আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ভারতীয় জাতিতত্ত্বের জনক - শরৎচন্দ্র রায়

সৃজা মণ্ডল




‘ভারতীয় জাতিতত্ত্বের জনক’ রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় - ভারতের প্রথম নৃতত্ত্ববিদ। যার দর্শন মানুষকে ভালোবাসা, নিপীড়িত মানুষের জীবনে জীবন-যোগ। তিনি অনুধাবন করেছিলেন শ্রদ্ধা করতে হবে এইসব মানুষের জীবনবোধকেও। শুধু ভাবাবেগ নয়, দেশের অতি সাধারণ ও পিছিয়ে পড়া মানুষজনদের মানসিকতা, তাঁদের জীবন-জীবিকার সমস্যা বুঝতে হবে হৃদয় দিয়ে। এ বছর পূর্ণ হতে চলেছে এই মহান মানুষটির জন্মের সার্ধশতবর্ষ।

৪ নভেম্বর, ১৮৭১ সাল। বাংলাদেশের খুলনায় কারাপাড়া গ্রামে শরৎচন্দ্র রায়ের জন্ম। মা রাজলক্ষ্মী দেবী। বাবা পূর্ণচন্দ্র রায় ছিলেন বেঙ্গল জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্য। যখন তাঁর বাবা পুরুলিয়ায় বদলি হন, কিশোর শরৎচন্দ্র সেই প্রথম জনজাতি মানুষদের সান্নিধ্যে আসেন। ১৮৮৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি কলকাতায় তাঁর মামার বাড়িতে পড়াশোনা করতে থাকেন। শরৎচন্দ্র সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন ১৮৮৮ সালে। ১৮৯২ সালে তিনি জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ স্নাতক হন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ.। শরৎচন্দ্র রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করেছিলেন ১৮৯৫ সালে। এম.এ., বি.এল. হয়ে তিনি কিছুদিন ময়মনসিংহের ধলা হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের চাকরি করেছেন। স্কুলের চাকরি ছেড়ে ১৮৯৭ সাল থেকে শরৎচন্দ্র চব্বিশ পরগণা জেলা আদালতে ওকালতির কাজ শুরু করেন। এখানেও তিনি বেশিদিন থিতু হননি। ওকালতির কাজ ছেড়ে রাঁচি চলে যান। আবার শিক্ষকতার কাজ করবেন ভেবে রাঁচির জি. ই. এল. মিশন হাইস্কুলে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। একটা সময় ঠিক করতে পারছিলেন না তিনি কী করবেন - স্বাধীনভাবে ওকালতি করবেন নাকি স্কুলে চাকরি করবেন। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, রাঁচির আদালতে ওকালতির কাজ।

জুডিশিয়াল কমিশনার পদে কাজ করার সময় ছোটনাগপুরের অভ্যন্তরীণ এলাকার স্থানীয় জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়ে জনজাতি মানুষের নিপীড়ন শরৎচন্দ্রের চোখে পড়ে। বিশেষ করে মুন্ডা, ওরাওঁ সহ অন্যান্য জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষেরা যেভাবে ঔপনিবেশিক প্রশাসনে অব্যাহত নিপীড়নের শিকার হন, আইন আদালতে তাদের যেমন অবজ্ঞা করা হয় এবং ‘উচ্চ বর্ণ’ হিন্দু আইনজীবীদের জনজাতিদের রীতিনীতি, ধর্ম, আচার ও ভাষা সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞানের কারণে সুবিচারে বঞ্চিত হন - এ সমস্ত বিষয় শরৎচন্দ্রকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, পরাধীন দেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই যেমন জরুরি, জমিদার জোতদার ও উচ্চবর্ণের মানুষের অত্যাচার ও শোষণের হাত থেকে জনজাতি মানুষদের রক্ষা করা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে মনে করতে হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথাঃ ‘এ দেশের বুনো অসভ্যদের রীতিনীতি বিষয়ে অনভিজ্ঞ রাজপুরুষেরা অনেক সময় যখন তাহাদের প্রতি অন্যায় অবিচার করিতেন, তখন তাঁহার প্রাণ এই অসভ্যদের জন্য কাঁদিয়া উঠিত এবং তিনি ইহার প্রতিবিধানের উপায় খুঁজিতেন’। শরৎচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন জনজাতি সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞান আহরণ জরুরি, অন্যথায় এইসব মানুষদের স্বপক্ষে লড়াই সম্ভব নয়। তাঁর গভীর অভিনিবেশের কেন্দ্র হয়ে ওঠে মুণ্ডা, ওরাওঁ ও অন্যান্য জনজাতি সমাজের জীবনযাত্রা। তিনি সোচ্চার হন ঔপনিবেশিক ও বর্ণ শাসনের বিরুদ্ধে।

শরৎচন্দ্র রায় নৃতত্ত্ব বিষয়ে প্রথাগত শিক্ষা নেননি। মানবতার স্বার্থে আইন কার্যকর করা লক্ষ্যে তিনি স্থানীয় জনজাতির মধ্যে জীবন অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত নেন - আত্মনিয়োগ করেন নৃতত্ত্বচর্চায়। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘The Mundas and their Country’ - ভারতীয় জনজাতির উপর ভারতীয় লেখকের লেখা প্রথম মনোগ্রাফ। এই গ্রন্থে শরৎচন্দ্র রায় তুলে ধরলেন মুন্ডাদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের দৈহিক বিবরণ, পোষাক, কৃষি, জনজাতির সংগঠন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তাদের রীতিনীতি, বিশ্বাস, ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রা। এই বইয়ে উঠে এল ব্রিটিশ শাসনকালে মুন্ডাদের অবস্থার অবনতির কারণ ও তাদের বিদ্রোহ, ভূমিব্যবস্থার প্রবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা ও পৈতৃক জমির জন্য মুন্ডাদের লড়াইয়ের আইনী দিক।

এরপর প্রকাশিত হল ‘The Oraons of Chotanagpur’ (১৯১৫)। এই বইতে বর্ণিত হল ওরাওঁ-দের ভৌগোলিক এবং সামাজিক পরিবেশ, শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তিগত সাজসজ্জা, গ্রাম সংগঠন, অর্থনৈতিক জীবন এবং জনজাতির সামাজিক সংগঠন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ওরাওঁ সমাজে ‘ঢুমকুরিয়া’ নামক ‘ব্যাচেলর হল’-এর উল্লেখ করেছেন, যা ওরাওঁ-দের জীবনের ‘অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের একটি অতি প্রাচীন রূপ’। এছাড়া রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় শরৎচন্দ্র ১৩২০ বঙ্গাব্দে লিখেছেন ‘ছোটনাগপুরের ওরাওঁ জাতি’, ‘ওরাওঁ-দের প্রতিবেশী’। ১৩২১-এ তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘ওরাওঁ যুবকদের জীবন’, ‘ওরাওঁ-দের শিল্প’, ও ‘ওরাওঁ-দের ঐতিহ্য’।

পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হতে থাকল ‘The Birhors: A Little Known Jungle Tribe of Chotanagpur’ (১৯২৫), ‘Oraon Religion and Customs’ (১৯২৮), ‘The Hill Bhuiya of Orissa’ (১৯৩৫) এবং ‘The Kharias’ (১৯৩৭)। প্রায় একশো বছর আগে সিংভূমের ‘অসুর’ সম্প্রদায়ের টোটেম বা প্রথা নিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন শরৎচন্দ্র রায়। এছাড়াও ছোটনাগপুরের পাহিরা, লেপচা জনজাতির অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া, সিকিমের জনজাতির আত্মীয়তা, খাসিয়া জনগোষ্ঠী, খোণ্ড জনজাতির আত্মত্যাগ, কোরকু জনগোষ্ঠীর স্মারক, রাজপুতানার জয়সামন্দ লেক অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী এবং বার্মার জাতিগোষ্ঠীর উপর তাঁর লেখা বহু নিবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় বের হয়। তাঁর বাংলায় প্রবন্ধের সংখ্যা ১৭, যার মধ্যে ১৬টি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’তে। ইংরেজি প্রবন্ধের সংখ্যা ১০০-এরও বেশি।

শরৎচন্দ্র রায় ‘ফোকলোর সোসাইটি অফ লন্ডন’-এর তদানীন্তন সভাপতি অ্যান্ড ল্যাং-এর কর্ম প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করে তিনি বলেছিলেন, লোকসংস্কৃতিই হল সমস্ত বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি। ১৯৩২ সালে একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতি আলোচনার গুরুত্ব এবং কিভাবে একে সমাজ বিজ্ঞানীদের সমাজ জীবনের ধারা বিশ্লেষণের প্রধান মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা যায় তার পথ নির্দেশ করেন। তিনি মহামিলন ঘটালেন ভারতের নৃবিজ্ঞানের ধারার সাথে লোকসংস্কৃতির ধারার। সারাজীবন ধরে ব্যাপ্ত রইলেন জনজাতীয় লোকসংস্কৃতির সংগ্রহ এবং আলোচনায়। তিনি মনে করতেন লোকসংস্কৃতি সেই মাধ্যম যেটি মানুষের মনের অন্তর্লীন ছন্দের হদিশ দেয়, একইসঙ্গে মানব সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতকেও ছোঁয়া যায়।

শরৎচন্দ্র রায় বিহার ও ওডিশা প্রদেশে প্রত্নতত্ত্ব ও অন্য নানা বিষয়ে গবেষণার জন্য 'বিহার-ওডিশা গবেষণা সমিতি'র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি এই সমিতির ত্রৈমাসিক পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। শরৎচন্দ্র বিহার ও ওডিশা আইনসভারও সদস্য ছিলেন। আদিবাসী সমাজের প্রকৃত চিত্র বিষয়ে তিনি গভীরভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন বলে 'সাইমন কমিশন' তাঁকে সাক্ষ্য দিতে অনেকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ১৯৩২ সালে লর্ড লোথিয়ানের নেতৃত্বে যে কমিটি ভারতে এসেছিল তারা তিন মাসে ৭,৬৮৯ মাইল পথ পরিভ্রমণ করে ভোটার তালিকায় নতুন মানুষের নাম যোগ করার সুপারিশ করে। মহিলা ও তথাকথিত ‘অস্পৃশ্য’দের জন্য সামান্য সংরক্ষণেরও প্রস্তাবনা করে। লোথিয়ান কমিটিতে সাক্ষ্যদান ও সুপারিশ পেশের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। তিনি সাধ্যমতো আদিবাসী সমাজের উন্নয়নের স্বপক্ষে কথা বলেছেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমাজ ও সংস্কৃতিকে অনুভব করে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। শরৎচন্দ্রের এই কর্মকাণ্ড প্রাতিষ্ঠানিক নৃতত্ত্ববিদ্যার চর্চা হয়তো নয়, কিন্তু পরবর্তীকালের প্রাতিষ্ঠানিক ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদরা তাঁর অবদান, বিশেষত জাতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

শরৎচন্দ্র রায় শুধু ভারতের প্রথম নৃতত্ত্ববিদই ছিলেন না, ১৯২১ সালে তাঁর হাত ধরেই ভারতের প্রথম নৃতত্ত্ববিদ্যার জার্নাল ‘ম্যান ইন ইণ্ডিয়া’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে কর্মভার গ্রহণ করে প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন যে, "এই পত্রিকা ভারতের মানুষকে প্রকৃতভাবে জানতে চেষ্টা করবে। পশ্চিমী দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় জীবনদর্শনের বিচার-বিশ্লেষণ নয়, সম্পূর্ণ দেশজ-অনুসন্ধিৎসু মানসিকতায় ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মূল্যায়ন করাবে; তবেই ভারতীয় সমাজ ও তার মানুষের আলোচনা ভারতীয়ত্বে প্রতিষ্ঠিত হবে। একজন ভারতীয় গবেষক তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতেই অনুপ্রাণিত হবেন"।

শরৎচন্দ্র রায়ের মূল লক্ষ্য ছিল নৃতত্ত্বের একটি ভারতীয় ধারা গড়ে তোলা। ১৯৮৫ সালের ‘ম্যান ইন ইণ্ডিয়া’ পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সর্বজনমান্য নৃতাত্ত্বিক সুরজিৎ সিনহা লিখছেন,

“‘ম্যান ইন ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় শরৎচন্দ্র রায়ের উদ্যোগের পিছনে ছিল তদানীন্তন জাতীয় চাহিদা ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রায়ের ব্যক্তিগত গর্ব। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বিষয়ে রায় ভারতীয় গবেষকদের পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের উপদেশ দিয়েছেন। ফলত এই বৈজ্ঞানিক পত্রিকাটিতে ভারতীয় নৃতত্ত্বের পথপ্রদর্শক প্রায় সমস্ত পশ্চিমী এবং ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকদের প্রবন্ধ দেখতে পাওয়া যায়”।

১৯৩৮ সালে শরৎচন্দ্র রায় ইংল্যান্ডের সুবিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক গবেষণা পত্রিকা ‘Man - The Journal of the Royal Anthropological Institute of Great Britain and Ireland-এ ‘An Indian Outlook on Anthropology’ নামে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধে রায় তদানীন্তন পশ্চিমী তত্ত্বগুলিকে অত্যন্ত খুঁটিয়ে সমালোচনা করেন এবং একইসঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মূল ভাবনার সঙ্গে পশ্চিমী ভাবধারার সম্মিলন ঘটাবার চেষ্টা করেন। নিঃসন্দেহে শরৎচন্দ্র রায়ের এই প্রচেষ্টা আজও আধুনিক। রায়ের মতে ভারতীয় দর্শনের মূল কথা হল আত্মানুসন্ধানী মনন প্রক্রিয়ার সাহায্যে ‘অন্য সংস্কৃতির’ (Other Culture) অন্তরে প্রবেশ। এর সঙ্গে পশ্চিমী বস্তুবাদী পদ্ধতির মিলন ঘটানোই হল আসল কথা। রায় (১৯৩৮ সালে) লিখছেন,

‘The better minds of India are now harking back to the old ideal of culture as a means of the progressive realization of the one Universal Self in all individual - and group-selves, and the consequent elevation or transformation of individual and ‘national’ character and conduct, through a spirit of universal love. The anthropological attitude while duly appreciating and fostering the varied self-expression of the Universal Spirit in different communities and countries, and not by any means seeking to mould them all in one universal racial or cultural pattern, is expected to help forward a synthesis of the past and the present, the old and the new, the East and the West’.

শরৎচন্দ্র রায় নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় ইউরোপীয় বিবর্তনবাদ (Evolutionism) ও পরিচালনবাদের (Diffusionism) উত্থান এবং পতন দুই-ই দেখেছিলেন। একইসঙ্গে উনি দেখেছিলেন ক্রিয়াবাদের (Functionalism) উত্থান। বিভিন্ন সময়ে ইউরোপীয় তত্ত্বগুলিকে উনি ভারতীয় গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োগও করেছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে শরৎচন্দ্র রায় নৃতত্ত্বে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে নৃতত্ত্ব আমাদের জাতীয় জীবনে বিভিন্ন উপাদানের মিলন ঘটিয়ে একীকরণ ঘটাতে সক্ষম। শরৎচন্দ্র রায়ের জাতীয়তাবাদী নৃতাত্ত্বিক চেতনা কখনই পশ্চিমী নৃতত্ত্বের অনুগামী ছিল না। তাঁর জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্ব ছিল একান্তই ভারতীয়।

শরৎচন্দ্র রায় রাঁচিতে বেঙ্গলি বয়েজ স্কুল এবং বেঙ্গলি গার্লস স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি একই সময়ে হরিজন সেবক সমিতি, মাতাল বিরোধী সমিতি, ওরাওঁ মুন্ডা শিক্ষাসভার সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯১৩ সালে ‘কায়সার-ই-হিন্দ’ রৌপ্য পদক পান। ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব পান ১৯১৯ সালে। তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি ‘ফোকলোর সোসাইটি অব লন্ডন’-এর সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত হন ১৯২০ সালে। ওই একই বছর তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

বই পড়া বিদ্যা নয়, গবেষণালব্ধ জ্ঞান তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল। ছোটনাগপুরের আদিম নিবাসী ওরাওঁ, মুণ্ডা, হো প্রভৃতি নানা জনজাতি সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করবার জন্য তাঁকে তাদের সঙ্গে মিশতে হয়েছিল, তাদের ভাষা শিখতে হয়েছিল। কোনো কোনো জনজাতি তাদের যেসব লোকাচার খুব গোপনে রাখে ও যেসব অনুষ্ঠান বাইরের কাউকে দেখতে দেয় না, জ্ঞানলাভ করবার জন্য তিনি কখনও কখনও প্রাণনাশের ভয় সত্ত্বেও গহন বনে গাছের ডালে লুকিয়ে থেকে সেইসব অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘…এখনও তিনি এই প্রৌঢ় বয়সে যুবার মতো উৎসাহে তাঁহার ছুটির দিনগুলি গ্রামে গ্রামে পর্বতে পর্বতে মানবতত্ত্বের গবেষণায় অতিবাহিত করিয়া প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ, ও লৌহযুগের মাল-মশলা সংগ্রহে নিযুক্ত রহিয়াছেন।… কি গ্রীষ্মে, কি শীতে অসভ্যদের কুঁড়েঘরের আশেপাশে, গভীর বন-জঙ্গলের মধ্যে এবং নির্জন গিরিকন্দরে কত রজনী মৃত্যুকে তুচ্ছ করিয়া বিপদসঙ্কুল স্থানে কাটাইতে হইয়াছে’।

এই প্রবাদপ্রতিম নৃতাত্ত্বিকের চিরবিদায়ের দিনটি ছিল ৩০ এপ্রিল, ১৯৪২। তাঁর মৃত্যুর পর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল - ‘রাঁচির প্রসিদ্ধ নৃতত্ত্ববিদ রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায়ের মৃত্যুতে বাঙালি সমাজ ও ভারতবর্ষ একজন সুপণ্ডিত নৃতত্ত্ববিদ, স্বদেশপ্রেমিক ও ছোটনাগপুরের আদিম নিবাসী অকপট দরদী বন্ধু হারাল’। ‘ম্যান ইন ইন্ডিয়া’ জার্নালে প্রকাশিত ভেরিয়ার এলউইনের স্মৃতিচারণও আমরা মনে করতে পারিঃ

‘Roy’s affection for his people was scientific, not sentimental. It was his reasoned love for them that made him intolerant of slovenly and inaccurate writing: love drove him to ‘scorn delights and live laborious days’ in the service of truth that was also the service of his people... For Roy, then, the discipline of anthropology was a pilgrimage towards the sainte realite, the country of entire and perfect truth. It aimed at illuminating the whole kingdom of humanity, its obscure past, its sad and doubtful present, the certain triumph (in which he trusted) of its future. Anthropology was the search for Beauty, expressed in terms of Truth.’ (1942, p.195-196)

মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আইনজীবী শরৎচন্দ্র রায়কে নৃবিজ্ঞানী করে তোলে। তাঁর হাত ধরেই সারা বিশ্ব জানল ছোটনাগপুরের ওরাওঁ, মুণ্ডা, হো, সাঁওতাল, খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর কথা। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় নৃবিজ্ঞানকে প্রকৃত অর্থে ভারতীয়ত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে। ভারতীয় নৃতত্ত্বের ইতিহাসে তাঁর অবদানকে স্মরণ করতেই হবে।


তথ্যপঞ্জিঃ
● Bera, G. K. (2009). The Patriarch Pathfinder: Anthropological Profile of Rai Bahadur Sarat Chandra Roy. Allahabad: The Oriental Institute of Cultural and Social Research.
● Dasgupta, S. (2007). Recasting the Oraons and the ‘Tribe’ Sarat Chandra Roy’s Anthropology. In P. Uberoi, N. Sundar, & S. Deshpande (Ed.), Anthropology in the East: Founders of Indian Sociology and Anthropology (pp. 132-171). Ranikhet: Permanent Black.
● Elwin, V. (1942). Comment. Man in India, 22 (4), 195-96.
● Guha, A. (2020). Nationalist Anthropology of Sarat Chandra Roy. Frontier.
● Sinha, S. (1985). Editorial. Man in India. 65(4): i-v.