আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বীর সাভারকরঃ কিছু সাম্প্রতিক বিতর্ক ও ইতিহাসের সাক্ষ্য

রঞ্জন রায়


[এই পর্বে আমরা আলোচনা করব কয়েকটি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে। যেমন বেয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সাভারকরের ভূমিকা, গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্র, দ্বিজাতি তত্ত্ব ও সাভারকর এবং সাভারকরের হিন্দুত্ব ঠিক কীরকম।]


১.০ উনি কি 'কুইট ইন্ডিয়া' আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন?

গান্ধীজির 'কুইট ইন্ডিয়া' আন্দোলনে নানা কারণে যাঁরা যোগ দেননি তাঁদের লিস্টিটা বেশ লম্বা, খানিকটা এ’রকমঃ দলিত নেতা আম্বেদকর, মুসলিম লিগ নেতা জিন্না, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট কনফারেন্স, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, নেহেরুর আশীর্বাদ ধন্য কিছু কিষান সভা; এবং কিছু লিবেরাল জনতা যাঁরা মনে করতেন জাপান জিতলে ভারত স্বাধীনতা পাবে। এরা কেউ ব্রিটিশের দালাল নন, কিন্তু কমিউনিস্ট সমেত অনেকের গায়ে কংগ্রেস এই তকমাটা সেঁটে দিয়েছিল। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কারণ ছিল। যেমন কমিউনিস্ট পার্টির রাশিয়ার নেতৃত্বে জনযুদ্ধ; নেহেরুর ইচ্ছে ফ্যাশিস্ত শক্তিকে প্রতিরোধ করা, আম্বেদকরের দলিত সমাজের জন্যে স্বতন্ত্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি, জিন্নার জন্যে পাকিস্তানের স্বপ্ন সফল করা।

সাভারকরের কাছে এটা ছিল হিন্দু যুবকদের বিশেষ সুযোগ - ব্রিটিশ ফৌজে ঢুকে যুদ্ধবিদ্যা অস্ত্রচালনায় পারঙ্গম হয়ে আগামী দিনের মহাসমরের জন্যে (মুসলিম-মুক্ত ভারত) প্রস্তুত হওয়া।

হিটলারের জার্মানি ১৯৩৮শের মার্চে অস্ট্রিয়া দখল করায় সাভারকর হিটলারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটা ওঁর চোখে জার্মানির ‘ঐক্যবদ্ধ’ হওয়ার উদাহরণ! উনি মনে করলেন এইভাবেই ‘হিন্দু ভারত’ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। নেহরুর হিটলার এবং মুসোলিনির নিন্দা সাভারকরের চোখে ‘অনাবশ্যক’।

১.১ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ না দেওয়ার জন্যে জেলফেরত সাভারকরের যুক্তিগুলোঃ

এক, ‘নিরস্ত্র, অসংগঠিত এবং একজোট না হওয়া’ জনতার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবা বাতুলতা। বেশ, কিন্তু গান্ধীজি তো অহিংস আন্দোলনের কথা বলছেন। তাতে কী আপত্তি?

দুই, গান্ধীজির পূর্ণ অহিংসার নীতি সশস্ত্র হামলার সামনে ভারতকে, বিশেষ করে হিন্দুদের, লোকসান করবে। স্পষ্টতঃ এই হামলার আশঙ্কা ব্রিটিশের থেকে নয়।

তিন, ফৌজে হিন্দুদের সংখ্যা দ্বিতীয় শত্রু মুসলমানেদের তুলনায় বাড়ানো খুব দরকার। উনি খুশি যে রিক্রুটমেন্টের নতুন নিয়মের ফলে একলাখ নতুন ভর্তির মধ্যে ৬০,০০০ হিন্দু।

সাভারকর স্পষ্ট কথায় বললেন, ‘হিন্দুদের সামরিকীকরণ এবং শিল্প গড়ে তোলা আমাদের বর্তমান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত’। সাভারকরের 'হিন্দু মহাসভা' একটি ‘হিন্দু মিলিটারাইজেশন বোর্ড’ গঠন করে যুবকদের আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্সে যোগ দিতে আহ্বান করল। এই সময়ে 'হিন্দু মহাসভা' ব্রিটিশ ‘রাজ’ এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামতে একটি প্রস্তাব পাশ করল। সেটা সাভারকর চেপে দিলেন এই বলে যে ভারতের পূর্ব-পশ্চিম দুই প্রান্তে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়েছে। এখন ‘মূর্খের মত জেলে ঢোকার কর্মসূচী’ শিকেয় তুলে রাখা উচিত।

সাভারকর হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে ওদের বিশিষ্ট নেতা জি ভি কেলকরের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া তাঁর সভাপতির অভিভাষণে বললেন - হিন্দুরা ‘এক মিনিট সময় নষ্ট না করে’ ফৌজে যোগ দিক। কারণ, জাপান অক্ষশক্তিতে যোগ দিয়েছে। এখন ব্রিটিশের শত্রুদের ভারতের মাটিতে ঠেকাতে আমাদের ভারত রক্ষার জন্যে সরকারের যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে সবরকমের সাহায্য করতে হবে।

চার্চিল ১১ মার্চ, ১৯৪২শে ভারতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে পাঠানোর কথা ঘোষণা করলেন। ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হওয়ায় গান্ধীজি অগাস্ট ‘৪২শে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কংগ্রেস নেতাদের জেলে পোরা হল। গান্ধীজির ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন নিঃসন্দেহে ১৮৫৭’র সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারত জুড়ে সবচেয়ে বড় জনআন্দোলন বা স্বাধীনতার জন্যে মহাজাগরণ। কিন্তু এর ফলে তিন বছর কংগ্রেসের নেতারা জেলে বন্দী রইলেন, পার্টির ফান্ড আটকে দেওয়া হল, সংগঠন নিষ্ক্রিয় রইল।

সাভারকর জেলে বন্দী কংগ্রেসের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েও ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনকে ‘অসময়োচিত’ বলে সমালোচনা করলেন। কিন্তু এরপর থেকে সাভারকর রাজনীতির আঙিনায় ক্রমশঃ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। অনেক হিন্দু মহাসভার সদস্যরা সাভারকরের ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের বিরোধিতা এবং হিন্দু যুবকদের দলে দলে ফৌজে যোগ দেওয়ার আহ্বান নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন।

সাভারকরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এন সি চ্যাটার্জি [প্রাক্তন স্পীকার সিপিআই(এম) সদস্য সোমনাথ চ্যাটার্জির পিতা] এই ব্যাপারে আরেক সাথী বি এস মুঞ্জেকে লিখলেন, "সমস্ত হিন্দু জনতা গান্ধীজির এবং তাঁর আন্দোলনের সাথে রয়েছে। কেউ যদি এর বিরোধিতা করে তবে সে বরাবরের মত শেষ হয়ে যাবে এবং রাজনীতির আঙিনা থেকে বিতাড়িত হবে। বীর সাভারকরের (বিয়াল্লিশের আন্দোলনের বিরোধিতা করে) দুর্ভাগ্যজনক বক্তব্যটি বাংলায় আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে"।

মারাঠি নাট্যকার, ব্যঙ্গলেখক এবং 'নবযুগ' পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক পি কে আত্রে, যিনি পাঁচ বছর আগে সাভারকরকে সম্বর্ধনা সভায় ‘স্বতন্ত্রবীর’ টাইটেল দেওয়ায় কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের বিদ্রূপের স্বীকার হয়েছিলেন, তিনিই এখন সাভারকরকে ব্রিটিশ ফৌজের স্বার্থে ‘রিক্রুট-বীর’ এবং ‘কাঁচের ঘরে সাজানো সিংহ’ বলে হিন্দু মহাসভার সমর্থকদের হাতে দু-দুবার ঠ্যাঙানি খেলেন, কিন্তু মত বদলালেন না।

রাসবিহারী বসু মার্চ, ১৯৪২শে (কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন শুরুর ঠিক আগে) টোকিও থেকে এক চিঠি লিখে সাভারকরকে অনুরোধ করলেন যাতে উনি ব্রিটিশের এই দুর্বল সময়ে ওদের সমর্থন না করেন, শত প্রলোভন এমনকি স্বাধীনতার আশ্বাসেও বিশ্বাস না করেন। দেশের সব অনিষ্টের মূল ব্রিটিশ শক্তিকে ধ্বংস করতে জাপানের সংগে হাত মেলালে কেমন হয়?

অগাস্ট, ৪২-এর শেষে সুভাষ চন্দ্র বোস জার্মানি থেকে এক রেডিও ব্রডকাস্টে বললেন ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনে ভারতাবাসী জেগে উঠেছে এবং এই আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে। উনি আরও বললেন, "মিঃ জিন্নাহ, মিঃ সাভারকর এবং আরও যারা এখনও ব্রিটিশের সঙ্গে সমঝোতার কথা ভাবছেন তাঁরা শেষবারের মত বুঝে নিন যে আগামী দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বলে কিছু থাকবে না। আজ যারা স্বাধীনতার জন্যে লড়ছেন শুধু তাঁরাই স্বাধীন ভারতে সম্মান পাবেন এবং যাঁরা আজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে, সেদিন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই তুচ্ছ বলে গণ্য হবেন"।

২.০ পাকিস্তান প্রস্তাব, দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং জিন্না ও সাভারকর

মহম্মদ আলি জিন্না দ্বিজাতি তত্ত্ব নিয়ে প্রথম কথা বলেন লাহোরে ১৯৪০ সালের এক অভিভাষণে। কিন্তু তার আগে ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দু’মাস পরে হিন্দু মহাসভার কলকাতা অধিবেশনে সাভারকর ‘নেশনহুড’-এর যে থিওরি পেশ করলেন তা একেবারে জিন্নার তত্ত্বের প্রতিরূপ। কংগ্রেসের ভৌগলিক এলাকা (টেরিটোরি) ভিত্তিক নেশনহুড এর সমালোচনা করে সাভারকর বললেন জাতীয়তার ভিত্তি হবে সংস্কৃতি, ভাষা, নরগোষ্ঠী (রেস) এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। তাঁর মতে হিন্দু একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ওপরের সব শর্তগুলি পূর্ণ করেছে। অর্থাৎ জিন্না নয়, সাভারকর হিন্দু-মুসলিম যে দুটো স্বতন্ত্র জাতি এই তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা।

সমালোচকেরা ছেড়ে কথা বলেননি। এস এ বেলভি বললেন, এই তত্ত্ব ‘ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রহেলিকায় ভরপুর’ এবং জিন্নার মত সাভারকরও এক ‘সাইকো-পলিটিক্যাল কমপ্লেক্সের’ শিকার। পাকিস্তানের পক্ষধর এবং ভারতে ইস্লামিক সাম্রাজ্যের ফিরে আসার স্বপ্ন-দেখা এফ কে খান দুরানি আঙুল তুললেন সাভারকরের স্ববিরোধিতা নিয়ে। একদিকে সাভারকর মুসলিমদের 'স্বতন্ত্র নেশন’ বলে স্বীকার করছেন, অন্যদিকে তাদের স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্বের অধিকারকে অস্বীকার করে গোটা ভারতকে 'হিন্দুদের পবিত্র ভূমি' বলে ঘোষণা করছেন।

কংগ্রেসের সমাজবাদী গোষ্ঠীর অশোক মেহতা এবং অচ্যুত পটবর্ধন বললেন, সাভারকরের তত্ত্বের প্রেক্ষিত তাঁর ‘সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতদুষ্ট’, তবে দুরানির সমালোচনা করে এঁরা বললেন ভারত বহু ন্যাশনালিটির দেশ হলেও এর মানে এই নয় যে সবাই একটা করে আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র পাবে।

সবচেয়ে খুঁটিয়ে সমালোচনা বোধহয় আম্বেদকারের। সাভারকরের থিওরি, ওঁর মতে, ‘অযৌক্তিক এবং অদ্ভুত। "মিঃ সাভারকর স্বীকার করছেন মুসলিমরা এক স্বতন্ত্র জাতি (নেশন)। মানছেন ওদের সাংস্কৃতিক স্বায়ত্ততার অধিকার, মেনে নিচ্ছেন ওদের আলাদা জাতীয় পতাকার কথা। অথচ মুসলিম নেশনের জন্যে একটা আলাদা ‘হোম’ চাইলেই ওনার আপত্তি। উনি হিন্দুদের জন্যে একটি ন্যাশনাল হোম চাইছেন, তাহলে কি করে মুসলিম নেশনের জন্যে আলাদা ‘হোমের’ দাবি অগ্রাহ্য করতে পারেন"?

কিন্তু সাভারকরের হেঁয়ালি সমালোচকদের হাতে আরও অস্ত্র তুলে দিল। অক্টোবর ১৯৩৯শে প্রাদেশিক আইনসভাগুলো থেকে কংগ্রেস বিধায়করা পদত্যাগ করলে হিন্দু মহাসভা মুসলিম মন্ত্রীসভায় যোগ দিল। মানে, মুসলিম মেজরিটি অঞ্চলে আইনানুযায়ী ওদেরই বেশি প্রধিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। ফলে অবিভাজিত বাঙলা, সিন্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সরকার গঠনে, দল আলাদা হলেও, মুসলিম সম্প্রদায়ের মুখ্য ভূমিকা ছিল। যেমন, বঙ্গে কৃষক প্রজা দলের ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা, সিন্ধে মুসলীম লিগের হিদায়েতুল্লার এবং সীমান্ত প্রদেশে লীগেরই ঔরঙ্গজেব খানের। সাভারকর ওইসব মন্ত্রীসভায় অল্পসংখ্যক হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার যুক্তিতে দলের লোকদের যোগ দিতে বললেন।

এরপর কংগ্রেসি ও অন্যান্য সমালোচকের চোখে মহাসভার বিধায়কেরা অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপের লক্ষ্য হয়ে উঠলেন। কারণ, সিন্ধ প্রাদেশিক সভা মার্চ ১৯৪৩শে পাকিস্তানের পক্ষে প্রস্তাব পাশ করল। মহাসভার বিধায়কেরা প্রতিবাদ করলেন কিন্তু সাভারকরের নির্দেশ মেনে পদত্যাগ করলেন না। ক্রমশঃ জিন্না এবং সাভারকর একে অন্যের আয়না হয়ে দাঁড়ালেন। জিন্না খোলাখুলি বললেন যে সাভারকর বাকি সবাইকে বোকা ভাবেন। উনি একই সঙ্গে ফৌজে ৭৫% হিন্দু ভর্তি করার সঙ্গে ব্রিটিশের কাছে 'ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস' চাইছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, ভারতে 'মিলিটান্ট হিন্দুরাষ্ট্র' স্থাপন করা।

ইতিমধ্যে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কাছে গান্ধী এবং নেহরু অধিক গ্রহণীয় হয়ে উঠেছেন এবং মুসলিমদের অধিকাংশের কাছে জিন্না। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ সম্পূর্ণ। ১৯৪৫-৪৬শের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সভার নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে অধিকাংশ আসনে বিজয়ী হল। মহাসভা গোহারা হারল। কেন্দ্রীয় সভায় একটা সীটও পেল না। বোম্বে এবং সেন্ট্রাল প্রভিন্সে সবার জামানত জব্দ হল। বঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ একজন আনকোরা কংগ্রেসির কাছে হারলেন।

১৯৪৬ নাগাদ ভগ্নস্বাস্থ্য সাভারকরের বয়েস তেষট্টি। সমস্ত দাঁত পড়ে গেছে, ঘুষঘুষে জ্বর ফিরে আসছে, দুটো হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে; দুঃস্বপ্ন তাড়া করে - কারা যেন লোহার রড দিয়ে পাঁচিল ভেঙে ফেলছে অথবা উন্মত্ত জনতা দরজা ভাঙছে। অগাস্ট ১৯৪৬-শের দাঙ্গায় কোলকাতায় ৫,০০০ এর উপর মানুষ মারা গেল; অক্টোবরে জ্বলে উঠল পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছে আমেদাবাদে, মুম্বাইয়ে। সাভারকর টের পাচ্ছেন দেশভাগ আর ঠেকানো যাবে না।

১৯৪৭-এর ১৫ই অগাস্ট; মুম্বাইয়ে সাভারকরের বাড়ির ছাদে দুটি পতাকা উড়ল - গেরুয়া এবং তেরঙ্গা। উনি বললেন যে এই স্বাধীনতা এসেছে বহু সহিংস পন্থার বিপ্লবী ও শহিদদের আত্মত্যাগের ফলে, আদৌ অহিংস অসহযোগের ফলে নয়।

৩.০ গান্ধীহত্যার সঙ্গে সাভারকরের আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কিনা?

ভারতের ক্ষেত্রে তিরিশ এবং চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক পরিদৃশ্য ছিল অনেকগুলো ক্রস কারেন্টের সমাহার। সেটা আদৌ মহাভারতের যুদ্ধের মত একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অন্যদিকে গান্ধীজির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ভারত - এমন ছিল না।

তখন অনেকগুলো প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে। যেমন, ব্রিটিশ-উত্তর ভারতের চেহারা কেমন হবে? ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধার্মিক সমূহের মধ্যে ব্যবস্থার বাঁটোয়ারা কেমন হবে? ব্রিটিশের তৈরি বিভিন্ন ধার্মিক সমুদায়ের জন্যে আলাদা আলাদা ইলেক্টোরেটস এবং রিজার্ভ সীটের ভবিষ্যৎ কী হবে? ভোট দেওয়ার অধিকার কারা পাবে? ব্রিটিশ রাজত্বে শুধু করদাতা এবং জমির মালিকদের ভোটাধিকার ছিল। আর হিন্দু-মুসলিম আলাদা ইলেক্টোরেট হওয়ার ফলে মাইনরিটি মুসলমানের একটি ভোটের ওজন মেজরিটি হিন্দু ভোটের চেয়ে বেশি হয়ে গিয়েছিল।

সাভারকর, আম্বেদকর, দেশি লিবারেল, জিন্না, গান্ধী নেহরু সবাই এসব প্রশ্নে নিজের নিজের অবস্থান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সাভারকর তখন ব্যস্ত ইংরেজ তাড়াতে নয়, ভারতে লড়াকু হিন্দুসমাজ সংগঠিত করতে। গান্ধী এবং কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর চাপান-উতোর চলতে লাগল। নেতাজী সুভাষ জুন, ১৯৪০শে সাভারকরের মুম্বাইয়ের বাড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু জার্মানি থেকে সুভাষচন্দ্র একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, মিঃ সাভারকর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে আদৌ ভাবেন না। ওঁর একটাই ভাবনা - কি করে হিন্দু ছেলেরা ব্রিটিশ আর্মিতে ঢুকে মিলিটারি ট্রেনিং নেবে!

১৫ অগাস্টের ঠিক আগে সাভারকর গেরুয়া পতাকাকে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় ধ্বজ করার প্রস্তাব রাখলেন; সংবিধান সভার ফ্ল্যাগ কমিটি সে প্রস্তাব খারিজ করল। তখন উনি পতাকার কেন্দ্রে গান্ধীজির চরখার বদলে সারনাথের অশোক চক্র করার প্রস্তাব রাখলেন; সেটা গৃহীত হোল।

৩.১ পাকিস্তানকে টাকা দেওয়ার অভিযোগটি এবং গান্ধীহত্যা মামলা

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১৪ অগাস্ট, ১৯৪৭ তারিখে ক্যাশ রিজার্ভ ছিল ২২০ কোটি টাকা। ঠিক হল, দেশ স্বাধীন হলে বৃটিশের হাত থেকে আনুপাতিক হিসেবে পাকিস্তান পাবে ২৫%, মানে ৫৫ কোটি টাকা। কিন্তু অক্টোবরে পাঠান আদিবাসীরা মহারাজা হরি সিংয়ের করদ রাজ্য কাশ্মীর আক্রমণ করল। নেহেরু-প্যাটেল টাকা দেওয়া স্থগিত রাখলেন। জানুয়ারি ১৯৪৮, অর্থাৎ যতদিন মহারাজা ভারতে যোগদানের সন্ধিপত্রে দস্তখত না করলেন টাকা আটকে রইল। শেষে নেহেরু-প্যাটেলের বিরুদ্ধে গান্ধীর অনশনে ক্যাবিনেট হার মানল; টাকা দিল পাকিস্তানকে। এটা নিয়ে দেশের জনমানসে টেনশন বাড়ল।

এই প্রেক্ষিতে গান্ধীহত্যা মামলা দেখা যাক।

ছেয়াল্লিশের দাঙ্গার সময় গান্ধীর মুসলিম শরণার্থী এবং দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যে হিন্দু যুবকদের এগিয়ে আসার আহ্বানে সাভারকর খেপে গেলেন। তাঁর হিন্দু মহাসভা এবং তাঁর দেওয়া ফান্ডিং নিয়ে নাথুরাম গডসের পত্রিকা ‘দৈনিক হিন্দু জাগরণ’ - যার মাস্টহেডে সাভারকরের ছবি থাকত - গান্ধী এবং মুসলিম সমাজের প্রতি আগুন উগরে চলল।

গান্ধীর উপর হামলা হল দু'বার। প্রথমবার ব্যর্থ, দ্বিতীয়বার সফল। প্রথমবার ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারিতে বিড়লা হাউসে; দ্বিতীয়বার ৩০ জানুয়ারিতে। প্রথমবারের হামলাকারী মদনলাল পাহওয়া, এক পাঞ্জাবী উদ্বাস্তু কিশোর। ওর ছোঁড়া সুতলি বোম গান্ধীজির থেকে ৭৫ ফুট দূরে ফাটল। দ্বিতীয়বার তিন মারাঠি চিতপাবন ব্রাহ্মণ (সাভারকরও তাই)। এঁরা হলেন নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে এবং বিষ্ণু কারকারে। তিন জনেই হিন্দু মহাসভার অগ্রণী সদস্য। গুলি চালালেন নাথুরাম পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে। লক্ষণীয় যে প্রথম হামলাকারী মদনলাল পাহওয়া ওই তিন জনের চ্যালা ছিল এবং প্রথম হামলার দিন (২০ জানুয়ারি) গডসে, আপ্তে, বাড়গে এবং পাহওয়া একসঙ্গে দিল্লিতে ছিল এবং হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় একসঙ্গে ট্রেনে মুম্বাই হয়ে পুণে ফিরে এসেছিল।

নাথুরাম ১৯৩০ সালে আরএসএস-এর সক্রিয় সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালে সাভারকর সবরকম প্রতিবন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে রাজনীতিতে নামতেই হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন। ১৯৩৮শে হায়দরাবাদের নিজামের বিরুদ্ধে সাভারকরের সবিনয় প্রতিরোধ আন্দোলনে উনি প্রথম ব্যাচের সত্যাগ্রহী হয়ে এক বছর জেল খাটলেন।কারকারে ১৯৪৩ সালে হিন্দু মহাসভার টিকিটে 'সিভিক কাউন্সিলর' নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সাভারকরের থেকে ১৫,০০০ টাকা ধার নিয়ে নাথুরাম ১৯৪৪ সালে শুরু করলেন 'অগ্রণী' পত্রিকার সম্পাদনা, বন্ধু আপ্তে হলেন ম্যানেজার। পত্রিকার মাস্টহেডে সাভারকরের ছবি। শুরুতেই পত্রিকায় গর্বের সঙ্গে লেখা হল কীভাবে উনি পুণের কাছে হিল স্টেশন পঞ্চগণিতে একটি জাতীয়তাবাদী ছেলেদের দল নিয়ে গিয়ে গান্ধীজিকে হেনস্থা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে প্রেস অ্যাক্ট ভঙ্গের দায়ে সরকার জরিমানা করায় পত্রিকার নাম বদলে দিয়ে করা হোল 'দৈনিক হিন্দু জাগরণ'। সাভারকর পাবলিক অ্যাপিল করে বললেন হিন্দুত্বে বিশ্বাসী সব পরিবার এক টাকা করে দান দিয়ে পত্রিকাটির পাশে দাঁড়াক।

মামলায় সাভারকরকে করা হল গান্ধীহত্যা চক্রান্তের মুখ্য মস্তিষ্ক। তবে গডসে, আপ্তে এবং কারকারে এতে সাভারকরের যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করলেন। কিন্তু জনৈক অস্ত্রব্যবসায়ী বাড়গে রাজসাক্ষী হয়ে বললেন ঘটনার ক'দিন আগে ১৪ এবং ১৭ জানুয়ারি উনি গডসে এবং আপ্তের সঙ্গে সাভারকরের শিবাজী পার্কের বাড়িতে গিয়েছিলেন। উনি নীচে ছিলেন, ওরা ওপরে গিয়ে সাভারকরের সঙ্গে বৈঠক করে একটু পরে একটা থলি নিয়ে নেমে আসে।

বোম্বের একজন নামকরা অভিনেত্রী বিম্বা (যিনি নিজের গাড়ি করে ওদের স্টেশন থেকে সাভারকরের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছিলেন) এবং সাভারকরের বডিগার্ড ও সেক্রেটারি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেন। কিন্তু আলোচনার সময় কি কথা হয়েছিল তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই।

সাভারকরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পুরোটাই সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সকে ভিত্তি করে তৈরি। যেমন তিন আসামীর সঙ্গে সাভারকরের ঘনিষ্ঠতা, কাজকর্ম এবং তিন জনেরই গান্ধীজির বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং বিশ্বাস যে গান্ধীজির জিন্না তুষ্টিকরণ নীতির ফলে দেশভাগ হয়েছে।কিন্তু ৪ঠা মার্চ, ১৯৪৮শে মুম্বাই পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ানে সাভারকরের সেক্রেটারি দামলে এবং বডিগার্ড আপ্পা কাসর জানায় যে গডসে এবং আপ্তে জানুয়ারির মাঝামাঝি, সম্ভবতঃ ১৫ কি ১৭ জানুয়ারি, রাত্তিরে সাভারকরের বাড়ি এসে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ সাভারকরের সঙ্গে কথা বলেছিল। ফের ২৩ অথবা ২৪ তারিখে এসে সকালবেলায় সাভারকরের সঙ্গে আধঘন্টা কথা বলেছিল। নাথুরামকে গান্ধীহত্যার জন্যে ৯ এমএম ব্যারেটা পিস্তল দিয়েছিল গোয়ালিয়রের হিন্দু মহাসভার সেক্রেটারি সদাশিব পরচুরে।

বিচারের রায় বেরলো। জাস্টিস আত্মারাম আট জন অভিযুক্তের মধ্যে শুধু সাভারকরকে প্রমাণাভাবে মুক্তি দিলেন - কারণ রাজসাক্ষীর বয়ানের কোনো স্বতন্ত্র সাক্ষী বা দলিল পাওয়া যায়নি। নাথুরাম এবং নারায়ণ আপ্তের ফাঁসি, বাকি পাঁচ জনের যাবজ্জীবন (তখন এর মানে ১৪ বছর)। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করল না। অভিযুক্তরা আপিল করলে হাইকোর্টের রায়ে পরচুরে এবং বাড়গের ড্রাইভার কিস্টায়া ছাড়া পেল, কিন্তু বাকিদের শাস্তি বহাল রইল।

৩.২ শ্যামাপ্রসাদ, নেহেরু ও সর্দার প্যাটেল

তখন শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন হিন্দু মহাসভার সেক্রেটারি। নেহেরু বললেন গান্ধীহত্যার পর ওঁর মন্ত্রিসভায় হিন্দু মহাসভার নেতা মন্ত্রী হবেন এটা উচিৎ নয়। শ্যামাপ্রসাদ মহাসভার সদস্যপদ ছাড়লেন। কিন্তু উনি প্যাটেলকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যে সাভারকরের বিচার যেন নিরপেক্ষ ভাবে হয়। প্যাটেল আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে উনি শ্যামাপ্রসাদকে লিখেছিলেন যে, আইনের নিক্তিতে সাভারকর ছাড়া পেলেও এই হত্যাকান্ডের নৈতিক দায় থেকে উনি মুক্ত হতে পারেন না।

নেহেরু তাঁর হোম মিনিস্টার বল্লভভাই প্যাটেলকে চিঠি লিখে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন যে গান্ধীহত্যার পেছনে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রটি’ খুঁজে বের করার চেষ্টায় নিষ্ঠার অভাব দেখা যাচ্ছে। সরকার ইতিমধ্যে আরএসএসকে নিষিদ্ধ করেছে। প্যাটেল নেহেরুকে উত্তরে জানিয়েছিলেন যে অপরাধীরা দোষ স্বীকার করে বিস্তৃত বয়ান দিয়েছে। এর পেছনে আছে সাভারকরের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত 'হিন্দু মহাসভা' বলে এক উগ্র সংস্থা। প্যাটেল নেহেরুর আরএসএস নিয়ে আশংকার উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, আরএসএস-কে অন্য অনেক দোষে দায়ী করা যায়, কিন্তু গান্ধী হত্যার জন্যে নয়।

সাভারকর এক বছর জেল খেটে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তবে বিতর্ক পিছু ছাড়ল না। ৬০-এর দশকে তিলকের নাতি জি ভি কেতকর পুণের এক সভায় বললেন যে, উনি গান্ধীহত্যার ব্যাপারে ঘটনার অনেক আগেই জানতেন। ১৯৬৬ সালে সরকার এ নিয়ে কাপুর জুডিশিয়াল কমিশন বসাল। কমিশন নতুন করে গান্ধীহত্যার তদন্ত করতে গিয়ে খেয়াল করে যারাই পরে গান্ধীহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে তাদের প্রায় সবাই কোন না কোন সময়ে 'সাভারকর সদন'-এ মিলিত হয়েছে এবং সাভারকরের সাথে দীর্ঘ আলোচনায় শরিক হয়েছে। হত্যায় মুখ্য অভিযুক্তরা হামলার অল্প আগে সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেছে। নিঃসন্দেহে গান্ধীজিকে নিয়ে সাভারকরের তিক্ত সমালোচনা আততায়ীদের হৃদয়ে মহাত্মার প্রতি তীব্র ঘৃণা জাগিয়েছে।

কাপুর বললেন যে, সমস্ত তথ্যপ্রমাণ একসাথে মিলিয়ে দেখলে সাভারকর এবং তার গ্রুপ মিলে যে ষড়যন্ত্র রচেছিলেন তাই মনে হয়। মোদীজি ক্ষমতায় এলে এক সাভারকর-ভক্ত কাপুর কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট গেল। সবোর্চ্চ আদালত তার মে, ২০১৮-র রায়ে বললো যে, কমিশনের রিপোর্ট 'জেনারেল অবসার্ভেশন' মাত্র; তা কোনোভাবেই ক্রিমিনাল কোর্টের রায় - সাভারকরের ভূমিকা অপ্রমাণিত - উলটে দিতে পারে না।সব মিলিয়ে প্যাটেলের কথাটাই মাথায় আসে - আইনের বিচারে ছাড়া পেলেও গান্ধীহত্যার নৈতিক দায় থেকে সাভারকরকে রেহাই দেওয়া কঠিন।

৪.০ সংঘ পরিবারের 'হিন্দুত্ব থিওরি' ও সাভারকর

সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক এজেন্ডা যে ‘হিন্দুত্ব’ সেটা অবশ্যই সাভারকরের অবদান। ওদের মূল তাত্ত্বিক বই গুরুজী গোলওয়ালকরের ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ স্পষ্টতঃ সাভারকরের বড়দা বাবারাও সাভারকরের 'রাষ্ট্র মীমাংসা' বইটির সংক্ষিপ্ত রূপ। প্রথমটির ছত্রে ছত্রে দ্বিতীয়টির ছাপ। কিন্তু সেসময় ঋণ স্বীকার না করায় সাভারকর মনে হয় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এছাড়া, গোলওয়ালকরের চুলদাড়ি এবং পোষাকে সন্ন্যাসীর ভাবভঙ্গি রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রবক্তা সাভারকরের না-পসন্দ ছিল। বিদ্রূপ করে বলতেন, ‘আরএসএস ভলান্টিয়ারের স্মৃতিফলকে লেখা থাকবে - জন্মেছিল, আরএসএস-এর সদস্য হল, তারপর কিছু না করেই মারা গেল’। তাই হিন্দু মহাসভার কর্মীদের একসময় আরএসএস-এর সদস্যপদ ছেড়ে দিতে বলেছিলেন।

সংঘ পরিবারের সাংস্কৃতিক ভারত নিয়ে ধারণার দুটো স্তম্ভ, ‘পূণ্যভু’ (হোলিল্যান্ড) এবং ‘পিতৃভু’ (ফাদারল্যান্ড) হুবহু ওঁর থেকে নেওয়া। সে ঋণ সংঘ পরিবার আজ সুদে আসলে ফিরিয়ে দিচ্ছে ওঁকে সামনের সারির স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে প্রজেক্ট করে। ওঁর ‘হিব্দুত্ব’ কিন্তু ধার্মিক হিন্দুত্ব নয়। বরং সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক হিন্দুত্ব। ওঁর মতে হিন্দু একটি সাংস্কৃতিক জাতি, যাদের শিরায় শিরায় বইছে একই শুদ্ধ রক্তধারা, যারা জন্মসূত্রে এই ঐতিহ্যের জন্যে গর্বিত। ওঁর হিন্দুত্ব আইন করে এফিডেভিট করে নাগরিকত্ব পাওয়া নয়। তার জন্যে ভারতে জন্মাতে হবে। কেন? কারণ যদি 'পিতৃভূমি' এবং 'পূণ্যভুমি' এক না হয় তাহলে মানুষের মনে টানাপোড়েন থাকবে এবং দেশপ্রেমের প্রশ্নে তার আনুগত্য বিভক্ত হবে।

উনি মনে করেন 'হিন্দু' একটি প্রাকৃত শব্দ, সংস্কৃত নয়, তাই বেদে উল্লেখ নেই। কিন্তু এটি প্রাচীন শব্দ। মধ্যপ্রাচ্যের জিভে 'স' কে 'হ' উচ্চারণ করা হত। ফলে 'সপ্তসিন্ধু' জেন্দাবেস্তায় 'হপ্তসিন্ধু' বলে উল্লিখিত, এবং সিন্ধুনদের এপারে সবাই হিন্দু। তাই ভারতে জন্মানো হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন সবাই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক হিন্দু। কারণ তাদের জন্মভূমি (পিতৃভূমি) এবং 'পুণ্যভূমি' হিন্দুস্তান। একই কারণে কোনো ক্রিশ্চান বা মুসলমান হিন্দুস্থানের নাগরিক বা সাংস্কৃতিক -রাজনৈতিক হিন্দু হতে পারে না। কারণ তার জন্মভূমি যদি ভারত হয়ও, এবং সে যদি দেশপ্রেমিক হয়ও তার পূণ্যভূমি আলাদা (আরব ও প্যালেস্তাইন)। ফলে সেইসব দেশের সঙ্গে যুদ্ধ হলে বা স্বার্থের সংঘাত হলে 'কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট' কাজ করবে(!)।

অতএব সাভারকরের ভারতবর্ষে মুসলিম/ক্রিশ্চানদের স্থান নেই। আরএসএস-এর গুরুজি গোলওয়ালকরের ‘এ বাঞ্চ অফ থট’ বইয়েও ‘ইন্টার্নাল থ্রেটস’ বলে একটি অধ্যায় আছে, যাতে শত্রু তিন জন - মুসলিম, ক্রিশ্চান এবং কম্যুনিস্ট। এদের পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি আলাদা যে!

এবার বোঝা যাচ্ছে - কেন আজকাল কথায় কথায় সেকুলার বা লিবেরালদের 'পাকিস্তান' চলে যেতে বলা হয় এবং কেন ক্ষমতাসীন দল নাগরিক রেজিস্টার এবং ছলেবলে কৌশলে মুসলিম বিতাড়নের ধুয়ো তুলেছে।

এখানে আমার দুটি প্রশ্নঃ

১) সমস্ত ইউরোপীয় নেশন স্টেট বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের (যাঁরা জন্মসূত্রে নাগরিক) পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি আলাদা। তাবলে এতদিন ধরে তাঁদের আনুগত্য কি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে? ইতিহাসের সাক্ষ্য কি বলে?

২) সিন্ধু এখন পাকিস্তানের প্রদেশ তাহলে কি আমাদের বর্তমান নাগরিকদের সাভারকরের অখন্ড হিন্দুরাষ্ট্র গড়তে সেটা কেড়ে নিতে হবে? আমরা 'জনগণমন' গানে সিন্ধু শব্দটা বাদ দিইনি; কেন?

কিন্তু ইউটিউবে বন্দেমাতরম শুনে দেখুন 'সপ্তকোটি কন্ঠ কলকল নিনাদ করালে' বদলে 'কোটি কোটি কন্ঠ কলকল নিনাদ' করালে, 'কোটি কোটি ভুজৈ ধৃতখরকরবালে' করা হয়েছে। আসলে আনন্দমঠে বঙ্কিম এখানে দেশ বলতে অবিভক্ত বঙ্গকেই বুঝিয়েছেন, গোটা ভারতকে নয়।

সাভারকর জাতিপ্রথা হিন্দুসমাজের এবং দেশের ক্ষতি করেছে বলে মনে করেন। উনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে। একটা মন্দির বানালেন যাতে সব জাতের লোক ঢুকতে পারবে। ওঁর মতে - একবার মুসলমানের ছোঁয়া লেগে যাওয়ার অপরাধে আমরা বহু হিন্দু পুরুষ এবং বিশেষ করে নারীদের সমাজের বাইরে করে দিয়ে মুসলমান সমাজের সংখ্যা বাড়িয়েছি মাত্র। কিন্তু সংঘ পরিবার জাতিভেদের তাত্ত্বিক প্রবক্তা মনুস্মৃতি ও শংকরাচার্যকে বিশেষ আসনে বসিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবার দীপাবলীর সময় কেদারনাথে গিয়ে শংকরাচার্য্যের মূর্তির ‘উদ্ঘাটন’ করে এসেছেন।

সাভারকর রিকনভার্সনের বা মুসলিম থেকে হিন্দুধর্মে ফেরার ডাক দিয়েছিলেন। বর্তমান সংঘ পরিবার শুরু করেছে ঘর-ওয়াপসি বা ঘরে ফেরার আন্দোলন। আজ সংঘ পরিবার সাভারকরকে মাথায় তুলে রেখেছে। আন্দামান জেলের নামকরণ আজ ওঁনার নামে। অথচ ওখানে ওঁর চেয়ে বেশি সময় জেল খেটেছে বা ওখানেই মারা গেছে এমন বন্দীর নামও পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রবন্ধের প্রথম ভাগে আমরা ত্রৈলোক্য মহারাজের বন্দীজীবন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি।

এখন সাভারকরের ছবি সংসদের দেয়ালে ঝুলছে। কাল হয়ত ভারতরত্ন দেওয়া হবে।এর পেছনে দুটি কারণ আছে বলে মনে হয়। এক, বিজেপির নেতাদের মধ্যে (আরএসএস-এর) স্বাধীনতা সংগ্রামে জেল খেটেছেন এমন নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার জেলে গেছেন কংগ্রেসি কার্যকর্তা হিসেবে। আরএসএস প্রতিষ্ঠার পরে নিজে যাননি, অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করেছেন। অথচ কংগ্রেস এবং কম্যুনিস্ট পার্টিতে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম, এমনকি সেলুলার জেল খেটেছেন তাদের মধ্যেও। দুই, গান্ধীজির নরম হিন্দুত্বের জায়গায় সাভারকর এক এক্সক্লুসিভ আক্রামক হিন্দুত্বের তাত্ত্বিক প্রবক্তা এবং মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত প্যারানইয়ার রূপকার।

কিন্তু আজ এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত। গত ১৫ আগস্ট, ২০১৯ স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার থেকে দেশের জনতার প্রতি সম্বোধনে প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা বিস্ফোরণের আশঙ্কার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু এটা ভিত্তিহীন। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কোথাও হচ্ছে না, ভারতেও না, বিশ্বের অন্য কোথাও নয়। ২০১৯ সালের সরকারী তথ্য অনুযায়ী ভারতের টোটাল ফার্টিলিটি রেশিও সূচক বা টিএফআর (অর্থাৎ, একটি সমাজে, রাজ্যে বা দেশে প্রজনসক্ষম বয়সে একজন নারী গড়ে ক’জনের জন্ম দিচ্ছে) ২.৩। এটা ২.২ হলেই বর্তমান জনসংখ্যা স্থির হয়ে যাবে। গড়ে এক বছরে যত জনের জন্ম হবে বা যত জনের মৃত্যু হবে তা প্রায় সমান সমান হয়ে কাটাকুটি হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার এই রেশিও মুসলিম প্রধান কাশ্মীরে মাত্র ১.৬ এবং বঙ্গেও তাই। অথচ হিন্দুপ্রধান গুজরাত এবং উত্তরপ্রদেশে ক্রমশঃ ২.৬ এবং ৩। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুতহারে কমছে।

‘গোমাতা’ এবং 'গো-পূজা' ওঁর মতে ‘বুদ্ধি-হত্যা’ ছাড়া আর কিছু নয়। গরু শুধু বাছুরের মাতা। গোমূত্র, গোবর খাওয়া নিয়ে ওঁর প্রবল বিতৃষ্ণা। কিন্তু গরু উপকারী পশু, তাই তার সংরক্ষণ দরকার। অথচ সংঘ পরিবারের বিভিন্ন ফ্রন্ট গোহত্যার কথিত অপরাধে মুসলমানদের লিঞ্চ করতে দ্বিধা করছে না।

সাভারকরের মতে বৌদ্ধধর্মের অহিংসা নীতি ভারতকে দুর্বল করে মুসলিম আগ্রাসনকে সহজ করে দিয়েছে। সিন্ধু আক্রমণের প্রসঙ্গে উনি বৌদ্ধদের বিশ্বাসঘাতক বলতে দ্বিধা করেননি। ওঁর মতে হিন্দুদেরও 'দাঁতের বদলে দাঁত চোখের বদলে চোখ' নীতি মেনে চলা উচিত ছিল। 'ক্ষমা বীরস্য ভূষণম' জাতীয় ফালতু স্তোকবাক্যে না ভুলে পরাজিত আত্মসমর্পণকারী মুসলিমদের হত্যা করা উচিত ছিল। এবং 'ওরা' যেমন পরাজিত হিন্দুদের বৌ-মেয়েদের লুটে নেয়, ধর্ষণ করে, বিয়ে করে বা রক্ষিতা বানায় আমাদেরও তাই করা উচিত ছিল। তাহলে আজ এত মুসলমান হত না।'

"শিবাজী যখন বিজাপুরের সুলতানের পরিবারের মেয়েদের সসম্মানে ফেরত দিলেন তখন কি সেই সিন্ধুবিজয়ের দিন থেকে অগণিত লুন্ঠিত ধর্ষিত হিন্দু মেয়েদের কান্না তাঁর কানে প্রবেশ করেনি"? হিন্দুসমাজ 'অহিংসা', 'শত্রুকে সম্মান', 'সহিষ্ণুতা' - এসবকে গুণ মনে করে নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছে। সাপ দেখলে মেরে ফেলা উচিত, স্ত্রী-পুরুষ বিচার করা উচিত নয়। রামায়ণে রামচন্দ্র তারকা রাক্ষসীকে বধ করেছিলেন। লক্ষ্মণ শূর্পনখার নাক কেটে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাহলে?

'ভারতরত্ন'-র যোগ্য নায়ক বটে!

আগেই বলেছি ওঁর ‘হিন্দু ভারত’ শুধু তাদের স্বীকার করে যারা ভারতে জন্মেছে (পিতৃভু) এবং যাদের ধার্মিক ও সাংস্কৃতিক শেকড় ভারতে; তাই হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন স্বীকার্য, অন্যেরা নয়। মুসলমানেরা বহিরাগত, তায় ওদের পুণ্যভূমি মক্কায়। যারা এদেশে জন্মেছে তারা প্রথম শর্ত ‘পিতৃভু’ পাশ করলেও দ্বিতীয় শর্ত ‘পুণ্যভূ’ পাশ করবে কি করে!

বর্তমান সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ পর্য্যন্ত আফগানিস্তান, পাকিস্তান, এবং বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় প্রতারণার ফলে আগত হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন এবং খৃস্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। স্বাধীন ভারতে গান্ধীহত্যার কলঙ্ক লাগায় জনমানস থেকে মহাসভা এবং সাভারকর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। ফলে উনি আরও উগ্র আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। এই সময়ে লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র এবং প্রবন্ধ তার সাক্ষী। 'সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি' বলে ওঁর বইটি পড়লে দেখা যাবে এমন এক অতীতমুখী মন যার চেতনা শুধু অতীতের হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে আবদ্ধ হয়ে হিন্দুর কথিত বিক্রমগাথায় সান্ত্বনা খোঁজে। শুধু তাই নয়, এই মানস একটি প্যারানইয়া - শিগগিরই মুসলিমরা ভারতে মেজরিটি জনগোষ্ঠী হয়ে উঠবে - থেকে আত্মসমর্পণকারী বন্দী মুসলিমদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হত্যা তথা 'টু পে ইন দেয়ার ওন কয়েন' নীতিতে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণকে উচিৎ বা কর্তব্য বলে ওকালত করে। বৃদ্ধ অসুস্থ সাভারকরের ইংরেজি অনুবাদে সহকারী এস টি গোডবোলের চোখে এগুলো রীতিমত ‘শকিং’ মনে হয়েছিল। তাঁর অন্য এক মারাঠি ভাষায় জীবনী রচয়িতা ডি এন গোখলের মতে, সাভারকরের এই ‘বদলা’ নেবার থিওরি হিন্দুধর্মের কিছু বেসিক ভ্যালুজকে - যেমন ‘ক্ষমা, নারীর প্রতি সম্মান, উদার হৃদয় হওয়া’ - খারিজ করে। তাই এর তীব্র সমালোচনা হয়েছিল।

বর্তমান শাসকদলের নেতারা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের বীরত্ব ও ত্যাগ নিয়ে অনেক কথা বলেন। কিন্তু ভুলেও নাম করেন না নেতাজির ব্যক্তিগত সহকারী হবিবুর রহমান বা কর্নেল শাহনওয়াজ খানের।

৪.১ সাভারকর আচার-আচরণে কতটুকু হিন্দু?

ব্যক্তিগত জীবনে বিনায়ক সাভারকর ছিলেন নাস্তিক এবং সংস্কারমুক্ত। হিন্দু ধর্মের সংস্কার, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। বর্ণাশ্রম ও ধর্মীয় সংস্কার যে হিন্দুধর্মকে বিভক্ত করে দিয়েছে এবং অনেক ক্ষতি করেছে তা বারবার বলেছেন। রত্নগিরিতে থাকবার সময় তিনি দলিতদের জন্যে পতিতপাবন মন্দিরের দ্বার খুলে দেন এবং ছোঁয়াছুঁয়ি ও নানারকম সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তাঁর উপস্থিতিতে বেশ কিছু অসবর্ণ বিবাহও হয়।

সাভারকর মাসাহারী ছিলেন। মাছ খেতে খুব ভালবাসতেন। খাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি ওঁর পছন্দ নয়। এসব হিন্দুদের দুর্বল করেছে বলে ওঁর ধারণা। উনি জাতিব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করেও বলেন যে, মুসলিম আমলে নিজেদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার খাতিরে এই ব্যবস্থা বেশি আঁটোসাটো হয়েছে, আজ দরকার নেই।

অসুস্থ সাভারকর ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান। পীড়ায় অস্থির হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু কামনা করেছিলেন, কিন্তু আইনে বাধে। তাই ধীরে ধীরে খাওয়াদাওয়া এমনকি জল পর্য্যন্ত ছেড়ে দিলেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মরদেহ কোন চিতায় তোলা হয়নি, মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়নি, বিনা আড়ম্বরে ইনসিনারেটরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাড়ির কাছে কাকেদেরও কিছু আহার বা পিন্ড দেওয়া হোল না। ভদ্রলোকের কাছে হিন্দু ধর্ম ব্যক্তিগত আচরণ না হয়ে রাজনৈতিক স্তরেই সীমাবদ্ধ রইল।

৫.০ উপসংহার

৫.১ সাভারকর এবং জিন্না

হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তা ‘বীর’ সাভারকর ও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রবক্তা ‘কায়েদ-এ-আজম’ জিন্নার মধ্যে আশ্চর্য মিল।সাভারকর জাতপাত মানতেন না। গরুকে মাতা বলতেন না। এবং জ্যোতিষেও বিশ্বাসী ছিলেন না। চিতপাবন মারাঠি ব্রাহ্মণ হলেও মাছ-মাংস খেতেন। নিজের মৃত্যুতেও কোনো শ্রাদ্ধ বা ধার্মিক সৎকার নিষেধ করেছিলেন। জিন্না নামাজ পড়তেন না, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে বাছবিচার ছিল না। নিয়মিত সুরাপান করতেন। দুজনেই মনে করতেন হিন্দু এবং মুসলমান দুই আলাদা জাতি এবং নেশন-স্টেট গড়তে গেলে এদের আলাদা হতেই হবে। সাভারকর, জিন্নার অনেক আগে ভারতে দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন।

সাভারকরের মতন জিন্নাও গোড়ায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি ১৯০৯ থেকে মিন্টো-মর্লি রিফর্মের সময়ে তৈরি ধর্মভিত্তিক আলাদা আলাদা ইলেক্টোরেটের বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে, এসব হল ভারত জাতিকে ভাগ করার প্রয়াস। যদিও কয়েক বছর পরে জিন্না মুসলিম লিগে যোগ দিলেন। জিন্নার সঙ্গে তুলনা? সাভারকরের নিতান্ত না-পসন্দ। কিন্তু দুজনের মধ্যে মিল সবারই চোখে পড়ছিল। আম্বেদকর লিখলেন - কী আশ্চর্য, এমনিতে মিঃ সাভারকর ও মিঃ জিন্নাহ একে অপরের বিরোধী, কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রশ্নে দুজনের কি অদ্ভুত মিল!

'লস এঞ্জেলস টাইমস'-এর সাংবাদিক টম ট্রেনর ১৯৪২ সালে মুম্বাইয়ে সাভারকরের বাড়িতে গিয়ে ওঁর ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। শেষে ওঁর মন্তব্য হল সাভারকরের হিসেবে চললে মুসলমানেরা যা চাইছে তা পেয়ে যাবে। আরও বললেন - “ইট ইজ দ্য সর্ট অফ অ্যাটিচুড হুইচ মেইকস মিঃ জিন্না আর্গু ফর পাকিস্তান”। 'ইন্ডিয়ান রিভিউ' পত্রিকা লিখল, ’হিন্দু মহাসভার যেমন সাভারকর, মুসলিম লিগের তেমন জিন্না’। আরও বলল, ’সাভারকর মহাসভাকে যেমন উগ্র হিন্দু বানিয়েছেন, তেমনি জিন্না লীগকে বানিয়েছেন উগ্র মুসলিম'।

জিন্না সম্ভবতঃ ১৯৪০ সালে প্রথম জনসমক্ষে দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা প্রচার করেছিলেন। কিন্তু সাভারকর তার প্রায় দু'দশক আগেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে হিন্দু এবং মুসলমান দুটো আলাদা জাতি। তারা এক রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে না। এর ভিত্তিতে জিন্না আলাদা করে মুসলিমবহুল অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলনে নামলেন। আর সাভারকরের স্পষ্ট মত, হিন্দুস্তানে মুসলমানদের মাথা তুলতে বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপরিচালনার পদে থাকতে দেওয়া উচিত হবে না। দুজনের মধ্যে দুটো মিল। দুজনেই ব্যক্তিগত আচার আচরণে ধার্মিক নন, কিন্তু দুজনেই ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। এঁদের রাষ্ট্র কল্পনায় অন্য ধর্মের মানুষ সমান অধিকার পাবে না।

১৯১৯-২০ নাগাদ ব্যারিস্টার জিন্না ছিলেন নরমপন্থী স্বরাজী। উনি খিলাফত আন্দোলনে গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সমর্থনের বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে, এর ফলে ভারতবাসীকে দুটো সম্প্রদায়ে ভাগ করে দেওয়া হবে। সংখ্যাগুরু গান্ধীর সমর্থকরা জিন্নাকে সমালোচনা করল। উনি রাওলাট অ্যাক্টের বিরোধিতায় গান্ধীকে সমর্থন করে আদালতে তাঁর পক্ষে মামলা লড়েছিলেন। ১৯২৯শে নাগপুর কংগ্রেসে উনি গান্ধীজিকে মিঃ গান্ধী বলে সম্বোধন করায় ভলান্টিয়াররা ওঁকে অপমান করে তাড়াল। তারপর উনি মুসলিম লিগে যোগ দিলেন।

৫.২ সাভারকর ও ভগত সিং

ভগত সিং যদিও সাভারকরের সিপাহী বিদ্রোহের উপর লেখা বইটি পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু শীগগিরই তিনি মার্ক্সবাদী সাহিত্যে প্রভাবিত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্যে লড়াইয়ের কথা বলতে থাকেন। তাঁর কল্পনার ভারতে শ্রমিক-কৃষক ছিল, হিন্দু-মুসলিম একে অন্যের 'অপর' হিসেবে দেখা দেয়নি। ব্যক্তিহত্যার জায়গায় গণান্দোলনে বিশ্বাসী ভগত সিং স্যান্ডার্স হত্যায় অভিযুক্ত ছিলেন কিন্তু অ্যাসেম্বলিতে সাধারণ (লো-ইনটেনসিটি) বোমা ফাটিয়ে লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শুধু প্রচারের উদ্দেশ্যে।

৫.৩ সাভারকর ও গান্ধীজি

গান্ধীজি নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিন্দু, সাভারকরের মত রাজনৈতিক হিন্দু নন। উনি গোমাতার পূজায় বিশ্বাসী। কিন্তু উনি সমস্ত ধর্মের মানুষদের সমান নাগরিক অধিকারে বিশ্বাসী। মাইনরিটিকে রক্ষা করা, বিশেষ মর্যাদা দেওয়া উনি কর্তব্য মনে করেন। এদিকে উনি কট্টর শাকাহারী, প্রাকৃতিক চিকিৎসা এবং কৃষিভিত্তিক সমবায়িক অর্থনীতির পক্ষে। উনি শ্রেণিসংগ্রামের বিরুদ্ধে। ধনীদের গরীবদের জন্য ট্রাস্টি হতে বলেন। অধিকার আদায়ের প্রশ্নে অহিংস পন্থা, অসহযোগ এবং সবিনয় অবজ্ঞা আন্দোলনে বিশ্বাসী।

সাভারকর গান্ধীজির সঙ্গে সংঘর্ষে এলেন খিলাফত আন্দোলন এবং ধার্মিক ইলেক্টোরেটে গান্ধীজির অবস্থান দেখে। সাভারকর মনে করতেন পুঁজিবাদী শিল্পই ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, গান্ধীর গ্রামীণ সংস্কার নয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এখন অনেকেই মনে করেন স্বাধীনোত্তর ভারত গান্ধী নয়, সাভারকরের পথেই চলেছে।


তথ্যসূত্রঃ

● রীড এন্ড ফিশার; 'দ্য প্রাউডেস্ট ডে', পৃঃ ৩২৮।
● সাভারকর; 'হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা', পৃঃ ১৫৭-৬৮।
● ঐ, পৃঃ ৫০-৫১।
● সাভারকর, 'হিন্দুরাষ্ট্র দর্শন', পৃঃ ৯৮-১১৭।
● রাঘবন, 'ইন্ডিয়া'জ ওয়ার'। পৃঃ ৭৩-৭৪।
● বম্বে ক্রনিকল, ১৫ জুন, ১৯৪১।
● ঐ, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৪১।
● ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, ১৯ অগাস্ট, ১৯৪২।
● রামচন্দ্র গুহের 'গান্ধী', পৃঃ ৬৮৪-৮৫।
● আত্রে, 'কড়েছে পানি', খন্ড ৩, পৃঃ ২০-২১।
● রথ এন্ড চ্যাটার্জি; 'রাসবিহারী বসু', পৃঃ ১৭১-৭৪।
● সুভাষচন্দ্র বোস, 'টেস্টামেন্ট অফ সুভাষ বোস', পৃঃ ২১-২৪।
● বম্বে ক্রনিকল, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৩৯।
● নিকোলস, 'ভার্ডিক্ট অন ইন্ডিয়া', পৃঃ ১৮৪-৮৫।
● মেহতা এন্ড পটবর্ধন, 'দ্য কম্যুনাল ট্র্যাঙ্গেল ইন ইন্ডিয়া', পৃঃ ১৭৮।
● আম্বেদকর, 'পাকিস্তান', পৃঃ ১৪৩।
● সীতারামাইয়া; 'হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস', খন্ড-৩, পৃঃ ৫৪২-৪৩ এবং ৫২৯।
● বৈভব পুরন্দরে, 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ২৭৭।
● জিন্না; 'সাম রিসেন্ট স্পীচেস এন্ড রাইটিং', পৃঃ ৩০৮-০৯।
● পুরন্দরে; 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ২৯২।
● ধনঞ্জয় কীর; 'বীর সাভারকর', পৃঃ ৩৭১; এবং গোখলে, 'স্বতন্ত্রবীর সাভারকর',পৃঃ ৫৬-৫৭।
● সাভারকর; 'ঐতিহাসিক নিবেদনয়ে'। পৃঃ ১৬১-৬৩।
● বোস; 'দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল', পৃঃ ৩৪।
● সাভারকর; 'ঐতিহাসিক নিবেদনয়ে', পৃঃ ১৬৪-১৬৫।
● জুডিথ ব্রাউন, 'নেহেরু, এ পলিটিক্যাল লাইফ', পৃঃ ১৭৭-৮০।
● মনোহর মালগাঁওকর, 'মেন হু কিল্ড গান্ধী', পৃঃ ৭৮-৭৯।
● রবার্ট পেইন, 'লাইফ এন্ড ডেথ অফ মহাত্মা গান্ধী', পৃঃ ৫৭০-৭১।
● 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ৩০২।
● রবার্ট পেইন, 'লাইফ এন্ড ডেথ অফ মহাত্মা গান্ধী', পৃঃ ৬২৮-৩০।
● ঐ, পৃঃ ৩০২-৩০৩।
● 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ৩০৪।
● ঐ, পৃঃ ৩০৭।
● মনোহর মালগাঁওকর, 'মেন হু কিল্ড গান্ধী', পৃঃ ১২৫-২৬।
● 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ৩২০।
● নেহেরু; 'সিলেক্টেড ওয়ার্কস', নিউ সিরিজ, খন্ড-৫, পৃঃ ৪৬-৪৭।
● প্যাটেল, 'করেসপন্ডেন্স', পৃঃ ৬৫।
● ঐ, পৃঃ ৫৫-৫৬। এতে নেহেরুর চিঠি এবং প্যাটেলের জবাব দুটোই আছে।
● 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ৩১২।
● ঐ, পৃঃ ২৯৩-৯৪ এবং 'দ্য ব্রাদারহুড ইন স্যাফ্রন', পৃঃ ৩৬ এবং ৪০।
● বৈভব পুরন্দরে, 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব' পৃঃ ১৭৮-১৭৯। সাভারকর ১৯২৩-এ রত্নগিরির জেলে বসে ইংরেজিতে লিখেছিলেন 'এসেনশিলাস অব হিন্দুত্ব'। তাতে দ্বিজাতিতত্ত্ব স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
● ঐ, পৃঃ ১১৯।
● গোলওয়ালকর; 'বাঞ্চ অফ থটস', পৃঃ ১৭৭-৯৫।
● বৈভব পুরন্দরে, 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ২০০।
● শংকরাচার্য্যের জাতিভেদের এবং শূদ্রদের প্রতি ঘৃণা বুঝতে 'ব্রহ্মসূত্র'-র ওঁর ভাষ্যে প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
● নীতি আয়োগের দেওয়া তথ্য, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে অগাস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত জনসংখ্যা বিষয়ক প্রবন্ধে উল্লিখিত। নীতি আয়োগের ওয়েবসাইটেও দেখা যায়।
● পুরন্দরে, 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব'; পৃঃ ২০০-০১।
● ঐ, পৃঃ ২০০-০১।
● ঐ, পৃঃ ৩৩৪ এবং সাভারকরের 'সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ হিস্ট্রি', পৃঃ ১৭৫-৮০।
● ঐ, পৃঃ ৩৩৩-৩৪ এবং সাভারকরের 'সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ হিস্ট্রি', পৃঃ ১৮৫।
● সাভারকর, 'দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ৩৩৩।
● গোখলে, 'স্বতন্ত্রবীর সাভারকর', পৃঃ ১১৫-১৮।
● ধনঞ্জয় কীর, 'বীর সাভারকর', পৃঃ ৫৩৩-৩৪।
● গোড়বোলে; 'মালা উমজলেলে স্বতন্ত্রবীর সাভারকর' (মারাঠি), পৃঃ ১৬২-৬৭।
● 'সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব', পৃঃ ১৩৭।
● রীড এন্ড ফিশার; 'দ্য প্রাউডেস্ট ডে', পৃঃ ৭৮ এবং আর সি মজুমদার; 'হিস্ট্রি অফ দ্য ফ্রীডম মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া', পৃঃ ৪২৪-২৫।
● আম্বেদকর, 'পাকিস্তান', পৃঃ ১৪২।
● ট্রেনর; 'ওয়ান ড্যাম থিং আফটার অ্যানাদার', পৃঃ ৮৪।
● ইন্ডিয়ান রিভিউ, অগাস্ট ১৯৪১, পৃঃ ৩৭৩।
● সাভারকরের ১৯২৪ নাগাদ লেখা 'হিন্দুত্ব' বইটিতে এই তত্ত্বের বিশেষ ব্যাখ্যা রয়েছে।
● জোসেফ লেলিভেল্ড, 'গ্রেট সোলঃ মহাত্মা গান্ধী অ্যান্ড হিজ স্ট্রাগল উইথ ইন্ডিয়া' (২০১৫), পৃঃ ১৬১।