আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কাজী নজরুল ইসলামঃ এক নির্ভীক সাংবাদিক

গোলাম রাশিদ


১৯১৭৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে৷ ১৮ বছর বয়সি কিশোর নজরুল শিয়ারসোল রাজ স্কুল ছেড়ে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিলেন৷ করাচি সেনানিবাস থেকেই তিনি 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন সমিতির সম্পাদক মুজফফর আহমদের মাধ্যমে৷ বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯২০-র মার্চ মাসে কলকাতায় পা রাখেন হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)৷ রবীন্দ্রনাথের শহর তখন জানত না আর কয়েক বছরের মধ্যেই এই শহরের ৩/৪সি, তালতলা লেন-এ জন্ম হতে চলেছে এক 'বিদ্রোহী'র (প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি, ১৯২২)৷ 'খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!' - দীপ্ত ঘোষণা শুনে চমকে উঠেছিল বাঙালি৷ স্কুলের পড়াশোনা করেননি, লেটোর দলে গান করেছেন, করেছেন মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ ও মক্তবের শিক্ষকতা৷ তিনি এমন গনগনে আগুনঝরা কথামালা কোথায় পেলেন? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে জানতে হবে ১৯২০-র মার্চ মাসে কলকাতায় এসে নজরুল কী করছিলেন সে সম্বন্ধে? সোভিয়েতে রুশ বিপ্লব সম্পন্ন, মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন আসছে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড, মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন৷ পটভূমি প্রস্তুত৷ হাবিলদার কবি নজরুল পরিণত হলেন সাংবাদিকে৷ এটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা৷ কবি-প্রতিভা নিয়েই তিনি নিশ্চয় জন্মেছিলেন৷ কিন্তু তাতে শান দিয়ে ধারালো করার কাজটি নিঃসন্দেহে করেছিল এই সাংবাদিকতা পেশাটিই৷ যেদিন 'উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না', সেইদিন যিনি শান্ত হবেন, তিনি যদি সাংবাদিক হয়ে ওঠেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে৷

মূলধারার সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করে প্রথম শ্রেণির সাংবাদিক ও কবি হয়ে দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য জনগণকে সচেতন ও উদ্দীপিত করে তুলছেন, এমন গুণের যুগপৎ সমাবেশ শুধুমাত্র কাজী নজরুলের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ভাবে ঘটেছে৷ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানের কথা যেভাবে আলোচিত হয়, তার সাংবাদিক সত্তা নিয়ে সেই আলোচনা হয় না৷ অথচ তাঁর যে বিদ্রোহী সত্তা, সেটি সাংবাদিক সত্তারই একটি অঙ্গ বলা যেতে পারে৷ তাঁর কবিতায় বারবার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে, পুরনোকে ভেঙে নতুনের আগমনের গান শোনা গিয়েছে, দিনবদলের গল্প ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়৷ এই চেতনা নজরুলের সাংবাদিক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ৷ কাজী নজরুল প্রথম জীবন থেকেই সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করে সাহিত্যের জগতে পা রেখেছেন৷ কলকাতায় এসে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিসে থাকতে শুরু করেন৷ এই সময় মোসলেম ভারত, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা ইত্যাদি পত্রিকায় লিখতে থাকেন৷ কিন্তু নিখাদ সাহিত্য করে জীবন চালানো এখনকার মতো তখনও কষ্টের বিষয় ছিল৷ এই সময় নজরুল ও মুজফফর আহমদ একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের কথা ভাবেন৷ তাঁদের সঙ্গী হোন শের-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠবেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী৷ মূলত তাঁরই উৎসাহ ও আর্থিক সহযোগিতায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই 'নবযুগ' নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে৷ সম্পাদক হিসেবে ফজলুল হকের নাম ছিল৷ তবে নজরুল এবং মুজফফর আহমদ ছিলেন এই পত্রিকার কাণ্ডারী৷ সান্ধ্য সংবাদপত্রটি নজরুলের লেখার গুণে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে৷ তিনি আগে কখনও সাংবাদিকতার কাজ করেননি৷ খবর বা নিবন্ধ সম্পাদনারও অভিজ্ঞতা ছিল না৷ কিন্তু তাঁর ভাষাগত দক্ষতা ছিল অতুলনীয়৷ তার লেখার মধ্যে প্রাঞ্জলতা এবং আবেগ ছিল যা খুব সহজেই পাঠককে নাড়া দিত৷ গ্রামের মসজিদে আজান দিতেন, মক্তবে পড়েছিলেন কুরআন, হাদিস, ইসলামি দর্শন৷ চাচা কাজী বজলে করিম আরবি, ফারসি, উর্দু জানতেন৷ চাচার মতো বালক নজরুলও লেটোর দলে যোগ দেন৷ সেখানে তিনি পরিচিত হন হিন্দু শাস্ত্র-পুরাণ-সংস্কৃতের সঙ্গে৷ এই দুই ধারার মিশ্রণ যেমন তাঁর মননকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই ভাষাকে করে তুলেছিল প্রাণশক্তিপূর্ণ, ঝরঝরে, সহজবোধ্য অথচ চমকপ্রদ৷ নজরুলের কড়া লেখার জন্য বেশ কয়েকবার 'নবযুগ' পত্রিকাকে সতর্ক করা হয়েছিল৷ কিন্তু তবুও তিনি তাঁর জ্বালাময়ী লেখা থামাননি৷ নজরুলের সংবাদ লেখার গুণের প্রশংসা করেছেন মুজফফর আহমদ৷ পত্রিকায় স্থানাভাবের জন্য নজরুল খুব ছোট করে খবরকে অল্প কথায় পাঠকের বোঝার মতো করে লিখতে পারতেন৷ তিনি কৃষক-মজুরদের দাবির কথা এখানে লিখতে শুরু করেন৷ জনপ্রিয় কবিতা বা গানের লাইন তুলে হেডিং করতেন৷ এমন ধরনের হেডলাইন মানুষকে সহজে আকৃষ্ট করত৷ কাগজের সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে নজরুলের মতবিরোধ হলে তিনি কাজে ইস্তফা দেন এবং ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি বন্ধ হয়ে যায় মালিকানা বিতর্কের কারণে৷ ১৯৪০ সালে ফের এ কে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় নবপর্যায় 'নবযুগ' প্রকাশ হলে সেখানে তিনি প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন৷ লিখেছিলেন 'পাকিস্তান না ফাঁকিস্তান'-এর মতো লেখা৷ ব্রিটিশ সরকারের জুলুম, এদেশের মানুষের অসচেতনতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নি কলমসম লেখা নবযুগে প্রকাশিত হয়েছিল৷ 'গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!', 'ছুতমার্গ', 'জাগরণী', 'ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ', 'লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য', 'শ্যাম রাখি না কুল রাখি' প্রভৃতি শিরোনামের লেখাগুলি পাঠ করলে তার আঁচ অনুভব করা যায়৷ হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যের অন্তরায় তুলে ধরতে গিয়ে 'ছুতমার্গ' নিবন্ধে তিনি লিখছেন, ''তোমরা রাজনীতিক যুক্তি-তর্কের চটক দেখাইয়া লেখাপড়া-শেখা ভণ্ডদের মুগ্ধ করিতে পার, কিন্তু এমন ডাকটি আর ডাকিতে পারিবে না। আমরা বলি কী, সর্বপ্রথম আমাদের মধ্য হইতে এই ছুতমার্গটাকে দূর করো দেখি, দেখিবে তোমার সকল সাধনা একদিন সফলতার পুষ্পে পুষ্পিত হইয়া উঠিবে। হিন্দু মুসলমানকে ছুঁইলে তাঁহাকে স্নান করিতে হইবে, মুসলমান তাঁহার খাবার ছুঁইয়া দিলে তাহা তখনই অপবিত্র হইয়া যাইবে, তাঁহার ঘরের যেখানে মুসলমান গিয়া পা দিবে সে-স্থান গোবর দিয়া(!) পবিত্র করিতে হইবে, তিনি যে আসনে বসিয়া হুঁকা খাইতেছেন মুসলমান সে আসন ছুঁইলে তখনই হুঁকার জলটা ফেলিয়া দিতে হইবে - মনুষ্যত্বের কী বিপুল অবমাননা! হিংসা, দ্বেষ, জাতিগত রেষারেষির কী সাংঘাতিক বীজ রোপণ করিতেছ তোমরা! অথচ মঞ্চে দাঁড়াইয়া বলিতেছ, ‘ভাই মুসলমান এসো, ভাই ভাই এই ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই!’ কী ভীষণ প্রতারণা! মিথ্যার কী বিশ্রী মোহজাল!''

এরপর নজরুল 'নওরোজ', 'সেবক', 'মোহাম্মদী' পত্রিকায় স্বল্পকালীন কাজ করেন৷ কোথাও বেশিদিন স্থায়ী হননি৷ অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও অন্যায়ের সঙ্গে আপোসহীন নজরুল ১৯২২ সালের আগস্টে নিজ সম্পাদনায় শুরু করেন অর্ধ সাপ্তাহিক 'ধূমকেতু'৷ এই পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু হতেই চারদিকে সাড়া পড়ে যায়৷ রবীন্দ্রনাথ ধূমকেতুর পথচলার শুরুতে লিখেছিলেন, 'আয় চলে আয়রে ধূমকেতু,/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/...জাগিয়ে দেরে চমক মেরে,/আছে যারা অর্ধচেতন৷' বিদ্রুপাত্মক কবিতা, সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য নানা নজরুলীয়-নিবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে যা শৃঙ্খলিত ও অত্যাচারিত মানুষকে সংগ্রামের পথ দেখায়৷ ব্রিটিশদের পদতল থেকে নজরুলই সর্বপ্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন এই পত্রিকার পাতায়৷ তিনি লেখেন, ''...সর্বপ্রথম, ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।

“স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথি এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ-দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনও। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।

পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।"

স্বভাবতই ব্রিটিশ সরকার তাঁর এই পত্রিকার বিরুদ্ধেও খড়্গহস্ত হয়৷ কবির রচিত 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতাটি ধূমকেতুতে প্রকাশিত হলে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে (এখন দেশে কথায় কথায় 'দেশদ্রোহী' তকমা দানের প্রবণতা ফিরে এসেছে) তাঁকে গ্রেফতার করা হয়৷ বিচারাধীন নজরুল দিয়েছিলেন 'রাজবন্দীর জবানবন্দী'৷ বিচারের পর তাঁর এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়৷ নির্ভীক, সাহসী সাংবাদিকতার জন্য এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সময়ের সেরা প্রোটাগনিস্ট৷ 'ধূমকেতু' পত্রিকাটি ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে বন্ধ হয়ে যায়৷ 'ধূমকেতু' ধূমকেতুর মতোই আসে, সবাইকে চমকে দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়৷ এই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হিসেবে 'মোহররম সংখ্যা', 'আগমনী সংখ্যা', 'দেওয়ালী সংখ্যা', 'কংগ্রেস সংখ্যা' ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল৷ বর্তমানে বাঙালি শারদীয়া প্রকাশ করে, ঈদ সংখ্যা হাতে গোণা৷ যিনি পুজোসংখ্যা করেন, তিনি ঈদ বা মুহাররমের কথা ভুলে যান৷ আর কোনও সম্পাদক ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করলে সেখানে আবার অনেকেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পান৷ সাংবাদিক কাজী নজরুল ১০০ বছর আগেই 'মোহররম' ও 'দেওয়ালী'র আলো দেখিয়েছিলেন বৈকি!

১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কাজী নজরুলের পরিচালনায় ফের আরেকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়৷ সাপ্তাহিক এই পত্রিকার নাম ছিল 'লাঙল'৷ কবি কংগ্রেসের সদস্য হন এই বছর৷ জাতীয় কংগ্রেসের একটি অংশ হিসেবে 'মজুর স্বরাজ দল' তৈরিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন৷ এই দলেরই মুখপত্র ছিল 'লাঙল' পত্রিকাটি৷ একে বাংলাভাষার প্রথম শ্রেণিসচেতন পত্রিকা বলা হয়৷ পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'গণবাণী'৷ এই দুই পত্রিকায় প্রকাশিত কবির নিবন্ধ ও কবিতাগুলিতে কৃষক-শ্রমিকের কথা উঠে এসেছে৷ ১৯২৬-এর এপ্রিলে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়৷ এরই প্রেক্ষাপটে কবি গণবাণীতে লেখেন 'মন্দির ও মসজিদ', 'হিন্দু-মুসলমান'৷ নিবন্ধ দু'টি আজকের উগ্র জাতীয়তাবাদ ও রামমন্দির-রাজনীতির ভারতবর্ষে সমান উপযোগী৷ 'গণবাণী'র পর 'সওগাত' পত্রিকায় নজরুল কিছুদিন কাজ করেন৷ এরপর সাংবাদিকতা ছেড়ে গান-কবিতার জগতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন৷ পরবর্তীতে চল্লিশের দশকে নবপর্যায় নবযুগে কাজ করার মাধ্যমে শেষ হয় তাঁর সাংবাদিক জীবন৷ ১৯২০ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলা সাংবাদিকতায় তিনি যে নির্ভীকতার প্রমাণ দেন, লেখনীতে যে অসাধারণত্ব ফুটে ওঠে তার পরিচয় পাওয়া যায় 'যুগ-বাণী' (১৯২২), 'দুর্দিনের যাত্রী' (১৯২৬), 'রুদ্র-মঙ্গল' (১৯২৭) গ্রন্থগুলিতে৷ দৈনিক নবযুগে প্রকাশিত নিবন্ধগুলি 'যুগ-বাণী' বইতে ছাপা হয়৷ ধূমকেতুতে যে সকল সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ লেখেন, তারই কিছু নিয়ে প্রকাশিত হয় 'দুর্দিনের যাত্রী'৷ 'ধূমকেতু' ও 'গণবাণী'তে প্রকাশিত লেখার সংকলন 'রুদ্র-মঙ্গল'৷ তিনটি বই-ই প্রকাশের পরপর ব্রিটিশদের চোখে বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ব্রিটিশরাজ সরকার বইগুলির প্রচার ও মুদ্রণ বেআইনি ঘোষণা করে৷ এই জন্যই কাজী নজরুল বিদ্রোহী, চিরদুর্দম৷ তাঁর সাহস, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদা, সাহিত্যবোধ তাঁকে কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিকে পরিণত করেছে৷ বই বাজেয়াপ্ত হোক, জেলের সাজা হোক৷ কিন্তু নজরুল মানে 'আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ' ৷ কখনও আপস করেন না৷ তাই তো 'রাজবন্দীর জবানবন্দী'তে তিনি লিখতে পেরেছেন, 'আমি সত্যপ্রকাশের যন্ত্র। সে যন্ত্রকে অপর কোনো নির্মম শক্তি অবরুদ্ধ করলেও করতে পারে, ধ্বংস করলেও করতে পারে; কিন্তু সে-যন্ত্র যিনি বাজান, সে-বীণায় যিনি রুদ্র-বাণী ফোটান, তাঁকে অবরুদ্ধ করবে কে? সে-বিধাতাকে বিনাশ করবে কে? আমি মরব, কিন্তু আমার বিধাতা অমর। আমি মরব, রাজাও মরবে, কেননা আমার মতন অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে, আবার এমনই অভিযোগ-আনয়নকারী বহু রাজাও মরেছে, কিন্তু কোনো কালে কোনো কারণেই সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হয়নি - তার বাণী মরেনি। সে আজও তেমনই করে নিজেকে প্রকাশ করেছে এবং চিরকাল ধরে করবে। আমার এই শাসন-নিরুদ্ধ বাণী আবার অন্যের কণ্ঠে ফুটে উঠবে।'


তথ্যঋণঃ

১. নজরুল-রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ
২. আজহারউদ্দীন খান, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, ডি এম লাইব্রেরি, কলকাতা
৩. মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা
৪. গোলাম মুরশিদ, বিদ্রোহী রণক্লান্তঃ নজরুল-জীবনী, প্রথমা