আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

চিন কমিউনিস্ট পার্টির সাম্প্রতিক প্লেনাম


সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের ধারণার সঙ্গে মৌলিকভাবে শ্রেণির একনায়কতন্ত্র ধারণাটি জড়িয়ে থাকলেও, ব্যক্তির একনায়কতন্ত্রের ধারণা কখনোই যায় না, ঠিক যেমনভাবে যায় না পার্টির একনায়কতন্ত্রের ধারণাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশই এই ঝোঁকের কবলে পড়েছে কোনো না কোনো সময়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের ব্যক্তিপুজো থেকে শুরু করে সাবেক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি, সর্বত্রই এই একনায়ককেন্দ্রিকতার ঝোঁক লক্ষ করা গিয়েছিল, এবং সেসব দেশে সমাজতন্ত্রের পতনের একটা কারণও হয়ত সেটাই ছিল। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া চিনের কমিউনিস্ট পার্টির প্লেনামেও সেই ব্যক্তিতান্ত্রিকতার মোহে আটকে পড়ার প্রবণতা দেখা গেল, যা কিছুটা আশঙ্কার জন্ম দেয় বই কী! আর্থ-সামাজিক পরিসরে চিনের অভুতপূর্ব উন্নতি, সেদেশের জীবনযাত্রার মান, মানুষকে মৌলিক পরিষেবা দেবার ক্ষেত্রে সাফল্য, এই সমস্ত কিছুকে স্বীকার করেও বলতে বাধা নেই যে একপ্রকার ব্যক্তিমোহের বিচ্যুতি দেখে ভয় লাগে - যতদিন চিন অর্থনৈতিক সাফল্য পাচ্ছে ততদিন এই সমস্তকিছুই ঢাকা থাকবে, কারণ সাফল্যের থেকে বড় সফলতা আর কিছুতে নেই। কিন্তু যদি এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ হতে শুরু করে, সঙ্গে সঙ্গে এই প্রসঙ্গগুলোই বড় হয়ে দেখা দিতে শুরু করবে, খুলে যাবে ফাটলের উৎসমুখ।

প্লেনামের সমাপ্তিতে ঐতিহাসিক প্রস্তাব পাশ করে পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি চিনফিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হল। আগামী বছর ২০তম পার্টি কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে শি-র হাতে তৃতীয় বারের মতো পার্টির সর্বময় কর্তৃত্ব তুলে দেওয়া হবে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে, পার্টি, সেনাবাহিনী এবং চিনের নাগরিকরা যেন শি-র নেতৃত্বে আরও ঐক্যবদ্ধ হন এবং চিনা চরিত্র বজায় রেখে সমাজবাদের নতুন যুগ প্রবর্তনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিশেষ প্লেনাম ডেকে প্রস্তাব পাশ করানোর মধ্য দিয়ে এমনিতেই মাও সে তুং এবং দেং জিয়াও পিংয়ের সমতুল্য হয়ে উঠেছেন শি, এবার সীমাহীন কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে তিনি মাওয়ের পর চিনের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠতে চলেছেন। ২০১৮ সালেই তিনি আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকার পথ প্রশস্ত করেছেন। একইভাবে এ বার পার্টিতেও দশ বছরের মেয়াদ অতিক্রম করে তৃতীয় বারের জন্য কর্তৃত্ব পেতে চলেছেন তিনি। এর আগে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি দু’বার এমন প্লেনাম ডেকে বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। ১৯৪৫ সালে মাও সে তুং এমনই এক প্রস্তাবের বলে পার্টিতে তাঁর নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে দেং জিয়াও পিং আরেকটি প্রস্তাবে পার্টিকে অত্যাধিক মাও চিন্তাধারা থেকে সরিয়ে যৌথ নেতৃত্বের পথে নিয়ে যান, যার ফলস্বরূপ দেং ও তাঁর সুযোগ্য দুই সেনাপতি, জিয়াং জেমিন ও হু জিনতাও এক নতুন ধরণের চিনা সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন। এবারের প্লেনামে যে প্রস্তাব নেওয়া হল তার ফলে পার্টির অভিমুখ আবার যৌথ নেতৃত্বের থেকে ঘুরে গেল ব্যক্তিনির্ভরতায়, এবং নতুন এক তত্ত্বের জন্ম দিল, 'শি জিনপিং চিন্তাধারা'। শি-কে অভিহিত করা হল 'কাণ্ডারি' হিসেবে, যা মাওয়ের পর কোনও নেতাকে বলা হয়নি, এমনকি দেংকেও নয়। আর এগুলোই সিঁদুরে মেঘ দেখাচ্ছে। কারণ একনায়কতান্ত্রিকতার ঝোঁক এমন একটা গুণ যা অবশেষে গিয়ে কোনও ডান বা বামদিক নেয় না। নেয় নিখাদ স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থান।

এ কথা ঠিক যে প্রতিটি দেশে সমাজতন্ত্র তার নিজের নিয়মে বিকশিত হয়, এবং এক দেশের অভিজ্ঞতা অন্য দেশে পরীক্ষা করলে ব্যর্থ হবে। সে হিসেবে চিনের সমাজতন্ত্রের রাস্তা তার নিজস্ব, এবং গত একশো বছর ধরে চড়াই উতরাই ভাঙতে ভাঙতে সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিজস্ব নিয়মেই এক প্রতিস্পর্ধী স্বর হয়ে উঠেছে, যা আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে এক বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটিয়েছে। যদিও, সেই দেশে বাড়তে থাকা বৈষম্য, পুঁজিপতিদের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ দান, নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।

নিজস্ব পথের যুক্তি মেনে নিয়েও বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দিকগুলো অস্বীকার করে আরও বেশি বেশি রুদ্ধদ্বার রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করার যৌক্তিকতাকে খতিয়ে দেখা জরুরি। প্রয়োজনে সাবেক মার্ক্সবাদকেও উলটে পালটে দেখে নিতে হবে, কারণ এই তত্ত্বগুলো কোনো দৈবপ্রেরিত বাণী নয় যারা অলঙ্ঘ্য। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞতা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন বামপন্থী পরীক্ষা নিরীক্ষা দেখাচ্ছে যে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে বর্জন না করেও বামেরা ক্ষমতায় আসতে পারে ও গণমুখী নীতি গ্রহণ করতে পারে। ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক মতাদর্শগত মহাবিতর্কের সময়ে যাঁরা এই কথাগুলো বলতেন, যেমন তোগলিয়াত্তি, বা হয়ত ক্রুশ্চেভও, তাঁদের অনায়াসে সংশোধনবাদী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ওভাবে সাদা কালো দিয়ে সব কিছুর বিচার হয়ত করা যায় না। প্রতিটি দেশের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়, এবং মনে রাখতে হবে যে কেরালা, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের শাসনকাল এক অভুতপূর্ব ইতিহাস তৈরি করে দিয়ে গেছে, এবং এই সরকারগুলি কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত হয়েও ভারতীয় সাংবিধানিক গণতন্ত্রের উজ্জ্বলতম রক্ষাকবচ ছিল। চিনের মত বিশাল দেশের সঙ্গে ভারতের একটি বা তিনটি অঙ্গরাজ্যের তুলনা চলে না ঠিকই। কিন্তু সাবেক নিয়ম মেনে রাষ্ট্র ও পার্টির বজ্রআঁটুনি, সেই সঙ্গে একনায়কতন্ত্রের রাস্তা খুলে দিয়ে ব্যক্তিপূজাকে প্রশস্ত করা, এগুলো হয়ত কোনও দেশকাল ও সংস্কৃতি নির্বিশেষেই বিপজ্জনক। ভুললে চলবে না যে শি জিনপিং-এর বহু সাফল্যের সঙ্গেই তাঁর সময়কালে হংকং-এ দমন-পীড়ন, উইঘুর মুসলিমদের উপর অত্যাচার - এগুলোও ঘটেছে, এবং এখন থেকে এই ইতিহাসগুলো চিনে ব্রাত্য, কোনও সরকারি বইতে, স্কুলের পাঠ্যবই হোক বা ইতিহাসগ্রন্থ, এগুলো রাখা হবে না। এরকম ফরমান আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কতটা খাটে?

চিনের সাফল্য, কমিউনিস্ট আন্দোলনের দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখে উন্নতির রাস্তায় এগিয়ে যাওয়া - এই সমস্তই সহস্রমুখে বলার। কিন্তু অন্তত শতমুখে হলেও বলতেই হবে যে শ্রেণির একনায়কতন্ত্র যখন পার্টির ও ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির একনায়কতন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, সেটা শুধুমাত্র মানবাধিকারের প্রশ্ন থেকেই নয়, এমনকি গোঁড়া মার্ক্সবাদী দৃষ্টি অনুসরণ করলেও একপ্রকারের বিচ্যুতি। এটুকু না বললে ভবিষ্যতের কাছে আমাদের উচ্চারণ সত্যবদ্ধ থাকবে না।