আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

নাগরিক সমাজ এখন যুদ্ধক্ষেত্র?


বিভিন্ন কারণে কৃষক আন্দোলনের জয় ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। এই জয় আবারো প্রমাণ করে দিয়েছে যে ভারতের গণতন্ত্রের উপর তীব্র কুঠারাঘাত করা হলেও, দেশটি এখনও গণতান্ত্রিকতার নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য যদি দেশের জনগণ সচেতনভাবে সংবিধানের পথে গণআন্দোলনকে প্রবাহিত করে। যখন এক বৃহদাংশের মানুষ মনে করছেন যে, মোদী সরকার দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক রীতিনীতিকে তছনছ করে দিয়ে তাদের মর্জি মতন সরকার চালাবে এবং বিরোধী স্বরকে মাটিতে পিষে দেবে, সেই সময় কৃষক আন্দোলনের জয় সমস্ত গণ-আন্দোলনের মধ্যে টাটকা বাতাস বইয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, লড়াই করা এখনও সম্ভব, ক্ষমতার রক্তচক্ষুকে ক্ষমাপ্রার্থীতে রূপান্তরিত করা সংগঠিত মানুষের পক্ষে এখনও সম্ভব। তবু, ভুলে গেলে চলবে না যে মোদী এবং দেশের সরকার ক্রমাগত নাগরিকের আন্দোলনের অধিকার, কথা বলার অধিকারকে খর্ব করার দুরভিসন্ধিকে পাকাপোক্ত করতে সদা ব্যস্ত। এই প্রেক্ষিতে, বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করার দিন কয়েক আগে অজিত দোভাল মহাশয়ের একটি উক্তির দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

অজিত দোভাল দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ভারতের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা তিনি। অনেকে মনে করেন মোদী এবং অমিত শাহের পরে দেশের সর্বাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি তিনি। অতএব, তিনি কিছু বললে, তাঁর কথা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শোনা দরকার। ১২ নভেম্বর, হায়দ্রাবাদে সদ্য পাশ করা পুলিশ আধিকারিকদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নতুন পুলিশ অফিসারদের উপদেশ দিতে গিয়ে দোভাল সাহেব বলেন, “নাগরিক সমাজ বর্তমান সময়ের নতুন যুদ্ধের সীমানা (Frontier of war)। যুদ্ধ এখন আগের মতন কার্যকারী নয়। যুদ্ধ করতে খরচ অনেক এবং তার ফলও নিশ্চিত নয়। কিন্তু নাগরিক সমাজকে বিভাজিত করে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় স্বার্থের ক্ষতিসাধন করা সম্ভব”। এরপরে তিনি বলেন যে গণতন্ত্রের নির্যাস ব্যালট বাক্সে থাকে না, থাকে আইনে, যা প্রণয়ন করেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।

অর্থাৎ দোভাল সাহেবের মতে ভারতের নাগরিক সমাজ এখন যুদ্ধের একটি সীমানা। রাষ্ট্র তাই নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেই পারে। নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ, আন্দোলনকে যদি কোনো মতে দেশহিতের বিরুদ্ধে বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তাদের উপর নিপীড়ন নামিয়ে আনাও দেশের স্বার্থের পক্ষেই থাকে। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে যে মোদী সরকার বিগত সাত বছর ধরে প্রত্যেকটি গণ-আন্দোলনকে এই ফর্মুলা মেনেই ভাঙার চেষ্টা করেছে। প্রথমে, আন্দোলনকারীদের পাকিস্তানের চর বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই অজুহাতে জনগণের একটি অংশকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা হয়েছে। সেই আক্রোশের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র নিপীড়ন চালিয়েছে আন্দোলনকারীদের উপর। দিল্লীর সিএএ বিরোধী আন্দোলন, জেএনইউ-জামিয়া-আলিগড়ের ছাত্র আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের দেশবিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে তাদের উপর নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়েছে। দোভাল নতুন পুলিশ অফিসারদের বলতে চাইছেন যে এটিই এখন থেকে সরকারী নীতি। নাগরিক সমাজকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ভাবতে শেখো। তোমার সহ-নাগরিক যে সরকারের সঙ্গে কোনো একটি বিষয়ে একমত নয়, সে আসলে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধ করছে বলেই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ফোনে বেআইনিভাবে আড়ি পাতাই হয়ে যাবে দেশসেবা, যেমনটা পেগাসাস কাণ্ডে হয়েছে বলে অভিযোগ। এই পুলিশ অফিসার-রা দোভাল সাহেবের কথাকে মান্যতা দেবেন এটাই স্বাভাবিক, আর এই নতুন স্বাভাবিকতার বলি হবে আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধান।

সংবিধান প্রত্যেক মানুষকে প্রতিবাদ করার অধিকার দিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল কথাই হল জনগণই রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক। কিন্তু দোভাল বলছেন তা নয়। নিয়ন্ত্রক হল আইন এবং আইন প্রণেতারা। অর্থাৎ সংসদে একবার যদি একটি আইন পাশ হয়ে যায়, তবে তার বিরুদ্ধ লড়াই করলে দোভাল সাহেবদের রাগ হবে। তারা মনে করেন তারা এই দেশের রাজা, আমরা হলাম প্রজা। ওনারা যা বলবেন তা মেনে চলাই আমাদের প্রধান কর্তব্য।

বিষয়টি শুধুমাত্র দোভালের মতন আমলারা কী বলছেন তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দোভাল মৌলিকভাবে নরেন্দ্র মোদীর মাইনে করা পরামর্শদাতা। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী বহুবার এই কথা বুঝিয়েছেন যে, দেশের মানুষের আন্দোলন আসলে দেশের স্বার্থবিরোধী একটি ষড়যন্ত্র। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি আন্দোলনকারীদের ব্যঙ্গ করে 'আন্দোলনজীবী' বলেছেন। সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মানুষদের পোশাক দেখে তাদের চেনার কথা বলেছেন। কয়েক দিন আগে তিনি বলেছেন যে ভারতে লোকে অধিকারের কথা অনেক বলে কিন্তু কর্তব্যের কথা কেউ বলে না। অর্থাৎ অধিকার গৌণ, দেশের প্রতি কর্তব্যই মুখ্য।

মোদী-শাহ-দোভালের এই ভাবধারার নেপথ্যে যে কারণটি রয়েছে তা চিনতে ভুল হওয়া উচিত নয়। ভারতের সংবিধানের জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তার বিরোধিতা করে এসেছে। সবার ভোটাধিকার, সবার কথা বলার অধিকার, সবার প্রতিবাদ করার অধিকার, মুক্তি, সাম্য, মৈত্রী - সংবিধানে বর্ণিত এই কথাগুলির সঙ্গে আরএসএস-এর মতাদর্শের মৌলিক বিরোধ রয়েছে। সেই বিরোধিতা করে কল্কে পাওয়া যাবে না, এই কথা তারা আগেই উপলব্ধি করেছিল। তাই প্রকাশ্যে তারা সংবিধানের বিরোধিতা করার সাহস দেখায় না। কিন্তু তাদের মজ্জায় মজ্জায় যেই হিংস্র মৌলবাদী চিন্তাধারা আসলে বাসা বেঁধে আছে, সেখানে সংবিধানের এই অধিকারগুলিকে তারা মান্যতা দেয় না। এখন এই ভাবাদর্শ দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে রেখেছে। অতএব, খুব সন্তর্পণে তারা সংবিধানকে পরিবর্তন করতে চাইছে এবং সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করতে চাইছে। তাদের এই নতুন ভারতের কল্পনায় নতুন পুলিশ অফিসারদের দীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই দোভাল তাঁর কথাগুলি বলেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে দেশের বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ভূমিকা কী? তারাও কি চায় দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হোক? বিশ্বাস করতে মন চাইলেও তথ্য সেই কথা বলছে না। প্রত্যেকটি বিরোধী দল, তারা যখন ক্ষমতায় থেকেছে, রাজ্যে বা কেন্দ্রে, তারাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রয়োগ থাকলে দেশে এক শ্রেণি এবং বর্ণের মানুষের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একচেটিয়া আধিপত্য বন্ধ হত। কোনো রাজনৈতিক দল তা চায়নি। অতএব, নিজেদের দলীয় এবং শ্রেণি তথা বর্ণের স্বার্থে তারা গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছে। আজ বিজেপি এই সংকোচনের সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করছে। গণতন্ত্রের এই সংকোচনকে উলটে দিতে পারে একমাত্র সাধারণ মানুষের সংগঠিত আন্দোলন। আবারো তাই কুর্নিশ জানাতে হয় কৃষক আন্দোলনকে। কোনো দল নয়, কোনো রাজনৈতিক নেতা নয়, শুধুমাত্র নিজেদের বিশ্বাস এবং সংগঠনের জোরে মোদীকে হারিয়েছেন কৃষকরা। আমাদের স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করেছেন, মোদী-শাহ-দোভাল নয়, আমাদের দেশে শেষ কথা বলবে জনগণ।