আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

এক শরণার্থী লেখকের নোবেল জয়

গৌতম সরকার




মাত্র আঠারো বছর বয়সে উদ্বাস্তু এক যুবক ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রেখেছিল, নিজের দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও আরব বংশোদ্ভূত হওয়ার অপরাধে অত্যাচার আর গণহত্যার ভয়ে স্বদেশে ফিরতে পারেনি, সেই মানুষটি সারাজীবন শিকড়হীন, ভূমিহীন, শরণার্থীদের কথাই লিখে গেলেন। বেশ কয়েকবার তাঁর উপন্যাস ‘বুকার’ থেকে শুরু করে ‘কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ’, ‘লস এঞ্জেলস টাইমস বুক প্রাইজ’ ইত্যাদি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে, কিন্তু পুরস্কার শিকে ছেঁড়েনি। ব্যক্তিগত জীবনে প্রত্যাশা বিমুখ মানুষটি বন্ধুবান্ধব, শুভান্যুধায়ীদের কাছ থেকে খবরটি পেয়ে বিশ্বাস করেননি, কিছুটা বিরক্তবোধ করেছিলেন। অবশেষে 'নোবেল কমিটি'-র মুখ থেকে খবরটি শুনে তাঁর সংযমী প্রতিক্রিয়া, "এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমি নিজেকে ভাগ্যবান এবং সম্মানিত বোধ করছি। আমি এই পুরস্কার আমার সমস্ত পাঠক এবং পৃথিবীর সমস্ত শরণার্থীদের জন্য উৎসর্গ করতে চাই।" এই স্বীকারোক্তি যাঁর তিনি হলেন ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ী ৭৩ বছরের তানজানিয়ার কথাসাহিত্যিক আব্দুলরজাক গুরনাহ্। পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমির বক্তব্য, 'ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন সংগ্রাম এবং একদিকে ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি আর অন্যদিকে মহাদেশীয় পরিসরে চাপা পড়ে যাওয়া উদ্বাস্তু মানুষদের কন্ঠস্বরকে সাহস এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরার জন্য তাঁর এই পুরস্কার।'

আব্দুলরজাকের জন্ম ১৯৪৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবার দ্বীপে। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে শরণার্থী হয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। যদিও ১৯৬৩ সালে তাঁর দেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়, কিন্তু স্বাধীন দেশে শুরু হয় আরেক নির্যাতন। সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আবেইদ কারুমের নেতৃত্বে চলতে থাকে আরব বংশোদ্ভূত মুসলমানদের নিধন এবং নিপীড়ন। আব্দুলরাজাকের পরিবারও এই হিংসার লক্ষ্য হয়ে উঠলে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। এরপর নিজের দেশে ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল ১৯৮৪ সাল। ভূমিচ্যুত হওয়ার এই যন্ত্রণাই তাঁকে একুশ বছর বয়সে প্রতিবাদী কলম ধরতে অনুপ্রাণিত করেছিল। মাতৃভাষা সোয়াহিলি হলেও, বিশ্বের আরও বেশি মানুষের কাছে নিজের রাগ, যন্ত্রণা, প্রতিবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্যে ইংরেজি ভাষাকে বেছে নিলেন। সারাজীবনে লিখলেন দশটি উপন্যাস আর কিছু ছোটগল্প, যেগুলি সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি-র খবরে প্রকাশ- আব্দুলরজাক গুরনাহ্-র সামগ্রিক লেখায় ফুটে উঠেছে উপনিবেশবাদের অভিশাপ এবং উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণা। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন 'ক্যান্টারবেরি ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট'-এর ইংরেজি এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অধ্যাপক। একদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে ক্লাসরুমে ঔপনিবেশিক অত্যাচার ও দুর্দশা বর্ণিত সাহিত্য আলোচনায় নিজেকে উজাড় করে দিতেন, অন্যদিকে নিজে লিখে চললেন বাস্তুচ্যুত মানুষের যন্ত্রণা ও অত্যাচারের কাহিনি, যে কাহিনির বীররসে নিজের এবং নিজের পরিবারের বেদনা, কষ্ট, যন্ত্রণা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। আব্দুলরজাক সাহিত্যের ধ্রুপদী উৎকর্ষতার পিছনে ছুটে সাহিত্য বোদ্ধাদের হাততালি পাওয়ার কখনও চেষ্টা করেননি, বরঞ্চ ইংরেজি সাহিত্যের মূলধারা থেকে বেরিয়ে এসে, উপনিবেশ-উত্তর চেতনা, বিশ্বাস এবং প্রচারকেই কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতিতেই তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে একের পর এক চমকে দেওয়ার মত উপন্যাস, 'মেমরি অব ডিপার্চার', 'পিলগ্রিমস ওয়ে', 'প্যারাডাইস', 'ডেসারশন' ইত্যাদি।

নোবেল কমিটির সাহিত্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘'আব্দুলরজাক গুরনাহ'-র সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সরলতা বিমুখতা উল্লেখের দাবি রাখে।' সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স অলিসন বলেছেন, "তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু প্রথাগত ছাঁচে ফেলা কাঠামোকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে 'নানা ভাষা, নানা মত, নানা সংস্কৃতি' সম্পন্ন পূর্ব আফ্রিকার বহু অজানা, অচেনা গল্প আমাদেরকে শুনিয়েছে।" তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো সবসময়ই সংস্কৃতি কিংবা মহাদেশ, যে জীবন ছিল কিংবা যে জীবন আসতে চলেছে তার মধ্যে নিহিত বিচ্ছেদ বা ফাঁকের সংকটে ভুগেছে। সেই বিচ্ছেদ বা অপূর্ণতা বা হতাশার ক্লান্তিহীন গল্পগুলি লিখিত রূপ পেয়েছে একের পর এক ছোটগল্পে, উপন্যাসে।

গুরনাহের নিজের কথায় - ‘আমি যখন ইংল্যান্ডে এলাম, দেখলাম আমি বা আমরা শুধু একক নয়, পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ তাদের দেশ হারিয়ে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের আশ্রয়প্রার্থী। পৃথিবী দিন দিন আরও হিংসাত্মক হয়ে উঠছে, তার সঙ্গে শরণার্থীদের চাপ বাড়ছে এই সমস্ত নিরাপদ দেশগুলোর ওপর’। ২০১৬ সালে একটি ইন্টারভিউয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "আপনি নিজেকে একজন উত্তর-ঔপনিবেশিক না বিশ্ব সাহিত্যের প্রথাগত লেখক, কোনটি বলে মনে করেন?” বলাবাহুল্য, প্রশ্নটিতে উনি খুশি হননি, উত্তরে বলেন, "আমি আমার লেখক নামের আগে বা পরে কোনোরকমের বিশেষণ ব্যবহারের পক্ষপাতী নই। সত্যি কথা বলতে কি, আমার নিজের নাম ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।" ১৯৮৬ সালে ওলে সোয়েনকার পর আব্দুলরজাকই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান লেখক যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। শুধু কালো মানুষের হিসেব ধরলে ১৯৯৩ সালে টনি মরিসন এই পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার আঠাশ বছর আরেক কালো মানুষ গুরনাহ এই সম্মানে ভূষিত হলেন।

গুরনাহের লেখায় উঠে এসেছে কিভাবে শিকড়হীন মানুষগুলোর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ইউরোপ ও আরব দেশগুলিতে দাস ব্যবসা রমরমিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলির সাবেক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংকটও লেখার অন্যতম বিষয়। তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন তথাকথিত বিশ্বায়ন শুরুর বহু আগেই এই সমস্ত আফ্রিকান দেশগুলিতে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির আমদানি ঘটে গিয়েছিল। প্রতিটি উপন্যাসেই তাঁর সন্ধান চলতেই থাকে। দেশ-কাল, সমাজব্যবস্থা, সামাজিক এবং মানবিক সম্পর্কগুলোকে বারবার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, মানুষের বিচার শালায় তাদের বিচার হয়, শাস্তি হয়, আসলে কিছুই হয়না; আর সেখানেই লুকিয়ে থাকে পাঠকদের জন্য এক আকাশ অতৃপ্তি, পড়তে পড়তে একটা সময় দম বন্ধ হয়ে ওঠে, দুই মলাটের মাঝে চাপা পড়ে যায় বহু রাগ, ক্ষোভ, হতাশা।

প্রথম উপন্যাস, 'মেমরি অব ডিপার্চার' হাসান নামের একটি ছেলের গল্প। হাসান একজন আরব বালক যে নিজভূমে বন্দি দশা এবং রক্ষণশীল শাসকদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়, এবং নিজের ক্ষমতা আর অধ্যবসায়ের জোরে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত দেশের বাসিন্দা হয়। যদিও গল্পটি এতটা সরলীকৃত করে দিলে লেখক এবং সৃষ্টির যথাযথ বিচার করা হয়না। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে লেখক তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লব ভঙ্গের কারণ ও ফলাফলকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছেন। আমরা সেই স্বপ্নভঙ্গের সাথে একাত্ম হয়ে পড়ি কারণ সেই স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী ছিল এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশের সাথে আমাদের দেশ ভারতবর্ষও।

তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস, 'পিলগ্রমস ওয়ে' প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। ডেভিড নামের ছেলেটি জীবনের প্রতি সব বিশ্বাস এবং ভরসা হারিয়ে নিজের মধ্যেই আশ্রয় খোঁজে। সে লিখে চলে একের পর এক চিঠি, কাকে লেখে নিজেই জানেনা। সেই চিঠি তাকে ভগ্ন অতীত, ঘুণ ধরা বর্তমানকে মেনে নিতে শেখায়, জীবনে অজস্র না পাওয়ার মধ্যেও বেঁচে থাকার কৌশল শেখায়। গোটা উপন্যাস জুড়ে মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে থাকে সম্পর্কগুলি, তার মধ্যে দিয়ে যখন ডেভিডের যাত্রা শুরু হয় তখন বাল্য স্মৃতি, আত্মীয়তা, সামাজিক ও মানবিক সম্পর্কগুলি সহজিয়া আবেদনে সাড়া না দিয়ে ক্রমশ জটিল ও অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।

এরপর আব্দুলরজাক লিখলেন 'ডট্টি'; একটি যুবতী মেয়ের গল্প। এটিও মাটির গন্ধ মাখা ভূমিচ্যুত মানুষের গল্প। এখানে কাহিনির মূল চরিত্র মেয়েটির চোখে থাকবে বাস্তবের সাদা-কালোর পরিবর্তে গোলাপি নেশার চশমা। মেয়েটির কোনোদিন জানার প্রয়োজন হয়নি বিদেশ বিভুঁইয়ে পায়ের নিচে একখন্ড শক্ত জমি পেতে তার পূর্বপুরুষদের কতটা কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল।

যে উপন্যাস গুরনাহকে আবিশ্ব খ্যাতি এনে দিয়েছিল সেটি হল ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত চতুর্থ উপন্যাস, প্যারাডাইস। এই উপন্যাসটি ওই বছরেই 'বুকার প্রাইজ'-এর চূড়ান্ত তালিকায় মনোনীত হয়েছিল। উপন্যাসটি হল একটি আফ্রিকান ছেলের গল্প, নাম ইউসুফ। নিজভূমি ছেড়ে এক আত্মীয়ের সাথে অন্য দেশে গিয়ে উপস্থিত হয় ছেলেটি, জানতেই পারেনা অগোচরে কখন তার বাবা তাকে বিক্রি করে দিয়েছে। এই উপন্যাসে একই সঙ্গে পূর্ব আফ্রিকান সমাজের ভালোবাসা এবং দুঃখের ছবি তুলে ধরেছেন লেখক। এটি ইউসুফের বয়স বাড়ার গল্প। এই উপন্যাসেই প্রথম ঔপনিবেশিক পটচিত্রের সীমানা অতিক্রম করে গুরনাহ পূরাণকথার সাথে ঘটমান বর্তমানের সংলাপকে জুড়ে দেন। গোটা উপন্যাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে জার্মান সেনাদের অত্যাচারের কথা। তারা কীভাবে জোর করে ভয় দেখিয়ে আফ্রিকান পুরুষদের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করে তাদের নিজ দেশ এবং নিজের দেশের মানুষদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করে সেই মর্মন্তুদ কাহিনী। ইউসুফের অসহায়তা এবং আত্মগ্লানি পাঠক প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করবেন ২৫৬ পাতার বইটি জুড়ে।

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হল 'অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স'। এই উপন্যাসে নীরবতাকে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসাবে দেখিয়েছেন লেখক। এটিও একটি আফ্রিকান যুবকের গল্প; যাকে একদিন অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু গল্পের আসল টুইস্টটা লেখক সঞ্চয় করে রেখেছেন সেই যুবক যখন পরিণত বয়সে আপাত স্থিতিশীল স্বদেশে এসে উপলব্ধি করলেন, আসলে কিছুই ঠিক নেই, গোটা দেশ জুড়ে মেকি সৃষ্টির কাঠামোয় ধ্বংসের চিহ্নগুলো চাপা দেওয়ার অক্ষম চেষ্টা করা হয়েছে।

এরপর তিনি লিখলেন আরেকটি সাড়া জাগানো উপন্যাস, 'বাই দ্য সি'। এই বইটিও বুকার প্রাইজের জন্য মনোনয়নের প্রাথমিক তালিকায় ছিল। এই গল্পে ইংল্যান্ডের এক শহরে সালেহ ওমর এবং লতিফ মেহমুদের দৈবাৎ সাক্ষাৎ ঘটে যায়। পরে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় তারা পরস্পরে আত্মীয়তা সূত্রে যুক্ত। তাঁদের মিলন গল্পের খোলস খুলতে খুলতে পাঠককে এক নির্মম আবেগ কাহিনির সামিল করে তুলবে।

এরপর লেখা হল 'ডেসারশন', ২০০৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে আব্দুলরজাক গুরনাহ্ সাম্রাজ্যবাদী রোমান্সের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী এক প্রেমকাহিনি বর্ণনা করেছেন। হাসান আলির জীবন রক্ষা পায় প্রাচ্য মনোভাবাপন্ন ইউরোপিয়ান মার্টিন পিয়ার্সের চেষ্টায়। তাঁদের পরিচয় আস্তে আস্তে গভীরতা পায়, একসময় সম্পর্কের সেই গভীরতা পিয়ার্স এবং হাসান আলীর বোনের মধ্যে এক প্রেমজ সম্পর্কের জন্ম দেয়, এবং আস্তে আস্তে সেই সম্পর্ক এক মহান প্রেমের গাথা সৃষ্টি করে। কিন্তু তাই বলে উপন্যাসের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-পরিসীমা জুড়ে লেখক কখনোই 'ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়' গোছের ভ্রান্ত চলচ্ছবিকে পাত্তা দেননি। সেখানেও বহু কাঁকর বিছানো পথ পেরোতে হয়, ধু ধু মরুর শুষ্কতাও অস্বীকার করা যায়না। মরুদ্যানের দেখা পাওয়ার আশায় লেখকের সাথে পাঠকেরও পথচলা চলতেই থাকে।

আব্দুলরজাকের লেখা অষ্টম উপন্যাসটি হল 'দ্য লাস্ট গিফ্ট'। আব্বাসের এতদিনকার অন্ধকারে ঢেকে রাখা অতীত ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। তিনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন, আর আব্বার অসুস্থতার খবর পেয়ে বাইরে থাকা দুই সন্তান বাড়িতে চলে আসে। উপন্যাসের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে শয্যাশায়ী এবং বাকশক্তিরহিত পিতা কি উপায়ে তাঁর বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা অতীত তাঁর সন্তানদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছেন তার মধ্যে।

'গ্রাভেল হার্ট' হল নবম উপন্যাস। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস জুড়ে নির্বাসন, বাস্তুচ্যুতি এবং বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি। আধুনিক জীবনের আড়ে-দৈর্ঘ্যে টাঙানো মেকি পর্দার আড়ালে জীবনের আসল সংঘাত এবং ক্ষমতার আস্ফালন ফালা ফালা করে দেয় পাঠকের অনুভূতি ও অনুধাবন।

এরপর ২০২০ সালে তাঁর লেখনীতে উঠে এল অন্যতম শ্ৰেষ্ঠ উপন্যাস 'আফটার লাইভস'। উপনিবেশ শাসনের অধীনে খণ্ডিত আফ্রিকায় ইলিয়াস একদিন জার্মান ঔপনিবেশিক সৈন্যদের দ্বারা চুরি হয়ে গেল। বহু বছর পর নারীর টান, শিকড়ের টানে জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে ইলিয়াস তাঁর বাবা-মায়ের কোনো সন্ধান পেল না, আর প্রিয় বড় বোন কতকাল আগে বাজারদরে বিক্রি হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে উত্তর ঔপনিবেশিক চিন্তকদের মধ্যে গুরনাহ্ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর নিজের কথায়, "এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আবিশ্ব জুড়ে নতুন করে শরণার্থী এবং ঔপনিবেশিকতার বিপদ নিয়ে আলোচনা হবে”৷ তিনি বলেন, "পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিদিন নিত্যনতুন শরণার্থী তৈরি হচ্ছে। কেউ জীবন বাঁচাতে, কেউ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন, কেউ আবার অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে গিয়ে তৈরি করছেন নতুন সংকট”। এক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের নোবেল জয় একদিকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য আমেরিকার অভিবাসী সংকট থেকে শুরু করে বিশ্ব জুড়ে সবলের হাতে দুর্বলের নিষ্পেশন সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেওয়া হবে বলে আশায় সারা বিশ্বের আক্রান্ত মানুষেরা।

গুরনাহের লেখায় কিছুই স্থবির নয়, সবকিছুই পরিবর্তনশীল। স্মৃতি, স্বীকৃতি, পরিচয় সময়ের সারণী বয়ে কোনও শর্ত না মেনে ক্রমশই বদলে যেতে থাকে। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একুশ বছর বয়স থেকে কলমধরা রজাক শিকড়ের খোঁজে ছুটে বেরিয়েছেন, তাঁর লেখনীর যুক্তিনিষ্ঠ বৌদ্ধিক দৃঢ়তা জীবনকে কঠিন ভাষায় ব্যক্ত করেছে। তাঁর এই যে নিরন্তর ছুটে চলা চলতেই থাকে, কারণ শেষ কথা বলা এখনও বাকি রয়ে গেছে। একজন সাহিত্য বিশ্লেষক এবং ২০২১ সালের 'কোস্টা প্রাইজ জাজ' মায়া জাগ্গি গুরনাহ সম্পর্কে বলেছেন, 'তিনি একাধারে একজন বলিষ্ঠ এবং অন্যধারে একজন সংবেদনশীল লেখক। প্রতিটি কাহিনি নিপুণ দক্ষতায় নিজের অভিজ্ঞতা আর শৈলীগুনে ফুটিয়ে তুলেছেন। তদানীন্তন ব্রিটিশ এবং জার্মান অধিকৃত উপনিবেশগুলির মানুষের কষ্ট, অপমান, যন্ত্রণা এবং তথাকথিত সাদা মানুষের হাতে কালো মানুষের নির্যাতন ও হয়রানির ছবি ফুটে ওঠে একটির পর একটি কাহিনিতে।'

আব্দুলরজাক গুরনাহ তাঁর লেখায় কৌতুক এবং ভয়ংকরতাকে সুন্দরভাবে সামঞ্জস্য দিয়েছেন। ফলে পড়তে পড়তে পাঠকের কখনও একঘেয়েমি আসেনা। যদিও অনেকের মতেই এই কথাসাহিত্যিকের সম্মান ও স্বীকৃতি অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল। আমরা সাধারণ সাহিত্যমোদীরা খুশি। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকে আমাদের ড্রইংরুমে পৌঁছে দেবে, আর আমাদের চোখের সামনে মনের গভীরে সাহিত্যের এক নতুন দুনিয়া খুলে যাবে, এটাই আমাদের প্রাপ্তি।