আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

লড়াই জারি আছে

হান্নান মোল্লা


কৃষকদের প্রত্যয় ও অধ্যবসায় দেখে সরকার ও শাসক দল ভীত। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভে সমবেত কৃষকের সংখ্যাও শাসকের পক্ষে ভয়ের আরও একটি কারণ যা, সরকার ও দেশের শাসক দলকেও দুর্বল করেছে। তারা (সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল) তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছে - অনৈতিক থেকে বেআইনি পদক্ষেপ - কিন্তু সবকিছুই ব্যর্থ হয়েছে। এখন যেহেতু উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন কয়েক মাসের মধ্যে হওয়ার কথা, এবং প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই রাজ্যে চারটি সফর করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্যই গোয়েন্দা শাখা থেকে খবর পেয়েছে যে উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল ভারতের বৃহত্তম রাজ্য হারানোর ঝুঁকি নিতে চায়নি।

কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি নয়, প্রধানমন্ত্রীর অহংকার এবং সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে প্রাণ হারানো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৭০০ জন নিহতের দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। সরকার আগে সাড়া দিলে এত মানুষকে শহীদ হতে হত না। যাই হোক, এটি কখনও না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হলেও ভালো প্রস্তাব এবং আমরা সরকারের ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।

আমরা কিন্তু স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যে সংসদে আইনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন প্রত্যাহার করা হবে না। এই সরকারকে বিশ্বাস করা যায় না। ২০১৫-য় বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে, তারা ২০১৩-র ভূমি অধিগ্রহণ আইনে যে সংশোধনীগুলি নিয়ে এসেছিল তা বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই সংশোধনী এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করা হয়নি৷ সবকিছু আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হোক। তারপর আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করব। ততক্ষণ পর্যন্ত স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

আমাদের মূল দুটি দাবি - কৃষি আইন বাতিল করে ভবিষ্যতের সংকট থেকে কৃষকদের বাঁচানো এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কৃষককে বিদ্যমান সংকট থেকে বাঁচানো। ১৯৯৩-৯৪ থেকে দেশে প্রায় ৪ লক্ষ কৃষক কৃষি সংকটের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। কৃষকদের আয় ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে এবং কৃষকরা বিশাল ঋণের মধ্যে আটকে পড়েছে। তাদের মধ্যে, ২০১৪-য় মোদি সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকে প্রায় ১ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি একটি MSP আইনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও তা উল্লেখ করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তারা কিছুই করেনি। এম এস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবিতে আমরা অবশ্যই আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। সেই আন্দোলনের রূপরেখা আমরা পরে স্থির করে নেব।

কিছু নির্দিষ্ট দাবিতে এই ধরনের দীর্ঘায়িত, গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুধু ভারতেই নয় সারা বিশ্বে নজিরবিহীন। বিশেষ করে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিপুল সংখ্যক অংশগ্রহণকারীদের বিষয়টি বিবেচনা করলে এর তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আন্দোলনের নেতৃত্বকে হেয় করার জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অগণিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। আমাদেরকে খালিস্তানি, পাকিস্তানি, চীনের কট্টর সমর্থক এবং মাওবাদী আর কত কী না বলা হয়েছে! স্বাধীনতা দিবসে তেরঙাকে অসম্মান করার মতো ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু আমরা তাদের সব মিথ্যা ফাঁস করতে পেরেছি, সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে পেরেছি এবং নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ থেকেছে।

সম্মিলিত নেতৃত্বের মধ্যে পার্থক্য অতীতে প্রায়ই গণআন্দোলনকে দুর্বল করেছে। অনেক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের নেতৃত্ব কিন্তু বরাবরই ঐক্যবদ্ধ ছিল। কারণ, প্রাথমিক প্রশ্নে আমাদের কোনো মতপার্থক্য ছিল না - দুটি দাবি, সেগুলি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প এবং অহিংস পদক্ষেপের দৃঢ়তা। প্রায় ৫০০টি বিভিন্ন সংগঠনকে একত্রিত করে রাখার ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল কোনো সংগঠনই কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারাতে রাজি নয়। সম্মিলিত নেতৃত্বের প্রত্যেকের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে কৃষকরা নড়াচড়া করার মেজাজে নেই। এবং যে বা যারা আন্দোলনকে দুর্বল করতে বা নেতৃত্বকে বিভক্ত করার চেষ্টা করতে চাইবে সে বা তারা কৃষকদের চোখে খলনায়কে পরিণত হবে। সেই ভয়ও সকলকে এক করে রেখেছে।

সবমিলিয়ে আইনসম্মত ভাবে তিন কৃষি আইন পুরোপুরি বাতিল করা, MSP-কে আইনী স্বীকৃতি দেওয়া, বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার, আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণ পৌঁছে দেওয়া, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রতিটি মামলা নিঃশর্ত ভাবে তুলে না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালু থাকবে।