আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

নাগাল্যান্ডে হত্যাকাণ্ড


না, কোনও প্রতিবাদ মিছিল হয়নি। হয়নি নিদেনপক্ষে মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক প্রকাশ। আগুন ঝরানো কোনো ভাষণ সংসদের ভেতরে বা বাইরে উচ্চারিত হয়নি। কয়েকটি রাজনৈতিক দল ধরাবাঁধা বয়ানে বিবৃতি প্রকাশ করে দায়িত্ব পালন করেছে। এবং সংসদের অধিবেশনে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি পাঠ করেছেন। ব্যাস! ওই পর্যন্তই। তারপর সব শান্ত।

ঘটনাস্থল নাগাল্যান্ড। তাও একেবারে প্রান্তিক জেলা মন। তারও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মায়ানমার সীমান্তের গ্রাম ওটিং। সেখানকার ১৪ জন গ্রামবাসী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উত্তাল আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ১৪ জন নিরীহ ভারতবাসীকে ভারতীয় নিরপত্তা বাহিনী সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে। এবং তা নিয়ে দেশের অন্যত্র তেমন কোনো হৈচৈ নেই।

ওটিং গ্রামে সাকুল্যে শ'দুয়েক কনিয়াক জনজাতির পরিবারের বসবাস। কয়েকজন আশপাশের চা বাগানের কাজে নিযুক্ত। নিজের জমিতে ঝাড়ু ঘাস এবং ধান চাষ জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উপায়। কিন্তু তাতে অতি সামান্য আয়। কাজেই ওটিং থেকে কমবেশি ছয় কিলোমিটার দূরের তিরু উপত্যকায় অবস্থিত কয়লা খনিতে কাজের জন্য ছুটতে হয়। প্রায় প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন খনি শ্রমিক। কেউ নিরাপত্তারক্ষী, অন্যরা মেশিন অপারেটর, শ্রমিক বা জেসিবি চালক কেউ আবার খাদানে কয়লা কাটার কাজে নিযুক্ত। এখানে সবই খোলামুখ কয়লা খনি। কাজেই প্রাণহানির আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম। অক্টোবর থেকে মে মাসের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে বছরের পর বছর ধরে সোমবার থেকে শনিবার খনিতে কাজ করে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে রবিবার গির্জায় যাওয়া এবং সোমবার আবার কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন এমনটাই ওটিং-এর বাসিন্দা খনি শ্রমিকদের জীবনের রোজনামচা।

২০১৯-এ সংসদে পেশ করা পরিসংখ্যান অনুসারে দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে নাগাল্যান্ডের বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ (২১.৪%)। রাজ্য সরকারও জানে যে সেই কারণে খনিই রোজগারের একমাত্র ভরসাস্থল। মন জেলার অন্যান্য খনিগুলো বেশ দূরের নকজাং, ওয়াকচিং এবং পোগং এলাকায় ছড়িয়ে আছে। কাজেই সেই খনিগুলিতে ওটিং গ্রামের শ্রমিক নেই বললেই চলে।

সংবিধানের ৩৭১(এ) ধারার অধীনে থাকায় নাগাল্যান্ডের বাসিন্দারাই জমির মালিক যেখানে খনিগুলি অবস্থিত। এতে সরকারের কিছু করার নেই। গ্রামের জমির মালিকরা বাইরের রাজ্য থেকে আসা বিনিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তি করে সরকারের অনুমোদন নিয়েই খনির কাজ চালায়। এমনটাই প্রচলিত রীতি।

তিরু উপত্যকা থেকে ওটিং পর্যন্ত রাস্তা আছে। তিরিশ বছর আগে তৈরি রাস্তা সংস্কারের অভাবে গাড়ি চলাচলের অযোগ্য। কাজেই শ্রমিকদের অন্য একটি প্রচলিত পথে যাতায়াত। এই পথে গ্রামের দূরত্বও কম। সপ্তাহান্তে ছোটো ছোটো পিক্ আপ ভ্যানে শ্রমিকদের ঘরে ফেরা। অনেকদিন ধরেই চলছে এই নিয়ম।

তবে ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২১ হঠাৎ করে হয়ে গেল নিয়মের ব্যতিক্রম। ঘরে ফেরার পথে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় ৮ স্থানীয় বাসিন্দা যাঁরা আদতে তিরু কয়লা খনি থেকে আসছিলেন। তারপর পাল্টা হামলা চলে নিরাপত্তা বাহিনীর ছাউনিতে। প্রাণ হারালেন একজন নিরাপত্তা কর্মী। সঙ্গে সঙ্গে আবার গর্জে ওঠে নিরাপত্তা বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র। তাতে মৃত্যু হয় আরও ৬ স্থানীয় বাসিন্দার। আহত অনেক। ঘটনায় ব্যবহৃত সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র নাগাল্যান্ডের পুলিশ বাজেয়াপ্ত করার পর দেখা যায় যে রাইফেল, পিস্তল, মেশিনগান তো বটেই ব্যবহার করা হয়েছিল রাইফেল গ্রেনেড।

এখান থেকেই উঠে এসেছে একের পর এক প্রশ্ন। গুলি কে চালায়? আসাম রাইফেলস্? সেনাবাহিনী?

সেনাবাহিনীর ২১ নম্বর প্যারা স্পেশাল ফোর্সের বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছাকৃত গণহত্যার অভিযোগ’ এনে এফআইআর দায়ের করেছে নাগাল্যান্ড পুলিশ। নাগাল্যান্ড সরকার ঘটনার দিন (৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২১) জানিয়েছিল যে ওটিং-এর ঘটনার জন্য দায়ী সেনা কমান্ডোদের ‘ভুল খবর’ ও ‘নিয়ন্ত্রণহীন গুলিচালনা’। নাগাল্যান্ড পুলিশ এফআইআর-এও লিখেছে, “পুলিশকে কোনও খবর না দিয়েই কমান্ডোরা গ্রামবাসীদের আসার পথে ওত পেতে ছিল। গ্রামবাসীদের গাড়ি দেখেই তারা বিনা প্ররোচনায় গুলি করে লোক মেরেছে। গ্রামবাসীদের হত্যা বা জখম করাই ছিল সেনার উদ্দেশ্য।” প্রথম দফায় কমান্ডোরা ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তাঁদের মৃতদেহ আনতে গেলে আরও ৭ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। জখম করে ২২ জনকে। এর পরে কমান্ডোরা যথেচ্ছ গুলি চালাতে চালাতে অসমের দিকে পালায়। জখমদের কয়েকজন পরে মারা যাওয়ায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয় ১৭।

অথচ ৬ই ডিসেম্বর অর্থাৎ ঘটনার ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে জানালেন যে, ভুল বোঝাবুঝির কারণেই নাগাল্যান্ডে গুলি চলেছিল। গুলিতে ১৪ জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনাকে ‘গভীর দুঃখজনক’ বলে তিনি জানান শনিবার রাতে মন জেলার ওটিং গ্রামের কাছে জঙ্গি ভেবে ভুল করে খনি শ্রমিকদের গাড়িতে গুলি চালিয়েছিল সেনা। অভিযানে ছিলেন, সেনার ২১ জন কমান্ডো। তাঁদের গুলিতে গাড়ির আট যাত্রীর ছ’জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত দু’জনকে সেনারাই হাসপাতালে নিয়ে যান বলে জানিয়েছেন তিনি। গুলি চালনার পরই সেনাঘাঁটিতে হামলা হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর-স্থিত ভারতীয় সেনার ৩ নম্বর কোরের তরফে আগেই জানানো হয়েছিল যে, বিশ্বস্ত গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেয়েই সন্ত্রাসবাদীদের ধরতে ওটিং গ্রামে অভিযান চালায় সেনা জওয়ানরা। পাশাপাশি, ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশও করে সেনা।

সেনাবাহিনী ঘটনায় জড়িত। কিন্তু সংসদে সরকারের অভিমত পেশ করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নয়?

এখানেই শেষ নয়। নির্দেশ সত্ত্বেও গাড়ি না থামানোয় নাগাল্যান্ডের মন জেলায় খনি শ্রমিকদের জঙ্গি ভেবে গুলি করেছে সেনা, সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিবৃতি নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। নির্দেশ না মানলেই কি এভাবে গুলি করে মারতে পারে কমান্ডোরা? নাগাল্যান্ড পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে যে, ওখানে কোনও চেক পোস্টই ছিল না যেখান থেকে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় রহস্য, সেনা কমান্ডোরা নাগাল্যান্ডে অভিযানে গিয়েছিল অসমের গাড়ি নিয়ে, নম্বর প্লেট পাল্টে! কিন্তু কেন?

স্পষ্টতই লোকসভায় দেওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ও সেনাবাহিনীর দাবির ঠিক উল্টো কথা বলছে নাগাল্যান্ড পুলিশ ও প্রশাসনের প্রাথমিক রিপোর্ট। যেখানে বলা হয়েছে, গ্রামবাসীদের তরফে প্রথমে কোনও আক্রমণের ঘটনাই ঘটেনি। বলার পরেও না থামায় কয়লা খনি থেকে আসা শ্রমিকদের গাড়ির দিকে গুলি চালানোর যে তথ্য লোকসভায় দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেই তত্ত্বও খারিজ করেছে পুলিশের সরেজমিন তদন্ত। তদন্ত রিপোর্টে পুলিশের বক্তব্য, পিছু ধাওয়া করে গুলি চালানো হলে গাড়ির পিছনে গুলি লাগত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পিক্-আপ ভ্যানের উইন্ডস্ক্রিন ভেদ করেছে অধিকাংশ গুলি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, গুলি সামনে থেকেই চালানো হয়। আরও অভিযোগ, ঘটনাস্থলে কমান্ডোদের ফেলে পালানো গাড়ির নম্বর প্লেট পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে আদতে অসমের গাড়ি ভাড়া নিয়ে উপরে ভুয়ো নম্বর প্লেট লাগিয়ে কমান্ডোরা ঢুকেছিলেন। ঘটনার পরে কমান্ডোরা জখম দুই গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে অসমে পালিয়ে যায়।

ওটিং থেকে সোয়াশো কিলোমিটার দূরের ডিব্রুগড় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের কে বা কারা পৌঁছে দিয়েছিল তা অজ্ঞাত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, শনিবার মাঝরাতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ যুবককে হাসপাতালের চত্ত্বরে দেখা যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। কেন নিয়মমাফিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়নি? কেউ কি দায়িত্ব নিতে রাজি নয়? কেন?

এতসব রহস্যজনক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেও আবার এক অন্য প্রশ্ন উপস্থিত হয়। কেন এই নৃশংস ঘটনা ঘটানো হল?

অনেকগুলি সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে। নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে। মাঝেমধ্যেই শোনা যায় এইবার চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে চলেছে। কিন্তু বাস্তবে তা এখনও হয়নি। যেমন এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি আফস্পা আইন (আর্মড ফোর্সেস্ স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট)। ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকার এই আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। ব্রিটিশ চলে গেলেও আইনটি বাতিল হয়নি। বরং ১৯৫৮-য় আবার নতুন করে প্রথমে অধ্যাদেশ জারি করে পরে সংসদে আফস্পা-কে আইনসিদ্ধ করা হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের সবকটি রাজ্য ছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরেও আফস্পা প্রয়োগ করা হয়। উনিশশো আশির দশকে পাঞ্জাবে জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে আফস্পা জারি হয়। পাঞ্জাব সরকার পরে আফস্পা প্রত্যাহার করার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন করে। এবং পাঞ্জাব আফস্পা-র আওতার বাইরে চলে যায়। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রথমে ত্রিপুরা এবং তারপর মেঘালয় সরকার আফস্পা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলে কেন্দ্রের মনমোহন সিংয়ের সরকার তা মেনে নেয়। প্রকৃতপক্ষে মনমোহন সিংয়ের সরকার আফস্পা পুরোপুরি বাতিলের জন্য শীর্ষ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল। জীবন রেড্ডি কমিটি আফস্পা বাতিল করার সুপারিশ করে। পরে বীরাপ্পা মৌলির নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন জীবন রেড্ডি কমিটির সুপারিশকে সমর্থন করে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে শেষ পর্যন্ত আফস্পা এখনও বাতিল হয়নি। এবং বিভিন্ন রাজ্যে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে আফস্পা চালু রাখা হয়। নাগাল্যান্ডে আফস্পা আপাতত ২০২১-এর শেষ পর্যন্ত জারি রয়েছে। নাগাল্যান্ডের রাজ্য সরকার অনেকদিন ধরেই আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি করে আসছে। নাগাল্যান্ডের শাসকদল আবার কেন্দ্রের শাসকদলের শরিক। প্রশ্ন উঠেছে আফস্পার মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই কি এই হত্যাকাণ্ড?

এই হত্যাকাণ্ডের সময় আসাম রাইফেলস্-এর ভূমিকা কী ছিল? ১৮৩৫-এ ব্রিটিশ সরকার আসাম রাইফেলস্ গঠন করে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সীমান্ত পাহারা দেওয়াই ছিল আসাম রাইফেলস্-এর প্রাথমিক দায়িত্ব। আফস্পা প্রবর্তনের পর রাজ্য পুলিশের সঙ্গে আসাম রাইফেলস্ও রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিযুক্ত হয়। আফস্পা-র আওতায় থাকার জন্য আসাম রাইফেলস্-এর গতিবিধি থেকে শুরু করে যে কোনো কাজকর্মে রাজ্য সরকারের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে চলছে আসাম রাইফেলস্-এর অমানবিক নির্যাতন ও স্বেচ্ছাচার। সাধারণ মানুষ তো বটেই রাজনৈতিক দলগুলিও এর বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই মূল দাবি আফস্পা প্রত্যাহার। মণিপুরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আফস্পা বিরোধী আন্দোলনে শামিল ছিলেন। অন্যান্য অনেক নেতা আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ জানিয়েছেন। কিন্তু বারেবারেই আফস্পার মেয়াদ কখনো ছয় মাস কখনও আবার এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নাগাল্যান্ডের বর্তমান সরকার আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে অনেক দিন ধরে মুখর। তাহলে কি সেই দাবিকে দাবিয়ে রাখার জন্য এই হত্যাকাণ্ডের আয়োজন? প্রশ্ন থেকেই যায়।

এমন বহু প্রশ্ন উঠলেও এখনকার ভারত সরকার কোনও উত্তর দিতে রাজি নয়। এমনকি সংসদে পেশ করা বিবৃতির উপর আলোচনা করতেও রাজি নয়। সরকারের এহেন স্বেচ্ছাচারী আচরণে বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পিছনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নতুন করে উস্কানি দেওয়ার কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করেছে কিনা সে প্রশ্নও অস্বীকার করা যায় না।

তবে এবার পরিস্থিতি একেবারে অন্যরকম। নাগাল্যান্ডের ১২টি জেলার ১৬টি মূল জনজাতি যাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন তাঁরা সকলেই একজোট হয়ে পথে নেমেছেন। তাঁদের প্রধান দাবি অবিলম্বে আফস্পা প্রত্যাহার করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনার দাবিতেও তাঁরা মুখর। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। মন জেলার ওটিং গ্রামের বাসিন্দারা মৃতদের জন্য পাঠানো ভারত সরকারের ক্ষতিপূরণ নিতে অস্বীকার করেছেন। এমনকি সরকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযোগিতার ডাক দিয়েছেন। মন জেলার কনিয়াক জনজাতির সব সংগঠন একজোট হয়ে ঘোষণা করেছে বড়দিনের সব উৎসব, বনভোজন, ভোজসভা ও অন্যান্য সব বিনোদনের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের দাবি যত দিন না নাগাল্যান্ড থেকে সশস্ত্র বাহিনীগুলির বিশেষ ক্ষমতা আইন তথা আফস্পা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তাবাহিনীর টহলদারি চলবে না। মন জেলায় আর সেনায় নিয়োগের প্রক্রিয়া চালানো যাবে না। কোনও কনিয়াক তরুণ সেনায় যোগদানের পরীক্ষায় অংশ নেবেন না। শিবির তৈরি বা অন্য যে কোনও কাজে মন জেলার যে সব স্থানীয় গ্রামবাসী জমি দিয়েছেন নিরাপত্তাবাহিনীকে, তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অবিলম্বে সব চুক্তি বাতিল করতে হবে। অর্থাৎ জেলায় নিরাপত্তাবাহিনীর কোনও ঘাঁটিই থাকা চলবে না। ভারতীয় সেনার সঙ্গে জনতার সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। এমনকি গ্রাম পরিষদ, ছাত্র সংগঠনকে উন্নয়ন প্রকল্প বাবদ দেওয়া সেনাবাহিনীর কোনো সাহায্যও গ্রহণ করা হবে না। সেনা বা সরকারের তরফে দেওয়া সব ধরনের প্যাকেজ ও সাহায্যও ফিরিয়ে দেবেন কনিয়াকরা। কনিয়াক এলাকাগুলিতে সব গাড়ি, দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে কালো পতাকা ওড়ানো হবে।

নাগাল্যান্ডের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশের মানুষ সোচ্চার হলে দাবি আদায়ের আন্দোলন শক্তিশালী হবে। নাগাল্যান্ডের মানুষ নিজেদের ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার প্রেরণা পাবেন। একজোট হয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দাবি আদায়ের আন্দোলন জয় ছিনিয়ে আনতে পারে - সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন সেই শিক্ষা দিয়েছে। এর ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা হ্রাস পাবে। এবং অবশ্যই দিল্লির আধিপত্যবাদীদের স্বেচ্ছাচারী আচরণ কিছুটা হলেও স্তিমিত হবে।