আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

চাষি কে? - গুনতি, স্বীকৃতি, নীতি

অশোক সরকার


চাষি কে এই প্রশ্নটার উত্তর যতটাই সহজ, ততটাই কঠিন। যে কাউকে জিগ্যেস করলে বলবে, ‘যে চাষ করে সেই চাষি’, কিন্তু এই সহজ জিনিসটা জটিল করেছে আমাদের সরকার, আমাদের গণনা আর নীতি।

কী রকম?

যদি বলি ‘যে চাষ করে সে চাষি’ তাহলে, খেতমজুর, ঠিকা চাষি, রেকর্ডবিহীন বর্গাদার, মেয়েদের দল, আদিবাসী - অনেকেই আসে যাদের নিজস্ব কৃষি জমি নেই। এটা বললে কম বলা হবে। অরণ্য এলাকা ম্যাপে যা আছে, আসলে তা কমে গেছে অনেকটাই, সেই জমিগুলির উপর দখল আছে, যে সব চাষি ভাই-বোনেদের, তাদের জমির কাগজ নেই। দখল থাকলে চলবে না, কাগজ থাকতে হবে। আবার অরণ্য অধিকার আইনে যে পরিবারগুলি কৃষি জমি পেয়েছে, তারা কি চাষি বলে পরিচিত হল? উত্তর না। তারা নাকি অরণ্য অধিবাসী। নদীর এপার ভেঙ্গে ওপার গড়েছে, এপারের লোকেরা ওপারে গিয়ে বস্তি করে জমিতে অসাধারণ সবজি ফলিয়েছে, কিন্তু তারা চাষি নয়, কারণ জমিটা নদীর প্লাবন ভূমিতে।

আবার দিন মজুর দিয়ে চাষ করায় এমন চাষ জমির মালিক চাষি। সিঙ্গুরে চাষ জমি আছে, কিন্তু সে কলকাতায় কলেজে পড়ায়, আর চার প্রজন্ম মজুর খাটা প্রজা পরিবার, মরশুম শেষে ধান পৌঁছে দেয়, এই অধ্যাপক চাষি। নিজের গ্রামের বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া দু'বিঘা জমি; জমির রেকর্ডে আছে বাস্তু, কিন্তু সাত প্রজন্ম সেখানে চাষ হচ্ছে, সে ভূমিহীন খেত মজুর, চাষি নয়। আবার উত্তরপ্রদেশে খাতায় কলমে লেখা-পড়া করা বাটাইদার, তার মেয়ে চাষি নয়, ছেলে হবে বাটাইদার চাষি।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, এ তো দেখছি ঘেঁটে ঘ! ঠিকই তো। নাগরিক পরিচয় যেমন কঠিন, চাষি পরিচয়ও তাই। ভোটার কার্ডে বানান ভুল হলে আমি নাগরিক নই, কিন্তু আমি ভোট দিতে পারি; আধার কার্ড নাগরিকের পরিচয়পত্র নয়, তাই দিয়ে কিন্তু পাসপোর্ট হয়ে গেল আমার; পাসপোর্ট নাকি শুধু আমার সঠিক ঠিকানা বলে; প্যান কার্ড নাকি আমার শুধুই আইডেন্টিটি, নাগরিকত্ব নয়, আরও কত কথা শুনতে হল আমাকে। চাষির চাষিত্ব প্রায় তাই।

চাষির স্বীকৃতির বেলায় সরকার বলবে চাষের জমি না থাকলে ‘তুমি বাপু চাষি নও, দখল থাকলে হবে না, কাগজ থাকতে হবে, দখল না থাকলেও চলবে, কাগজ থাকলেই হবে।‘' খেত মজুর হল মজুর, সে চাষি নয়, মহিলারা চাষের কাজ করে সবচেয়ে বেশি কিন্তু তারা তো ঘরের বউ, চাষি হবে কি করে? আমার নিজের তো জমি নেই, কিন্তু আমি ঠিকা নিয়ে চাষ করি। ঠিকা চাষটাই যদি বেআইনি হয়, তাহলে আমি চাষি হব কী করে? বেশির ভাগ রাজ্যে বিধবা, বিকলাঙ্গ, বা সেনা পরিবার ছাড়া বাকিদের জন্য ঠিকা চাষটাই তো নিষিদ্ধ!

সরকারের গণনাই নানারকম। যেমন ধরুন কৃষি সেন্সাস। এই সেন্সাস একটা অদ্ভুত নাম দিয়েছে চাষের জমির। Operational holding। কতটা চাষের জমি কার্যত আমি চাষ করি, তার অঙ্ক বলে দেবে দেশে ‘কার্যত চাষি’ ক-জন। কার্যত চাষি মানে কাগুজে মালিকানা ব্যতিরেকে আমার দখলে আসলে কতটা চাষের জমি। কার্যত মালিকানা আমার জমির প্রতিটা জোত গুনে হিসেব করা হয়। ২০১৫-২০১৬ সালে শেষ তথ্য পাওয়া গেছে, তা অনুযায়ী দেশে ১৪ কোটি কার্যত চাষি আছে। আবার অন্যদিকে ২০১৮-২০১৯ সালের ‘Situation Assessment of Agricultural Households Report’ এই ক'দিন হল বেরিয়েছে, তাতে বলছে দেশে চাষি ঘরের সংখ্যা ৯ কোটি ৩০ লক্ষ। এই তফাতটায় চাষির কোনো দোষ নেই, চাষ ও চাষির সংজ্ঞা সমস্যা এটা। ধরুন আমার ৪ বিঘা জমি আছে তিনটি জোতে, তার একটা আমার ভাই চাষ করে। আমরা এক বাড়িতেই থাকি। জমিটা বাবার নামে। কৃষি সেন্সাস বলবে দুটি ‘কার্যত মালিকানা’, অর্থাৎ দু'জন কার্যত চাষি, আর ২০১৮ সালের সার্ভেতে আমরা হলাম একটা চাষি ঘর। পশ্চিমবঙ্গে ‘কার্যত মালিকানার’ সংখ্যা ৭২ লক্ষের কাছাকাছি। চাষি ঘরের সংখ্যা ৬৬ লক্ষের মত।

কৃষি সেন্সাস গোনার সময় পুরুষ, নারী আলাদা করে গোনে, তার সঙ্গে তপশিলী জাতি-উপজাতিও গোনে। কিন্তু ঠিকা চাষি গোনে না। অরণ্য আধিবাসীরা যারা নিজেদের চাষের জমিতে অরণ্য অধিকার আইনে পাট্টা পেয়েছে, তাদের গোনে না। কৃষি শ্রমিক গোনে না। আবার এই যে নতুন রিপোর্ট বেরোল, তাতে ঠিকা চাষি কত ঘর গোনা হয়েছে, কিন্তু মহিলা চাষি কত ঘর গোনা হয়নি। কৃষি শ্রমিকও গোনা হয়নি। তেমনি অরণ্য অধিকার পাওয়া আদিবাসীদেরও গোনা হয়নি।

কাজেই ‘যে চাষ করে সে চাষি’ এমন সংজ্ঞা দিয়ে চাষি কতজন তা পাওয়া যাচ্ছে না।

ঝামেলা এতেই শেষ নয়। ‘তুমি কতদিন চাষ কর বাপু? আর চাষ থেকে তোমার রোজগারই বা কতটা, আর কতটা বা অন্য সব কাজকর্ম থেকে?’ এই সব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সত্যি তো, যত দিন যাচ্ছে, ততোই চাষে আমাদের সময় দেওয়া কমছে, আর অন্য কাজে সময় দেওয়া বাড়ছে। চাষে রোজগার কোথায়, ঘর চালাতে হবে তো? তাইতো দেখছি, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে চাষির রোজগারের মধ্যে ফসল থেকে রোজগারের অংশ এখন যথেষ্টই কম। ২০১৮-২০১৯ সালের ‘Situation Assessment of Agricultural Households Report’-এ দেখা যাচ্ছে, ১ হেক্টর (৪ বিঘা) পর্যন্ত যাদের জমি, ফসল ফলানো থেকে তাদের মাসিক রোজগার, মোট রোজগারের ৩০%-এর মত। তার উপরে, এই অনুপাত একটু বাড়তে থাকে - ১ থেকে ২ হেক্টর পর্যন্ত যাদের জমি তাদের ফসল ফলিয়ে মাসিক রোজগার মোট রোজগারের ৩৪%, ২ থেকে ৪ হেক্টর পর্যন্ত যাদের জমি, তাদের ফসল ফলিয়ে মাসিক রোজগার মোট রোজগারের ৩৭%, আর ৪ থেকে ১০ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকানা যাদের, ফসল ফলিয়ে তাদের মাসিক রোজগার মোট রোজগারের ৫০%। তুলনায় শ্রম থেকে আসা রোজগার, মোট রোজগারের ৩৭ থেকে ৬৭% পর্যন্ত। একটাই ব্যতিক্রম যারা ভূমিহীন কিন্তু ঠিকা বা ভাগে চাষ করে, তাদের বেলায় শ্রম থেকে রোজগারের ভাগ মাত্র ১৪%। সব স্তরের চাষিদের বেলাতেই দেখছি রোজগারের মধ্যে ব্যবসা বা রেমিট্যান্স-এর ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। ব্যবসার মধ্যে স্বনিযুক্তি, রেমিট্যান্সের মধ্যে প্রবিবারের পরিযায়ী শ্রমিকের পাঠানো টাকা ও সরকারি অনুদান আছে।

যা অবস্থা, তাতে আর ক’দিন বাদে হয়ত বলা হবে ‘তোমাদের যাদের রোজগার যেহেতু প্রধানত চাষবাস থেকে আসছে না, তাদের আর চাষি বলে গণ্য করা হবে না’। ইতিমধ্যেই কৃষি বিশেষজ্ঞ হরিশ দামোদরন হিসেব করে বলছেন, সারা দেশে মাত্র ৩ কোটি ৬১ লক্ষ চাষির মোট রোজগারের ৫০ ভাগ বা তার বেশি চাষবাস থেকে আসে, তাই তারাই প্রকৃত চাষি। বিপদ এলো বলে।

সরকারের নীতি মূলত তৈরি হয় কাকে কেমন কতটা সহায়তা দেওয়া হবে, তার নিরিখে। সেখানে কাগজই আসল। জমির কাগজ থাকতে হবে, তবে পি এম কিষান পাবে। রাঁচি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে মহিলা পুরুষদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। পি এম কিষান কতজন পেয়েছেন জিগ্যেস করাতে আদিবাসী মহিলারা হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমাদের জমির কাগজ নাই, ও আমাদের দেয় না।‘ ‘আরে বাবা কোনো না কোনো কাগজ তো থাকবে?’ ‘হ্যাঁ তা আছে, ঠাকুরদার নামে, জেঠ ঠাকুরদার নামে।‘ ‘তা জমি ভাগাভাগি করে নাম পালটে নিতে অসুবিধা কী?’ পুরুষেরা উত্তর দেয়, ‘ভাই-এ ভাই-এ লড়াই হবে, কাকা জেঠায় লড়াই হবে, বাবা ছেলের লড়াই হবে, এ টাকা আমাদের দরকার নেই।‘ আদিবাসীদের কাছে, পরিবার বা সমাজের বাঁধন ধরে রাখা রাষ্ট্রের অনুদানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য ঘেঁটে দেখি ঝাড়খণ্ডে পি এম কিষান মাত্র ৪৮% কৃষিজীবী মানুষের কাছে পৌঁছেছে।

স্বনির্ভর দল যেহেতু মহিলারা করেন, তাই তারা কৃষি ঋণ চাইতে গেলে ব্যাঙ্ক বলে, তোমরা কৃষি ঋণ পাবে কি করে, কাগজ তো নেই, তোমরা স্বনির্ভর দলের ঋণ পেতে পার। ঠিকা শ্রমিকেরও একই কাহিনি। নগদ টাকা দিয়ে জমি লিজ নিয়ে চাষ করছে, ভূমিহীন কৃষক, সে কৃষি ঋণ পাবে না। তার ঘরণী স্বনির্ভর দল থেকে লোন এনে দেবে, সেই টাকা দিয়ে সে জমি লিজ নেবে। ২০১৮-১৯ সালের ঐ সার্ভে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৪ লক্ষের বেশি লিজ চাষির খোঁজ পেয়েছে। তার ৬০ ভাগ নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে নেওয়া লিজ, আর ১২ ভাগ নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসলের বিনিময়ে লিজ। অন্যদিকে সিঙ্গুরে চাষের জমির অধিগ্রহণ হলে কলকাতাবাসী অধ্যাপক এবং তাঁর তিন পুরুষ চাষের জমির ক্ষতিপূরণ পেয়ে যান। দেশের যে অল্প কয়েকটা ক্ষেত-মজুর ইউনিয়ন আছে, তারা নিজেদের চাষি ইউনিয়ন বলে না, বলে ক্ষেত মজুর ইউনিয়ন। একইভাবে অরণ্য অধিকর্তাকে জিগ্যেস করলে বলেন, আমাদের এখানে কোনো চাষি নেই, এটা জঙ্গল। চাষি সমবায়-কে জিগ্যেস করলে বলেন, আমার চাষি হল যাদের আছে জমি।

জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সময় একটা ইংরেজি কথা প্রচলিত ছিল, land to the Tiller. সারা পৃথিবী জুড়ে এই কথাটি শোনা গেছে বিভিন্ন সময়ে। মানে হল, যে চাষ করে ফসল ফলায় সেই চাষি, জমিটা তার না অন্যের, জঙ্গলের না নদীর, পরিবারের না গ্রামের, সেটা উপলক্ষ মাত্র।

প্রশ্ন হল এই কচকচির দরকার কী? নানা কারণে দরকার আছে।

সারা দেশে ঠিকা চাষির সংখ্যা চাষিকুলের ১৮%, তাঁরা কেন পি এম কিষান পান না? তাঁরা যে চাষি তার প্রমাণ কি তাদের মালিকানা জমি, না তাদের শ্রম, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা? ব্যাঙ্কের ঋণ তাঁরা পাবেন না কেন? কারণ ব্যাঙ্ক আসলে চাষিকে দেখবে না, দেখবে তার বন্ধক যোগ্য জমি?

আমরা কি ভুলে গেছি কী করে কয়েক লক্ষ বর্গা চাষিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল? কার সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল তখন? ভূমি সংস্কার দপ্তরের আমলারা গ্রামে ক্যাম্প করতেন, সেখানে চাষি, খেতমজুর, পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি, পাড়া-পড়শিরা এসে সাক্ষ্য দিত, চিনিয়ে দিত বর্গা চাষিকে, দেখিয়ে দিত বর্গা জমিটাকে। ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের এক বিশেষ ধারায় এই ধরনের সাক্ষ্যের স্বীকৃতি আছে। সেভাবে যদি বর্গা করা যায়, তাহলে সেই একই পদ্ধতিতে ঠিকা চাষিকে চাষি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে করতে বাধা কোথায়? তাহলে তার নামে বীমা হতে পারে, ঋণ হতে পারে, সার বীজ সবই হতে পারে।

অরণ্যের অধিকার আইনে দেশে ইতিমধ্যেই ১৯ লক্ষ ২৪ হাজারের মত ব্যক্তিগত পাট্টা দেওয়া হয়েছে, সেটা তো এক, বাস্তু জমির জন্য, আর দুই, পারিবারিক চাষের জমির জন্য। তাহলে এই ১৯ লক্ষ ২৪ হাজার পাট্টা প্রাপক আদিবাসীদের চাষি বলে স্বীকার করতে বাধা কোথায়? নাকি জঙ্গলে থাকা আদিবাসীদের চাষি বলা যাবে না? পাট্টায় কিন্তু চাষের অধিকার দেওয়া হয়েছে, এবং সেই জমিগুলিকে এখন থেকে খাজনা জমি বলে স্বীকার নেওয়া হয়েছে।

একই প্রশ্ন ওঠে নদীর প্লাবনভূমিতে চাষ করা জমি ও চাষিদের নিয়ে। বিহারে, পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, ওড়িশায় এই মানুষগুলির সংখ্যা কম নয়, কিন্তু আসল সংখ্যা কেউ জানে না। জমিটা যেহেতু নদীর প্লাবনভূমিতে, তাই ও জমি নাকি চাষ জমি নয়, তাই মানুষগুলিও চাষি নয়, তাঁরা নাকি নদীর কাছে অনুপ্রবেশকারী। নদী তা বলেনি, বলেছে সরকারি সেচ দপ্তর।

চাষি পরিবারের মহিলাকে চাষি বলে স্বীকার করে নিলে তাদেরও কৃষি ঋণ পাবার অধিকার জন্মায়। সারা দেশের এমনকি সারা পৃথিবীর মহিলাদলের স্বল্প ঋণ প্রকল্পের ঋণ ফেরতের যে উজ্জ্বল খতিয়ান আছে, ব্যাঙ্কগুলি কৃষি ঋণেও তার ফায়দা নিতে পারে। মহিলাদের নিজস্ব স্বাধীনতা বাড়ে। ফসল উৎপাদন কমে না তাতে। বর্তমানে কৃষি সমবায়ে মহিলাদের সদস্য সংখ্যা নগণ্য, এমনকি সে তথ্যটাই আলাদা করে সংগৃহীত হয় না। ২০১২ সালে সবুজ বিপ্লবের জনক এম এস স্বামিনাথন রাজ্যসভায় থাকাকালীন, একটা সুদূর প্রসারী বিল পেশ করেছিলেন, যেখানে প্রস্তাব ছিল চাষি ঘরের বউ স্বাভাবিক ভাবেই চাষি, এই সহজ সত্যকে স্বীকার করে নিতে। কেউ পাত্তা দেয়নি। এই খসড়া বিলটি 'মহিলা কৃষক বিল ২০১২' নামে পরিচিত। সেখানে আরও কিছু প্রস্তাব ছিল, যা এই অহেতুক কচকচির নিরসন ঘটাতে পারত।

অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে ২০১০-২০১১ সালে সরকার Licensed Cultivators’ Act 2011 নামক আইনে ঠিকা চাষিদের স্বীকৃতি দেবার ব্যবস্থা করেছিল। প্রায় ৫ লক্ষ ঠিকা চাষি সেই আইনে একটা কার্ড পেয়েছিল। গ্রাম সভা ঠিকা চাষির লিস্ট বানাত, মালিকের সঙ্গে ঠিকা চাষির কোনো লিখিত বোঝাপড়ার দরকার ছিল না। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি বেঁকে বসায় ঠিকা চাষিরা ব্যাঙ্ক ঋণ পেলেন না। ২০১৯ সালে, জগনের অন্ধ্র সরকার, Crop Cultivators’ Rights Act 2019 নামক আইন করে ঠিকা চাষিদের স্বীকৃতি দেবার ব্যবস্থা করেছে। আগের আইনটি এখন বাতিল, কিন্তু কী করে ঠিকা চাষি চিহ্নিত হবে তার কোনো স্পষ্টতা নেই, অথচ আইনের বয়ানে ঠিকা চাষিরা মালিকের সব সুবিধা পাবার অধিকারী। অভিযোগ উঠেছে, যে জমির মালিকেরা তাদের আত্মীয়স্বজনকে ঠিকা দেখিয়ে সরকারি সুবিধা আদায় করছে। মহারাষ্ট্রে যেখানে যেখানে অরণ্য আধিবাসিদের অধিকার প্রাপ্ত জমিগুলি খাজনা জমি হিসেবে রেকর্ড করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেখানে অধিবাসী চাষিদের স্বীকৃতি দাবি করছেন, ওড়িশা থেকেও এরকম দাবি শোনা যাচ্ছে। কেরালাতে ঠিকা চাষ একেবারেই বেআইনি কিন্তু সেখানে সরকার, গ্রামে পঞ্চায়েত এবং সমুদায়িক উন্নয়ন সমিতি নামক মহিলা ফেডারেশনগুলির যৌথ চেষ্টায়, প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর পতিত জমি আবার চাষে ফিরিয়ে এনেছে, কুদুম্বশ্রির কর্মসূচীর প্রায় ৬০,০০০ মহিলা দল। কিন্তু, তাতে মহিলাদের ওই জমির উপর কোনো আইনি অধিকার জন্মায়নি।

চাষি কে প্রশ্নটা পুরনো, কিন্তু তার নতুন উত্তর খোঁজা খুবই দরকার হয়ে পড়েছে। চাষ জমি মালিকানার সঙ্গে চাষির কোনো অন্তর্নিহিত সম্পর্ক নেই। চাষি সেই যে চাষ জানে, চাষ করে, যার চাষের জ্ঞান আছে, অভিজ্ঞতা আছে, চাষ করে সে নিজের ও পরিবারের জীবন নির্বাহ করে। জমিটা অরণ্যে, পাহাড়ে, না নদীতে, বা জমিটা নিজের, স্বামীর, ঠাকুরদার, বন দপ্তরের, না কি সেচ বিভাগের, না কি অন্য মালিকের, তার থেকে চাষির স্বীকৃতিকে বিযুক্ত করা দরকার। সত্যি কথা বলতে কি জমির পরিমাণ একটা সীমার উপরে হলে তাকে চাষি বলে স্বীকৃতি দেওয়াটাই বন্ধ করতে হবে। তর্কের খাতিরে যদি বলি সেই সীমা হবে ২০ একর, তাহলে দেড় কোটি একর জমি আসল চাষিকে দেবার জন্য পাওয়া যাবে। ভারতীয় কৃষিতে ইতিমধ্যেই কৃষি জমির মালিক, অথচ চাষ করে না, এমন প্রায় কয়েক কোটি চাষি পরিবার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে গরীব, বড়লোক দুই আছে। গরিব-রা করছে না, কারণ সংস্থানের অভাব, এবং সামান্য জমিতে চাষ করে পেট ভরছে না, আর বড় চাষিরা করছে না, কারণ দেখাশুনা করার লোক নেই বা, অন্য রোজগারের সুযোগ খুলে গেছে। এই পরিস্থিতিতেও কে আসলে চাষি এই প্রশ্নটা করা দরকার।


তথ্যসূত্রঃ

1. Situation Assessment of Agricultural Households 2018-2019, appendix-A-Table-23B দেখুন।

2. Harish Damodaron and Samridhi Agarwal, ‘Counting the Kisan’, Indian Express, 4th October 2021, page 9.

3. www.pmkisan.gov.in ওয়েবসাইটে ২০২১-২০২২-এর ২য় পিরিয়ডের তথ্য বলছে ঝাড়খণ্ডে ৩০.৫৮ লক্ষ চাষি আছে, যার মধ্যে ১৪.৮৫ চাষি পিএম কিসান পেয়েছেন।

4. Situation Assessment of Agricultural Households 2018-2019, পৃষ্ঠা ৯৮-এ বলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে ৬৬.৮৯ লক্ষ চাষি-ঘর আছে, পৃষ্ঠা ১১৫-এ বলা হচ্ছে বিভিন্ন মরশুমে ২১.৪% ও ২২.২% লিজ চাষি পাওয়া গেছে, যা ১৪ লক্ষের একটু বেশি। ওই সার্ভের ১১৬ পাতায় বলা হচ্ছে ৬০% লিজ ক্যাশ টাকা দিয়ে নেওয়া।

5. ওই সার্ভের ১১৫ পাতা।

6. ওই বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা আছে দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত, World View, Kolkata প্রকাশিত land, Labour and Governance বইটিতে, পৃষ্ঠা ১০৩-১১৮ দেখুন।

7. https://dashboard.tribal.gov.in/Dashboard ডাউনলোড করে FRA সেকশনে গেলে এই তথ্য পাওয়া যায়।

8. https://ruralindiaonline.org/en/library/resource/the-women-farmers-entitlements-bill-2011 ২রা নভেম্বর ২০২১ তারিখে ডাউনলোড করা হয়েছে।

9.https://www.indiacode.nic.in/bitstream/123456789/15654/1/ap_land_licensed_cultivators_act_2011.pdf ২রা নভেম্বর ২০২১ তারিখে ডাউনলোড করা হয়েছে।

10. https://cdn.landesa.org/wp-content/uploads/Impact-of-Licensed-Cultivators-Act-in-Andhra-Pradesh-India-262-Haque.pdf পৃষ্ঠা ৫, ২রা নভেম্বর ২০২১ তারিখে ডাউনলোড করা হয়েছে।

11. https://prsindia.org/files/bills_acts/acts_states/andhra-pradesh/2019/2019AP30.pdf ২রা নভেম্বর ২০২১ তারিখে ডাউনলোড করা হয়েছে।

12. https://www.thehindu.com/news/cities/Vijayawada/crop-cultivator-rights-act-hits-tenant-farmers/article29866776.ece ২রা নভেম্বর ২০২১ তারিখে ডাউনলোড করা হয়েছে।

13. https://www.kudumbashree.org/storage/cmspages/downloads/1166639539_Collective%20Farming%20Details.pdf ২রা নভেম্বর ২০২১ তারিখে ডাউনলোড করা হয়েছে।

14. Vikas Rawal, Ownership Holdings of Land in Rural India: Putting the Record Straight, Economic and Political Weekly, Vol. 43, No. 10 (March 8-14, 2008), pp. 43-47.