আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

পেট্রো-পণ্য ও শাসকের ঠাট্টা


ক্ষমতাবান রাজারা তাদের দেশের প্রজাদের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ঠাট্টা করতেন, যা তাদের আত্মম্ভরীতা এবং প্রজাদের জীবন সম্পর্কে উদাসীনতাকেই প্রকট করে। ফ্রান্সের সেই বিখ্যাত রানি যিনি প্রজাদের রুটির অভাবে কেক খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি আজও বিখ্যাত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, রাজা নেই কিন্তু শাসকের ঠাট্টা রয়ে গেছে। বিগত সাত বছর ধরে মোদী সরকার দেশের মানুষের সঙ্গে একের পর এক নিষ্ঠুর ঠাট্টা করে চলেছে। নোট বন্দীর নামে গোটা দেশের মানুষকে লাইনে দাঁড় করানো দিয়ে যার সূত্রপাত, নির্দয় লকডাউন পেরিয়ে তার নতুন সংস্করণ পাওয়া গেল দিপাবলীর ঠিক আগে। অক্টোবরের শেষে বিভিন্ন রাজ্যের উপনির্বাচনে বেশ কিছু আসনে হেরে গিয়ে বিজেপি তথা ভারত সরকারের মনে হল যে পেট্রো-পণ্যের দাম সমস্ত রেকর্ড ভেঙে সার্গেই বুবকার মতন নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে। ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১০০ টাকার বেশি, পেট্রোলের দাম ১১০ টাকা পেরিয়ে গিয়েছে। হিন্দুত্বের আগুনে রান্না করা সম্ভব নয়, আর রান্নার গ্যাসের দাম ১০০০ টাকার কাছাকাছি হওয়াতে গৃহস্থ্য পরিবারের মাথায় হাত। মুসলমানদের বিরুদ্ধে লোক খেপিয়েও উপনির্বাচনে হারার পরে তাই মোদীজি দেশের মানুষকে দীপাবলির উপহার দিলেন পেট্রোল ও ডিজেলের উপর কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক যথাক্রমে লিটার প্রতি ৫ ও ১০ টাকা কমিয়ে। মোদীর ভৃত্য সংবাদমাধ্যম সাধু সাধু রব তুলল গোটা দেশে। কিন্তু জনগণের কী লাভ হল?

ধরুন আপনার কাছ থেকে কেউ বেশ কিছু পরিমাণ টাকা নিয়ে নিল। তারপরে একদিন আপনাকে এসে বলল যে, এই নাও তোমাকে ১০ টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছি, এটাই আমার দীপাবলির উপহার। এতে আপনি যতটা খুশি হবেন, কেন্দ্রীয় সরকারের পেট্রো-পণ্যের দাম কমানোর নীতিতে আপনার ঠিক ততটাই খুশি হওয়া উচিত।

মোদী যখন ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসেন তখন আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম বর্তমানের তুলনায় বেশি ছিল। কিন্তু এক অদ্ভুত জাদুতে বর্তমানে তেলের দাম কম হওয়া সত্ত্বেও ভারতের জনগণকে বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে। এর কারণ পেট্রোল এবং ডিজেলের উপর কেন্দ্রীয় সরকার একের পর উৎপাদন শুল্ক চাপিয়েছে, যার ফলে অতিমারির সময় আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম শূন্যের কাছে চলে যাওয়ার পরেও ভারতের জনগণকে প্রচুর টাকা দামে পেট্রোল-ডিজেল কিনতে হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট কর কমিয়েছে, যার ফলে ভারতের পুঁজিপতিদের করের বোঝা কমেছে। একদিকে পুঁজিপতিদের কর ছাড় দেওয়া হয়েছে আর অন্যদিকে পেট্রোল ও ডিজেলের উপর করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবর্ষে, অর্থাৎ অতিমারি শুরু হওয়ার আগে, কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট করের খাতে মোট সংগ্রহ করে ৫,৫৬,৮৭৬ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ সালে (অতিমারির বছর) কমে হয় ৪,৫৭,১৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অতিমারি-জনিত লকডাউন এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কর্পোরেট কর সংগ্রহ কমে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু এই একই সময় কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক, যার মূল অংশ পেট্রো-পণ্যের করের মাধ্যমে আসে, তার সংগ্রহ ২,৩৯,৪৫২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয় ৩,৮৯,৬৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ কর্পোরেটদের কর সংগ্রহ কমলেও সাধারণ মানুষের উপর চাপানো উৎপাদন শুল্ক বাড়ে ১৫,০০০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে, সেপ্টেম্বর মাস অবধি, উৎপাদন শুল্ক কমানোর আগে এই খাতে সরকার সংগ্রহ করেছে ১,৭১,৬৪৮ কোটি টাকা যা আগের বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় প্রায় ৪৩,০০০ কোটি টাকা বেশি।

এই বিপুল পরিমাণ করের টাকা সাধারণ মানুষের পকেট কেটে আদায় করার পরে মোদী সরকার দাম কমিয়ে মানুষকে দীপাবলি উপহার দিচ্ছে। উৎপাদন শুল্ক কমানোর পরেও কলকাতায় প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম প্রায় ১০৫ টাকা আর ডিজেলের দাম প্রায় ৯০ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ দামের কারণ কিন্তু পরিবর্তন হয়নি। উৎপাদন শুল্ক কমানোর পরেও বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোলের প্রতি লিটারে কর পায় ২৭ টাকা ৯০ পয়সা এবং ডিজেলের প্রতি লিটারে ২১ টাকা ৮০ পয়সা। তবে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার নয়, রাজ্য সরকারগুলিও পেট্রোল-ডিজেলের উপর বিক্রয় কর চাপিয়ে টাকা সংগ্রহ করে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতি লিটার পেট্রোলে কর সংগ্রহ করে ২৫ টাকা মত আর ডিজেলে প্রায় ১৫ টাকা। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দুইয়ে মিলে প্রতি লিটার পেট্রোলে কর সংগ্রহ করে প্রায় ৫৩ টাকা, আর ডিজেলে প্রায় ৩৭ টাকা। অর্থাৎ পেট্রোল ও ডিজেলের দামের প্রায় ৫০ শতাংশ আসলে সরকারের কর। অতএব দাম কমানোর জন্য পেট্রোল ও ডিজেলে করের বোঝা কমানো একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু মোদী সরকার যৎসামান্য উৎপাদন শুল্ক কমিয়ে যেই কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন তা বিভ্রান্তিকর এবং মানুষের সঙ্গে এক নিদারুণ ঠাট্টা।

আসল বিষয়টি হল কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার যৎসামান্য তেলের দাম কমালেই এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না। বিজেপি কিছু টাকা কর কমিয়ে এখন বিরোধী রাজ্যগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করছে ভ্যাট বা বিক্রয় কর কমানোর, যা রাজ্য সরকারগুলি সংগ্রহ করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘোষণা করেছে তারা এই করের হার কমাবে না। অন্যদিকে বিজেপি এমনকি বামপন্থীরাও এই দাবি তুলছে যে পশ্চিমবঙ্গে ভ্যাটের হার কমাতে হবে, যদিও কেরালা সরকার ঘোষণা করেছে তারা এই হার কমাবে না। আমাদের জানা নেই রাজ্যের বামপন্থীরা কেরালা সরকারকে কী পরামর্শ দেবে। কিন্তু বিষয়টির সমাধান এই সংকীর্ণ রাজনীতির অন্ধগুলিতে পাওয়া যাবে না।

জিএসটি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে রাজ্য সরকারগুলির নিজের নীতি অনুসারে রাজস্ব আদায় করার ক্ষমতা চলে গিয়েছে, কারণ গোটা দেশে একই হারে জিএসটি আদায় হয়। ব্যতিক্রম পেট্রোল-ডিজেল। যেহেতু পেট্রোল-ডিজেলের চাহিদা দাম বাড়ানোর ফলে কমে না, অতএব রাজ্য ও কেন্দ্র নির্বিশেষে এই দুটি পণ্যের উপরে করের হার চাপানো হয় বেশি রাজস্ব আদায় করার জন্য। অতিমারি পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারগুলির খরচ প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে, কিন্তু আয় কমেনি। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির প্রাপ্য জিএসটি ক্ষতিপূরণ দেয়নি। বিভিন্ন সেস চাপিয়ে সংগৃহীত করের উপরে রাজ্য সরকারগুলির হকের টাকা দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারগুলিকে ভ্যাট কমাতে বাধ্য করা আসলে বিজেপি-র একটি রাজনৈতিক চাল ছাড়া আর কিছু নয়। রাজনৈতিক কানাগলিতে আবারও বিজেপি চেষ্টা করছে বিষয়টির আসল সমাধানকে লোকচক্ষু থেকে সরিয়ে দিতে। দুর্ভাগ্যজনক হল এই যে বিরোধীরাও বিজেপি-র সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে।

যেই দাবি জোরালোভাবে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির তোলা উচিত তা হল দুটি। প্রথমত, পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটি-র আওতায় আনা। জিএসটি নিয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে এটি-ই এখন ভারতের পণ্য কর ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ। জিএসটি-র নীতি অনুযায়ী কোনো পণ্যের উপরেই ২৮ শতাংশের বেশি কর আদায় করা যাবে না, যেখানে পেট্রোল-ডিজেলের উপর বর্তমানে প্রায় ১০০ শতাংশ কর লাগানো হয়েছে, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার মিলে। অতএব জিএসটি-র আওতায় আনলে পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমতে বাধ্য। যা রাজস্ব সংগ্রহ হবে তার থেকে রাজ্যগুলি তাদের অংশ পেয়ে যাবে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারগুলির মধ্যে কে কত কর বাড়াতে বা কমাতে পারে তা নিয়ে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতারও ইতি হবে।

কিন্তু শুধু এইটুকু বললে সবটা বলা হয় না। এর সঙ্গেই প্রয়োজন এই দাবি তোলার যে কর্পোরেটদের এবং ধনীদের উপরে করের হার বাড়াতে হবে। সম্পত্তি করের প্রবর্তন করা দরকার। আদানী-আম্বানিদের সম্পত্তি কোটি-কোটি টাকা বাড়লেও, আমাদের দেশে তারা এক পয়সাও সম্পত্তি কর দেন না। সরকার তাদের আয়কর অথবা কর্পোরেট কর কমাচ্ছে, বাড়াচ্ছে শুধু সাধারণ মানুষের উপরে আরোপিত কর। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার। তাই একদিকে, পেট্রোল-ডিজেলকে জিএসটি-র আওতায় আনা, অন্যদিকে কর্পোরেট কর বাড়িয়ে তথা সম্পত্তি কর চাপিয়ে বাড়তি টাকা আদায় করার মাধ্যমেই সাধারণ মানুষকে সুরাহা দেওয়া সম্ভব। মোদী এবং মিডিয়ার চমকের বাইরে বেরিয়ে এই প্রশ্নগুলি নিয়ে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা বামপন্থী ও প্রগতিশীল শক্তির প্রধান কাজ।