আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

পরিবেশ ও দেউচা-পাচামি


দেউচা-পাচামি আগামী দিনের সিঙ্গুর হতে যাচ্ছে কী না সেটা রাজনৈতিক দরকষাকষি ও লাভক্ষতির ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তার বাইরেও একটা বৃহত্তর রাজনীতি আছে, তা হল পরিবেশের রাজনীতি। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি সমগ্র অঞ্চলে বাস্তুতন্ত্র কীভাবে বিপন্ন করবে, সত্যিই এখনো শক্তির এই প্রচলিত উৎসগুলোকেই বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করতে হবে না কি বিকল্প সমাধানের রাস্তায় যেতে হবে, এই কয়লাখনি আগামী পঞ্চাশ বছরে সমগ্র অঞ্চলের পরিবেশ, জনজীবন ও অর্থনীতিকে সত্যিই উন্নত করবে কী না, এই প্রশ্নগুলো ভীষণ জরুরী। দুঃখের ব্যাপার, কর্মসংস্থান ও ভারী শিল্পের আশাতে গদগদ হয়ে কেউই এই প্রশ্নগুলো তুলছেন না। এমনকী যে নক্সালপন্থী ও মানবাধিকারকর্মীরা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে রাজ্য কাঁপিয়ে তুলেছিলেন, তাঁরাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তামাক খেতে ব্যস্ত। বীরভূমের কয়েকজন আদিবাসী নেতা, যাঁরা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছিলেন, রাতারাতি ভোল পালটে বলতে শুরু করেছেন যে তাঁরা শিল্পের পক্ষে। সম্ভবত দু'জন তৃণমূলে যোগও দিয়েছেন। টাকার মহিমা সর্বত্রগামী, এ কথা অনস্বীকার্য, কিন্তু সব গাছ কাটা হয়ে যাবার পর এবং শেষ মাছটা জালে পড়বার পর যে টাকা চিবিয়ে খাওয়া যাবে না, সেকথা বাংলার এক গায়ক অনেক আগেই বলে গিয়েছেন। তাই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো সামনে রাখতে হচ্ছে।

প্রথমত, ভারী শিল্পের ফলে বিপুল কর্মসংস্থান হবে, এ কথা এমনকি উন্নত দেশের পুঁজিবাদীরাও আজকাল বলে না। অটোমেশনের ফলে ভারী শিল্প, ম্যানুফ্যাকচারিং ইত্যাদির কর্মসংস্থানের জায়গা ছোট হয়ে গেছে, এবং আমেরিকার গ্রিন পার্টি হোক অথবা নরওয়ের সোশাল ডেমোক্র্যাটরা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ডেমোক্র্যাট এবং ব্রিটেনের লেবার পার্টিও তাদের ইস্তাহারে স্বীকার করে নিয়েছে যে ভারী শিল্পে কর্মসংস্থানের বদলে শ্রমনিবিড় শিল্পের অন্যান্য সংজ্ঞা খুঁজতে হবে। বলা যেতেই পারে যে ইউরোপের অভিজ্ঞতা ভিন্ন, ভারত সেই রাস্তায় হাঁটবে কেন? যাঁরা এই প্রশ্ন তুলবেন তাঁদের সারল্যকে কুর্ণীশ জানিয়ে বলার, ভারী শিল্পের থেকে কর্মসংস্থানও একটি ইউরোপীয় আইডিয়া হিসেবেই এসেছিল, ভারতবর্ষের নিজস্ব শিল্পপদ্ধতি অন্য ছিল। কাজেই, সেই ধারণা যদি পশ্চিম থেকে নেওয়া হয়, আজ সেই পশ্চিমই যখন ধারণাটিকে বাতিল করছে, তখন সেটাকে নেওয়া হবে না কেন? নিজের সুবিধেমত গ্রহণ-বর্জন করা হবে, যাতে ভোট আসে এবং সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবি, অভিনেতা ইত্যাদিরা এই প্রকল্পের থেকে টাকা খেতে পারেন? এমনকি তথ্যও দেখাচ্ছে যে এক লক্ষের কর্মসংস্থান একটি মিথ্যে প্রচার। কয়লাখনি সাধারণত দুই প্রকার, আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং এবং খোলামুখ খনি। দেউচা-পাচামি একটি খোলামুখ খনি। এই ধরনের খনির উৎপাদন খরচ এতই বেশি যে অটোমেশন না করলে এরা লাভের মুখ দেখে না। তাই খোলামুখ খনি মানে সারা পৃথিবীতেই অটোমেশনের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন হয়। মানে, এর উৎপাদন, মেশিন নির্ভর। এটি মানুষের সংখ্যা, কর্মসংস্থান কম করার জন্যই করা হয়। এখানে দক্ষ শ্রমিক লাগে। অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা নগণ্য। তাই লক্ষ লক্ষ দক্ষ শ্রমিকের কাজের কথা বলা প্রতারণা ছাড়া কিছুই না।

তাহলে কি সিঙ্গুরও ভুল ছিল? অবশ্যই ছিল, এবং বেশিদূর যাবার দরকার নেই, সিপিআই(এম) তাদের রাজনৈতিক প্রতিবেদনেই এই ভুল স্বীকার করে নিয়েছে। তাও তো সিঙ্গুরে অনুসারী শিল্পের ফলে কর্মসংস্থানের কিছু সুযোগ ছিল। কিন্তু কয়লা শিল্পের উৎপাদন এলাকায় কয়লা নিয়ে অনুসারী শিল্প হয় না। আর দেউচা-পাচামির কয়লার যে প্রকার, তা ছোট শিল্পে কাজেও লাগবে না। ফলত অনুসারী শিল্প দিয়েও কর্মসংস্থান সম্ভব নয়, যদি না চায়ের দোকান বা রিয়াল এস্টেটের বাড়বাড়ন্তকে ধরা হয়। ধ্রুপদী বামপন্থীদের সমস্যাটা বোঝা যায়, কমিউনিস্ট ইস্তাহারের ছাত্র হিসেবেই তাঁরা ভারী শিল্প, শ্রমিকের সন্নিবেশ ইত্যাদির পক্ষে। কিন্তু তার পরেও পৃথিবী একশো সত্তর বছর এগিয়ে গেছে এবং এগুলো নিয়ে মার্ক্সবাদীদের মধ্যেও প্রভূত বিতর্ক চলেছে বহুদিন। মার্ক্সবাদ যে আসলে পরিবেশবান্ধব একটি তত্বায়ণ সেই বিষয়েও লেখালেখি হচ্ছে। কাজেই ভারী শিল্পের বিরোধিতা, বিশেষত কয়লাখনির মত একটি বাস্তুতন্ত্র বিপন্নকারী প্রকল্প, সেটা দেখলে কার্ল মার্ক্স হয়ত খুশিই হতেন, যদি বেঁচে থাকতেন।

এ তো গেল তত্বের জায়গা। এরপর কিছু তথ্যে আসা যাক। খনি অঞ্চলে ৩০১০টি ভিটে, যার মধ্যে ১০১৩টি আদিবাসী পরিবারের। খনি অঞ্চলে মোট বনভূমি ৩০৭ একর। তাঁদের অনেকেই জায়গা ছাড়তে চাইছেন না। দ্বিতীয়ত, পর্তুগাল এই নভেম্বর মাসেই তাদের শেষ কয়লার আগুনে চলা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজেরা সময়সীমা রেখেছিল ২০৩০, তার নয় বছর আগে কাজ সম্পন্ন করল। ফসিল ফুয়েল সম্পর্কে এই অবস্থান রেখেছে নরওয়ে ও জার্মানির সরকারও। ওরা পারে, এবং তারপরেও ওরা শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশ - কিন্তু আমাদের সেই প্রচলিত শক্তির উৎস নিয়েই গুণগান গাইতে হয়।

তৃতীয়ত, সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সারা পৃথিবী জুড়ে ৬১টি মেগাসিটির মধ্যে কলকাতায় কয়লার আগুণ থেকে দূষণের ফলে অকালমৃত্যুর সংখ্যা সবথেকে বেশি। প্রতিবেদন বানিয়েছে সি৪০ নামে একটি সংস্থা, যারা পৃথিবীর সমস্ত মেগাসিটিগুলোর জীবনযাত্রার মান নিয়ে কাজ করে। কলকাতায় বায়ুদূষণের পরিমাণ 'হু' নির্দেশিত সর্বোচ্চ সীমার সাতগুণ, এবং দেউচা-পাচামি জাতীয় খনি সেই পরিমাণ আরও বাড়াবে। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে অকালমৃত্যুর সংখ্যা ৩১,০০০ ছোঁবে, যদি এইভাবে নির্বিচারে কয়লা উত্তোলন হয়। সংখ্যাটা বিজেপি ও তৃণমূলের রাজনৈতিক উচ্চাশার কাছে যদিও কিছুই নয়। প্রসঙ্গত, আসন্ন কর্পোরেশন নির্বাচনে বামফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে পরিবেশকে মূল ইস্যু করেছে - নির্বিচারে গাছ কাটা, অবৈধ নির্মাণের ফলে জলতল নেমে যাওয়া, মাটি বসে যাওয়া, যথেচ্ছ বায়ুদূষণ, এই সমস্তকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রধান অ্যাজেন্ডা বানিয়েছে একটা বামপন্থী জোট, এটা যেমন আশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনই এই খনির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনের দাবীটাও সেই বামপন্থীদের কাছেই থাকল।

সদ্য সমাপ্ত গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে কয়লার প্রয়োগ ক্রমাগত কমানো হবে বলে আন্তর্জাতিক স্তরে চুক্তি হয়েছে। কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি পৃথিবীর জলবায়ুকে বিষাক্ত করে তুলেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলি, যেমন ভারত ও চীন, তারা মাথাপিছু হারে কার্বন নির্গমনের হিসেবে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির থেকে অনেক পিছিয়ে। এই অজুহাতে অনেক বামপন্থীও মনে করেন যে কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি আরো ব্যবহার করার অধিকার ভারতের মতন দেশের রয়েছে। তত্ত্বটি ভ্রান্ত। জলবায়ু, উন্নত পুঁজিবাদী এবং উন্নয়নশীল পুঁজিবাদী দেশের জন্য একটিই রয়েছে, আলাদা নয়। অতএব, দূষণের মাধ্যমে তাকে যেই বিষাক্ত করুক, ক্ষতি আসলে সবার। তাই তোমরা কয়লা পুড়িয়ে উন্নত হয়েছ, অতএব আমরাও তা করব, কথাটি ইতিহাসকে উনিশ শতকের ধারণাতেই আটকে রাখে। একবিংশ শতকের দাবি হওয়া উচিত নতুন, নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রচলন বাড়িয়ে পরিষ্কার পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন সাধন করা। যারা দেউচা-পাচামিতে উন্নয়ন খুঁজছেন তাঁরা আসলে রয়েছেন দুই-শ বছর আগের পৃথিবীতে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশকে বাধ্য করতে হবে গরীব দেশগুলিকে পর্যাপ্ত অর্থ ও প্রযুক্তি দিতে যাতে তারা জীবাশ্ম নির্ভর জ্বালানির পরিবর্তে নতুন শক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারে।

আগামীদিনের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হবে পরিবেশ ইস্যু, এই ভবিষ্যদ্বানী আমাদের সম্পাদকীয় করছে এখন থেকেই। শ্রেণি রাজনীতি হোক, ধর্মের রাজনীতি হোক, কাটমানি ও চালচুরির রাজনীতিই হোক, মানুষ মরে গেলে মঙ্গলগ্রহে গিয়ে যে কোনও রাজনীতিই হবে না, এই কথাটা সমস্ত দলেরও মাথায় রাখা উচিত।