আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

এখানে থেমো না


সকাল সকাল আচমকা তিনি টিভির পর্দায় উপস্থিত। এহেন আকস্মিক উপস্থিতির অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। দেশের মানুষ রীতিমতো চিন্তিত। অথবা বিস্মিত। কিংবা আতঙ্কিত। ভয়ে ভয়ে সকলেই টিভির পর্দায় চোখ রাখলেন। না জানি আবার কোন বিপজ্জনক ঘোষণা উচ্চারিত হয়।

শুরুটা একেবারেই অন্যরকম। গুরু নানকের জন্মদিন উপলক্ষে তিনি দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানালেন। গুরু নানকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বেশ কিছু ভালো ভালো কথা বললেন। টিভির পর্দার এপাশে বসে থাকা দর্শক/শ্রোতা তখনও শঙ্কামুক্ত নয়। সকলের কপালে ভাঁজ। এবার কি নতুন কায়দায় নতুন কোনো ভয়ঙ্কর ঘোষণা হতে চলেছে?

টিভির পর্দাকে নাটকের মঞ্চ বিবেচনা করে তিনি অভিনেতা সুলভ সংলাপ প্রয়োগ করে যা বললেন তার নির্যাস এইরকম -
• গুরু নানকের আবির্ভাব দিবসে সবাইকে অভিনন্দন।
• দেড় বছর পর খুলে গিয়েছে কর্তারপুর করিডর।
• আমাদের সরকার সেবা ভাবনায় চলে।
• কৃষকদের অসুবিধাকে কাছ থেকে দেখেছি।
• কৃষক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।
• দেশের বেশিরভাগ কৃষক ক্ষুদ্র কৃষক।
• ছোটো মাপের জমিতে এইসব কৃষকদের জীবন আটকে আছে।
• প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই জমি উত্তরাধিকার সূত্রে আরও ছোটো হয়েছে।
• বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
• আজ কেন্দ্রের কৃষি বাজেট আগের তুলনায় পাঁচ গুণ বেড়েছে।
• সওয়া লক্ষ কোটি টাকা কৃষি খাতে খরচ করা হচ্ছে।
• কৃষকদের জন্য নেওয়া হচ্ছে একের পর এক পদক্ষেপ।
• কৃষকদের ভালোর জন্যই আনা হয়েছে ৩ কৃষি আইন।
• সংসদে আলোচনার পরেই কৃষি আইন আনা হয়েছে।
• ৩ আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেক কৃষক সংগঠনই।
• এই আইন আনার পিছনে সত্‍ উদ্দেশ্য ছিল।
• কয়েকজন কৃষককে আমার বোঝাতে পারিনি।
• আমরা কৃষকদের কথা বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।
• ২ বছর আইন প্রয়োগ বন্ধ রেখেছি।
• ৩ কৃষি আইনকে প্রত্যাহার করছি।

গুরুপরব শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের আবির্ভাব দিবস। শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ দিন। সেই উপলক্ষে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কর্তারপুর করিডর ১৭ই নভেম্বর খুলে দেওয়া হয়েছে। এই কর্তারপুর করিডর দিয়েই পাকিস্তানের দরবার সাহিবে যেতে হয়। শিখ সম্প্রদায় যেন তাদের উৎসবে অংশ নিতে পারেন সেজন্য গুরুপরবের দু'দিন আগে এই করিডর খোলার মধ্যে নতুনত্ব নেই। এটা বহুদিন ধরেই প্রচলিত।

যথারীতি ধর্মীয় ভাবাবেগকে সম্বল করে ভাষণের সূচনা। তারপর পরতে পরতে অসংখ্য অসত্য তথ্য জড়িয়ে রচিত ভাষণের শেষ পর্বে এসে অবশেষে ঘড়ি ধরে পাক্কা তেইশ মিনিট পর তাঁর কন্ঠ থেকে নিঃসৃত হল এক অন্য স্বর। একেবারে অন্য সুর। তিনি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আশ্বাস দিলেন যে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।

৫ই জুন, ২০২০ অধ্যাদেশ জারি করে কৃষি আইনের সূচনা। ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সংসদে সংখ্যাধিক্যের দাপটে বিনা আলোচনায় প্রায় জবরদস্তি করে অধ্যাদেশ আইনে রূপান্তরিত হয়। অধ্যাদেশ জারির সঙ্গে সঙ্গেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে শুরু হয়েছিল ছোটো ছোটো বিক্ষোভ সমাবেশ, প্রতিবাদ মিছিল। প্রায় দু' মাস ধরে নিজেদের সংগঠিত করে কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ২০২০-র ২৬শে নভেম্বর শুরু হয় দিল্লি অভিযান। ততদিনে পাঁচশোরও বেশি বিভিন্ন কৃষক সংগঠন মিলিত হয়ে গড়ে উঠেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আহ্বানে হাজারে হাজারে কৃষক দিল্লির সীমান্তে উপস্থিত হলে প্রশাসন পথ অবরোধ করে। যুদ্ধের সময় যে ধরনের ব্যারিকেড বানানো হয় ঠিক সেইরকম অথবা তার থেকেও কঠিন সেই ব্যারিকেডের পাশেই শুরু হয় শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন। আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে এমন শপথ নিয়ে শীতের ঠান্ডার তীব্রতা, গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার যন্ত্রণা সহ্য করে চলতে থাকে অবস্থান আন্দোলন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অবিচল। দিল্লি হরিয়ানা সীমান্তের টিকরি ও সিঙ্ঘু, এবং দিল্লি উত্তরপ্রদেশের সীমানায় গাজিপুর সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকদের প্রতীতি এত দৃঢ় যে কোনো ভাবেই তাঁদের প্ররোচিত করা যায়নি। খালিস্তানি, পাকিস্তানি, চিনের দালাল, মাওবাদী আর কত কী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কৃষক ধীর-স্থির। কিন্তু লক্ষ্যে কোনও ভ্রান্তি নেই। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তাঁদের সাতশোর বেশি সাথীর মৃত্যু হয়েছে। সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

সেই আবহে ২০২১-এর ২৬শে নভেম্বর আন্দোলনের বর্ষপূর্তির আয়োজন চলছিল। সংগঠনকে আরও সংহত করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষককে সঙ্ঘবদ্ধ করে আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা যখন ব্যস্ত তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে টিভির পর্দায় ঘোষণা করা হয় যে তিনটি আইনই প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।

টিভির ভাষণ শুনে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্ব প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন যে এই ঘোষণা আংশিক জয়; এদের বিশ্বাস নেই; সংসদে যে আইন পাস হয়েছে সেটা সংসদ থেকেই বাতিল করতে হবে। তত দিন আন্দোলন চলবে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা স্থির করে যে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরুর দিনে অন্তত পাঁচশো ট্র্যাক্টর নিয়ে সংসদ ভবনের সামনে কৃষকরা উপস্থিত হবেন। যতদিন না সংসদে আইন প্রত্যাহার করা হবে ততদিন পর্যন্ত প্রতিদিন ট্র্যাক্টর অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে।

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার দৃঢ়তা দেখে সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়ে। তড়িঘড়ি মন্ত্রিসভার বৈঠকে কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং জানিয়ে দেওয়া হয় যে শীতকালীন অধিবেশনের সূচনা লগ্নেই এই আইন প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হবে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ যথেষ্ট সৌজন্য ও শিষ্টাচার দেখিয়ে ২৯শের 'ট্র্যাক্টর অভিযান' স্থগিত রাখেন। এবং ২৯শে নভেম্বর, ২০২১ সংসদের উভয় কক্ষেই আইনগুলি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংসদের অতি সক্রিয়তায় আবার বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আইন পাশ করানোর সময় যেমন কোনো আলোচনা বিতর্কের অবকাশ ছিল না আইন প্রত্যাহারের সময় সেই একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। লোকসভায় মাত্র চার মিনিটের মধ্যে আইন প্রত্যাহারের প্রস্তাব ধ্বনি ভোটে গৃহীত হয়েছে। রাজ্যসভায় সময় লেগেছে মাত্র দুই মিনিট। কোনও আলোচনা বা বিতর্কের বালাই নেই। আইন পাশ করানোর সময় কোনও বিতর্কের ধার ধারেনি সরকার। আবার চাপের মুখে আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হওয়ার সময়ও সরকারি দল বিতর্ক পরিহার করেছে।

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার বাদবাকি দাবিগুলোর কী হবে? কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি-কে আইনসিদ্ধ করার বিষয়ে সরকার নীরব। আন্দোলনের সময় যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তা কবে এবং কীভাবে তুলে নেওয়া হবে সে বিষয়ে সরকারের কোনো মন্তব্য নেই। যাঁরা শহীদ হলেন তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণ পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারেও সরকারের কোনো নির্দিষ্ট মতামত পাওয়া যায়নি। সর্বোপরি প্রস্তাবিত নতুন বিদ্যুৎ বিল সংসদে পেশ না করার জন্য কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। এইসব দাবিদাওয়ার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ।

আইন প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সরকারের অতি সক্রিয়তায় সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ সিঁদুরে মেঘ দেখতে পাচ্ছেন। ২০১৪-য় ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকেই এই সরকারের প্রতিশ্রুতি আশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে সমগ্র দেশবাসীরমতো কৃষকরাও বীতশ্রদ্ধ। আশ্বাসে বিশ্বাস নেই। তড়িঘড়ি কৃষি আইন প্রত্যাহারের জন্য যে বিল সংসদে পেশ করা হয় তার বয়ানেও সেই চালিয়াতি আবারও ধরা পড়েছে।

সংসদে কোনও বিল পেশ হলে সেই বিলের লক্ষ্য কী, কেন তা আনা হচ্ছে, তা বিলের ‘উদ্দেশ্য ও কারণ’ অংশে ব্যাখ্যা করা থাকে। সংসদে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের জন্য যে বিল পেশ করা হয়েছে, তার সিংহ ভাগ জুড়ে কৃষি আইনের উপকারিতাই বোঝানো রয়েছে। সরকার ফের দাবি করেছে, কৃষকদের উন্নতি, বিশেষ করে ছোটো ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্যই তিন কৃষি আইন আনা হয়েছিল।

তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার কেন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করছে? বিলে সরকার বলছে, কৃষকদের একটা ছোটো গোষ্ঠী কৃষি আইনের বিরোধিতা করছে। সরকার কৃষকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে। উপকারিতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। দেশে স্বাধীনতার ৭৫-তম বর্ষ উদ্‌যাপনের সময়ে বৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলা প্রয়োজন।

স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকারের তরফে আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনাও করা হয়েছে। তারপরেও এখন আবার কৃষি আইনের উপকারিতার গুণকীর্তন করা হচ্ছে কেন? উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে আপাতত পিছিয়ে গিয়ে পরে আবার কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে আইন ফেরানোর কথা কি ভাবা হচ্ছে? সেইজন্যই কি কোনো আলোচনা বিতর্ক ছাড়াই হৈহৈ করে কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে?

প্রশ্ন থেকেই যায়। দেশের কৃষক আর কোনো অশ্বাসবাণী শুনতে রাজি নন। কাজেই লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।