আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

রামায়ণের কথকতা

বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী


রামায়ণের কতরকম সংস্করণ? উত্তরটা একটু গোলমেলে। বিদ্বানরা হিসাব কষেছেন (কীভাবে গোণা হল তার উপর নির্ভর করে), প্রায় তিনশো রকম। এই হিসাবটা প্রথম করেছিলেন ক্যামিল বার্কে, ১৯৫০ সালে। বইটা প্রকাশ হয়েছিল হিন্দিতে। এরপর হিসেবটা করেন রামানুজন, ১৯৯১ সালে। প্রবন্ধের নাম, ‘দ্য থ্রি হান্ড্রেড রামায়াণাজ’।প্রবন্ধটা এককালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস পাঠক্রমে পড়ান হত। ২০১১ সালে তুলে নেওয়া হয়। আমি এই প্রবন্ধের শিরোনামে ‘কথকতা’ শব্দটা ব্যবহার করেছি রামানুজনকে অনুসরণ করে। উনি বলেছিলেন যে, সংস্করণ শব্দটা তখনি ব্যবহার করা যায় যখন তার কোনো অপরিবর্তনীয় মূল উৎস থাকে। রামানুজনের হিসাবে বাল্মীকি রামায়ণকেও মূল উৎস বলা যায় না। এটা তর্কসাপেক্ষ, এবং এই নিয়ে যথেষ্ট তর্ক হয়েছে, সেখানে গিয়ে লাভ নেই। রামানুজন ইংরেজি ‘টেলিং’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। আমি সেটাকেই কথকতা করে নিয়েছি, কারণ পরে লিখিতভাবে প্রকাশ হলেও (যদিও সবকটা ‘ভার্সান’ নয়), মূলত সবগুলোই ‘ওরাল ট্রাডিশন’ অর্থাৎ ‘কথিত’ পরম্পরা অনুসরণ করে।

তবে সবথেকে পুরনো ভার্সান (বা রূপক, যাই বলুন) যে বাল্মিকী রামায়ণ, এ বিষয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেননি। কথিত, যে মূল রামায়ণ লিখেছিলেন দেবর্ষি নারদ, এবং সেটাই তিনি ঋষি বাল্মিকীকে দিয়েছিলেন, যেটা 'বাল্মিকী রামায়ণ' নামে পরিচিত। বাল্মিকী রামায়ণের প্রধান কথকতা হিসাবে 'রামচরিতমানস' তো আছেই, এছাড়া উল্লেখযোগ্য হল দ্বাদশ শতাব্দীতে লেখা তামিল ভাষায় ‘রামাবতারম’, চতুর্দশ শতাব্দিতে তেলেগুতে লেখা ‘শ্রী রঙ্গনাথ রামায়ণম্‌’, এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণ কথকতা।

ভারতের বাইরে বর্মা (মিয়ান্মার), ইন্দোনেশিয়া (জাভা), মালয়েশিয়া, কাম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপিনস্‌, শ্রীলংকা, নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, চিন, ইত্যাদি দেশে বিভিন্ন রূপে রামায়ণ প্রচলিত। এগুলোর আলোচনায় পরে আসব। আপাতত এইটুকু বলব যে রামায়ণের মূল বক্তব্য শুধু লিখিত এবং কথিত ভাবে নয়, নৃত্য, গীত, চিত্র এবং স্থাপত্য, সবের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে শুধু ভারতে নয়, যেসব দেশের নাম উল্লেখ করেছি সেই সব দেশেও। কেরল এবং লাক্ষ্মাদ্বীপের মুসলমানদের ‘মাপ্পীলা’ গীত, আংকোরভাটের প্রাচীরগাত্রের চিত্র, কাম্বোডিয়া, লাওস এবং জাভার নৃত্য শৈলী এসবই উল্লেখের দাবি রাখে।

প্রচলিত ভারতীয় রামায়ণ কথকতার কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছিঃ
আধ্যাত্ম রামায়ণ - আধ্যাত্মিক রামায়ণ ব্রহ্মান্ড পুরাণের থেকে নেওয়া। অনেকে মনে করেন যে তুলসীদাসের 'রামচরিতমানস' এই আধ্যাত্মিক রামায়ণের ওপর নির্ভর করেই রচিত হয়েছিল। বাল্মিকী রামায়ণে যেমন রামের মনুষ্য চরিত্র প্রাধান্য পেয়েছে, আধ্যাত্মিক রামায়ণে প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর আধ্যাত্মিক এবং দৈবিক রূপ। বাল্মিকী রামায়ণের মত আধ্যাত্মিক রামায়ণও সপ্তকান্ডের।

বাল্মীকির লেখাবশিষ্ঠ রামায়ণ (যোগ বশিষ্ঠ) - প্রধাণতঃ রাম এবং বশিষ্ঠের মধ্যে অদ্বৈত বেদান্ত নিয়ে আলোচনা। বিভিন্ন উপাখ্যান আছে, তবে মূল রামায়ণ বিশদভাবে বলা নেই। কাশ্মীরের অভিনন্দর লেখালঘু যোগ বশিষ্ঠ এই পর্যায়তেই পড়ে। এই শৈলির আরো কথকতার মধ্যে আছে আনন্দ রামায়ণ (বাল্মীকি) যাতে রামের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, যেমন রামেশ্বরমে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির কথা বলা আছে। তবে রামের শেষ জীবনের ঘটনা এই কথকতার প্রধান উপকরণ।

অগস্ত্য রামায়ণ - অগস্ত্য মুনির লেখা আছে, তবে এর প্রচলন দক্ষিণ ভারতে বেশি। ষোল হাজার শ্লোক সম্বলিত এই কথকতায় প্রতাপভানু এবং অরিমর্দনের উপাখ্যান রয়েছে যা তুলসীদাস কৃত রামচরিতমানসেও রয়েছে (ব্রাহ্মণদের শাপে কৈকেয় দেশের রাজা সত্যকেতুর দুই পুত্র প্রতাপভানু এবং অরিমর্দন পরজন্মে রাবণ এবং কুম্ভকর্ণ হয়ে জন্মেছিলেন, এবং তাঁদের মন্ত্রী ধর্মরুচি বিভীষণ হয়ে জন্মেছিলেন), এছাড়া সাগরের (সমুদ্রের) উৎপত্তি, রামেশ্বরের শিবলিঙ্গের আবির্ভাব ইত্যাদি নানা উপাখ্যান আছে।

অদ্ভুত রামায়ণ - প্রধানতঃ সীতাকে নিয়ে। লেখক সেই বাল্মীকিই। সীতার জন্মবৃত্তান্ত বিশদভাবে বলা হয়েছে, এবং সীতার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলোচনা আছে।

মহাভারতের রামাখ্যান অংশে (বনপর্ব) রামায়ণের আলোচনা আছে। 'ভাগবতপুরাণ'-এর নবম স্কন্ধে রামায়ণের গল্প সুন্দরভাবে বলা আছে। 'বিষ্ণু পুরাণ' এবং 'অগ্নি পুরাণ'-এও রামায়ণের গল্পের স্বল্পদৈর্ঘ্য উল্লেখ পাওয়া যায়।

ফার্সী ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করিয়েছিলেন সম্রাট আকবর। আকবরের রামায়ণ লেখা শেষ হয়েছিল ১৫৮৪ সালে। প্রথমে মিথিলার ব্রাহ্মণরা সংস্কৃত থেকে অবধি ভাষায় অনুবাদ করেন, তারপর এর ফার্সী অনুবাদ হয়। যদিও আবুল ফজল অনুবাদক হিসাবে তিনজনের নাম করেছেন, তবে নাকিব হান (ঐতিহাসিক) এবং আল বাদাউনি (পেশাগত অনুবাদক) দুজনেই নিজেদের এই অনুবাদের জন্মদাতা হিসাবে দাবি করেছেন। এ বই কোনোদিন ছাপা হয়নি। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, তাও পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রন্থাগারে, টুকরো টুকরো ভাবে।

বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত দশরথ জাতক। অন্যান্য রামায়ণ কথনের সঙ্গে তফাৎ এই যে, এতে রাম এবং সীতাকে ভাই বোন হিসাবে দেখানো হয়েছে, যারা নিজেদের মধ্যে বিবাহ করে। প্রথম দিকের বৌদ্ধ সাহিত্যে এই ভাই-বোনের বিয়ে লক্ষ্য করা যায়। রাজবংশের শুদ্ধতা রক্ষা করার জন্য এই প্রথা চালু ছিল। মিশরীয় রাজবংশেও এই প্রথা ছিল। রাম-সীতার ক্ষেত্রে এটা দেখানোর প্রয়োজন বোধহয় এই কারণে যে রাম ইক্ষাকু বংশজাত, এবং বুদ্ধও এই বংশের। সুতরাং বুদ্ধের বংশ গরিমা দেখাবার প্রশস্ত উপায় এটাই মনে করা হয়ে থাকতে পারে।

জৈনদের মধ্যে সবথেকে বেশি প্রচলিত রামকথা, পৌমাচারিয়াম ('পদ্মচরিতম'-এর প্রাকৃত প্রতিশব্দ)।রচনাকার বিমলসুরী, রচনাকাল সম্ভবত পঞ্চম শতাব্দী। প্রথম পর্বে বলা হচ্ছে যে শ্রেনিকা নামে এক রাজা, জৈনধর্ম অবলম্বন করার পর জৈন গুরু গৌতমের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন যে, রামায়ণে যেসব কথা বলা আছে সেসব সত্যি কিনা। এটা কি করে হতে পারে যে বানররা সেতুবন্ধন করেছিল এবং রাবণের মত পরাক্রমী রাজার সৈন্য ধ্বংস করেছিল? কুম্ভকর্ণ ছ’মাস ঘুমোতেন কী করে? এবং তাঁর বুকের ওপর দিয়ে হাতি চলে গেলেও কেন ঘুম ভাঙত না? গুরু গৌতম বললেন যে এসবই অপপ্রচার। তারপর তিনি রামায়ণের আসল গল্প (জৈনদের মতে) বললেন। বললেন যে রামায়ণের বানররা আসলে বানরই নয়। তারা আসলে বিদ্যাধর, কিষ্কিন্ধ্যা নগরে থাকত। তাদের বানর বলা হত এই কারণে যে তাদের ঢাল, পতাকা ইত্যাদিতে বানরের প্রতিকৃতি আঁকা থাকত। জৈন রামায়ণে রাবণকে অন্যভবে দেখান হয়েছে। রাবণকে বলা হয়েছে যুক্তিবাদী, পরাক্রমশালী, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জৈন রাজা। একটাই অবগুণ - কামুক। জৈন রামায়ণে রাম উত্তম পুরুষ, তুলনায় লক্ষ্মণ এবং রাবণ অধম। রাবণ বধ করেছেন লক্ষ্মণ। এটা গুরুত্বপুর্ণ এই কারণে যে, রামকে দেখান হয়েছে আদর্শ জৈন নায়ক হিসাবে, যিনি অহিংসার পথ অবলম্বন করেন এবং যাঁর নির্বাণপ্রাপ্তি হয়। রাবণ এবং লক্ষ্মণ নরকপ্রাপ্ত হন, এবং বারবার তাঁদের জন্মগ্রহণ করতে হয়। জৈন ধর্মে কর্মের গুরুত্ব এইভাবেই বোঝান হয়েছে।

রামায়ণ নিয়ে লেখা সংস্কৃত নাটকের অভাব নেই। বিশিষ্ট হল ভাসের ‘প্রতিমা’, ‘আভিষেক’, ‘যজ্ঞ-ফলম্‌’ ইত্যাদি ছাড়াও ভবভূতির ‘উত্তর-রামচরিত’, এবং ‘মহাবীরচরিত’।ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অনেক নাটক লেখা হয়েছে রামায়ণ নিয়ে। তার লম্বা ফিরিস্তি এখানে দেবার প্রয়োজন নেই।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণ প্রচলিত আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃত্তিবাসী রামায়ণ তো বটেই, এছাড়া অন্ধ্র প্রদেশের মহিলা কবি মোল্লার লেখা 'রামায়াণমনু', শ্রী বিশ্বনাথ সত্যনারায়ণের লেখা 'শ্রীমদ্‌রামায়ণ কল্পবৃক্ষামু', অসমের মাধবকুন্ডলীর (চতুর্দশ শতাব্দী) সুপ্তকান্ড রামায়ণ, গোয়ার কৃষ্ণদাস শর্মার কোঙ্কনিতে লেখা 'রামায়ানু' (পঞ্চদশ শতাব্দী), দ্বাদশ শতাব্দীর কবি নাগচন্দ্রর লেখা কানাড়া ভাষায় 'রামচন্দ্র চরিত্র পুরাণ' ইত্যাদি।

আরো আলোচনা করার আগে কয়েকটা দেশে প্রচলিত রামায়ণের সম্বন্ধে একটা সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক সারণি এখানে দিলাম।

* অনেকগুলো শূন্যস্থান রয়ে গেছে। পত্রিকার স্বল্প পরিসরে তা পূরণ করা সম্ভব নয়।

কাম্বোডিয়াতে রামায়া বা রামকের্তী ঠিক কবে এসেছিল জানা যায় না। তবে প্রাচীন কাম্বোডিয়ার প্রচুর দেয়ালচিত্র, ছবি এবং লেখা থেকে একটা আন্দাজ করা যায়। সপ্তম শতাব্দীর ভেয়াল কান্টেলের প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায় যে মন্দিরে রামায়ণ এবং মহাভারতের পাণ্ডুলিপি দেওয়া হয়েছিল রোজ পাঠ করবার জন্য। খ্‌মের রিয়ামকের-এর কথনে কতগুলো দৃশ্য আছে যা বাল্মিকী রামায়ণে নেই। উদাহরণ স্বরূপ, সেতুবন্ধনের সময় দেখা যেত যে রোজ যা পাথর ফেলা হচ্ছে, রাত্রে সেগুলো সরে যাচ্ছে। হনুমান দেখলেন যে জলপরীরা রোজ রাত্রে পাথরগুলো সরিয়ে ফেলে। তখন তিনি জলপরীদের রাণী নিয়াং মাচ্চা-কে এই বিষয়ে বলেন। নিয়াং মাচ্চা হনুমানের প্রেমে পড়েন, এবং তখন হনুমানের অনুরোধে জলপরীদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। তবে একথা স্বীকার্য যে পঞ্চদশ শতাব্দীর আগের কোনো পাণ্ডুলিপি এখন আর পাওয়া যায়না। যদিও প্রস্তরলিপির কোনো অভাব নেই।

'রামাকের্তী'কে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে রাবণের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বলা আছে। এর পরের সমস্ত ঘটনা দ্বিতীয় ভাগে। রাবণের মৃত্যুর পর রাম যখন আযোধ্যায় ফিরলেন তখন তাঁর মনে নিজের স্ত্রীর সম্বন্ধে সন্দেহ জাগল। এটা আরও বাড়ল একটা ঘটনা থেকে। সীতার সখী তাঁকে অনুরোধ করলেন রাবণের একটা ছবি এঁকে দিতে। সীতা ছবি আঁকলেন, এবং সে ছবি সখীকে দেখাবার সময় রাম সেই ঘরে ঢুকে পড়েন। সীতা তাড়াতাড়ি সে ছবি বালিশের তলায় লুকিয়ে ফেললেও রাম সেটা বার করে দেখেন। সীতা রামকে বোঝাবার চেষ্টা করলেও রামের সন্দেহ যায় না। শেষ পর্যন্ত অগ্নিপরীক্ষা। এরপর থেকে সবই আবার বাল্মিকী রামায়ণের মতই।

ইন্দোনেশিয়ার (জাভা) রামায়ণের প্রথম ভাগ বাল্মিকী রামায়ণের মত, কিন্ত এর পর থেকে আর বাল্মিকী রামায়ণের সঙ্গে কোনো মিল নেই। দ্বিতীয় ভাগে জাভার নিজস্ব দেবতা ধ্যায়ান (বালি সাহিত্যে ত্বালেন) এবং তার পুত্রদের যোগ করা হয়। এটা বলে রাখা ভাল যে জাভাতে এই দ্বিতীয় ভাগটাই বেশি লোকপ্রিয়।

থাইল্যান্ডের রামায়ণের নাম 'রীয়ামকের'। এর যে কথন এখন প্রচলিত সেটা লেখা হয়েছিল থাইল্যান্ডের (তদানীন্তন শ্যামদেশ) রাজা প্রথম রামের সময় (১৭২৬-১৮০৯)। ইনি চোক্রি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা (যা এখনো চলছে)। রাজা লেখার কাজটা নিজের তত্ত্বাবধানে করান (১৭৯৯-১৮০৭) এবং নিজেও এর অনেকাংশই লেখেন। এঁর রাজত্বকালেই ব্যাংকক-এ রাজপ্রাসাদ তৈরি হয়, যার মধ্যে ওয়াট ফ্রা কিউ-এর মন্দিরও আছে। এই মন্দিরের গায়েই খোদাই করা আছে রামায়ণের প্রচুর চালচিত্র। কাম্বোডিয়ার রামায়ণের সঙ্গে উপাখ্যানের ঘটনা প্রবাহের খুব একটা তফাৎ নেই।

'ফ্রালাক ফ্রালাম' লাওসের রামায়ণ কথন। লক্ষ্যণীয় যে কথকতায় লক্ষ্মণের নামটা আগে। এর কারণ, লাওশিয়ানরা বলে যে লক্ষ্মণ যা করেছিলেন সেটা স্বেচ্ছায় বনবাস, রাম যা করেছিলেন সেটা তাঁর পিতার আজ্ঞায়। অতএব, লক্ষ্মণের স্বার্থত্যাগ বড়ো। গল্পটা রামায়ণ থেকেই নেওয়া, তবে শেষ হয় সীতার অগ্নিপরীক্ষার পর। লাও রামায়ণের গল্পের অবশ্য পুরোটাই বাল্মিকী রামায়ণের মত নয়। থতসাকান (রাবণ) তার সমস্ত শক্তি পায় দেবরাজ ইন্দ্রর কাছ থেকে। হনুমান রামের পুত্র (রাম একসময় বানর রূপ ধারণ করেছিলেন, সে সময় নাং ফেংসি-র ঔরসে হনুমানের জন্ম হয়) এবং তিনি বানররাজ।

বর্মায় রামায়ণের নাম 'ইয়াম জাতদাও'। তবে আসল নাম 'ইয়ামানা'। জাতদাও শব্দটা রামায়ণ নাটকের ইঙ্গিত দেয়। ইয়ামানা লেখা হয়েছিল অষ্টদশ শতাব্দীতে।

বর্মার বৌদ্ধদের লেখা উনবিংশ শতাব্দীতে মন উপজাতির ‘লোক সামোইং রাম’ অনেকেটা ইয়ামানা থেকে নেওয়া, আবার এতে থাই, জাভানীজ, আর ইন্দোনেশিয়ান প্রভাবও দেখা যায়। উপাখ্যান শুরু হয় উত্তরা কান্ড থেকে। রামকে বলা হয় একজন বোধিসত্ব। সোইতে (সীতা) শচীর (দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী) অংশ। তিনি মন্দোদরীর কন্যা। মন্দোদরীর জন্ম এক পদ্মফুল থেকে। সীতা (সোইতে), ইন্দ্রজিৎ এবং অঙ্গদ তিনজনই মন্দোদরীর সন্তান। অতএব রাবণের (ততসাগারি) সীতার প্রতি আগ্রহ বস্তুত এক পিতার তার কন্যার প্রতি আগ্রহ, যা ক্ষমার্হ নয়। বালী সূর্য্যের পুত্র, এবং সোইনগ্রিদ (সুগ্রীব) চন্দ্রের পুত্র। গল্পের মধ্যে রাম-সীতার পূর্বরাগের কথা আছে। রাম বানর রূপ ধারণ করেন এবং সীতা বানরীর। তাঁদের পুত্র হনুমান। সীতার স্বয়ম্বরে ততসাগরি (রাবণ) উপস্থিত থাকেন। রামের বনবাস বারো বছর (চোদ্দ নয়)। রাবণের ছবি আঁকার গল্পটা রিয়ামকেরের মতই, যদিও অগ্নিপরীক্ষার ব্যাপারটা নেই। সীতার পুত্র একটাই - নিক্বে (লব)। কুশ (নি চোয়া)-কে প্রাণ দেন একজন ঋষি। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। লোক সাময়েং রাম-এ রামেশ্বরের সেতু নষ্ট করার পিছনে জলপরীরা নয়, এক বিরাটাকায় কাঁকড়া। এই লোক সামোয়েং রামের গল্প আর ইয়ামানার গল্প অনেকটাই মেলে।

জাপানে রামায়ণের নাম 'রামায়েন্না' বা 'রামায়েনশো'। এর সঙ্গে জাতকের গল্প মিলিয়ে দশম শতাব্দীতে লেখা হয়েছিল ‘সাম্বো একোটোবা’ এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে ‘হোবুতসোশু’।এর ওপর নির্ভর করে ভারতীয় প্রাচীন নৃত্যশৈলির ধাঁচে জাপানে দুটো নৃত্যশৈলীও আছে। নাম ‘বুগাকো’ আর ‘গাগাকু’। রামায়েন্নাতে দেবদেবীর প্রাধান্য রামায়ণের মতই - বেঞ্জাইতেন্সামা (সরস্বতী), বিশামন (কুবের), কিচিইয়তেন (লক্ষ্মী), দিয়াককুতেন (শিব), শে তেন সোদেন (গণেশ), বিশুকাতসুমা (বিশ্বকর্মা), দিয়াকো কুতেন্নইয়ো (কালী)।

শেষে বলি যে ফিলিপিনস এবং শ্রীলংকায় রামায়ণ রাবণের চোখ দিয়ে দেখা। সেজন্য শ্রীলঙ্কায় এর নাম ‘রাবণায়ন’ এবং ফিলিপিনসের মানরি উপজাতির মধ্যে ‘মহারিদা লাওয়ানা’ বা ‘মহারাজা রাবণ’। উল্লেক্ষণীয়, মহারিদা লাওয়ানাতে লক্ষ্মণকে দেখান হয় রাম-সীতার পুত্র হিসাবে।

বাল্মিকী রামায়ণের ‘ট্র্যাজিক এন্ডিং’ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বদলে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশের কথনে। হতে পারে সেটা আখ্যানকে আরো জনপ্রিয় করার জন্যে। তবে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হনুমানের জন্মবৃত্তান্ত এবং দু’এক জায়গায় রাম-সীতার পূর্বরাগ। আমি এখানে ধার্মিক আলোচনা করতে বসিনি, সুতরাং সে নিয়ে কোনো কথা বলব না। তবে যেটা শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে খাটে, সেটা অন্যত্র খাটবে না কেন, তা তর্কের অপেক্ষা রাখে বইকি।

একটা কথা আরো বলে শেষ করব। রামায়ণের সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রচুর, এবং বিভিন্ন দেশে এই প্রভাব বিভিন্ন রকম। এটা লক্ষ্যণীয়। মূল গল্পের উদ্দেশ্য, অর্থাৎ নীতিজ্ঞান, আদর্শপরায়ণতা, সদাচরণ, ঔচিত্যবোধ ইত্যাদি এবং চরিত্রগুলো কিভাবে এইসব মূল্যবোধকে প্রকাশ করেছে সেটা মাথায় রেখে এবং মূল গল্পের কাঠামো খুব একটা বেশি পরিবর্তন না করে ঘটনা প্রবাহকে নানা দিক দিয়ে বদলানো হয়েছে দেশ, কাল এবং পাত্রর পরিপ্রেক্ষিতে। সমসাময়িক ভাবে, উপাখ্যান এবং কথনকে আরও সরল এবং প্রকৃষ্ট ভাবে জনসমক্ষে আনার প্রচেষ্টা চলেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই তার পরিণতি ঘটেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে। রামায়ণ ভিত্তিক নৃত্যশৈলী, নাটক, গীতিকাব্য, চিত্রাঙ্কন এবং প্রস্তরলিপি পুরো দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ছড়িয়ে আছে।

ভারতবর্ষে রামায়ণ ভিত্তিক নাটক অগুণতি। কিছু সংস্কৃত নাটকের কথা আগে বলেছি। নিশ্চয় এসব নাটক অভিনীত হত, কিন্তু সেগুলোর প্রচলন এবং জনপ্রীতি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। যেটুকু জানা যায় তাতে মনে হয় অন্তত দশম শতাব্দী অবধি নাট্যাভিনয়ের বহুল প্রচলন ছিল, তবে তার মধ্যে রামায়ণ ভিত্তিক নাটক কতটা ছিল তার সঠিক মূল্যায়ন করা শক্ত। তবে ‘শুদ্ধ’ রামায়ণ নাটক, যা উত্তর ভারতে ‘রামলীলা’ বলে পরিচিত, তা পাঁচশ বছরের বেশী পুরনো নয়। সেটা হয়ে আসছে কাশীর রামনগর, তুলসীদাসের 'রামচরিতমানস' লেখার প্রায় পর থেকেই।তিন-চারশ বছরের পুরনো রামলীলা অনেক জায়গাতেই আছে, তার মধ্যে উত্তরাখন্ড, হিমাচল, উত্তরপ্রদেশ উল্লেখযোগ্য। তবে ঐতিহাসিক হেইন বলেন যে, মথুরাতে রামলীলার প্রচলন ছিল তার অনেক আগে থেকেই।

আজকালকার রামলীলায় আঞ্চলিক তফাৎ খুব স্পষ্ট। কাশীর রামনগরে যে রামলীলা হয় তা চলে পুরো মাস ধরে। অন্যান্য জায়গায় সাধারণত দশ দিনেই পালা শেষ হয়, রাবণ বধ দিয়ে। ইউনেস্কোর (২০০৮) রিপোর্ট অনুযায়ী সব থেকে উল্লেখযোগ্য রামলীলা হয় রামনগর, অযোধ্যা, বৃন্দাবন, আলমোড়া, সাতনা এবং মধুবনিতে। সব জায়গাতেই যে নাটক হয় তা নয়, কোথাও প্যান্টোমাইম স্টাইলে ঝাঁকি, মানে ট্যাবলো বার করা হয়, আবার কোথাও পুতুল নাচ হয়। আর যাকে বলে ‘অপেরাটিক স্টাইল’, তাও আছে। লোকনাট্যের সঙ্গে এই স্টাইল মেলানো হয়। 'রামচরিতমানস'-এর দোহা এবং চৌপাইগুলোই ডায়ালগ, আর কোরাসও তাই। এছাড়া রামলীলা ‘মন্ডলী’, যারা পেশাদার, তাদের প্রদর্শন তো আছেই।

বিদেশের রামলীলা বলতে থাইল্যান্ডের রামলীলার কথা আগে আসে। রাজা প্রথম রামের পুত্র দ্বিতীয় রাম পিতার আদর্শ বজায় রেখে রামাকিয়েনের নাট্যরূপ দেন। এখানে নাট্যচরিত্ররা কোনো কথা বলে না, মঞ্চের পাশে বসা কোরাস রামকিয়েনের থেকে পাঠ করে। এটা রামাকিয়েনের একটা পরিমার্জিত সংস্করণ - হনুমানের চরিত্রকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, এবং শেষে - ওই আগে যা বলেছি, শুভায় ভবতু বলে শেষ করা হয়। চরিত্রদের পোশাক এবং মুখোশ অনেক ভেবেচিন্তে ডিজাইন করা হয়। রামাকিয়েন এখন থাই সংস্কৃতির একটা প্রধান অংশ। থাই সাহিত্যের এক মাহাত্ম্যপূর্ণ স্তম্ভ তো বটেই, স্কুলের পাঠ্যক্রমেরও বিশিষ্ট অংশ।

ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণ ব্যালের নাম সেন্দ্রাতারি রামায়ণ। দুই ধরনের নাচের পরম্পরা আছে - জাভানীজ্‌ এবং বালিনীজ্‌। দুটোই নৃত্যনাট্য এবং জটিল গ্যামেলান অর্কেস্ট্রার ওপর নির্ভর। জাভাতে যে রামায়ণ ব্যালে হয় তা জাভানীজ্‌ ওয়ায়াং ওয়ং পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত। এতে জাভানীজ্‌ নৃত্যশৈলী, নাটক এবং সংগীত, তিনটেই আছে। বালিতে রামায়ণ ব্যালের দুটো রকম আছে। দুটোই স্টাইলের দিক দিয়ে, যাকে বলে, ইউনিক।

বর্মায় রামায়ণের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম চরণে। এর প্রমাণ ৩৪৭টা রামায়ণের খোদাই করা দেয়ালচিত্র, যা রয়েছে মহালোক মারাজাইনের প্যাগোডায়। তৈরি হয়েছিল ১৮৪৯ সালে। বর্মার রাজা সিঙ্গু মিনের প্রধান রানি থাকিন মিন মি, নিজে ছিলেন একজন কবি এবং লেখিকা। তিনি রামায়ণের নাটক পরিবেশনাকে প্রথম উৎসাহ দেন। তাঁর উৎসাহেই প্রথম রামায়ণের পরিবেশনা হয় রাজপ্রাসাদে, রাজা বদাওপায়ার সময়, পুরো জাঁকজমকের সঙ্গে। এখনও যে রামায়ণ পরিবেশন হয় তা লিখেছিলেন মিয়াওয়াদি মিং ইয়ি উ সা, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। তিনি রামায়ণ জাতকের রূপান্তর করেন পরম্পরাগত নৃত্যশৈলী এবং নাট্যশৈলী যোগ করে। তখন থেকেই রামায়ণের পরিবেশনা রীতিমত জনপ্রিয়।

রামায়ণের তিনশত রূপ আমি প্রথমেই বলেছি। তবে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল যে, এত রূপ ঠিক এক অঙ্গে নয়। এই ছোট পরিসরে সেটা আলোচনা করা যাবে না। ব্যাপারটা সহজ নয় আরো একটা কারণে। সেটা এই যে, অনেকগুলো সংস্করণ শ্রুতি, অর্থাৎ অলিখিত ভাবে চলে আসছে। সেগুলো ভারতীয় ভূখন্ডের বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে প্রচলিত। তবে এটাও বলতে হয়, মূল রামায়ণের সঙ্গে এগুলোর তফাৎ খুব বেশি নয়। যাক সে কথা। সেই আলোচনা করতে গেলে বই লিখতে হয়; সে মশায় আমার দ্বারা হবে না।