আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়




‘উল্টোরথ’ পত্রিকা আয়োজিত ১৯৫৮ সালের মানিক স্মৃতি পুরস্কারের প্রথম তিন জন যে মতি নন্দী (‘ধুলোবালির মাটি’, পরে ‘নক্ষত্রের রাত’ নামে পুনর্লিখিত), অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় (‘সমুদ্র মানুষ’) এবং পূর্ণেন্দু পত্রী (‘দাঁড়ের ময়না’) সেকথা বেশ প্রচারিত। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থানে থাকা আজিজুল হক যে পরবর্তীকালের হাসান আজিজুল হক তা তেমন জানা কথা নয়। তখন হাসান আজিজুল হকের বয়স আঠারো-উনিশ হবে। ১৯৩৯-এ বর্ধমানের যবগ্রামে জন্ম তাঁর। স্কুলের পড়া শেষ করে ১৯৫৪-য় পাড়ি দিয়েছেন ওপার বাংলায়। তবে বুকের মধ্যে আজীবন পুষে রেখেছেন রাঢ় বাংলাকে তার সমস্ত বাস্তবতা সমেত। ‘কালো বরফে’র লেখক মাহমুদুল হকের মতোই হাসান আজিজুল হকও র্যা ডক্লিফ রোয়েদাদে উদ্বাস্তু, দু-জনেরই যাত্রাপথটা পশ্চিম থেকে পুবে। তিরিশ বছর পর ফের নিজের জন্মভিটেয় বেড়াতে যাবার অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে ‘আবার যদি ইচ্ছা করো’ নিবন্ধে তিনি নিজের গ্রামের একটা বর্ণনা দিয়েছেনঃ

"ভূগোলটা আগেই জানিয়ে রাখি। বর্ধমান-কাটোয়া ছোটো লাইনের মাঝামঝি জায়গায় নিগন; স্টেশন থেকে সিধে পুবমুখো সড়ক। সড়কটা সিধে নয় বরং একটু বেশিই আঁকাবাঁকা, খানিকটা এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসতে হয়, কোথাও ‘দ’-এর মতো, কোথাও বা বাংলাদেশের মানচিত্রের নীচের দিকটার মতো ধুলোভর্তি সড়ক। মোরাম দেওয়া হয়েছিল তার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি এখনও। কিন্তু রাঢ়ের ফাঁকা মাঠের হুহু হাওয়ায়, বৃষ্টির তোড়ে, গরু-মোষের পায়ে পায়ে, গাড়ির চাকায় চাকায় লাল মোরাম ধুয়ে-মুছে সাফ। ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে এই অঞ্চলের মূল সাদা শক্ত এঁটেল মাটি। এই সড়ক ধরে আমাকে দু-মাইল যেতে হবে। মাঝখানে আর কোনো গাঁ নেই। একেবারে সেই এক ক্রোশ গিয়ে তবে আমার গ্রাম যবগ্রাম। দু-পাশেও, বাঁ-পাশে ডান পাশে দু'তিন মাইলের মধ্যে কোনও জনপদের ঠিকানা নেই। মোট কথা সড়কের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতে একেবারে দিশেহারা। মাথার উপরে শীতকালের দুপুরবেলার নীল আকাশ, বিরাট একটা খালি পেয়ালার মতো উপুড় হয়ে পড়ে আছে বহুদূরে আশেপাশের গাঁ-গুলির হালকা রেখামাত্র দেখা যায়। ধান কেটে নিয়ে জমি শূন্য এত সমতল যেন পেটানো ছাদ, যেন ফুটবল খেলার মাঠ। হঠাৎই একটা হুহু হাওয়া উঠল। কী রকম যে করে উঠল বুকের মধ্যে ! হুহু করে উঠল হাওয়া নয়, হুহু করে উঠল বুকের ভেতরের ফাঁকা জায়গাটা। হাওয়া তো সেখানেও ওঠে"।

এই টোপোগ্রাফি আর এখানকার মানুষ ও তার মুখের রেখা এবং ভাষা তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। হাসান আজিজুল হকের এই যে নিজস্ব এক ভূগোল, যা তাঁর বহু লেখায় ঘুরে ফিরে আসে, তার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে ‘বিজ্ঞাপন’ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত ‘লেখকের উপনিবেশ’ গদ্যে। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন কেন একজন লেখকের পক্ষে অন্যজনের মতো হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। মানুষের অভিজ্ঞতার বহুস্তরীয় জগতে যেভাবে পরোক্ষ আর প্রত্যক্ষের দেওয়া-নেওয়া চলে, স্বপ্ন-অভিমান ভরা কৈশোর, জীবনের ভালোবাসা, শ্রম কিংবা ঘৃণার বয়ান, চেনা অনভূতি যদি ‘অজানা বোধের প্রান্তদেশ ছুঁয়ে যায়’, যদি সবটা প্রতিফলিত হয় সাহিত্যে, তবে একজন লেখকের অনন্যতার খোঁজ মেলে। আর নিজের জগতে নিজের মুদ্রাদোষে না হলেও, একা হয়ে যাওয়াটা লেখকের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী। তাঁর ভাষায়ঃ "যে জগতের পত্তনি নিয়েছেন তিনি একটি একটি করে সেখানে গাছ, বাড়ি, নদী, মানুষ সাজাতে হয়, একা কোদাল চালিয়ে রাস্তা তৈরী করতে হয় নিজের সব বিচিত্র নিয়ম চালু করতে হয়। সোজা কথায় লেখককে স্থাপন করতে হয় একটি নিজস্ব উপনিবেশ"।

সেই ১৯৬০-এ ‘শকুন’ গল্প দিয়ে তাঁর এই উপনিবেশ স্থাপনের সূচনা। রুক্ষ রাঢ়ের পরিবেশে এক দুর্দান্ত শিশুর হাতে ‘নির্বাক, নিরুদ্যম, নিরুৎসাহ’ বুড়ো শকুনের করুণ পরিণতি, মৃত শকুনের পাশে পড়ে থাকা অর্ধোস্ফুট এক মানবশিশুর লাশের দিকে শকুনের পালের ছুটে আসা, শকুন যে শকুনের মাংস খায় না সেকথা মনে করিয়ে দিয়ে লেখক কীভাবে যেন আমাদের মধ্যবিত্ততাকে ভয়ানক অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। আমাদের সুসামাজিক ব্যবস্থাপনার ঠুনকো দিকটা উন্মোচিত হয়েছিল সহজেই।

এভাবে সাহিত্যজীবন শুরু করা লেখক প্রায় পাঁচ দশক সময় নিয়েছেন নিজের প্রথম উপন্যাস লিখতে। এমন নয় যে লেখা বন্ধ ছিল। একের পর এক গল্প গ্রন্থ, স্মৃতিমূলক লেখা বা প্রবন্ধ, এমনকী দর্শন শাস্ত্রের ঘনিষ্ঠ বিষয় নিয়েও তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে। তবু প্রথম উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ প্রকাশিত হল ২০০৬-এ।

‘আগুনপাখি’ বস্তুত গত শতাব্দীর সমবয়সী এক নারী-কথকের বয়ানে গ্রামবাংলার দিবস-রজনীর বয়ে চলা। কিন্তু ভুললে চলে না, গত শতাব্দী দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, দাঙ্গা দেখেছে, মন্বন্তর দেখেছে আর কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতা হয়েছে বাঙালির নিজস্ব ভূখণ্ডটাকে দু-টুকরো করে দিয়ে। এই নিয়েই ‘আগুনপাখি’। কীভাবে গ্রামের এক সাধারণ নারীর আত্মকথনমূলক আখ্যান ধারণ করল একটা শতাব্দীর প্রায় অর্ধেকটা সেখানেই লেখকের মুনশিয়ানা। নাটকীয় জয়-পরাজয় কিংবা জীবনের মধ্যবিত্ততোষ ভাবালুতা বর্জন করে লেখক বুনে গেছেন একটার পর একটা দিন। বাপের বাড়ির কথন আর বেশিটা স্বাভাবিকভাবেই শ্বশুরবাড়ির কথা। স্বামী-পুত্র-কন্যা-বিধবা শাশুড়ি-ননদ নিয়ে ঘরকন্নার কথা। এ যেন মুকুরে বিশ্বদর্শন। কিন্তু মূল সুরটা বাংলার চিরকালীন সংবেদনশীল জীবনপ্রবাহের সমীপবর্তী। কথক-নারীকে কোনো অর্থেই বাংলার প্রান্তিক গরিব মানুষের প্রতিনিধি বলা চলে না। বরং গ্রামবাংলার অসংখ্য গরিব মুসলমান বাড়ির তুলনায় তার বাপের বাড়ি এবং বিশেষ করে বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়ি বেশ সম্পন্নই। লেখক অনুপুঙ্খে কথককে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন নিজস্ব শ্রেণি অবস্থান থেকেই। কেননা শ্রেণি অবস্থান সম্পর্কে হাসান আজিজুল হক একেবারে নীরব ছিলেন এমনটা নয়। ‘বিজ্ঞাপনপর্ব’ পত্রিকার ১৯৮৯ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘সংস্কৃতি নিয়ে’ নিবন্ধে তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন সংস্কৃতি মানে শ্রেণি সংস্কৃতি এবং তা শ্রেণির অবস্থান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু মানুষের দুর্জয় প্রাণশক্তি এবং সৃজন ক্ষমতার খোলা ক্যানভাসও সংস্কৃতি বলেই মানতেন তিনি। তাই কী 'আগুনপাখি'র মুখ্য চরিত্র গ্রাম বাংলার এক নারী? যে নিজের বাপজির সামনে কখনো বিশেষ কথা বলতে পারেনি, খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে ছোটো ভাইকে কোলে-কাঁকালে মানুষ করেছে। কত বয়স তখন তার? মাত্রই আট-ন বছর হবে। কিন্তু তার সারাজীবনে প্রাপ্তি যেমন আছে, তেমনই হাত থেকে সব কিছু বেরিয়ে যাওয়াও দেখতে হয়েছে সাশ্রু নয়নে। মাকে দিয়ে শুরু, তারপর নতুন মা বন্ধুর মতো এল বটে কিন্তু ছোটো ভাইটা চিরকালের মতো চলে গেল মামার বাড়িতে। আর শ্বশুরবাড়িতে তো একছত্র আধিপত্য শাশুড়ির। কথকের ভাষায়,

"আমি লতুন বউ হয়ে থাকলম আর কদিন? কানে তুলো পিঠে কুলো চোখে ঠুলি লাগিয়ে সোংসারের ঘানিতে জুতে গ্যালম দু'দিন যেতে না যেতেই। তবে, এই এক সুবিদা, ই সোংসারে আমার দেখার কিছু নাই। বাড়ির গিন্নি আছে, সেই দেখবে। যা করবার সেই-ই করবে। বড়ো বৌ আর আমি শুদু ঘুন্নিপাক খেলেই হয়ে যাবে। হ্যাঁ, সেই যি ঘানি টানতে লাগলম, সারা জেবন একবারও আর থামতে পারলম না। ডাইনে বললে ডাইনে, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। শুদুই হুকুম তামিল করা। এ্যাকন মনে হয়, জেবনের কুনো কাজ নিজে নিজে করি নাই, নিজের ইচ্ছা কেমন করে খাটাতে হয় কুনোদিন জানি নাই। আমি কি মানুষ, না মানুষের ছেঁয়া? তা-ও কি আমার নিজের ছেঁয়া?"

বাংলার সেসময়ের গ্রামসমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা এখানে পাওয়া যায় ঠিকই, তবে তা নিয়ে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত করতে গেলে আমাদের বিপাকে পড়তে হবে। কথকের ‘কত্তা’ এক আশ্চর্য মানুষ। বিয়ের পর নতুন বউকে গ্রামের হিন্দু জমিদারবাড়ি নিয়ে যায় সে। সেখানকার গিন্নিমার সেও এক ছেলে যেন, এমনভাবেই নতুন বউকে গিন্নিমা এক-গা গয়না পরিয়ে দেয়। আর কত্তা বৈষয়িক কাজেকর্মেও অত্যন্ত দড়। তার পিতৃবিয়োগের পর প্রায় ভেসে যাওয়া সংসার সে একা হাতে সামলেছে বলেই আকারে-প্রকারে অনেক বেড়েছে আয় এবং স্বাভাবিকভাবেই সংসারের শ্রী বেড়েছে সেই অনুপাতে। এমনকী নিজের স্ত্রীকে খানিক লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থাও করেছে সে। তবু পুরুষতন্ত্রের সামনে নতজানু হয়ে থাকার স্মরণাতীতকালের ধারণার বোঝা কাটিয়ে ওঠা সহজ কথা ছিল না। সংসারে আসার পর প্রথম কয়েক বছর নতুন খোকা আর সংসারের ক্রমাগত শ্রীবৃদ্ধি একদিক থেকে ‘মেতর বৌ’কে খানিকটা প্রতিষ্ঠাই দিয়েছিল। কিন্তু জীবনের রং যেমন বদলায় কথককেও তেমনই বদলে যাওয়া সময়ে নীরব সাক্ষী হয়ে থাকতে হয়েছে। প্রথম সন্তানের মৃত্যু মেনে নিতে হয়েছে। পরের ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁজে নিতে হয়েছে বেঁচে থাকার নতুন মানে। কত্তা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়েছে, আবার স্বাভাবিক নিয়মেই সেই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিপত্তি পরে কমেও এসেছে। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি দেখেছে আবার তুচ্ছ ভোটের কারণে দলাদলিও দেখেছে। কাছের মানুষকে পর করে দিয়েছে রাজনীতির জটিলতা। তারই মাঝে তার বুঝতে অসুবিধে হয়েছে কোথাকার কোন বিশ্বযুদ্ধ কেন এমন অচল করে দিতে থাকল বাংলার গ্রামজীবনকেও। কাপড় পাওয়া যায় না ! গ্রামের আকাশে বিশাল পাখির মতো এরোপ্লেন পাক খায়, গোরা পল্টন গ্রামে ঢুকে যথেচ্ছাচার চালায়। মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আসে পঞ্চাশের মন্বন্তর। প্রায় তিরিশ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান মানুষ স্রেফ না খেতে পেয়ে মরে গেল অথচ সরকারের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। ততদিনে কথক একটু একটু বুঝতে শিখেছে বিশ্বের রাজনীতি কীভাবে আমাদের দেশের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। যে-সংসারে উপচে পড়ত চাল-ডাল, সেখানেও দিন গোনা শুরু হল আর ক-দিন চলবে জমা চালে তাই নিয়ে। দুঃখে-সুখে এভাবে চলছিল বটে কিন্তু মারাত্মক ধাক্কাটা এল ১৯৪৬-এর ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-কেন্দ্রিক ১৬ থেকে ১৮ অগাস্ট কলকাতার নারকীয় দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে। গ্রামের এক হিন্দু যুবক নৃশংসভাবে খুন হল কলকাতায়। তিনদিন কলকাতার হিন্দু মুসলমান মহল্লা ত্রস্ত হয়ে থাকল দাঙ্গার আগুনের আঁচে। জীবনানন্দের কথায়, "মানুষ মেরেছি আমি তার রক্তে আমার শরীর/ ভ’রে গেছে, পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার/ ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু/ হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ করে গেল"। আর হাসান আজিজুল হক লিখছেন, "এত খুন, এত লউ, মানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লেগে"। কথক ‘বঙ্গবাসী’ কাগজে ততদিনে দেখেছে, ‘মোসলমানদের আলেদা একটো দেশের লেগে আন্দোলন হচে’। তার কানে আসছে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বা লিগ নেতাদের সঙ্গে একটার পর একটা ব্যর্থ আলোচনার কথা। কিন্তু তার বিবেচনায়ঃ "ইসব কথার সাথে হিঁদু-মোসলমান সোংসারি মানুষের কোনো সম্পক্ক নাই আর নাই য্যাকন ত্যাকন আমি মাথা ঘামাইতে যাই ক্যানে ! তবে খালি মনে হতে লাগল মোসলমানের দ্যাশ হবে অথচ সব মোসলমান সিখানে থাকবে না, এমনও হতে পারে জি আমি থাকব কিন্তুক আমার সোয়ামি ছেলেমেয়ে থাকবে না। তাই যেদি হয় তাইলে ই কাজ করতে যেয়ে হিঁদু-মোসলমান সম্পক্ককে বিষ বিষ করতে হবে ক্যানে?" কিন্তু বাংলার এই বধূ জানত না গঙ্গা-পদ্মায় ততদিনে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তার ধারণা অনেকটা ঋত্বিককুমার ঘটকের ‘আমার ছবি’ প্রবন্ধের বক্তব্যের মতোঃ

"আমরা এক বিড়ম্বিত কালে জন্মেছি। আমাদের বাল্যকাল বা আমাদের কিশোর বয়স যে সময়ে কাটে সে-সময়ে দেখেছি বাংলার পরিপূর্ণ রূপ।... রূপকথা, পাঁচালী আর বারো মাসের তেরো পার্বণের গ্রামবাংলা নবজীবনের আশায় থৈথৈ করছে। এমন সময় এলো যুদ্ধ, এলো মন্বন্তর, মুসলিম লিগ আর কংগ্ৰেসরা দেশের সর্বনাশ ঘটিয়ে দেশটাকে টুকরো করে দিয়ে আদায় করল ভগ্ন স্বাধীনতা। সাম্প্রদায়িকদাঙ্গার বন্যা ছুটল চারদিকে। গঙ্গা পদ্মার জল ভাইয়ের রক্তে লাল হয়ে গেল। আমাদের স্বপ্ন গেল বিলীন হয়ে! আমরা এক লক্ষ্মীছাড়া জীর্ণ বাংলাকে আঁকড়ে ধরে মুখ থুবড়ে রইলাম। এ কোন বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য আর নীতিহীনতা আমাদের নিত্যসঙ্গী, যেখানে কালোবাজারি আর অসৎ রাজনীতিকের রাজত্ব, যেখানে বিভীষিকা আর দুঃখ মানুষের নিয়তি !"

ঋত্বিক রক্তবমি করতে করতে দেশভাগের যন্ত্রণা উগড়ে গেলেন দেশভাগের প্রায় তিন দশক পর পর্যন্ত। কিন্তু এই নারী আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয়ে থেকে যাবে আমাদের সামনে। সে জানাচ্ছে আমাদের, "ই দ্যাশ থেকে কজনা যেচে জানি না, উ দ্যাশ থেকে লিকিন বেশুমার মানুষ সব্বস্ব হারিয়ে ইখানে এসে হাজির হচে"। কিন্তু তার জীবনেও, ওই শুরুতে যেমন বলা হল, এক হাতে যেমন আসে তেমনই ছাড়তে হয় অন্য হাতে। সমাজের সর্বব্যাপী ভাঙন আটকানো ক্রমশ তার ক্ষমতার বাইরে চলে গেল। সংসার টুকরো হল। ছেলেমেয়েরা পূর্ব পাকিস্তানে গেল কেউ চাকরি করতে, কারুর বরের চাকরি-সূত্রে, কেউ কলেজে পড়তে। ঘর বাড়ি সমাজ সংসার সাত টুকরো হতে লাগল। সে বুঝল, ‘এ্যাকটো মানুষও আর গোটা থাকবে না, আমিও থাকব না, কত্তাও থাকবে না।’

‘উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা’ প্রবন্ধে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন পূর্ববর্তী পুরুষদের পুনরাবৃত্তি করে কোনো সময়ের কোনো শিল্পীই মানুষের মধ্যে নতুন করে আবেদন তৈরি করতে পারেননা। শুধু প্রকরণগত পরিবর্তনও উপন্যাসে প্রাণ সঞ্চার করতে পারে না। নতুন ভাবনা থাকলে তবেই নতুন কিছু হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের সমসাময়িক দুই লেখকের দৃষ্টি এখানে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। বাংলা ভাষায় আত্মকথনমূলক উপন্যাসের তালিকা তৈরি করতে বসলে তার দৈর্ঘ্য নেহাত কম হবে না। কিন্তু ‘আগুনপাখি’র কথক চরিত্রটি উপন্যাসের শেষে এসে যে ঋজু ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা এই উপন্যাসকে বাংলা ভাষায় অনন্য করেছে। ভিটেমাটিকে জড়িয়ে থেকে পরিবারের সবার গন্তব্যের বিপরীতে মুখ ফিরিয়ে সে একাই থেকে গেছে রাঢ় বাংলার গ্রামের বাড়িতে। উপন্যাসের শেষের কয়েক পাতায় এসে লেখক তাকে দিয়ে এমন সব মৌলিক মানবিকতার প্রশ্ন তোলেন যার কোনো ব্যাখ্যা সেদিন দেশ বদল করতে বাধ্য হওয়া মানুষের কাছে ছিল না। এমনকী সে তখন তার কত্তাকে শুধু অমান্যই করে না, প্রশ্নবিদ্ধও করে। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটা ‘সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়’? অথচ উত্তরটা জানা তার ভীষণ দরকার ছিল। উপমহাদেশের ইতিহাসের জঘন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সেই প্রহরে এত সহজ করে ভাবতে পেরেছিল বাংলার এক বধূ, যে বিদ্ধ হয়েছে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, যার আকাশ পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। আর হাসান আজিজুল হক দেশভাগের প্রায় ষাট বছর পর আত্মজৈবনিক নানান উপাদান ব্যবহার করে গড়ে তুললেন এই আখ্যান যার অসহায় মূল চরিত্রটি অন্ধকারে একা মশালের মতো জেগে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গে হাসান আজিজুল হকের রচনা নিয়ে একেবারে প্রথম দিকে যারা আলোচনা করেছেন তাঁদের অন্যতম সুবীর রায়চৌধুরী ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার ডিসেম্বর ১৯৮৭ সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘হাসান আজিজুল হকের গল্পের জায়গা জমি মানুষ’ নামে একটি অনবদ্য প্রবন্ধ। সেখানে হাসান আজিজুল হকেরই ‘গল্পের জায়গা জমি মানুষ’ প্রবন্ধ থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন লেখকের মূল অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁর লেখার মানুষেরা, ‘নামহীন গোত্রহীনরা’ চিরকালই সাহিত্যের উপকরণ হয়ে থাকবে। হাসান আজিজুল হকের আক্ষেপ তারা কেউ মানুষের জীবন কাটাল না, সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির কথা তাদের কাছে তোলা নেহাতই বাতুলতা। আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন পশুর সঙ্গে মানুষের জীবনের ভেদরেখাটুকুও ওদের জীবনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। সুবীর রায়চৌধুরীর মনে হয়েছিল হাসান আজিজুল হকের মেজাজ এদিক দিয়ে অনেকটা জীবনানন্দীয়। "তিনি নিজের প্রতি, স্ব-শ্রেণীর প্রতি নির্বিকারভাবে নির্মম হ’তে পারেন"। আমাদের মনে হয় মানব চরিত্রের অসামান্য রূপকার হাসান আজিজুল হক তাঁর ‘আগুন পাখি’তেও এভাবে চিত্রকরের দক্ষতায় এঁকে গেছেন জীবনের টুকরো টুকরো টানা-পোড়েন, যার ক্যানভাসটা বিপুল এবং পলিফোনিক। অকারণ আত্মপ্রক্ষেপণ নয় বরং নিয়ন্ত্রিত আবেগে পরতের পর পরতে খুলে গেছেন জটিল সব গ্রন্থি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানিক ভাষাতেও রূপকল্প নির্মাণের অসাধারণ ক্ষমতা। একেবারে শুরুতে কথকের মায়ের ‘মওতে’র ছবি দিয়ে যার শুরু আর শেষে রিক্ত পরিত্যক্ত অবস্থায় সে যখন বসে দেখে চারটি গরুর গাড়ি ধীরে ধীরে একবার চোখের আড়াল হয়, আর এক বার দৃশ্যমান হয়, শেষ পর্যন্ত কয়েকটি কালো বিন্দু শূন্যে মিলিয়ে যায়। চলমান চিত্রমালার মতো সেই বিবরণ আমাদের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছে’র শুরুর লাইন দুটির চিত্রকল্পের সমীপবর্তী করে দেয়। সেখানে শীতবাতাসে কলাপাতার যে দোদুল্যমানতার কথা আছে, ‘আগুন পাখি’র শেষ সন্ধেতেও পাঠক যদি একই রকম শীত অনুভব করেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। স্বজন পরিত্যক্ত নারীটির তখন প্রার্থনা সকালের রোদ। একটুকু উষ্ণতা। আর সারা আখ্যানে লেখক তো আমাদের সামনে তার বুক-পিঠ সহ গোটা জীবনটাই খোলা পাতার মতো মেলে রেখেছেন।