আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

গ্লাসগোতে গন্ডগোল

অনিন্দিতা রায় সাহা


আমার ঘরের কথা

আমার গৃহসহায়িকার ছেলেমেয়েগুলি রাস্তায় দেখা হলে মোটেই ‘নমস্তে’ বলে না, যদিও ওদের মা-মাসি-দিদিমারা আজও হাত জোর করে ‘রাম রাম’ বলে। ওরা আমাকে দু'চক্ষে দেখতে পারে না। আমার যে গাড়ি চালায়, তার মেয়েটি ইস্কুল পাশ করে এক কল সেন্টারে কাজ করে। ও আমাকে ‘হ্যালো, গুড মর্নিং’ বলে, সারা রাত বাড়ি থেকে মোবাইল ফোন দিয়ে কাজ করে। আর আমার নিজের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা শেষ করে এখন বহুজাতিক সংস্থার ঝাঁ-চকচক আপিসে যায়। এই তিন দলের ছেলেমেয়েগুলিকে যদি একটা গোল টেবিলে আলোচনায় বসিয়ে দেওয়া যায়, আর একটা সরল সমীকরণ দিয়ে উষ্ণায়ণ-প্রদূষণ-কয়লা-তাপবিদ্যুৎ-সংরক্ষণ বোঝানো হয়, তবে কী সমাধান আশা করা উচিত? আমার ছেলেমেয়ে গাড়ি, এয়ার কন্ডিশনার, রুম হিটার সব চালানো বন্ধ করে দেবে, কল সেন্টারের মেয়েটি গরমকালেও ঘরের এয়ার কুলার চালাবে না, আর ‘বেয়াদপ’ ছেলেমেয়েগুলি তাদের আট ফুট বাই আট ফুট ঘরের একমাত্র পাখা আর বাতি নিবিয়ে দেবে। মানে এইসব করার কথা ঘোষণা করবে আর কি! তারপর সবাই হাসিমুখে করমর্দন করে ফিরে যাবে, তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পৃথিবীর ঘোরতর অসুখের নিরাময়ের জন্য তারা যারপরনাই অঙ্গীকারবদ্ধ। গ্লাসগোতে গত ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর এরকমই একটা আলোচনাচক্র আমরা দেখলাম। সারা দুনিয়ার উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিদের একযোগে এক সমস্যার একরকম সমাধানের এক অভূতপূর্ব প্রয়াস।

গ্লাসগোর ২৬ নম্বর বৈঠক

অনেকদিন ধরেই তো ঘন্টা বাজছে। ক’মাস আগে IPCC (Intergovernmental Panel for Climate Change) Assessment Report 6 প্রকাশ হওয়ার পর থেকে প্রস্তুতি জোরদার হচ্ছিল, যেমন করেই হোক গ্লাসগোর আসরে UNFCCC (United Nations Framework Convention for Climate Change)-র COP 26 (Conference of Parties)-এ সব দেশকে রাজি করাতেই হবে। ক্রমাগত গরম হতে থাকা পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পবিপ্লব সময়ের তাপমানের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের বেশি বাড়তে দেওয়া চলবে না। আগামী ২০৩০, ২০৫০, ২১০০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে শুদ্ধ শূন্য নিঃসরণ (Net zero emission)-এর লক্ষ্যে পৌঁছতেই হবে। কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। আনতে হবে সৌর, বায়ু, ইত্যাদি নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক শক্তি। এর দায় সেই সব দেশের সবচেয়ে বেশি, যারা কয়লা পোড়াচ্ছে সবচেয়ে বেশি। একদিকে রয়েছে চীন আর ভারতের মতো দেশ, অন্যদিকে আমেরিকার মতো দেশ, যারা উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে দাঁড়িয়ে আছে। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি মোতাবেক সব দেশই মেনে নিয়েছে এই সাধারণ লক্ষ্য। নিজের নিজের পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা ঘোষণা করেছে নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা (NDC বা Nationally Determined Contributions)। যেমন ভারত ধার্য করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগা ওয়াট সৌর শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা, সেই সঙ্গে মোট শক্তি ব্যবহারের ৫০% নবায়নযোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা।

এই আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রগুলি নিয়মিত সংঘটিত হয়। অনেক প্রতিশ্রুতি, কর্মপরিকল্পনা, আশাভরসা। ফল হয় না কিছুই, সবই ক'দিনের উত্তেজনার শেষে ঠান্ডা। যেমন, আগের চুক্তি অনুযায়ী আর্থিক সাহায্যের যে দায় উন্নত দেশগুলির ছিল, তা তো পূরণ হয়নি। পিছিয়ে থাকা দুনিয়ার দেশগুলিকে যে আর্থিক সাহায্য পৌঁছনোর কথা ছিল, উন্নত দুনিয়ায় কেউ সে কথা রাখেনি। এবারের সভা শেষেও কিন্তু এ ব্যাপারে ধোঁয়াশা কাটলো না। যদিও জলবায়ু অভিযোজন (climate adaptation) এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষয়ক্ষতি (loss and damage) সম্পর্কে এবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, উন্নত দেশগুলিকে তার দায়ভার নিতে বলা হয়েছে, তবু ঘর পোড়া গরুর মন সন্দিহান। শেষের দিনগুলিতে ভারত বেশ একটা হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। চুক্তির একটা বাক্যাংশ পরিবর্তনে সাফল্যও এসেছে। সেই অনুযায়ী কয়লার ব্যবহার ও ভর্তুকিকে একেবারে গলাধাক্কা দিয়ে বের করার (phase out) বদলে ধীরে ধীরে কমানো (phase down) যাবে। এতে লাভ হলো কী? কিছু বেশি সময় পাওয়া যাবে। প্রথম এই দিকটি আলোচনায় তুলে ধরেছিল চীন। ভারতের তৎপরতায় বোধ হয় সবচেয়ে বেশি লাভ হল তাদের, কারণ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহার করে তারাই। ২০১৯ সালে চীন দেশ কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে ৪৮৭৬ ট্রিলিয়ন ইউনিট (terawatt hour)। সেই তুলনায় ভারতের উৎপাদন ৯৯৯ ট্রিলিয়ন ইউনিট। যেহেতু এই কমিয়ে আনার দিন স্পষ্ট ধার্য হয়নি, তাই কয়লার ব্যবহার কমাতে চীন কিংবা ভারতের গড়িমসি দেখা যেতে পারে। অন্যদিকে তৃতীয় বৃহত্তম তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ আমেরিকা কী করে সেটাও দেখার। ইউরোপের উন্নত দেশগুলি কয়লা ব্যবহার করে কম। গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার সুবাদে তাদের অনেক বিষয়ে সুবিধাও আছে। আমাদের মতো উন্নয়শীল দেশগুলির সামনে প্রশ্নগুলি আলাদা।

ভারতে শক্তি নিরাপত্তা, জীবিকা আর ব্যয়ভার

আমাদের এক আজব অবস্থা। একদিকে মাথাপিছু শক্তির ব্যবহার সারা দুনিয়ার গড়ের এক তৃতীয়াংশ, সকলের জন্য স্বচ্ছ জ্বালানির অভাব, অন্যদিকে শিল্পে, শহরে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা। ভারতের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড়ো অংশ তাপবিদ্যুৎ (৫৩.৪৯%)। ২০১৯ সালের হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ভাগ ২৬.৩৭%, জলবিদ্যুৎ ১১.৯%, গ্যাস ৬.৩৭% আর পারমাণবিক ১.৭৩%। নিজস্ব উৎপাদন ও আমদানী মিলিয়ে দেশে কয়লার মোট বার্ষিক ব্যবহার ৮১১.৪৭ মিলিয়ন টন। উন্নয়নের যে পর্যায়ে আমরা আছি, তাতে শক্তির চাহিদা এখনো বাড়বেই। উন্নয়ন ও শক্তি চাহিদার একটি উল্টোনো U আকৃতির বক্র রেখার চড়াই অংশে রয়েছে যে দেশগুলি, তাদের সঙ্গে উৎরাই-এর দেশগুলির তুলনা কি চলে! তাই আমাদের মূল প্রয়োজন উন্নয়ন, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, সঙ্গে জল-বিদ্যুৎ-রন্ধনের জ্বালানি। বর্তমান উন্নয়নের হারে ২০৩০ সাল নাগাদ ভারতের শক্তির চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার কথা।

এছাড়াও কয়লা শিল্পের সাথে জুড়ে আছে প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবিকা। পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গে যে খনিজ সম্পদের ঝুড়ি, তা যদি বন্ধ হয় আর পশ্চিমদিকে গুজরাট আর রাজস্থানের দীর্ঘ উষর ভূমিতে সৌর প্যানেল বসতে থাকে, তবে তৈরি হবে আরেক ধরনের আঞ্চলিক বৈষম্য। বেরোজগারী। এই বিপুল কর্মহীনতার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আর অভিবাসনের দায়িত্ব সরকারের পক্ষে একটি অতিরিক্ত সমস্যা।

সেই সুদূর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে ভারতের কয়লা প্রভূত পরিমাণে ব্যবহার হয়ে চলেছে। শিল্প, জাহাজ, রেল পরিবহন। ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে স্বীকার করলে, শিল্প বিপ্লবের মধ্যে মানব সভ্যতার চরম সার্থকতা খুঁজে পেলে, আজকে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতাকে অমান্য করা যায় না। বর্তমান পৃথিবীর পরিবেশ সংকটের সমাধান একটি সাধারণ কিন্তু পৃথক দায়িত্ব (common but differentiated responsibility)। সারা পৃথিবী গরম হয়ে উঠলে, বিস্তীর্ন স্থলভূমি খরা-বন্যা-দাবানল কবলিত হয়ে পড়লে, সমুদ্রে ঝড় উঠলে, বনভূমি কমে গেলে, পৃথিবীর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হলে আক্রান্ত হবে সকলেই। IPCC রিপোর্টেও স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে, পৃথিবীর কোনো কোণই আজ আর নিরাপদ নয়। যদি বাঁচতেই হয়, যদি আমাদের নোয়ার আর্কে চড়াকে বিলম্বিত করতে হয়, তবে সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ আর কারিগরি ও প্রযুক্তির জ্ঞান।

হিসেবে বলা হচ্ছে, এই শক্তির মুখ বদলের পর্বে (green transition) ভারতের আনুমানিক ব্যয় বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে মোট বার্ষিক বাজেট ৫০০ বিলিয়ন ডলার। গ্লাসগো সম্মেলনে এই আলোচনাগুলি ধরি-মাছ-না ছুঁই-পানি করে এড়িয়ে গেছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলি। অন্যদিকে কার্বন ক্রেডিটের বাজারী ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। উন্নত আর অন্যান্য দেশের মধ্যে বিভেদ তাই চলতেই থাকবে। এর নতুন নাম কার্বন-ঔপনিবেশিকতা (carbon colonialism)। কার্বন ডাইঅক্সাইড একমাত্র শত্রু। আর কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস কিন্তু এতো বিদ্বেষের শিকার নয়। এক সময় ছিল মিথেনের বিরুদ্ধে তুমুল হৈচৈ। আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে ধানজমির ওপর এই আক্রমণ কি বৈজ্ঞানিকভাবেও সঠিক ছিল? মিথেন গ্যাস তো তার রাসায়নিক গঠনগত কারণেই ভেসে ওপরে চলে যাওয়ার কথা। এবারের আলোচনায় মুখ্য আসামী কয়লা। গ্যাস আর তেলের কথা তেমন শোনা গেলো না কেন? এগুলি কি জীবাশ্ম জ্বালানি নয়? নাকি বিশেষ বিশেষ দেশে এর ব্যবহার বেশি বলে এই পক্ষপাত। ভারত যেই বলেছে কয়লার ওপর সরকারি ভর্তুকি রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না, তার সাথে যোগ দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভেনেজুয়েলা, নাইজেরিয়া, চীনের মতো দেশগুলি, যাদের উন্নয়নের পর্যায় মোটামুটি সমতুল। দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষের শক্তির নিরাপত্তা আগে, না, পরিবেশ রক্ষা আগে, না উন্নত বিশ্বের অনুশাসন মানার প্রয়োজন আগে, সে সব অপ্রিয় প্রশ্ন থেকেই যায়। যেমন, মনে করা যাক সবুজ বিপ্লবের উদাহরণ। অসংখ্য দেশবাসীর খাদ্য সুরক্ষা, না, পরিবেশ ও জমির জৈব গুণ সংরক্ষণ? খাদিবস্ত্র না সস্তা মিলের কাপড়? গান্ধীজির চরকা নাকি ল্যাঙ্কাশায়ারের কাপড় কল? ইতিহাস অনেক ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, সঠিক উত্তর পাওয়া এখনো বাকি।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ন্যায্যতার প্রশ্ন (climate justice)। বিশ্বব্যাপী তোলপাড়ের ফলে যে দেশেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক, যে হতভাগ্য মানুষই জলবায়ু-শরণার্থী হয়ে পড়ুক, তার সম্মিলিত দায়িত্ব হওয়া উচিত সমগ্র বিশ্ববাসীর। তার জন্য অর্থ বরাদ্দ হোক (global resilience fund)। আসুক জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আর কমিয়ে দেওয়ার (climate adaptation and mitigation) জন্য কারিগরি দক্ষতা। উন্নত দুনিয়ার প্রযুক্তি সরবরাহ হোক দরিদ্র ও দুর্যোগপ্রবণ দেশে। এ কথা তো জানাই আছে যে, ভারতবর্ষ ও অন্যান্য ক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। জলবায়ু নিয়েও ঔপনিবেশিকতা (climate colonialism) নয়। উন্নত দুনিয়াকে আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য দিতেই হবে। এটা ঐতিহাসিক দায়, অসাম্যের প্রতিকার, দুর্বলের প্রতি সবলের ধৰ্ম। বিপরীত যুক্তি হতে পারে যে উন্নয়নশীল দেশে ভ্রষ্টাচার বেশি, অর্থ এলেই যে তার সদ্ব্যবহার হবে তার স্থিরতা নেই। কিন্তু সেই যুক্তিতে দায় এড়ানো যায় না। প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার, চাই বিধিবদ্ধতা, আর উত্তরদায়িতা।

সৌরশক্তি কি জাদুর ছড়ি

নবায়নযোগ্য শক্তি গ্লাসগো মহাসভার মূলমন্ত্র। আর তার ধ্রুবপদটি হল সৌর শক্তি। হাতে নিলেই জাদুর দেশে পৌঁছে যাবে জগন্নাথ। কয়লা-দৈত্যকে মারতে সূর্য মুশকিল-আশান। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা, পরিবেশ আন্দোলনকারী আর সাধারণ জনতা সৌরশক্তি সম্পর্কে যতখানি উল্লসিত, প্রযুক্তিবিদরা কিন্তু তেমন আশাবাদী নন।

সৌরশক্তির সমস্যা অনেক। প্রথমত, সৌরশক্তির উৎপাদকতা বা শক্তি ঘনত্ব (energy density) তাপবিদ্যুতের চেয়ে অনেকটাই কম। উৎপন্ন বিদ্যুতের গুণগত মান খুব উচ্চ নয়। মানে সৌর বিদ্যুতের ভোল্টেজ ও ফ্রেকুয়েন্সি খুব স্থির হয় না। এমনকি গন্ডগোলে পুরো গ্রিড বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উপরন্তু এই উৎপাদন শুরু করা ব্যয়সাধ্য। প্রচুর জমিও দরকার কারণ শুধু ছাদের ওপর প্যানেল বসিয়ে আমাদের বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। উপরন্তু জমি, প্যানেল, ব্যাটারী ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির খরচ ইত্যাদি মিলিয়ে দাম প্রায় ওয়াট পিছু ৩ ডলার পড়ে যেতে পারে। যদি উৎপন্ন বিদ্যুত গ্রিডে সরবরাহ করা যায়, তাহলে সব খরচ উসুল হতে ৩ থেকে ৫ বছর লাগবে। অন্যদিকে, সৌর বিদ্যুৎ যদি আংশিকভাবে তাপবিদ্যুৎকে প্রতিস্থাপিত করে, তাহলে এই সময়সীমাটাই বেড়ে যাবে প্রায় দশ বছর। মোদ্দা কথা, সৌরশক্তির মণিমুক্তোখচিত জাদুদন্ডটি বেশ দামী।

রাতের বেলা কিংবা বর্ষাকালে ব্যবহার করার জন্য ব্যাটারীর সাহায্যে উৎপন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চয় করা দরকার। সেই প্রযুক্তি এখনো তেমন উন্নতমানের নয়। এমনিতেই এই ব্যাটারী ব্যবস্থার জন্য প্রভূত আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন। এছাড়া আছে এইসব ভঙ্গুর যন্ত্রপাতির সমস্যা। ঝড়-বৃষ্টি আর তীব্র হাওয়ার মুখে এই প্যানেলগুলি ভেঙে পড়তে পারে, ধুলোর আবহাওয়ায় নিয়মিত পরিষ্কার না করলে যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই এইসব ব্যাটারি খুব দীর্ঘমেয়াদি হয় না, গড় আয়ু ৫-৭ বছর।

যে পরিবেশ ও জলবায়ু সমস্যা মেটাতে সৌরশক্তির আগমন, সেই পরিবেশের ওপর এর প্রভাব কিন্তু খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সৌর কোষগুলি (solar photovoltaic cell) তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় বহুল পরিমাণ সিলিকন। সঙ্গে লাগে প্রচুর শক্তি ও জল। পরিশেষে আসে অবশেষ বা জঞ্জালের ব্যবস্থাপনার (waste management) প্রসঙ্গ। সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার মোটামুটি আয়ু ২৫ বছর। তখন যে সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাষ্টিক, কাঁচ, নানারকম ধাতব ও বৈদ্যুতিন অবশেষ পড়ে থাকবে, তার জন্য কী ধরনের চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে? একইভাবে ৫-৭ বছর চলার পর ব্যাটারী শেষ হলে প্লাষ্টিক, পলিমার ফিল্ম আর ধাতব টুকরোগুলি কোথায় কীভাবে যাবে, তার জন্যও যথাযথ পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে অতি শীঘ্র। ব্যাটারীতে ব্যবহৃত হবে যে লেড অ্যাসিড, তার অ্যাসিড ক্ষতি করবেই, যদিও ব্যাটারীর সীসা পুনর্ব্যবহার করা যেতে পারবে।

নতুন নতুন আবিষ্কার চমক তৈরি করেছে বারবার। আজ থেকে একশো বছরের কিছু বেশি আগে, ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যান্ড আবিষ্কার করেছিলেন ব্যাকেলাইট। এই জাদুর জিনিসটিকে আজও বলা হয় একটি ‘ঐতিহাসিক রাসায়নিক আবিষ্কার’। আমেরিকান কেমিক্যাল এসোসিয়েশন ১৯৯৩ সালে এটিকে পৃথিবীর ‘প্রথম কৃত্রিম প্লাষ্টিক’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ব্যাকেলাইট, নাইলন, প্লাষ্টিক দৈনন্দিন জীবনে যে বিপ্লব এনেছিল, আজ তাইই হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড়ো ত্রাস। সৌরশক্তির জয়যাত্রা ভবিষ্যতে এমনিই সংকট সৃষ্টি করবে না তো!

ভারতের সুদীর্ঘ তটভূমি বায়ুশক্তি উৎপাদনের উপযুক্ত। উত্তর-পূর্ব ভারতের জলবিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনাকেও এখনো পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি। অবশ্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে স্থানীয় মানুষজন ও জীবজন্তু, পশুপাখির উৎখাত হওয়ার মতো কিছু গভীর সমস্যা জড়িয়ে আছে। খরচও কম নয়। জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীলও বটে। অন্যদিক বিবেচনায় পারমাণবিক শক্তির কথাও ভাবা যেতে পারে। ভারতে মোট বিদ্যুতের মাত্র ২% পারমাণবিক, যেখানে চীনে ৪%, রাশিয়াতে ১৮%, আমেরিকায় ১৯%, ফ্রান্সে ৭২% - সমস্যামুক্ত কেউই নয়। আমরা তো ভুলিনি চেরনোবিল, ফুকুশিমা। কিন্তু বড়ো সমস্যার সমাধানে সব বিকল্পকেই বিবেচনা করতে হবে।

বিশ্বের দরবারে এবং আবার ঘরে

অর্থনীতির পরিভাষায় বাহ্যিকতা (externality) বলে একটা ধারণা আছে। একজনের ভোগ বা উৎপাদন জনিত কৃত কর্মের ফল অন্য কারো ওপর পড়ে। সার্বজনিক জিনিসপত্র (public goods) বা পরিষেবার ক্ষেত্রে তা প্রায়ই দেখ যায়। পরিবেশ, প্রদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি একই গোত্রভুক্ত। অতএব, ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব আর দায় বিশ্বের সব দেশের, সব কালের, সব পাত্রের। তাই এর সমাধানকেও হতে হবে সকলের। সেই কারণেই গ্লাসগোর মহাসভা। কিন্তু উত্তর-দক্ষিণ আর উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত বিভাজনরেখাটা যে মুছলো না। দাদাগিরির প্রচেষ্টা জারি রইলো। আর্থিক ও প্রযুক্তিগত দায় যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টন না হয়, তবে আবারো ব্যর্থ এতো আলোচনা। যে রাষ্ট্রনায়ক হাফ প্যান্ট পরে জলে দাঁড়িয়ে তাঁর ক্রমশ ডুবতে থাকা দ্বীপদেশের জন্য আবেদন জানালেন, তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে কে! যতদিন ঐতিহাসিক দায় না স্বীকার করা হবে, যতদিন ধনী রাষ্ট্র আর্থিক অবদান না দেবে, যতদিন অনগ্রসর দেশ নতুন প্রযুক্তিতে পৌঁছতে না পারবে, ততদিন সমস্যার সমাধান নেই। প্রতিটি রাষ্ট্র এককভাবে এবং সকল রাষ্ট্র যৌথভাবে এগোবে, এটাই ভবিষ্যতের একমাত্র দিশা। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে, আমাদের মতো উলুখাগড়ার প্রাণ যাবে। ১৯৭২ সালে ক্লাব অফ রোমের limits to growth তত্ত্ব থেকে যাত্রা শুরু করে আজ COP-এর ২৬তম অধিবেশন তো নেতাদের নেতৃত্বহীনতা বা স্বার্থান্বেষণেরই ইতিহাস। কিয়োটো প্রোটোকল ছিল গ্রীন হাউস গ্যাস সম্পর্কে প্রথম আন্তজাতিক চুক্তি। তিন দশক ধরে ব্যর্থ। যুব সমাজ আওয়াজ তুলেছে, আমরা তাদের মৃত্যু উপত্যকা দিয়ে যেতে পারি না।

কিছুদিন আগেও শীতকাল এলে আমার গৃহসহায়িকা মহিলাটি আশপাশের মাঠঘাট থেকে অনেক কাঠকুটো, ডালপালা, শুকনো পাতা কুড়িয়ে আনতো। দিল্লির ভয়ানক শীতে হাত-পা সেঁকা, জল গরম করা, এইসব আর কি। আমরা ফরমান জারি করতাম, খোলা জায়গায় এসব জ্বালানো চলবে না। যেমন বলি, ডিসেম্বর-জানুয়ারির রাতে ফুটপাতবাসীরা টায়ার টিউব জ্বালিয়ে বায়ু দূষিত করতে পারবে না। কিছুদিন হলো, মেয়েটি একটা ইমার্শান রড কিনেছে, জল গরম করে। কারণ দিল্লি সরকার পানি-বিজলির ওপর ভারী ছুট দিয়েছে, ওদের কোনো বিজলীর বিল আসে না। রাষ্ট্রের এই কল্যাণকামী ভূমিকার গল্প দিয়েই আমার কথাটি ফুরোলো। বিশ্বের তাবৎ দেশের রাষ্ট্রনেতা ও নীতিনির্ধারকদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি আর শুভবুদ্ধির ওপর প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি আস্থা রইল। তাই নটে গাছটি মুড়োলো না।