আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলির ফলাফল


সম্প্রতি সারা দেশে হয়ে যাওয়া কয়েকটি রাজ্যের উপনির্বাচন বিজেপির জন্য অশনি-সংকেত বহন করে এনেছে। বিশেষত হিমাচল প্রদেশ ও কর্ণাটক, যেখানে বিজেপির সরকার থাকা সত্ত্বেও বিধানসভা আসনগুলি তারা খুইয়েছে। হিমাচল প্রদেশের তিনটি হেরে যাওয়া আসনের মধ্যে একটি মাণ্ডি, আবার মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুরের নিজের জেলা। তেমনভাবেই কর্ণাটকে হেরে যাওয়া হানাগাল আসনটি সদ্য-অভিষিক্ত মুখ্যমন্ত্রী বি এস বোম্মাই-এর জেলা, যেখানে তিনি নিজে প্রচারে গিয়েছিলেন। এছাড়াও বিজেপি পর্যুদস্ত হয়েছে রাজস্থানে কংগ্রেসের কাছে, মহারাষ্ট্রের দুটি লোকসভা আসনে শিবসেনার কাছে এবং বাংলার চারটি বিধানসভা আসনে তৃণমূলের কাছে। মধ্যপ্রদেশে, যেখানে বিজেপির শাসন, সেখানেও একটি আসন হেরেছে এবং একটি জিতেছে। সান্ত্বনা বলতে আসামে পাঁচটি আসন এবং তেলেঙ্গানা ও মধ্যপ্রদেশের একটি করে আসনে জয়লাভ।

এটাই বিজেপির শেষের ঘণ্টা কী না সে বিষয়ে এখন থেকে অনুমান করা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কারণ পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের এখনো আড়াই বছর দেরি, যা অনেকটা সময়। দ্বিতীয়ত, উপনির্বাচন বেশিরভাগই হয় স্থানীয় ইস্যুতে। সেক্ষেত্রে রান্নার গ্যাসের দাম, পেট্রল ডিজেলের মুল্যবৃদ্ধি, কৃষি বিল - এগুলো তো বটেই, স্থানীয় স্তরেও অনেক কিছু ফ্যাক্টর থাকতেই পারে যা বিজেপির বিরুদ্ধে গেছে। কিন্তু যেটা লক্ষ্যণীয় তা হল, উপনির্বাচনে সাধারণত প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া থাকে না, কারণ সেখানে সরকার পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও হিমাচল ও কর্ণাটকের ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে বিজেপির বিরুদ্ধে সাধারণের ক্ষোভ কোন জায়গায় গিয়েছে, যেখানে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর জেলাতেই শাসক দল হেরে যাচ্ছে। পরিস্থিতি বিজেপির জন্য উদ্বেগজনক তো বটেই, নাহলে ফলাফল সামনে আসার পর তড়িঘড়ি পেট্রল ডিজেলের দাম কমাতে হয় না। সামনেই উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন, যেখানে যোগী আদিত্যনাথ সম্ভবত সর্বকালের অপদার্থতম মুখ্যমন্ত্রীত্বের রেকর্ড তৈরি করেছেন। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে সমাজবাদী পার্টি। আর এটা পরীক্ষিত সত্য যে উত্তরপ্রদেশ যার, দিল্লির তখত তার। সেক্ষেত্রে এই উপনির্বাচনগুলোর হার উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে বিপদ-ঘণ্টা বাজিয়ে তুলছে। অবশ্য বিরোধীদের ঐক্য, সঠিক রাজনীতির রূপায়ণ, নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা কমিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া, এরকম অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে, কংগ্রেস ও আঞ্চলিক পার্টিগুলোর ওপর যারা নির্ভরশীল।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আবার অন্যরকম, কারণ এখানে ত্রিমুখী, আবার কোথাও চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। চারটি আসনেই তৃণমূল কংগ্রেস জিতবে সেটা প্রত্যাশিত, কারণ বিজেপির যে তথাকথিত হাওয়া বাংলায় উঠেছিল ভোটের পরে তার চিহ্নমাত্র নেই, বরং দল ভাঙার হিড়িক উঠেছে। কিন্তু গুরূত্বপূর্ণ ব্যাপার, যেটা বামেদের জন্য, তা হল শান্তিপুর কেন্দ্রের ফলাফল। মাত্র ছয় মাস আগে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামেরা এখানে ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার জোট না করে পেয়েছে ২০ শতাংশ ভোট। প্রাপ্ত ভোট বেড়েছে প্রায় তিরিশ হাজার। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিজেপির সঙ্গে তাদের প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য মাত্র ৭,০০০। এবার সংগতভাবেই প্রশ্ন ওঠে, জোট করে লাভ কী আছে যেখানে ভোট এত কমে যায়? বস্তুত প্রথম থেকেই এই জোটের রাজনীতির বিরোধিতা করে আসা হয়েছিল, এবং বারবার বলা হয়েছিল যে নীতিগত দিক ছেড়ে দিলেও বাংলায় কংগ্রেস একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। তাদের সঙ্গে জোট করে কোনো লাভ নেই। সেটাই এখানে দেখা যাচ্ছে যে বহু মানুষ কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে ক্ষুব্ধ হয়ে বামেদের ভোট দেননি, আবার সেই ভোট ফিরে এসেছে জোট ভেঙে যেতেই। উল্টোদিকে জোটপন্থীরা এই প্রশ্ন করতেই পারেন যে খড়দহতে তাহলে জোট ভাঙার পর ভোট না বেড়ে কমে গেল কেন? এর উত্তর নানাবিধ হতে পারে, স্থানীয় ফ্যাক্টর, প্রার্থীর ভাবমূর্তি ইত্যাদি। কিন্তু জোট করেও যেখানে দুটি আসনেই শোচনীয় হার হয়েছিল, সেখানে জোট ভেঙে যদি একটি আসনে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভোট বৃদ্ধি হয়, তাহলে সেদিকেই স্বাভাবিকভাবে বেশি মনোযোগ পড়বে। দুঃখের ব্যাপার, বাংলার বামেরা, মূলত সিপিআই(এম) এখনো এ প্রশ্নে দিশাহীন। যখন সীতারাম ইয়েচুরি বলছেন, যে ভোটের পরেই জোট শেষ, তখন আবার তাঁরা কর্পোরেশন ও পুর নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতায় যাচ্ছেন। নিজের পায়ে হাঁটতে ভয় পায় শিশুরা। শিশুসুলভ এই সিদ্ধান্তগুলি, নাকি একে সুবিধাবাদ বলা হবে জানি না, আদতে বামেদের ক্ষতিই করবে। আর বামফ্রন্টের বাকি শরিকরা আপাতত রাজ্যে ১-২ শতাংশ ভোট পাচ্ছেন, দিনহাটা এবং গোসাবার উপনির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট প্রমাণ করছে যে বামফ্রন্ট শরিকদের মানুষ আর কোনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে না। এই পরিস্থিতিতে বামপন্থীরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট এবং বামফ্রন্টের পুরোনো রেকর্ড বাজাবেন, নাকি একটি প্রকৃত আন্দোলনমুখী বামশক্তি নির্মাণে নিজেদের নিয়োজিত করবেন এই প্রশ্নের উপর রাজ্যের বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।

আবার ফেরা যাক বিজেপির প্রসঙ্গে। বাংলা ছিল তাদের যুদ্ধজয়ের শেষ সীমান্ত, যেখান থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। তারপর তারা দুর্বল হয়েই চলেছে ক্রমাগত। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো, আর সম্ভবত গুজরাত, এই দুই বাদ দিলে এমন কোনো রাজ্য নেই যেখানে বিজেপি নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। আর বিজেপি দুর্বল হলে জোটসঙ্গীরা কেমন আচরণ করবে, নীতিশ কুমার হন বা নবীন পট্টনায়েক, সে বিষয়েও কেউ জানে না। আবারো যেটা বলার, এই ফলাফল মানেই বিজেপি কেন্দ্রে হারতে চলেছে ২০২৪-এ, এমনটা মোটেও নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা যে তারা হারিয়েছে সেটা নিশ্চিন্তে বলা যায়। এবার, এই ক্ষয় নিজে থেকে বাড়বে না, একে মারণ আঘাত দিতে দরকার কৌশলী বিরোধী রাজনীতি ও আঞ্চলিক দলগুলির বোঝাপড়া। সেই প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু হওয়া দরকার।