আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

নোবেল পুরস্কার ও পরিবেশ সংকট

সাম্যদেব ভট্টাচার্য্য


২০২১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন জন গবেষক; সিকুরো মানাবে, ক্লাউস হাসেলম্যান এবং জর্জিও পারিসি। পদার্থবিদ্যায় প্রতি বছরই কিছু মানুষ তাদের প্রভাবশালী মৌলিক গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু চলতি বছরের এই পুরস্কারটির গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক, আর মূলত সেই কারণেই এই লেখার অবতারণা। চলতি বছরে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে এমন তিন জন গবেষককে, যাদের গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন।তিন জন পুরস্কার প্রাপকের মধ্যে সিকুরো মানাবে এবং ক্লাউস হাসেলম্যানের মৌলিক অবদান হল পৃথিবীর জলবায়ু এবং তার ওপর মানবসভ্যতার প্রভাব সংক্রান্ত তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা। অপরদিকে জর্জিও পেরেসির বৈপ্লবিক অবদান হল সেই কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে বিষয়টিকে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করা। এক কথায় বলা যেতে পারে যে এই তিন গবেষক মিলে বর্তমান পরিবেশ বিষয়ক পদার্থবিদ্যার মৌলিক কাঠামোটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

পৃথিবীর জলবায়ু তত্ত্বের মূল ভিত্তিটি নির্ভর করে জটিল ব্যবস্থা (complex systems)-এর তাত্ত্বিক পৃষ্ঠভূমির ওপর। মানাবে দেখিয়েছিলেন কীভাবে পরিবেশে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সাথে পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতাবৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ষাটের দশকে মানাবে, আজকের পরিবেশবিদ্যার তাত্ত্বিক কাঠামো গঠনের গবেষণাকে নেতৃত্ব দেন। তিনি সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি, যিনি বিকিরণ ভারসাম্য (radiation balance) এবং বায়ুভরের উল্লম্ব পরিবহনের (vertical transport of air mass) মধ্যেকার সম্পর্ক আবিষ্কার করেছিলেন। মানাবের মৌলিক গবেষণা কার্যত আধুনিক পরিবেশবিদ্যার তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর এক দশকের মধ্যে হাসেলম্যান একটি তাত্ত্বিক মডেল দেন, আবহাওয়া এবং জলবায়ুর মধ্যেকার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে, যা কার্যত আবহাওয়ার ঘন ঘন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার থেকে স্বাধীনভাবে জলবায়ুতত্ত্ব-এর মডেলগুলির নির্ভরযোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। সাথে সাথে তিনি কিছু তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন, যার সাহায্যে জলবায়ুর ওপর বেশ কিছু প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট প্রভাবকে চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয়। এরপর আশির দশকে পারিসি অবিন্যস্ত জটিল বস্তুসমূহ (disordered complex materials)-এর মধ্যেকার লুকনো নকশা (hidden pattern) খুঁজে বার করেন। কমপ্লেক্স সিস্টেমের তাত্ত্বিক গবেষণা জগতে পারিসির কাজ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অনুসন্ধানগুলির মধ্যে অন্যতম। তাঁর এই কাজের পরিধি এতটাই বিশাল যে, পদার্থবিদ্যার গণ্ডি ছাড়িয়ে এর কার্যকারিতা আজ গণিতশাস্ত্র, জীববিদ্যা, নিউরোসায়েন্স, মেশিন লার্নিং-এর গবেষণায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

চলতি বছরে নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত এটাই জানান দিচ্ছে যে জলবায়ু বিজ্ঞানকে আমাদের গবেষকরা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের কঠোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথেষ্ট শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। জলবায়ু সঙ্কট, বিশেষত বিশ্ব উষ্ণায়ণের মাত্রা বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে মানবসভ্যতাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সেখানে এটি অন্তত একটু হলেও স্বস্তির বিষয় যে, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উপাদান আমাদের কাছে আছে। এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় স্তরে মূল্যবোধহীন মুনাফার নেশাকে সরিয়ে রেখে মানব সভ্যতার অগ্রগতিকে যথার্থরূপে পরিবেশ-বান্ধব করে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার। এই লেখার অবশিষ্ট অংশে আমরা এই তিন বিশিষ্ট গবেষকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি একটু সহজ ভাষায় বোঝবার চেষ্টা করবো।

পদার্থবিদ্যা বলে যে কোনো ধরণের ভৌতিক জটিল ব্যবস্থা (complex physical system) গঠিত হয় তার মধ্যেকার বহু ছোট ছোট অংশ বা উপ-ব্যবস্থা (sub-systems) এবং তাদের মধেকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার (interactions) দ্বারা। এই ধরণের জটিল ভৌতিক ব্যবস্থা (complex physical systems) নিয়ে পদার্থবিদরা কয়েক শতক ধরে গবেষণা করে চলেছেন। এদের মধ্যে কিছু ব্যবস্থা - যেমন আবহাওয়া, অত্যন্ত বিশৃঙ্খল (chaotic)। অর্থাৎ এই ধরনের ব্যবস্থায় প্রাথমিক শর্তের (initial conditions) সামান্য হেরফেরের জন্য পরবর্তীকালে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যায়। তাত্ত্বিকভাবে এই ধরণের ব্যবস্থাগুলির গাণিতিক মডেল দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। এই বছরের নোবেলজয়ী পদার্থবিদরা ঠিক এই কাজটাই করেছেন, যা জটিল ব্যবস্থা, বিশেষত জলবায়ু ও পরিবেশ গবেষণায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।

পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভূমিকা

আজ থেকে প্রায় দু'শো বছর আগে ফরাসি পদার্থবিদ জোসেফ ফুরিয়ার প্রথম সূর্য থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠে বিকীর্ণ তাপের এবং পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে পরিবেশে বিকীর্ণ তাপের মধ্যেকার শক্তির অনুপাত নিয়ে কার্যকারী গবেষণা করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই অনুপাত নিয়ন্ত্রণে পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিকীর্ণ তাপ বায়ুমণ্ডল শোষণ করে এবং ফলত পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিকীর্ণ তাপকে এভাবে বায়ুমণ্ডলের মধ্যে ধরে রাখার এই প্রক্রিয়াকে বলে 'গ্রিনহাউস এফেক্ট'। এক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট গ্যাস এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে, যার মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ও জলীয় বাষ্প অন্যতম। এই গ্যাসগুলি অন্য উপাদানের তুলনায় পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে নিষ্কৃত তাপ বেশী পরিমাণে প্রথমে শোষণ করে এবং পরবর্তীতে সেই শোষিত তাপ ছেড়ে দিয়ে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

বস্তুত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ খুবই কম। যেমন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, বায়ুমণ্ডলে যার পরিমাণ মোটের ওপর ০.০৪ শতাংশ। সবথেকে শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস হল জলীয় বাষ্প, কিন্তু বাতাসে তার পরিমাণের ওপর আমাদের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অপরদিকে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা হ্রাস পেলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ায়, যা ঘুরিয়ে তাপমাত্রা আরও কমাতে সাহায্য করে। তেমনি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা ঘুরিয়ে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে।

কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাতাসে বৃদ্ধি পেলে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়বে, যা আবার বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে এবং তার ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই বোঝাই যাচ্ছে যে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে পরিবেশের তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য ঘটানো যায়। এ'বিষয়ে নোবেলজয়ী সুইডিশ গবেষক স্তিফান আরহেনিয়াসের কথা উল্লেখযোগ্য। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আরহেনিয়াস তার বিখ্যাত বিকিরণ তত্ত্বটি (Stephan’s Law) আবিষ্কার করেন, যা বলে যে কোনো বস্তু দ্বারা বহির্মুখী বিকিরণ, বস্তুটির পরম উষ্ণতার (T) চতুর্থ ঘাতের (T^4) সাথে সমানুপাতিক। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে সূর্য থেকে, যার পৃষ্ঠ তাপমাত্রা ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সমান, বিকিরিত রশ্মি যা পৃথিবীতে আসে তা মূলত visible range (বে নি ও স হ ক লা)-এর হয়। অপরদিকে পৃথিবী, যার পৃষ্ঠ তাপমাত্রা মাত্র ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেই তাপ গ্রহণ করে ইনফ্রারেড রশ্মি হিসেবে বিকিরণ করে। বায়ুমণ্ডল যদি এই তাপ শোষণ না করতো, তাহলে পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতা হত -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। আরহেনিয়াস এটিও অনুমান করেন যে শেষ বরফ যুগে (ice age) বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিলো, যার ফলে তাপমাত্রার এই বিশাল তারতম্য ঘটেছিল। সাথে সাথে তিনি এটিও অনুমান করেন যে এই পরিমাণ যদি তৎকালীন সময়ের দ্বিগুণ হয়, তবে পরিবেশের তাপমাত্রা প্রায় ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে।

সিকুর মানাবের গবেষণা

মানাবের গবেষণারও মূল উদ্দেশ্য ছিল আরহেনিয়াসের মতো, বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কীভাবে পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর প্রভাব ফেলছে, সেই প্রক্রিয়ার গভীরতর বিশ্লেষণ করা। কিন্তু এবিষয়ে তিনি আরহেনিয়াসের থেকে ভিন্ন পথ গ্রহণ করেন। ৬০-এর দশকে মানাবে পরিচলন (convection) প্রক্রিয়ার দ্বারা বায়ু ভরের উল্লম্ব পরিবহনের (vertical transport of air mass) তত্ত্বের অবতারণা করেন। এবিষয়ে গাণিতিক প্রক্রিয়াকে সহজ করবার জন্য তিনি তার মডেলটিকে একটি একমাত্রিক ব্যবস্থা (one dimensional system) হিসেবে কল্পনা করেন এবং দেখান যে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে পরিবেশের তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। মানাবে হলেন প্রথম গবেষক যিনি জলচক্র জনিত তাপপ্রবাহকে অন্তর্ভুক্ত করে, বিকিরণ ভারসাম্য এবং পরিচলনের দরুন উল্লম্ব পরিবহনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। যদিও মানাবের মডেলটি অপেক্ষাকৃত সরল ছিল, তথাপি তিনি এই জটিল বিষয়টির মূল প্রতিপাদ্যগুলি অত্যন্ত সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে তার মডেলের ওপর ভিত্তি করে জটিলতর ত্রিমাত্রিক মডেলেরও সমীক্ষা করা হয়।

ক্লাউস হাসেলম্যানের গবেষণা

এর প্রায় ১০ বছর পর হ্যাসেলম্যান আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যে প্রথম সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন। যেহেতু সূর্যের আলো পৃথিবীর সব জায়গায় সমানভাবে পড়ে না, তাই আবহাওয়ার পরিবর্তন স্থানিক তারতম্যে প্রচুর আলাদা হয়। তার ফলে আবহাওয়ার একটি নির্দিষ্ট নকশা খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য কাজ। সেই কারণে আগামী ১০ দিনের বেশি সময়ের জন্য কোনো স্থানের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। পাঠকের স্বার্থে বিষয়টি আরেকটু বিশ্লেষণ করা যাক। ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যার মূল স্তম্ভ হল নিউটনের গতিসূত্রগুলি। এই সূত্রগুলির ওপর দাঁড়িয়েই বলবিদ্যার ধাঁচাটি তৈরি হয়েছে, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল নির্ণয়বাদ (determinism)। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি পদার্থবিদ ল্যাপ্লাস দাবি করেন যে, যদি মহাবিশ্বের সব অনু পরমাণুগুলির প্রাথমিক অবস্থান ও গতিবেগ জানা থাকে, তবে স্থান কাল নির্বিশেষে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণরূপে নির্ধারণ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে এই মন্তব্যটি সত্যের থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে। এর সবথেকে বড় উদাহরণ হল আবহাওয়া। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে একটি বিশাল মাপের ব্যবস্থা (system) - যা ক্লাসিকাল বলবিদ্যা মেনে চলে, হিসেবে ভাবা গেলেও, এই গোটা ব্যবস্থাটি কোনো অবস্থাতেই নির্ধারক (deterministic) নয়।

পৃথিবীর আবহাওয়া ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যার নীতি মেনে চললেও একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে তাকে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ বাস্তবে তার প্রতিটি অনু পরমাণুর প্রাথমিক গতীয় অবস্থা নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ সহজভাবে বললে পৃথিবীর প্রতিটি কোনার তাপমাত্রা, বায়ুর গতিবেগ, চাপ, জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব ইত্যাদি প্যারামিটারগুলি একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্টভাবে জানা কখনই সম্ভব নয়।

এছাড়া, আবহাওয়া সংক্রান্ত গাণিতিক সমীকরণগুলি মূলত নন-লিনিয়ার। তাই প্রাথমিক শর্তের সামান্য তারতম্য আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিতে চরম পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ ধরুন ব্রাজিলে একটি প্রজাপতি সজোরে ডানা ঝাপটালো, আর তার জন্য টেক্সাসে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেলো। উদাহরণটি বাস্তবিক ক্ষেত্রে অতিসয়োক্তি হলেও, এটিকে আলোচ্য বিষয়ের জন্য একটি রূপক হিসেবে ধরা যেতেই পারে। এই ধরনের ব্যবস্থাগুলির তত্ত্ব নির্ধারণের জন্য গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এডওয়ার্ড লোরেঞ্জের হাত ধরে ক্যাওস থিওরির (chaos theory) আবির্ভাব ঘটে। হ্যাসেলম্যান তাঁর গবেষণা শুরু করেন oceanography ও fluid dynamics নিয়ে। পরবর্তীকালে তিনি জলবায়ুর জন্য একটি stochastic climate model-এর অবতারণা করেন। সহজভাবে বলতে গেলে যার অর্থ হলো, তাঁর এই মডেলে এই ধরণের ভৌত ব্যবস্থার অনির্দেশ্যতা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর মূল অনুপ্রেরণা ছিল আইনস্টাইনের ব্রাউনিয় গতীয় তত্ত্ব, যাকে আধুনিক পদার্থবিদ্যার পরিভাষায় 'Random walk' ও বলা হয়ে থাকে। হ্যাসেলম্যান এই আইনস্টাইনের ব্রাউনিয়ান তত্ত্ব-এর ওপর ভিত্তি করে দেখালেন আবহাওয়ার মুহুর্মুহু পরিবর্তন কীভাবে মহাসমুদ্রের বৈশিষ্টের পরিবর্তন করে থাকে। মাথায় রাখতে হবে যে, মহাসমুদ্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলি আবহাওয়ার মতো নয়, এটি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য, যা দীর্ঘস্থায়ী। জলবায়ুর পরিবর্তন আবহাওয়ার পরিবর্তনের মতো নয়। আবহাওয়া ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু জলবায়ু দীর্ঘস্থায়ী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কলকাতার জলবায়ু মূলত নাতিশীতোষ্ণ, যেখানে সুমেরুতে বছরের সবসময় বরফ জমে থাকে। এই বৈশিষ্ট্য দীর্ঘস্থায়ী এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে এর পরিবর্তন খুব একটা হয় না। তাই আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে জলবায়ুর পরিবর্তনের সূক্ষ্ম সম্পর্কটি স্থাপন করা তাত্ত্বিকভাবে খুব কঠিন কাজ। হ্যাসেলম্যান তাঁর কাজের মাধ্যমে আবহাওয়ার সাথে জলবায়ুর এই সম্পর্কটি স্থাপন করেছিলেন, যা পরিবেশবিদ্যার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী কাজ।

জলবায়ু পরিবর্তনের মডেলের কাজটি শেষ করে হ্যাসেলম্যান মনোনিবেশ করেন পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রভাবের মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর। কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা সংগৃহীত তথ্য, অন্যান্য উপায়ের সংগৃহীত আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য এবং বেশকিছু তাত্ত্বিক মডেলের সাহায্যে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, গত ১৫০ বছরে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ প্রায় ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল গত প্রায় লক্ষাধিক বছর এই পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড ধারণ করেনি। এর ফলে এই ১৫০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা যথেষ্ট চিন্তার কারণ।

অবিন্যস্ত ব্যবস্থা (disordered system) এবং জর্জিও পেরেসির গবেষণা

ক্যাওস থিওরির কথা এই লেখায় আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। আশির দশকে জর্জিও পেরেসি তাঁর কাজের মাধ্যমে দেখান যে কিভাবে বিভিন্ন অবিন্যস্ত ভৌতিক ঘটনার (disordered or random physical phenomena) পিছনে কিছু নির্দিষ্ট লুকোনো পার্থিব সূত্র (hidden physical rules) কাজ করে। তাঁর কাজ জটিল ব্যবস্থার তত্ত্বের ইতিহাসে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে একটি। তবে পেরেসির প্রাথমিক গবেষণা সরাসরিভাবে পরিবেশবিদ্যার সাথে জড়িত নয়। তাঁর এই কাজ মূলত স্পিন গ্লাস (spin glass) নামক একধরনের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা (system) নিয়ে, যা কিছু ধরণের গুরুত্বপূর্ণ ধাতু সংকরের (metal alloy) মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। এইধরনের ধাতু সংকরে লৌহ পরমাণু (iron atoms), কিছু অন্যান্য ধাতব পরমাণু - যেমন তাম্র পরমাণুর (copper atoms) সাথে অবিন্যস্তভাবে মিশ্রিত থাকে। এইধরনের মিশ্রণে লৌহ পরমাণু পরিমাণে খুব কম থাকলেও তা সংকর ধাতুটির চৌম্বক ধর্মের কিছু বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটায়।

প্রতিটি লৌহ পরমাণু একেকটি ছোট্ট চুম্বকের মতো কাজ করে, যার বৈশিষ্ট্য অন্যান্য লৌহ পরমাণুর উপস্থিতির জন্য পরিবর্তিত হয়। সাধারণ চুম্বকের মধ্যেকার চুম্বক অনুগুলি একটি নির্দিষ্ট দিকে বিন্যস্ত থাকে। কিন্তু স্পিন গ্লাসের চৌম্বক অনুগুলি অবিন্যস্ত অবস্থায় থাকে। এইধরনের ধাতু সংকরের চুম্বক অনুগুলির কিছু একটি নির্দিষ্ট দিকে ও কিছু অন্য একটি দিকে বিন্যস্ত থাকে। এর ফলে এদের চারিত্রিক বৈশিষ্টের গুরুতর তফাত দেখা যায়। এই নির্দিষ্ট বৈশিষ্টগুলি সঠিকভাবে বোঝার জন্য স্পিন গ্লাসের চৌম্বক অনুগুলির সর্বোত্তম বিন্যাসের (optimal orientation) কারণ বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরী। স্পিন গ্লাসের এই চমকপ্রদ বৈশিষ্টগুলির একটি নির্দিষ্ট ধরণের জটিল ব্যবস্থা (complex system)-এর সন্ধান দেয়।

সত্তরের দশক থেকে বহু পদার্থবিদ, যাদের মধ্যে নোবেলজয়ীও আছেন, এই স্পিন গ্লাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁদের ব্যবহার করা তাত্ত্বিক মডেলগুলির মধ্যে একটি হল প্রতিরূপ কৌশল (replica trick)। পারিসির আগে এই প্রতিরূপ কৌশল ব্যবহার করে গবেষকরা বিশেষ সাফল্য পাননি। কিন্তু ১৯৭৯ সালে পারিসি দেখান যে কিভাবে এই কৌশল ব্যবহার করে স্পিন গ্লাসের একটি নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করা যায়। তিনি প্রতিরূপগুলির মধ্যেকার একটি নির্দিষ্ট ধাঁচা খুঁজে পান এবং তার একটি যথার্থ গাণিতিক মডেল দিতে সক্ষম হন। পারিসির এই গাণিতিক মডেলটি সঠিক প্রমাণিত হতে বহু বছর সময় লেগেছিল। কিন্তু তারপর তাঁর এই তাত্ত্বিক পদ্ধতি বহু ধরণের অবিন্যস্ত ব্যবস্থার (disordered systems) তাত্ত্বিক রুপায়নের ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে এবং বর্তমানে তাঁর এই কাজ জটিল ব্যবস্থার (complex systems) গবেষণার একটি অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে পরিগণিত হয়। এর পরবর্তীতে পারিসি অন্যান্য জটিল ব্যবস্থা, যার মধ্যে জলবায়ু অন্যতম, নিয়ে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। তাঁর পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণার মূল প্রশ্নগুলির মধ্যে অন্যতম হল - কেন পৃথিবীর জীবনচক্রে বরফযুগের বারংবার আগমন ঘটে। অথবা - ক্যাওস ও টারবুলেন্ট সিস্টেমের মধ্যে কোনো সাধারণ গাণিতিক সম্পর্ক আছে কিনা। এছাড়াও তিনি গবেষণা করেছেন স্টারলিং পাখীদের একত্রিত গুঞ্জনের পিছনে লুকিয়ে থাকা নির্দিষ্ট নকশা (pattern) নিয়ে। আপাতভাবে আমাদের মনে হতে পারে যে স্পিন গ্লাস ও জলবায়ুর মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের তত্ত্বগুলির মধ্যে কোনো মিল থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু পারিসি তাঁর যুগান্তকারী কাজের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন যে কিভাবে আপাতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন জটিল ব্যবস্থাগুলিকে একটি নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক ধাঁচার মধ্যে ফেলে তার সঠিক বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর হয়।

কিছু শেষের প্রশ্নোত্তর

সিকুরো মানাবে, ক্লাউস হাসেলম্যান এবং জর্জিও পারিসি মানবসভ্যতার ইতিহাসে তাঁদের পদচিহ্ন রেখেছেন, বিশ্বের জলবায়ু ও পরিবেশ গবেষণায় তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মধ্য দিয়ে। তাঁরা একত্রিতভাবে বস্তুত পরিবেশ গবেষণার মূল ভিত্তিপ্রস্তরটি স্থাপন করে দিয়েছেন। তাঁদের কাজের ওপর ভিত্তি করে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল - পৃথিবী কি দিনে দিনে উত্তপ্ত হচ্ছে? উত্তর হল - হ্যাঁ। পরের স্বাভাবিক প্রশ্নটি হল - পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ার মূল কারণ কি বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের উত্তরোত্তর বেড়ে চলা? এরও উত্তর হল - হ্যাঁ। অথবা - গ্রিনহাউস গ্যাসের এই ভয়ানক বৃদ্ধি কি প্রাকৃতিক কারণে হচ্ছে? উত্তর হল - না, এটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে মনুষ্যসৃষ্ট। তাঁদের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের ওপর ভিত্তি করে পরিবেশবিদ্যা আজ একটি সুস্পষ্ট তাত্ত্বিক ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম যৌবনে এসে কয়েক হাজার বছর বয়সী মানবসভ্যতা যে অবিসংবাদিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে যদি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সর্বোপরি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ঐকান্তিক প্রয়াসের দ্বারা কোনদিন মুক্ত হওয়া যায়, তবে মানবসভ্যতা এই তিন গবেষকের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।

পুনশ্চঃ চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার সংক্রান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য জানতে আগ্রহী পাঠক 'রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি'র ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখতে পারেন। এই লেখার গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য সেখান থেকেই নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রয়োজনে www.nobelprize.org-তে গিয়ে আপনি সরাসরি নোবেলজয়ীদের বক্তব্যও শুনতে পারেন।