আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

‘নামাজ আমার হইল না আদায়’


ভারতীয় সংবিধান ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মেরুদণ্ড স্বরূপ। যেখানে সরকারের গঠন, কার্যপদ্ধতি, ক্ষমতা ও কর্তব্য নির্ধারণের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক আদর্শের রূপরেখাটি তৈরি হয়। সংবিধান সর্বজনমান্য। সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র - এ কথা পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়ারও অজানা নয়। সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হয়েছে এবং জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য জনগণের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার কথাও বলা আছে। কিন্তু ভারতবর্ষের ভিত্তি স্বরূপ সংবিধানে উল্লিখিত বিষয়গুলি কি আজ ভারতের সর্বক্ষেত্রে মান্য? সংবিধানের লিখিত বাণী আর প্রকৃত ছবি কি এক? প্রশ্ন উঠছে বারবার। নভেম্বর-এর পাঁচ তারিখে ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলিতে উঠে এল এমনি এক খবর।

নাজি মহম্মদ। পেশায় নাপিত। ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ। হরিয়ানার গুরুগ্রাম অর্থাৎ গুরগাঁও-এর বাসিন্দা। প্রতি শুক্রবার শহরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নামাজ পাঠ করতে যান আরও অনেকের মতোই। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার নামাজ পড়ার জায়গাটি গেল হারিয়ে। সে প্রায় পুকুর চুরির মতো ঘটনা। ‘ছিল বেড়াল হয়ে গেল রুমাল’-এর মতো করে দীর্ঘ বছরের নামাজ ক্ষেত্র হয়ে গেল ‘গোবর্ধন পূজা’র স্থল। ঘটনার নেপথ্য কারিগর ‘সংযুক্ত হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি’ নামক এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন।

মূল ঘটনার শিকড় আরও কিছুটা পুরনো। এই সমিতি প্রকাশ্য রাস্তায় নামাজ পড়া যাবে না বলে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। তার ফলে পুলিশি প্রহরায় নামাজ পাঠ করতে হচ্ছিল ঐ অঞ্চলের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের। এমনকি প্রার্থনার সময় বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা এবং উচ্চস্বরে ভক্তিগীতি চালিয়ে দেবার মতো ঘটনাও ঘটে। একই সঙ্গে প্রকাশ্য স্থানে নামাজ পড়ার জন্য যেহেতু সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নাগরিকদের অনুমতি প্রয়োজন সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের একাংশকে প্ররোচিত করার চেষ্টাও চলে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের তরফে অভিযোগ করা হয় নামাজ পাঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভাবাবেগে আঘাত দিচ্ছে। অথচ পারস্পরিক সহযোগিতা সম্মতি ও বোঝাপড়ার সূত্রে ২০১৮ সাল থেকেই ওখানে নামাজ পড়া চলছে। কিন্তু আমরা প্রবল বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে, আজ এত বছর পরে সপ্তাহে একদিন পনের-কুড়ি মিনিটের জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা কীভাবে অন্য ধর্মের মানুষকে আঘাতের কারণ হয়ে গেল। এই পরিপ্রেক্ষিতে অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধি, হিন্দু সংগঠন এবং স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ত্রিপাক্ষিক আলোচনাও হয়। ঠিক হয় মসজিদ সহ ওয়াকফ বোর্ডের উনিশটি আটকে রাখা সম্পত্তি যেন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নামাজ পাঠের জায়গা নির্দিষ্ট করা থাকবে। আবার সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী আলোচনার সময় ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’-এর মুসলমান শাখা ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’ বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসলামধর্মীদের কোণঠাসা করতে থাকে। এরই মধ্যে গোবর্ধন পূজার আয়োজন। আমরা দেখলাম বিতর্কিত স্থানে আয়োজিত গোবর্ধন পূজায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এলেন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র যিনি গত বছর দিল্লিতে ধর্মীয় হিংসা ছড়ানোর ঘটনায় অভিযুক্ত। স্বভাবতই কপিল মিশ্র গোবর্ধন পূজার মঞ্চ থেকেও ঘৃণা এবং বিদ্বেষই ছড়াবেন।

আমরা বারেবারেই লক্ষ করছি যে একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষদের উপর অন্যায়, অগণতান্ত্রিক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের একতরফা আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে পিছিয়ে থাকা ধর্মের মানুষরা যেমন আরও পিছিয়ে পড়তে থাকেন; একই সঙ্গে সংকুচিত হতে থাকে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ফানুসটি। তাই গোবর্ধন পূজার আগের দিন আরেকটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটে। হরিয়ানা থেকে ২০১৮ সালে ৩৭টি স্থান নামাজ পড়ার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পূজার ঠিক আগের দিন ৮টি জায়গার নামাজ পড়ার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় প্রশাসনের তরফে। এমনকি গুরগাঁও-এর সেক্টর ৪৭, ১৮ এবং ১২এ-তে নামাজ পাঠের জন্য কোনো জায়গাই নেই। অন্তত চার কিমি দূরে গিয়ে জুম্মাবারের নামাজ পড়তে হয়। তাহলে নাজি মহম্মদের মতো ছোট ব্যবসায়ী বা দরিদ্র শ্রমিকদের পক্ষে কাজ ছেড়ে ধর্মপালন কতটা আর্থিক ক্ষতিকর এবং শারীরিক গ্লানি উৎপাদক তা সহজেই অনুমেয়। ‘মুসলিম একতা মঞ্চ’-এর সদস্য শেহজাদ খানের কথায় উঠে আসে এই ঘটনার আড়ালে থাকা আরেক সত্য যে ‘গুরুগ্রাম’-এ মসজিদের সংখ্যা এতই কমে গেছে যে বাধ্য হয়েই তাদের রাস্তায় নামাজ পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি উন্নয়নের টানে নবগঠিত, ক্রমপ্রসারণশীল গুরুগ্রামে কাজের উদ্দ্যেশ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন যে সব নির্মাণ শ্রমিকরা তাদের অধিকাংশই ইসলামধর্মী। কয়েক হাজারের বেশি শ্রমিকদের জন্য মসজিদ মাত্র দুটি। প্রার্থনার স্থান মেলেনা। পুঁজিবাদী সমাজে দরিদ্র সংখ্যালঘু শ্রমিকের জন্য ধর্মাচরণের ব্যবস্থা করার কথা ভাবতেই পারেনা হিন্দু ধর্মের ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করা বর্তমান সরকার।

একটি ঘটনা যে একটি সরকারের বিশেষ প্রবণতা বা অভিমুখকে চিনিয়ে দেয় তার প্রমাণ গুরুগ্রামের ঘটনা। কারণ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই ঘটনার রেশ টেনে উত্তরাখণ্ডে ভোট প্রচারে গিয়ে মন্তব্য করলেন প্রকাশ্য রাস্তায় নামাজ পাঠের অনুমতি আসলে মুসলিম তোষণ যা পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারের কাজ। এই কথার মধ্য দিয়ে আসলে সুকৌশলে গুরগাঁও-এর ঘটনাটিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেবার বার্তা দিলেন আমিত শাহ। যাতে ইসলামধর্মীদের ধর্মাচরণের অধিকার সংকুচিত হতে পারে গোটা দেশ জুড়ে। কিন্তু ভারতের ইতিহাস ধৈর্য সহিষ্ণুতা ও আত্মীকরণের ইতিহাস। তাই ধর্ম নির্বিশেষে উৎসব পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই আয়োজিত হয় সুদীর্ঘ কাল ধরে। কিন্তু আজ ইসলামিয়দের অবশ্য পালনীয় নামাজটুকু পড়বার জন্য ও প্রতিমুহূর্তে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হয়।

এমন তো হওয়ার কথা নয়। সংবিধানের ২৫-এ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে ভারতীয় সংবিধান তার নাগরিকদের ইচ্ছামতো প্রকাশ্যে ধর্মাচরণের অধিকার দেয়, ধর্মপালন থেকে বিরত করতে পারে না। ঘটনা আর নিয়ম এভাবেই আলাদা হয়ে যায়। ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়। বস্তুত একটি নির্দিষ্ট ধর্মকেই বারবার আক্রমণ, হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি প্রদর্শনের যে কোনো প্রয়াসকে গলা টিপে মারার চেষ্টা প্রায় প্রতিদিনের বিষয়। তাই গুরগাঁও-এর সন্তনগরেদিওয়ালি উপলক্ষ্যে এক মুসলিম ব্যবসায়ীর দেওয়া ছোট বিরিয়ানির দোকান ভেঙ্গে দেওয়া হয়। হিন্দু প্রধান এলাকায় উৎসবের সময় আমিষ খাবারের দোকান দেওয়ার জন্য হেনস্থা হতে হয়। আবার এই দিওয়ালি উপলক্ষেই ভারতবর্ষের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ফ্যাবইন্ডিয়া-র বিজ্ঞাপনে যখন 'জশন-এ-রিয়াজ' শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয় তখন সেটিও কট্টরপন্থীদের রোষানলে পড়ে। উর্দু শব্দ ব্যবহার করলে নাকি হিন্দু উৎসবের অপমান হয়। মনে পড়বে কয়েক বছর আগে জাভেদ হাবিবের বিজ্ঞাপনে মা দুর্গার সপরিবারে পূজার আগে পার্লারে যাবার ছবিটি ঘিরেও বিরাট প্রতিবাদের ঘটনা। একই অজুহাতে তানিশক-এর বিজ্ঞাপনে দেখানো এক মুসলিম মহিলার তার হিন্দু পুত্রবধূর জন্য সাধের আয়োজন হয় ‘লাভ জিহাদ’-এর প্রচার। আমরা আরও অবাক হই এটা দেখে যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছু হটে নির্মাতারা আর জিতে যায় কিছু মূর্খ অর্বাচীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানহীন মৌলবাদীর দল। প্রতিটি বিষয়েই প্রশাসন আশ্চর্যজনক ভাবে থাকে নীরব। ধর্মাচারণের স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা, শিল্পের স্বাধীনতা রক্ষার যে অধিকার ভারতীয় সংবিধান আমাদের দিয়েছে তা যদি রাষ্ট্রের তরফে থেকে রক্ষিত না হয় তাহলে ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের ভিতটি অচিরেই ভেঙ্গে পড়বে তা বলাই বাহুল্য।

ভারতবর্ষের বিশ্বাসী মানুষ, সে যে ধর্ম সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, তার ঈশ্বর আরাধনার পরিসরকে গায়ের জোরে সংকুচিত করে ভারতের সংবিধান, আদর্শকে যারা অবমাননা করে তারা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় শত্রু। জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণি নির্বিশেষে সেই সব শত্রুকে চিহ্নিত করা এবং প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভিতর দিয়ে সংবিধানের আদর্শকে টিকিয়ে রাখাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।