০ সালে দেশের জিডিপি-র পরিমাণ ছিল ২০৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ সালে কমে হবে ১৯৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী ভেবেছিলেন ২০২০-২১ সালে এই জিডিপি-র পরিমাণ হবে ২২২ কোটি টাকার বেশি। এই ঘাটতি সরাসরি প্রতিফলিত হবে রাজস্ব আদায়ের সংখ্যায় এবং রাজস্ব ঘাটতির হিসেবে।

নভেম্বর ২০২০ অবধি যেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্ব আদায় আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ কম রয়েছে। এই হ্রাস আরো বেশি হত যদি না সরকার পেট্রোল এবং ডিজেলের উপর ব্যাপক পরিমাণ উৎপাদন শুল্ক লাগিয়ে বাড়তি টাকা মানুষের থেকে আদায় না করত। ফলত, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঐতিহাসিকভাবে কমে গিয়েছে, সেখানে দেশের মানুষকে এখন সর্বাধিক বেশি দাম দিয়ে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন।

কিন্তু অতিমারির কবলে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে সরকারী খরচ বাড়াতে হয়েছে। নভেম্বর ২০২০ অবধি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৪.৭ শতাংশ খরচ বাড়ানো হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে গতবছর বাজেট পেশ করার সময় কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল মোট সরকারী খরচ আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বাড়ানো হবে। সেখানে বাড়ানো হল মাত্র ৪.৭ শতাংশ। একদিকে সরকার আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পে ৩০ লক্ষ কোট টাকা খরচ করা হবে বলে দাবি জানাচ্ছে। অথচ, যেখানে অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার ঐতিহাসিক পতন প্রত্যক্ষ করেছে দেশে মন্দা দেখা দিয়েছে, তখন সরকারী খরচের উপর এহেন লাগাম পরানোর কারণ কী?

আসলে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি যে-কোনো সরকারী বিনিয়োগ বা খরচের বিরোধী। বিশ্বের সমস্ত সরকার তটস্ত - খরচ বাড়ালে এই বুঝি আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি বিশ্বায়নের চাকায় ভর করে অন্য দেশে পাড়ি দেবে। বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের মতন পুঁজিবাদের প্রহরীরা বারবার দেশগুলিকে এই কথাই বুঝিয়েছে যে, কোনো অবস্থাতেই সরকারী খরচ বাড়ানো যাবে না। বিশেষ করে রাজস্ব ঘাটতি যেন কিছুতেই না বাড়ে। বর্তমানে এই সংস্থাগুলি এহেন কড়া অবস্থান না নিলেও মোটের উপর তাদের বক্তব্য একই থেকে গেছে যা আসলে নবউদারবাদী অর্থনীতির একটি মূল স্তম্ভ। এই পরিস্থিতিতে, বিশ্বের তাবড় অর্থব্যবস্থা, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা ব্রিটেন, তারা কিন্তু নিজেদের রাজস্ব ঘাটতি বাড়িয়েছেন। কিন্তু মোদী দেশের ভিতর ৫৬ ইঞ্চির গল্প শোনালেও আসলে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির সামনে ভীরু খরগোশের মতই গুটিয়ে যান। তাই দেশের রাজস্ব ঘাটতি যাতে খুব বেশি না বেড়ে যায়, তাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য।

অতএব, মন্দাবস্থা চললে যেখানে সরকারী খরচ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তাকে মোকাবিলা করার কথা সেখানে মোদী সরকার সেই পথে খুব বেশি হাঁটতে রাজি নন। গত বছর বাজেট পেশ করার সময় বলা হয় যে সরকারের মোট বাজেট ঘাটতি ২০২০-২১ সালে ৮ লক্ষ কোটি টাকা হবে। পরে করোনার প্রকোপের পরে সরকার জানায় যে তারা আরো ৪ লক্ষ কোটি টাকা বাজার থেকে ধার করবেন। অর্থাৎ, সরকারের মোট বাজেট ঘাটতি ২০২০-২১ সালে ১২ লক্ষ কোটি টাকা হবে বলে সরকার ধরে নিয়েছে।

কিন্তু সরকারের রাজস্ব আদায় ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায়, এবং খরচের বৃদ্ধি খুব বেশি না হলেও, ইতিমধ্যেই সরকারের বাজেট ঘাটতি ১০৭৫৫০৭ কোটি টাকা হয়েছে (নভেম্বর ২০২০ অবধি)। অর্থাৎ আর মাত্র দেড় কোটি টাকা সরকার বাজার থেকে ধার নিতে পারবে। এই পরিমাণ মাত্র ধার যদি করা হয় তবে সরকারের খরচে রাশ টানতে সরকার বাধ্য হবে। এহেন রাশ টানা হলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। অতএব, দেশের অর্থব্যবস্থার হাল খুব বেশি বদলাবে না বলেই মনে হয়।

তাহলে উপায়? করোনা জনিত লকডাউনের ফলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমেছে, রাজস্ব আদায় কমেছে, অতএব বাজেট ঘাটতি বেড়েছে, তবে তাকে বাগে রাখতে খরচের বৃদ্ধি খুব বেশি করা হয়নি, যদিও আত্মনির্ভর প্যাকেজের নামে প্রচুর খরচের প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল। একদিকে যখন সাধারণ মানুষ এই আর্থিক পরিস্থিতির জন্য দুর্দশায় পড়েছেন, সেখানে কিন্তু দেশের ধনী শ্রেণি তাদের সম্পদ বাড়িয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। অথচ দেশে সম্পদের উপর কোনো কর দিতে হয় না। আপনার যদি সম্পদ প্রভূত পরিমাণ বাড়ে, কারণ আপনার বাবা-মা আপনাকে কয়েক কোটি টাকা দান করল বা আপনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেলেন, তাহলে কিন্তু আপনাকে তার থেকে কোনো কর দিতে হয় না। আপনার মোট সম্পদের উপরেও করের পরিমাণ শূন্য।

ভারতে যতজন ডলার বিলিয়নেয়ার (যাদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার বা তার বেশি)আছেন তাদের সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ৪২৩০০ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ হবে ৩১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের থেকে যদি মাত্র ৩ শতাংশ কর নেওয়া যায় তাহলে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা সরকারের তহবিলে আসতে পারে। আবার যদি দেশের ধনীতম ১ শতাংশের থেকে এই কর সংগ্রহ করা হয় তবে ১ শতাংশ কর নিলেই কয়েক লক্ষ কোটি টাকা সরকারের তহবিলে আসবে। অর্থমন্ত্রী বলছেন যে আসন্ন বাজেট ঐতিহাসিক হবে। তবে তিনি যে এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন না, তা হলপ করে বলা যায়। সাধারণ মানুষের জন্য মোদী শক্তিধর যুগপুরুষ সাজেন। আসলে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি এবং ভারতের পুঁজিপতিদের সামনে তিনি কাগুজে বাঘ ছাড়া আর কিছু নন।